“তৃ-তনয়া” পর্ব- ৪২

0
2720

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৪২
(নূর নাফিসা)
.
.
নাফিসার ট্রেইনিং ক্লাস শেষ হয়েছে। বাসায় ফিরে সে মায়ের কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান শুরু করেছে যেন বাবাকে বলে তাদের ফাকা উঠুনটায় একটা পোল্ট্রি ফার্ম তৈরি করতে! সন্ধ্যায় নিয়াজ উদ্দিন বাড়িতে ফিরলে আবার বাবার কাছেও আকুল আবদার! নিয়াজ উদ্দিন বলেছেন, আগে পড়াশোনা শেষ করে তারপর যেন জীবিকার কথা চিন্তা করে। কিন্তু নাফিসা মোটেও তাতে রাজি না। সে আত্মকর্মসংস্থানী হতে চায়। এজন্যই ট্রেইনিং টা করেছে। পড়াশোনাও করবে সাথে কর্মসংস্থানেও নিয়োজিত থাকবে। তাছাড়া তার কর্মসংস্থান বাড়িতেই হবে, এতে তার মা-ও সাহায্য করতে পারবে। অন্যরা দেখেও অনুপ্রাণিত হবে। এতে তার তেমন কোনো ক্ষতি হবে না। বরং নিজেকে স্বাবলম্বী মনে করবে।
মেয়েদের ইচ্ছে কখনো অপূর্ণ রাখে না নিয়াজ উদ্দিন। অন্যথায়, মেয়েরা এমন কোনো আবদার রাখেও না যেটা বাবার কাছে অসম্ভব! কিছুটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও নাফিসার জোরাজোরিতে তিনি রাজি হয়ে গেলেন। যদিও বাড়ির সৌন্দর্যের কথা ভেবে তার মা নিষেধ করেছিলো। কিন্তু তার বাবা রাজি তো সব প্ল্যান কনফার্ম সেই ভেবে নাফিসাও মহা খুশি! সেই খুশিতে, সকালে সম্পূর্ণ নাস্তা সে তৈরি করলো। অথচ এমনিতে তাকে চুলার কাছেও নিয়ে যেতে পারে না! সবরান্না হয় মায়ের হাতে খাবে, নতুবা আপুদের হাতে। কেটেকুটে কাজ এগিয়ে দিতে আবার প্রস্তুত থাকে।
তার পরিকল্পনার কথা আপুদের কাছে জানিয়ে আবার কল করলো ট্রেইনারের কাছে। প্রক্রিয়া কার্য সম্পাদন করতে তারা সাহায্য করবে নাফিসাকে।
ছুটির দিনে নিয়াজ উদ্দিন বাশ, কাঠ ও টিন সংগ্রহ করে লোক লাগিয়েছে ফার্ম তৈরির জন্য। দু তিন সপ্তাহের মধ্যে সকল ব্যবস্থা হয়ে গেলে ট্রেইনাররা দেখতে এসেছে নাফিসার বাসা। ট্রেইনিং প্রাপ্তদের মধ্যে সুইং বাদে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে নাফিসাই প্রথম পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে কার্য সম্পাদন করার। তা-ও কেবল তার বাবার সাপোর্টে।
.
প্রথম প্রথম দিনগুলো ভালো চললেও শেষ সময়ে হাত টান পড়ে গেছে! নাহিদার কাছ থেকে দুশো এবং তার মায়ের কাছ থেকে একহাজার টাকা ধার নিয়ে তারপর যাতায়াত ভাড়া মেটাতে হয়েছে। গত একমাসে অতিরিক্ত কোনো টাকা খরচ করেনি মেহেদী। এমনকি রেস্টুরেন্ট পর্যন্ত যায়নি! যে কিনা, ত্রিশ দিনের মধ্যে পঁচিশ দিনই অন্তত একবেলা রেস্টুরেন্ট খায়! অফিসের লাঞ্চ টাইমেও মাঝে মাঝে বাড়িতে চলে এসেছে খাওয়ার জন্য আবার কখনো ইচ্ছে হয়নি বিধায় খায়ওনি! বাকিরা তাকে যত দেখছে ততই অবাক হচ্ছে! নিজের মাঝে এমন অমূল পরিবর্তন দেখে নিজেরই হতবাক হওয়ার কথা, যদিও সে এতোটা গভীরে ভাবে না! আজ তার জীবনের প্রথম উপার্জনের প্রথম বেতন পেয়েছে। কতটা উৎফুল্ল সে, তা নিজে পরিমাপ করতে না পারলেও যারা তার চেহারা দেখেছে তারা পরিমাপ করতে পেরেছে তার উৎফুল্লতা। ব্যাংক থেকে টাকা তুলে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে রুমেও যায়নি, সবার আগে সে তার বাবার কাছেই এসেছে। জহিরুল ইসলাম মাগরিবের নামাজ পড়ে টিভিতে খবর দেখছিলেন। মেহেদী তার বাবার পাশে বসে গণে গণে পাঁচ হাজার টাকা তার বাবার হাত ধরিয়ে দিয়ে বললো,
– নাও, ধরো তোমার টাকা। বলেছি না, মাস শেষে খাবারের বিল বাবদ পাঁচ হাজার টাকা পাবে। পুরো পাঁচ হাজার আছে এখানে।
– লাগবে না, তোমার কাছে রেখে দাও।
– না, না, না, বাবা! তা হবে না। মেহেদী যা বলে করেই ছাড়ে! অকর্মক না আমি! স্বনির্ভরও বটে! অন্যের উপর নির্ভর করা অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছি।
কথাটা বলার পরপরই সে তার মায়ের কাছে গেলো কিচেনে। এক হাজার টাকা মায়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে আর কিছু বলার সুযোগ দিলো না মেহেরুনকে। সে নাহিদাকে ডেকে চলে গেলো রুমে। মেহেরুন তাকে ডাকলে সে বললো, ফ্রেশ হয়ে আসছে।
মেহেদী ডাকায় নাহিদা হাতের কাজটা সেড়ে রুমে এলো। শার্ট খুলে খাটে রেখে দিয়েছে। নাহিদা সেটা তুলে এঙ্গেলে ঝুলিয়ে রাখলো। হাতমুখ ধুয়ে মেহেদী বাথরুম থেকে বেরিয়েছে মাত্র। নাহিদাকে রুমে দেখে ওয়ালেট থেকে দুই হাজার সাতশো টাকা পঞ্চাশ টাকা নিয়ে খণ্ডিত ভাবে প্রথমে আড়াই হাজার টাকা তার হাতে দিয়ে বললো,
– এটা, ওইযে পাঁচ হাজারের ফিফটি পার্সেন্ট। বুঝতে পেরেছো।
অত:পর পঞ্চাশ টাকা দিয়ে বললো,
– এটা, ওই যে রিকশাভাড়া নিয়েছিলাম। পুরোটাই রিটার্ন করলাম।
অবশেষে দুইশো টাকা দিয়ে বললো,
– এটা ধার নিয়েছিলাম যে, সেই দুশো। ক্লিয়ার?
নাহিদা কিছু বলতে যাবে তার আগেই দরজায় টোকা পড়লো। দরজা পুরো খোলা থাকা সত্ত্বেও জহিরুল ইসলাম নক করেছেন মেহেদীর দৃষ্টি আকর্ষনের জন্য। সাথে মেহেরুন ইসলামও এসে দাড়িয়েছে। মেহেরুন রুমে প্রবেশ করতে চাইলো কিন্তু জহিরুল ইসলাম বাধা দিলো। মেহেদী তাদের দিকে তাকাতেই জহিরুল ইসলাম বললেন,
– স্যার, খাবারের বিল তো পেলাম। এবার বাসা ভাড়াটা পরিশোধ করুন।
মেহেদী বিস্মিত হয়ে বললো,
– হোয়াট!
– জ্বি, স্যার! এটা যেমন সত্য, আপনি আমার বাড়িতে গত একমাস খেয়েছেন! সেটাও তেমনই সত্য, আপনি গত একমাস আমার বাড়িতেই থেকেছেন।
মেহেদী বিষন্ন ভঙ্গিতে তার ওয়ালেটে তাকিয়ে দেখলো ইতোমধ্যে বেশি অর্ধেক ফাকা হয়ে গেছে! এখান থেকে বাড়ি ভাড়া কি দিবে! তবুও জিজ্ঞেস করলো,
– বাড়ি ভাড়া কত?
– গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ বিলসহ পাচ হাজার দিলেই হবে।
– এ!
– হ্যাঁ।
– এ মাসে পারবো না। আগামী মাসে দিব।
– তখন তো দুই মাসে দশ হাজার হয়ে যাবে! পারবেন তো দিতে!
– আম্মু, তুমি কিছু বলবে! আব্বু, আমি কিন্তু খাবারের জন্য চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করিয়ে নিয়েছি। সেখানে কোনো বাড়ি ভাড়ার কথা উল্লেখ ছিলো না। সুতরাং এ মাসের ভাড়া আউট! সামনের মাস থেকে নতুন করে শুরু হবে ব্যাস! এ মাসেরটা দিবো না।
নাহিদা ও মেহেরুন তাদের বাবা ছেলের কান্ড দেখে মিটিমিটি হাসছে! জহিরুল ইসলাম হেসে রুমে প্রবেশ করলো। মেহেদীর ডান হাতের মুঠোয় টাকা রেখে হাতটি নিজের দুহাত দ্বারা মুঠোয় ধরে বললেন,
– আব্বু, তুমি যতই বড় সাজার চেষ্টা করো না কেন! তোমার জন্মদাতা পিতা আমি। তোমার আগে এ পৃথিবীতে আমার আগমন। সেই সূত্রে এক ধাপ হলেও বেশি বুঝার ক্ষমতা আছে আমার। অশিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও আমার বাবাও আমার থেকে এক ধাপ বেশি বুঝতেন, এমনকি তুমিও তোমার সন্তান থেকে এক ধাপ বেশি বুঝবে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। সন্তান যতই বড় হোক না কেন, পিতামাতার সমতুল্য বুঝ সে কখনোই ধারণ করতে পারবে না। তুমি আমার আসনে আসতে আসতে আমি দাদার আসনে পদার্পণ করবো। সকল পিতামাতাই চায় তার সন্তানরা ভালো হোক, পরিশ্রম করতে জানুক, নিজেকে স্বাবলম্বী করতে সক্ষম হোক। আমিও এর ব্যতিক্রম নয়। তুমিও একসময় তোমার সন্তানের জন্য চাইবে সেটা। গত দিনগুলোতে যখনই তোমাকে মনযোগ সহকারে কাজ করতে দেখেছি তখনই গর্ববোধ করেছি। হ্যাঁ, তার আগে কটু কথা বলেছি। কিন্তু কেন বলেছি, সেটা তুমি জানো? তুমি যাতে নিজেকে স্বাবলম্বী করতে জানো, নিজের জীবনটাকে পরিপূর্ণভাবে গুছিয়ে নিতে জানো সেজন্যই। আমি আর ক’দিন বাঁচবো! মেয়ের ভার তো অন্যের উপর তুলে দিতে পেরেছি কিন্তু তোমার ভার আমি কার উপর তুলে দিব! আমার সকল চিন্তা এখন তোমাকে নিয়ে। তোমার আম্মুরও তোমাকে নিয়েই চিন্তা। তাছাড়া তোমার উপর নির্ভর করেই কিন্তু নাহিদাকে ঘরে এনেছি। তুমি নিজেকে কর্মঠ না করলে নাহিদার খেয়াল রাখবে কে! তার বাবাও তো তোমার উপর নির্ভর করেই মেয়েকে ছেড়েছে। আমার এই টাকার প্রয়োজন নেই। তুমি স্বনির্ভর হতে শিখেছো এতেই আমি মহাখুশি! এই বাড়ি গাড়ি অফিস সকল প্রচেষ্টাই আমার শুধুমাত্র তোমার জন্য। তুমিও চাইবে তোমার সকল প্রচেষ্টা যেন তোমার সন্তানদের জন্য হয়। তোমার হাতে সবটা তুলে দিতে পারলেই আমি দায়মুক্ত হতে পারবো বাবা। নিজের কাছেই রাখো এটা। যতদিন বেচে আছি, তোমার সকল নেক কাজের সাপোর্টার হয়ে থাকবো আমি।
জহিরুল ইসলাম তার মাথায় হাত বুলিয়ে বেরিয়ে গেলেন। মেহেরুন এগিয়ে এসে একহাজার টাকা তার মুঠোয় ঠেলে দিয়ে বললেন,
– আমি আর কি বলবো! তোর আব্বু ই তো সব বলে চলে গেলো! আমারও এই টাকার কোনো প্রয়োজন নেই। মায়ের কাছে সন্তান কখনো ঋণি হয় না। তুই উপার্জন করতে শিখেছিস, এতেই আমি মহা খুশি।
কথাটা বলার পরপরই দু’হাতে মেহেদীর মাথা টেনে নিচু করে কপালে চুমু দিলেন তিনি। এবং বললেন,
– টাকা রেখে খেতে আয়। রুটি বানিয়েছি।
মেহেরুন ইসলাম চলে গেলে মেহেদী তার হাতের টাকা থেকে আরও আড়াই হাজার টাকা নিয়ে নাহিদার হাতে দিয়ে বললো,
– যাও, তোমার পুরো পাঁঁচ হাজারই ফিরিয়ে দিলাম।
নাহিদার হাতে টাকা দেওয়ার সময় নাহিদা মেহেদীর হাত ধরে ফেলেছে। এবং নিজ হাত উল্টে উপর করে মেহেদীর হাত তলায় রেখে বললো,
– আমি টাকা দিয়ে কি করবো! আমার প্রয়োজন তো তুমি আর বাবা মা-ই মিটিয়ে দিচ্ছো। আমার আর এর কোনোই প্রয়োজন নেই। বরং তোমার প্রয়োজন আছে নিজেকে সহ নিজের পরিবারকে সচ্ছল রাখার। আমার আবদার একটাই, তুমি সর্বদা নিজেকে নিয়ে ভাবো, অসৎ পথে যেও না কখনো। এবং পরিবারকে হেলা করো না কভু।
জহিরুল ইসলামের কথা শুনার পরই নাহিদার চোখ ছলছল করছিলো আর এখন নিজে কিছু শব্দ উচ্চারণ করার পর চোখের কোটরে পানি টলমল করছে। গড়িয়ে পড়বে বলে যেন প্রস্তুতি নিচ্ছে অশ্রু বিন্দু। নাহিদা সেটা অতি দ্রুতই ওড়নার আঁচল দ্বারা মুছে নিলো। মেহেদী উপহাস স্বরূপ বললো,
– বাহ! ভালোই তো! মেহেদী, তোর তো কপাল খুলে গেছে! বাবামায়ের সাথে বউয়েরও কোনো প্রয়োজন নেই টাকার! সব প্রয়োজন কি তোর একারই হয়ে থাকে!
নাহিদা মুচকি হেসে ওয়ারড্রব খুলে টিশার্ট এনে দিয়ে বললো,
– কখন থেকে খালি গায়ে আছো। ঠান্ডা লাগছে না?
মেহেদী টাকা ওয়ালেটে রেখে টি-শার্ট নিয়ে বললো,
– না, আমি তো দুনিয়ার উল্টো নীতিতে চলি। সবার ঠান্ডা লাগলে আমার আবার গরম লাগে!
কথা বলতে বলতে টি-শার্ট পড়ে নিলো মেহেদী। এদিকে নাহিদা আবার জ্যাকেট এনে দিলে মেহেদী হাত বাড়িয়ে দিলো পড়িয়ে দেওয়ার জন্য। নাহিদা মুচকি হেসে পড়িয়ে দিলো। এই ভেবে তার আরও খুশি লাগছে যে, যে মানুষটার এক সপ্তাহ চলেনি ত্রিশ হাজার টাকায় সে মাস শেষে পনেরো হাজার টাকা পেয়ে মহা খুশি। যেটা তার চেহারায়ই ভেসে উঠেছে! হবেই না কেন! এটা যে তার প্রথম উপার্জন!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here