“তৃ-তনয়া” পর্ব- ৪৩

0
2765

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৪৩
(নূর নাফিসা)
.
.
খাওয়াদাওয়ার পর ইশার নামাজ পড়তে গেছে। বাড়ি ফিরেছে একটু দেড়িতেই। নাহিদা ঘুমানোর জন্য প্রস্তুত। মেহেদী ফ্রেশ হয়ে জ্যাকেট খুলে অতি শীতে কাপানো ভঙ্গিতে খাটে উঠতে উঠতে বললো,
– সরো! সরো! ওফ্ফ! কি শীতরে বাবা!
বলতে বলতে সে কম্বল টেনে নাহিদার সাথে জড়ো হয়ে শুয়ে পড়েছে। নাহিদা বললো,
– আরে! লাইট অফ করবে কে!
– তুমি করো। আমার ঠান্ডা লাগছে প্রচুর! উফফোফো…!
– ইশ! এতোক্ষণ ধরে বাইরে ছিলো ঠান্ডা লাগেনি! আর এখন বাথরুম থেকে বের হতে হতে উনাকে ঠান্ডায় আক্রমণ করে ফেলেছে!
– উহু! বাথরুম না, কম্বলের নিচে আইসকুল!
কথাটা বলেই শরীর কাপিয়ে হেসে উঠলো মেহেদী। নাহিদা লাইট অফ করার জন্য উঠতে গেলেও মেহেদী উঠতে দিলো না। হাত পা দ্বারা আটকে দৃষ্টিতে দৃষ্টি রেখে বললো,
– আব্বুআম্মু কি চাইতো বলোতো?
– মানে?
– আব্বু আম্মু তো এটাই চাইতো যে, তাদের ছেলে আড্ডা ছাড়বে, উপার্জন করবে, ছেলের সুন্দর একটা সংসার হবে, বাচ্চাকাচ্চা আসবে আর পুরো বাড়িতে তাদের চিৎকার চেচামেচিতে গমগম করবে! তাই না?
– হু!
– তাহলে, এখন তো আমি আড্ডা ছেড়েছি, উপার্জন করছি, সংসারও সাজাচ্ছি। রাইট?
– হ্যাঁ।
– তাহলে আর কি বাকি?
– কি বাকি?
– একটা আয়াশ আরেকটা আরিশা বাকি!
নাহিদা পরিষ্কার বুঝতে পারছে মেহেদী কি চাইছে। তাই সে দৃষ্টি নামিয়ে ফেলেছে! অজানা এক মিশ্র অনুভূতি কাজ করছে তার মনে! মেহেদী তার রিয়েকশন দেখার অপেক্ষায় পলকহীন তাকিয়ে আছে তাই নাহিদা দৃষ্টি নিচের দিকে রেখেই দুষ্টুমি ছলে বললো,
– একটা আয়াশ আর একটা আরিশা তো আছেই মেহতাজ আপুর কাছে!
মেহেদী তার থুতনি ধরে মুখটা একটু উপর দিকে তুলে বললো,
– কথা পেচিয়ে নিচ্ছো কেন! আমার সহজ উক্তি বুঝো না?
নাহিদা তার চোখের দিকে তাকাতেই মেহেদীর হাসিমাখা মুখটা মলিন হয়ে গেছে! সে থুতনি ছেড়ে দিয়ে বললো,
– কাদছো কেন! আমি মজা করছিলাম! তোমার উপর কোনো কিছু চাপিয়ে দিতে চাইছি না আমি।
কথাটা বলে মেহেদী সরে যেতে চাইলো। নাহিদা একহাতে তার টিশার্টের কলার মুঠোয় ধরে টেনে কাছে এনে, অন্যহাতে মেহেদীর ঠোঁটে স্পর্শ করে কম্পিত কণ্ঠে বললো,
– কথা দাও, কখনো এই মুখে মদ্যপান করবে না। কখনো এই ঠোঁটে মাদক স্পর্শ করবে না। আমার খুব কষ্ট লেগেছিলো বিয়ের প্রথম রাতে তোমাকে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় দেখে! একটুও সহ্য হচ্ছিলো না! কোনো মেয়েরই সহ্য হবে না স্বামীকে এমন অবস্থায় দেখলে! সবাই সুন্দর জীবন গড়তে প্রত্যাশিত! বাবা মা জানলেও খুব কষ্ট পাবে। এসবে হাত লাগিও না কোনোদিন! বিশ্বাস করো, একজন স্ত্রী হিসেবে আমার এইটুকু ছাড়া আর কোনো চাওয়া নেই তোমার কাছে। সব কিছু তোমার ইচ্ছাতেই হবে। এসবে আর হাত লাগিও না প্লিজ।
কথা বলতে বলতে চোখের দুই ধার গড়িয়ে অনবরত ঝরে পড়ছে অশ্রু! মেহেদী নাহিদার চোখের দুই ধার মুছে দিতে দিতে বললো,
– খাবো না।
নাহিদা খুশিতে পুলকিত! মেহেদী তার মুখ থেকে নাহিদার হাত সরিয়ে ওষ্ঠ দ্বারা আঁকড়ে ধরলো আকুল আবেদনকারীর ওষ্ঠ জোড়া! আজ প্রথম যেন মনে মনে মনকথন উপলব্ধি করতে পারছে নাহিদা! মনে হচ্ছে দীর্ঘ সময়ের কাজ খুব অল্প সময়ে হয়ে গেছে! মেহেদীকে দেখার পর সজ্জিত জীবন নিয়ে তার ভাবনা জীবনের বহুদূর পর্যন্ত ছুটে চলে গিয়েছিল! আজ মনে হচ্ছে অতি দ্রুতই সেটা জীবনের সূচনায় চলে এসেছে!
.
প্রতিদিনই সকালে রুলস অনুযায়ী মেহেদীকে রেডি করে দিতে হয়। আর বোনাস স্বরূপ শর্টকাট কিসমিস! আজ বোনাসের উপর বোনাস ছিলো। একটু অন্যরকম মাধুরি মিশিয়েছে মেহেদী।
নাহিদাও ভার্সিটি যাবে বিধায় তৈরি হয়ে গেছে। নাহিদার সাথে মেহেদী রুম থেকে বের হতেই জহিরুল ইসলাম বললো,
– আজ ড্রাইভারকে ছুটি দিয়েছি। তাহলে গাড়ি ড্রাইভ করবে কে! বলতো!
মেহেদী জবাব দিলো,
– ড্রাইভার যেহেতু ছুটিতে আছে, একদিন রিকশায় গেলে কি হয়!
– মেহেরুন, দেখেছো! তবুও আমার ছেলে ড্রাইভ করবে না! গাড়ি থাকতে শুধু শুধু রিকশা ভাড়া দেওয়ার দরকার আছে!
– আম্মু, আব্বু কিন্তু দিন দিন হার কিপটে হয়ে যাচ্ছে!
মেহেরুন জবাব দিলো,
– তোদের বাপ-বেটার কাহিনী পরে করলেও চলবে। অফিস তোদের হলেও ভার্সিটি কিন্তু তোদের না। নাহিদার লেট হচ্ছে।
– যাচ্ছি। আল্লাহ হাফেজ।
তারা তিনজনই গন্তব্যে চলে গেলো গাড়িতে করে।
.
ভার্সিটিতে এক্সাম দিয়ে নাফিসা বাড়িতে ফিরেছে। রাস্তা থেকে বাড়ির দিকে নামতেই তার ফুপু অর্থাৎ, শিথির মা তাকে ডাকলো,
– নাফিসা, আয়তো একটু।
– কেন ফুপু?
– আয়, দরকার আছে।
নাফিসা তাদের ঘরে এলো। মেইন দরজায় পা রাখতেই ফুপি ইশারা করলো শিথির রুমে যেতে। নাফিসা সেখানেই চলে এলো। শিথি জানালার পাশে বসে ছিলো। নাফিসা বললো,
– কি করছো আপু?
– কিছু না। আয়। ফাইল হাতে কেন? পরীক্ষা চলছে?
– হ্যাঁ। ইনকোর্স পরীক্ষা।
– অহ। বাসায় যাসনি মনে হয়। কোনো প্রয়োজনে এসেছিস?
– ফুপি না ডাকলো কি জন্য যেনো!
– ওহ্!
এমনি শিথির মা রুমে এসে বললো,
– ব্যাগটা রেখে আয় আমার সাথে।
– কোথায়?
– মেহমান আসছে।
– তো আমি কি করবো!
– আরে, আয় না।
নাফিসা কিছু বুঝতে পারছে না! শিথিও ইশারা করলো যেতে। নাফিসা ফাইল আর পার্স রেখে চলে গেলো শিথির মায়ের সাথে। পাশের রুমে গিয়ে দেখলো দুজন মহিলা আর একজন পুরুষ বসে আছে। শিথির মা নাফিসাকে সামনে দাড় করিয়ে মেহমানদের উদ্দেশ্যে বললো,
– এটা আমার ভাইয়ের মেয়ে। অনার্সে পড়ে।
পরিচয় করিয়ে দিতেই নাফিসা সালাম দিলো। মহিলাটি সালামের জবাব নিয়ে বসতে বললো। নাফিসার এখন মনে পড়েছে তার ফুপু যে ঘটক! এবং এটাও বেশ বুঝতে পারছে তার বিয়ের জন্য পাত্র ঠিক করছে! নাফিসা বিরক্তি নিয়ে ফুপুর দিকে তাকাতেই তিনি চুপচাপ বসতে বললেন! বিরক্তি সহিত নাফিসা বসে পড়লো চেয়ারে! ফুপু মুখে হাসি ঝুলিয়ে বলতে শুরু করলো,
– আমার ভাইয়ের তিনটা মেয়েই। বড় দুজন বিয়ে হয়ে গেছে আর এই ছোট মেয়েটা বাকি আছে। পড়াশোনায় খুব ভালো। বাবার আয়ও ভালো, জমিজমাও মোটামুটি ভালোই আছে। খুবই সচ্ছল ও মার্জিত পরিবার। ছোট মেয়েটা বিয়ে দিতে পারলেই বাবা মায়ের শান্তি। মেয়েদের নিয়ে আর ভাবতে হবে না।
নাফিসার খুব বিরক্ত লাগছে! এক গাদা সুনামের পর এখন এমন ভাবে বলছে যেন মেয়েটার বিয়ে আটকে আছে! অন্যথায় এখন বিয়ে দেওয়াটা খুবই জরুরী! মেহমান সামনে বিধায় কিছু বলছে না সে! কিন্তু বাবা মাকে বলে তো এর একটা বিহিত ঠিকই করবে! কে বলেছে উনাকে এতো পন্ডিতি করতে! মেহমানদের মধ্যে একজন মহিলা জিজ্ঞেস করলো,
– আপনার মেয়ের কথাও না বলেছিলেন। সে কোথায়? আসলে আমাদের দুইটা মেয়ে প্রয়োজন।
– আমার মেয়েটা বেড়াতে গেছে। পরে না হয় দেখা করিয়ে দিব একদিন।
এমন মিথ্যে বলায় নাফিসার আরও বেশি রাগ হচ্ছে! নিশ্চয়ই সমন্ধ পছন্দ হয়নি তাই এখন তার মেয়েকে লুকিয়ে তাকে দেখাচ্ছে! ইচ্ছে করছে হাটে হাড়ি ভাঙতে! ফুপু বলে ছেড়ে দিলো। ভাঙতে গেলে তো আবার বিস্ফোরণ ঘটবে! চব্বিশটা প্রেম একসাথে করে তার মেয়ে! এজন্য সারাদিন ঘরে বন্দী রাখে আবার নাকি বলে বেড়াতে গেছে! মহিলাটি বললো,
– অহ, আচ্ছা। মা, তোমার নাম কি?
নাফিসা গম্ভীরমুখে জবাব দিলো,
– নূর নাফিসা।
– খুব সুন্দর নাম। বাবার নাম কি?
– জনাব মোহাম্মদ নিয়াজ উদ্দিন।
– মায়ের নাম?
– আমি বাঙালি মেয়ে। বাঙালিরা পিতৃতান্ত্রিক পরিচয়ে বড় হয়। সেখানে মায়ের নামটা কেন শুনাতে যাবো?
– এতে, সমস্যা কি। নামই তো বলবে।
– অনেক সমস্যা। অপ্রয়োজনে বাইরের লোকদের কাছে মায়ের নাম বলার কোনো প্রয়োজন মনে করছি না।
সাথের মেয়েটা বললো,
– মা, থাক না। ও ঠিকই বলেছে। মায়ের নাম দিয়ে কি করবে!
– দাড়াও তো দেখি একটু।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও নাফিসা দাড়ালো। তার উচ্চতা দেখে মহিলাটি বললো,
– মাশাল্লাহ। বসো।
– ব্যায়াম করাচ্ছেন?
মহিলাটি হেসে বললো,
– না, তোমার উচ্চতা দেখলাম। হিজাবটা খুলবে একটু? তোমার চুলগুলো দেখতাম।
নাফিসা চরম রাগ হচ্ছে! সে নির্দিধায় বললো,
– আন্টি একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
– হ্যাঁ, করো।
নাফিসা পুরুষ লোকটিকে দেখিয়ে বললো,
– উনি কি পাত্র?
– হ্যাঁ, ও আমার ছেলে।
– ওহ! তা আমার চুল দেখে কি করবেন? চুল না থাকলে কি বিয়ে করাবেন না আপনার ছেলেকে? আপনার ছেলে নিজেই তো টাকলা! সেখানে আমার চুল না থাকলে সমস্যা কোথায় যেখানে আপনার ছেলের টাকলা মাথা সমস্যা বলে মনে করছেন না!
মহিলাটি সহ উপস্থিত সবাই ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো! ফুপু একটু ধমকের সুরেই বললো,
– নাফিসা, এসব কোন ধরনের কথাবার্তা! মেহমানদের সামনে এভাবে কথা বলে!
– ভুল কিছু বলিনি তো আমি! মেয়ে দেখতে এলে আবার চুল দেখতে হয়! একটু পর তো বলবে কিচেনে গিয়ে রান্না করে দেখাও! আর এই বাট্টা টাকলার সামনে আমাকে ডাকা হয়েছে আবার আযব টাইপের ভাইভা নেওয়া হচ্ছে, এর সাথে কি আমার কোনোভাবে যায় আসে! যত্তসব ফাউল কর্মকাণ্ড!
কথা বলার পরপরই নাফিসা বেরিয়ে যাচ্ছিলো। দরজার পাশে এসে ভাবলো হাড়ি না ভাঙলেও একটা গ্লাস ভাঙা দরকার। সে বিস্মিত মেহমানদের দিকে তাকিয়ে বললো,
– আন্টি, আরেকটা কথা। ফুপির মেয়ে বাড়িতেই আছে। বিশ্বাস না হলে ওইরুমে গিয়ে দেখে আসুন।
কথাটা বলে আর এক সেকেন্ডও না দাড়িয়ে দ্রুত তার পার্স নিয়ে বেরিয়ে এলো। এবার খুব শান্তি লাগছে! দেখার মতো হয়েছে এক একজনের চেহারা! হুহ! মেয়ে বলে কি পেয়েছে তারা! খুটিয়ে খুটিয়ে এতো দেখতে হয়! যত্তসব ক্ষেতমার্কা রাস্কেল মাইন্ডের লোক! মেহমানরা কি করছে এখন কে জানে! তবে মিথ্যেবাদী ঘটক ফুপুকে প্যাচে ফেলতে পেরে শান্তি লাগছে! এক নম্বর বানোয়াট একটা!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here