“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৪৪
(নূর নাফিসা)
.
.
ঘরে ফিরে মাকে নামাজ পড়তে দেখলো নাফিসা। সে বোরকা হিজাব খুলে গোসলের জন্য চলে গেলো। গোসল সেড়ে ওযু করে বেরিয়ে এসেছে তখন তার মা কিচেনে ছিলো। সে নামাজ আদায় করার পর লাঞ্চ করতে কিচেনে এলে রুমানা বেগম তাকে দেখে চড়া মেজাজী কন্ঠে বললো,
– শেলী আপা কি বলে গেলো! তুই নাকি বেয়াদবি করছিস!
– বাব্বাহ! নালিশও দিয়ে গেছে এসে! তা তোমার শেলী আপা কি করছে সেটা বলে যায়নি!
– মেহমান এসেছে, মেয়ে বড় থাকলে দেখাতেই পারে তাই বলে এমন ব্যবহার করবি! মেহমানদেরও নাকি অপমান করেছিস! দাড়া, তোর বাবা ফিরুক! এই শিক্ষা দিয়েছি কিনা, জিজ্ঞেস করবো! ফাজিল মেয়ে, গুরুজনদের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় এখনো সেটা জানা নেই! কিসের এতো পড়াশোনা করাচ্ছি শুধু শুধু, যদি প্রকৃতভাবে শিক্ষিত না ই হতে পারে!
– মা, অন্যের মুখে উল্টাপাল্টা শুনে বকো না শুধু শুধু। সবাই নিজের সাপোর্টার। সত্য মিথ্যা বানিয়ে নিজেকেই ভালো সাজাবে সবার কাছে! আর যুক্তি দিবে শুধুমাত্র সে-ই সঠিক! ফুপি কি বলে গেছে আমি জানি না, তবে আমারটাও শুনো। আমি ভার্সিটি থেকে নিজের ঘর পর্যন্ত পৌছাতে পারিনি, রাস্তার ধার থেকে ফুপি ডেকেছে আমাকে। আমি তাদের বাড়িতে গেলে তিনি আমাকে ভালোমন্দ কিছু না বলে সরাসরি মেহমানদের সামনে নিয়ে গেছে! আমি তখনও কিছু বলিনি, কথামতো চুপচাপ গিয়েছি। তুমি জানো, কেমন একটা ছেলের সামনে নিয়ে গেছে আমাকে! টাক মাথা, আমার চেয়ে এক ফুট খাটো হবে, যদিও আমি দাড়ানো অবস্থায় দেখিনি। কিন্তু যেই ফুটবল, বসে থাকা অবস্থায়ই বুঝে গেছি ওই ব্যাটা পাচ ফুটের ধারেকাছেও হবে না!
– একটা থাপ্পড় দিয়ে সব দাত ফেলে দিবো! কি বলতে কি বলে! মুখে কিছু আটকায় না! আল্লাহর দান নিয়ে এমন উপহাস করতে হয়, বেয়াদব মেয়ে!
– আমি তো উনাকে উপহাস করছি না! আমার সাথে যে কতটা বেমানান আর তোমাদের আপার কেমন রুচি সেটা বুঝাতে চাইছি! আমি যদি দেখতে এমন খাটো ফুটবল আকৃতির হতাম তাহলে মানিয়ে নেওয়া যেতো! কিন্তু এতো লম্বা একটা মেয়েকে ওই লোকের সাথে মানায় কিভাবে, সেটা বলো!
– বেমানান বলে তুই এমন আজেবাজে ব্যবহার করবি! দেখেছে বলেই কি বিয়ে হয়ে গেছে! ব্যবহারে বংশের পরিচয়। এতে তুই তোর বাবার দুর্নাম করে এসেছিস!
– মা, আমি সেজন্য কিছু বলিনি তাদের। ফুপি এতো বানিয়ে বানিয়ে কথা বলে সেটা দেখে খুব বিরক্ত লেগেছে! উনারা দেখতে এসেছিলেন শিথি আপুকে! আর ফুপি নিয়ে দেখিয়েছেন আমাকে! শিথি আপুর কথা মেহমানরা জিজ্ঞেস করতেই ফুপি ডিরেক্টলি বলে দিয়েছে, শিথি আপু নাকি বেড়াতে গেছে! অথচ পাশের রুমে বসা উনার মেয়ে! তারপর আবার মেহমানদের কান্ড দেখো, আমার নাম, বাবার নাম জিজ্ঞেস করার পরেও মায়ের নাম জিজ্ঞেস করে! মূল পরিচয়ে কি আবার মায়ের নাম জিজ্ঞেস করে কেউ! এরপর আবার শুরু করেছে, দাড়াও তো একটু, বসো তো একটু! পরক্ষণেই আবার বলে, চুলগুলো দেখাও তো একটু! চিন্তা করতে পারছো কতটা আযব টাইপের লোক! এদিকে নিজের ছেলের মাথার চান্দী ফাঁকা সেই খবর নেই, অথচ আমার মাথার চুল দেখতে আসছে! এজন্যই আমি আর সহ্য করতে না পেরে মুখের উপর বলে দিয়েছি আমার চুল না থাকলে কি উনারা টাকলা ছেলেকে বিয়ে করাবে না, নাকি!
রুমানা বেগম না চাইতেও হেসে উঠলেন এবং সাথে পিটুনি দেওয়ার ভঙ্গিতে হাত উঠালেন! মায়ের মুখে হাসি দেখে নাফিসাও হেসে উঠলো এবং পিটুনি থেকে বাচতে একটু পিছিয়ে গেলো। এবং বললো,
– বলো তো এবার, আমি ঠিক বলে এসেছি না? উনাদের সমস্যা কোনো সমস্যা না, আর আমাদের সমস্যাই কঠিন ও গুরুতর সমস্যা! হুহ্!
– পাকনা বুড়ি একটা আমার ঘরে জন্মেছে! প্লেট নে, ভাত খাবি।
– ওফ্ফ! মা, কথা ঠিক করো। পাকনা না, পাকা হবে!
– যা, ভাগ! আসছে আমার কুখ্যাত শিক্ষক! টাকলা, চান্দী, নিজের কথার স্টেশন নেই আবার আমাকে শেখাতে আসে!
নাফিসা খিলখিল করে হেসে উঠে বললো,
– হয়েছে, বলে বলে তোমার আর মুখুস্ত করতে হবে না! ভাত দাও, আমি একটু বাচ্চাদের সাথে দেখা করে আসি।
– এখন যেতে হবে না, খেয়ে তারপর যা।
– আরে যাব আর আসবো। মা, আরেকটা কথা! আমি না মেহমানদের জানিয়ে দিয়ে এসেছি, শিথি আপু ঘরেই আছে। ফুপি মনে হয় এজন্যই বেগুনের মতো জ্বলে উঠেছে!
কথাটা বলে নাফিসা আর এক সেকেন্ডও নেই এখানে। সে তার ছোট্ট খামারে চলে গেলো বাচ্চাদের সাথে দেখা করতে। পরক্ষণে মা মেয়ে একসাথে খেতে বসেছে। রুমানা বেগম নাফিসার উদ্দেশ্যে বললেন,
– আর কখনো যেন কারো সাথে এমন দুর্ব্যবহার করতে না শুনি। এভাবে তোর বাবার অসম্মান হবে।
– মা, অন্যায় হলে আমি বসে থাকবো কেন! অন্যায়ের প্রতিবাদ অবশ্যই করবো।
– সবক্ষেত্রে প্রতিবাদ করতে হয় না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মুখ বুজে সহ্য করতে হয়। মেয়ে বিয়ের যোগ্য থাকলে দেখতে আসতেই পারে। আর বউ যেহেতু নিবে সেহেতু তারা দেখে শুনেই নিবে।
– তুমি কি এখন আমাকে বিয়ে দিয়ে দিবে?
মেয়ের একটু কঠিন গলা শুনে রোমানা বেগম মাথা তুলে তাকালো। নাফিসার চোখ দুটো ভেজা হয়ে গেছে। তিনি জবাব দিলেন,
– আমার ও তোর বাবার ইচ্ছে অনার্স শেষ করিয়ে তারপর বিয়ে দিবো। কিন্তু কার ভাগ্যে কখন কি প্রতিফলন ঘটে তা কি আর জানা! নাজিয়াকে ঠিক সময়ে দিতে পারলেও নাহিদাকে তো অনার্স শেষ করাতে পারিনি বিয়ে হয়ে গেলো। তোকেও অনার্স শেষ করিয়েই বিয়ে দিবো। বাকিটা আল্লাহর হুকুম।
– এখন যেহেতু ইচ্ছে নেই সেহেতু বাড়িতে কোনো মেহমান আসতে দিবে না। আর যদি বিয়ে দিয়ে দাও, তো বলো। আমি আর ভার্সিটি যাবো না। পড়াশোনা শেষ আমার।
– একটা মাইর দিবো, ভাত খা! তোকে তো আমি বুড়ি বানিয়ে তারপর একটা বুড়ার হাতে তুলে দিবো।
নাফিসা হেসে উঠে বললো,
– তোমার আব্বাজান বেচে থাকলে না ভেবে দেখা যেতো।
উভয়েই এবার হেসে আবার খাওয়াতে মনযোগ দিলো।
.
শীত প্রায় ছুটিতে চলে গেছে। বেশিদিন নেই, গড়িয়ে আসবে বসন্ত। অদৃশ্যমান হয়ে যাবে ভোরের কুয়াশা! মিষ্টি সুরে গান গেয়ে ভোরের ঘুম ভাঙাবে কোকিল। দুয়ার খুলে যাবে দক্ষিণা হাওয়ায়! পাতা থাকবে না তবুও থাকবে লাল কৃষ্ণচূড়া ফুল। হয়তো বা আবার কোথাও কোথাও উঁকি দিবে কচি কচি সবুজের সমারোহ। আস্তে আস্তে ভুবন ছেয়ে যাবে নতুন সজীবতায়!
দুদিন আগে বাবার বাসা থেকে ঘুরে এসেছে নাজিয়া। দুই মেয়ের শ্বশুর বাড়ি দাওয়াত করে শীতের নানান পিঠার আয়োজন করেছে নিয়াজ উদ্দিন। বাবা-মা ও বোনদের সাথে সেখানে দুদিন কাটিয়ে এসেছে নাজিয়া। নাহিদা এবার থেকেছে চার পাচ দিনের মতো।
সকালে রুটি নাস্তা করেছিলো বিধায় দুপুরার জন্য রান্না বসিয়ে দিয়েছিলো। রান্নাবান্না শেষে আরাফের কাছে কল করে সালাম দিয়ে বললো,
– আজ একটু তারাতাড়ি বাড়ি ফিরতে পারবে?
– কেন?
– এমনি।
– খুব প্রয়োজন?
– না, পারলে এসো।
– আচ্ছা, দেখি। ক্লাসে আছি। এখন রাখি।
– আচ্ছা।
দুপুরের পরপর আরাফ বাড়িতে ফিরেছে। ঘরে প্রবেশ করে দেখলো নাজিয়া শাড়ি পড়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়িয়ে ভেজা চুল আচড়ে নিচ্ছে। আরাফ পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাধে উষ্ণ ছোয়া দিলো। অত:পর কাধে থুতনি রেখে আয়নায় নাজিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
– কোথায় বেড়াতে যাবে, যে এতো জরুরী তলব!
– কোথাও না।
– তাহলে এতো সাজুগুজু আর শাড়ি পড়েছো যে!
– ইচ্ছে হলো আজ।
– হঠাৎ এমন ইচ্ছের কারণ কি?
নাজিয়া চিরুনি রেখে আরাফের দিকে ঘুরে দাড়ালো এবং শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বললো,
– বলবো, আগে ফ্রেশ হয়ে এসো।
– না, এখন বলো।
– উহুম, আগে ফ্রেশ হয়ে এসো তারপর বলবো।
আরাফ চলে গেলো হাতমুখ ধোয়ার জন্য। এতোক্ষণে নাজিয়া খাবারের প্লেট নিয়ে এসেছে রুমে। তোয়ালে দিয়ে হাতমুখ মুছতে মুছতে আরাফ বললো,
– এবার বলো?
– খাওয়া শেষ করো আগে।
– এই, এড়িয়ে যাচ্ছো কিন্তু।
নাজিয়া হিহিহি করে হেসে বললো,
– ভালো বুঝতে পেরেছো। এবার তারাতাড়ি খাওয়া শেষ করো।
– বসো তুমিও।
– খেয়েছি আমি।
– কখন খেলে! মাত্র গোসল করেছো। চুল সম্পূর্ণ ভেজা।
– না, আমি গোসল করে, নামাজ পড়ে, খেয়ে তারপর খোপা খুলে চুল আচড়ে নিয়েছি। খোপা করা ছিলো বিধায়ই ভেজা।
– তবুও বসো। একা একা ভালো লাগবে না আমার।
– ওকে, বসলাম। এবার খাও।
আরাফ ভাত মেখে প্রথম লোকমা নাজিয়ার মুখের সামনে ধরলো। খেয়েছে বলা সত্ত্বেও মুখের সামনে তুলে ধরায় নাজিয়া ব্রু কুচকে তাকালো। আরাফ হা করতে ইশারা করলে সে বললো,
– শুধুমাত্র এটাই নিবো। আর কিন্তু খাবো না।
আরাফ মুচকি হাসলো আর নাজিয়া মুখে নিয়ে নিলো। নাজিয়ার মুখেরটা শেষ হতেই আরাফ আবারও সামনে ধরে বললো,
– একবার খাওয়া ভালো না। এটাই শেষ, আর দিবো না।
নাজিয়া দ্বিতীয় লোকমা খেয়ে পানি পান করে নিলো। বাকিটা আরাফ শেষ করলো। খাওয়াদাওয়ার পর প্লেট রেখে এলে আরাফ তাকে আটকে ধরে বললো,
– এবার তো বলো?
নাজিয়া আরাফের কাধে ভর করে উঁচু হয়ে দাড়ালো। মাথাটা নিচের দিকে টেনে কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,
– অভিনন্দন, আরোহীর আব্বু। আরোহী অথবা তার ভাই আসছে অতি শীঘ্রই।
আরাফ নাজিয়াকে আরও কাছে এনে কান পেতে বললো,
– কি বললে? শুনিনি!
– নতুন অতিথি আসবে।
নাজিয়ার মুখের সাথে কান একদম লাগিয়ে বললো,
– শুনিনি, আবার বলো।
নাজিয়া তার দুষ্টুমি বুঝতে পেরে দু’হাতে সরানোর চেষ্টা করে বললো,
– যাও, আর বুঝতে হবে না!
আরাফ হেসে তাকে কোলে তুলে নিতেই নাজিয়ার চোখ জোড়া বড় বড় হয়ে গেছে! ঠোঁটের কোনায় হাসি ঝুলিয়ে আরাফ বললো,
– এটা, কেমন কথা! না বুঝলে বুঝিয়ে দিতে হবে না!
– এই! একদম ভালো হবে না কিন্তু! নামাও বলছি!
আরাফ বিছানার দিকে যেতে যেতে বললো,
– তোমার সব ভালো হবে না গুলোকে আজ ভালো করে দিবো, মিসেস!
– নামাতে বলছি।
আরাফ বিছানায় নামিয়ে দিয়ে বললো,
– ওকে নামিয়ে দিলাম।
নাজিয়া হাসতে হাসতে আরাফকে ঠেলে সরিয়ে নেমে যেতে চাইলে আরাফ তাকে আটকে বললো,
– আরে, যাচ্ছো কোথায়! আমার জন্য সেজেছো, আর আমি দেখবো না!
– অনেক দেখেছো, এখন আর দেখতে হবে না। রান্নার আয়োজন করতে হবে।
– সব পরে। আপাতত শুধু আরোহীর আব্বু, আরোহীর আব্বু, আর আরোহীর আব্বু।