“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৪৬
(নূর নাফিসা)
.
.
বাসায় ফিরলে মেহতাজের বকাবকি শুনলো কিছুক্ষণ! রাতের জন্য আর রান্না করবে না। ওই খাবারই খাওয়াবে তাদের। সেদিকে মেহেদীর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই! সে কানে আঙুল দিয়ে চলে গেছে আয়াশ আরিশার কাছে! তার এই বদ অভ্যাসটা আয়াশ আরিশাও ধারণ করে নিয়েছে! একটু বকাঝকা করলেই আয়াশ কানে আঙুল দিয়ে পালায়। আর আরিশা বুঝে আর না বুঝে আয়াশের পিছু পিছু ছুটে! মেহতাজের রাগ হলেও আসিফ তখন হাসে! আর তখন আয়াশের দাদীর উক্তি, “পুরাই মামার মতো হইছে!”
আসিফকে সাথে নিয়ে ইশার নামাজ পড়তে বেরিয়েছে মেহেদী। নামাজের পর বাড়ির বাকিদের খাওয়া হয়ে গেলেও মেহতাজ বসে আছে তাদের জন্য। সাথে নাহিদাও। নাহিদাকে খেয়ে নিতে বলেছিলো কিন্তু সে অনিচ্ছা প্রকাশ করলো। মেহতাজ ভাবলো মেহেদীর জন্যই সে-ও খাচ্ছে না। যতই হোক, এ বাড়িতে মেহমান সে। তাই লজ্জা পাচ্ছে বাকিদের সাথে খেতে বসতে। তাই মেহতাজ জোর করলো না। আয়াশের রুমে নাহিদা খেলা করছিলো তাদের নিয়ে। ওড়নায় হাত মুছতে মুছতে মেহতাজ রুমে এসে ফোন নিলো আয়াশের কাছ থেকে। অত:পর কল করতেই কেটে দিলো আর ভিডিও কল এলো মেহেদীর ফোন থেকে! মানুষ দেখা যাচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে, টেবিল, আর খাবারসমূহ! সাথে মেহেদীর কন্ঠে ভেসে আসছে,
– তোমরা খেয়ে নাও। আমরা খাওয়া শেষ করে বাড়ি ফিরছি।
– দেখেছিস অবস্থা! তোদের পিটিয়ে ছাল তুলে নেবো আমি! ভাবতে অবাক লাগে, মানুষ কতটা নির্বোধ হতে পারে! আমরা তাদের জন্য না খেয়ে বসে আছি আর তারা ঘর ছেড়ে রেস্টুরেন্ট বসে গিলছে!
– আরে আপু, রাগ করছো কেন! আচ্ছা, বলো তুমি কি কি খাবে। আসার সময় নিয়ে আসবো। বিল কিন্তু আসিফ ভাইয়াই পে করবে।
– আমার কিছু খেতে হবে না। খেয়ে আয় তোরা বেশি করে। আর এই যে মিস্টার..
– হু, মিসেস?
– আগামী সাতদিনেও ঘরের ভাত জুটবে না কপালে।
– ধুর! কপালে ভাত নিয়ে কি হবে! মুখে দিও, তাহলেই হবে।
আয়াশ চেচিয়ে বললো,
– আব্বু আমার জন্য একটা গ্রিল নিয়ে এসো কিন্তু!
এমন ঝগড়ার মাঝে আয়াশের এমন উক্তি শুনে এদিকে নাহিদা আর ওদিকে মেহেদী ও আসিফ হেসে উঠলো। মেহতাজ প্রথমে আয়াশকে ধমকে বললো,
– ওই, চুপ থাক!
পরে আবার আসিফকে বললো,
– মুখে তোমার ভাত জুটাবো! হাড়িই বসবে না চুলায়। দেখি কিভাবে খাও। ছেলে মেয়ে সহ পুরো পরিবার নিয়ে গিয়ে রেস্টুরেন্ট খাবে এখন থেকে!
– আরে, শুনো তো। আমার কোনো দোষ নেই। মেহেদী টেনে নিয়ে চলে…
মেহতাজ কল কেটে দিলো। সাথে সাথেই আবার কল করলো কিন্তু এবারও মেহতাজ কেটে দিয়েছে! তাদের বকাঝকা করতে করতে নাহিদাকে সাথে নিয়ে খেতে বসে গেলো।
ঘন্টাখানেক পর তারা শালা দুলাভাই বাড়িতে ফিরলো। হাতে করে কিছু এনেছে তারা। দরজা খুললো অথচ হাতের প্যাকেটগুলো এগিয়ে দিলে ধরলো না মেহতাজ। কারো সাথে কোনো কথাও বললো না সে। নাহিদার কোলে আরিশা ঘুমিয়ে পড়েছিলো, মেহতাজ আরিশাকে নিয়ে রুমে চলে গেলো। আসিফ নাহিদাকে জিজ্ঞেস করলো,
– খেয়েছো নাহিদা?
– জ্বি ভাইয়া।
– তোমার আপু খেয়েছে?
– হ্যাঁ।
– আয়াশ কোথায়?
– আয়াশ তার দাদুর কাছে ঘুমিয়ে পড়েছে।
– ওহ, আচ্ছা।
আসিফ চলে গেলে নাহিদা মেহেদীর পিছু পিছু আয়াশের রুমে চলে এলো। সিটি বাজাতে বাজাতে মেহেদী ফোন ওয়ালেট রেখে হাতের ঘড়ি খুলছে। নাহিদা বললো,
– কাজটা কি একটুও ঠিক হয়েছে! আপু রান্না করে বসেছিলো, আর তুমি দুপুরেও রেস্টুরেন্ট খেয়ে এলে এখনো আবার যাওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিলো! বেড়াতে এসে মানুষ এমন কান্ড করে!
– আরে, নামাজ পড়ে হাটতে হাটতে রেস্টুরেন্টের কাছে গিয়ে ক্ষুধা লেগে গেলো! তাকিয়ে দেখলাম ঝুলন্ত মুরগিটা আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। পেট ও মুরগি কাউকেই কষ্ট দিতে ইচ্ছে করছিলো না। তাই খেয়ে এলাম!
– তাই বলে একবার আপুর কথা ভাববে না! কত কষ্ট করে রান্না করলো! আর তোমরা রেস্টুরেন্টে খাওয়াদাওয়া সেড়ে দিলে তো আপুর মনটা খারাপ করে।
মেহেদী নাহিদাকে একটানে সামনে দাড় করিয়ে বললো,
– ওমা! আমার গিন্নিও দেখি রাগ করে বসে আছে!
– আপু কিন্তু সত্যিই খুব কষ্ট পেয়েছে।
– আরে, ওসব নিয়ে ভেবো না। আসিফ ভাইয়া আছে তো।
হঠাৎই মেহেদীর চোখ পড়লো নাহিদার পেছনে থাকা আয়নায়। খোলা চুলের ফাকে লাল ফিতাটা দেখা যাচ্ছে। মেহেদী আয়নায় তাকিয়েই চুলগুলো পিঠ থেকে সরিয়ে সামনে নিয়ে এলো এবং ফিতাটা টেনে গিট খুলে ফেললো! মেহেদী হঠাৎই এমন কিছু করবে সে ভাবতে পারেনি! কখন কোন মুডে চলে যায় বলা মুশকিল! নাহিদা তাকে ঠেলে সরে আসতে চাইলে মেহেদী তাকে আলমারির আয়না ঘেঁষে আটকে ফেললো। নাহিদা চোখ বন্ধ করে আছে! মেহেদী তার কাধে উষ্ণ ছোয়া দিয়ে চুলে নাক ডুবিয়ে বললো,
– চুল ভেজা কেন এখনো?
নাহিদা তার টিশার্ট আকড়ে ধরে জবাব দিলো,
– হিজাবের নিচে ভেজা চুল খোপা করা ছিলো। তাই শুকায়নি এখনো।
আস্তে আস্তে মেহেদীর মাতলামো যেন বেড়ে চলেছে! এটা মদ্যনেশা নয়। সে আরও আগেই নাহিদার প্রেম নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছে! নাহিদার অসস্তি লাগছে খুব! অন্যের বাড়িতে আছে তারা! রুমের দরজাটাও লক করা হয়নি। চাপিয়ে রাখা হয়েছে শুধু। নাহিদা তাকে সরিয়ে দিতে বললো,
– শাড়িটা চেঞ্জ করবো আমি।
– না করলে সমস্যা কোথায়!
– ঘুমাতে পারবো না শাড়ি পড়ে।
– আমি ঘুম পাড়িয়ে দেবো।
– আমরা আপুর বাসায় আছি।
– তো?
– রুমের দরজাটা খোলা আছে।
মেহেদী তার কাছ থেকে এক হাত পরিমাণ পিছিয়ে চমকে বললো,
– হোয়াট!
নাহিদা চোখে ইশারা করলো দরজার দিকে। মেহেদী তাকিয়ে দেখলো সত্যিই দরজা খোলা!
নাহিদার মুখে লেগে আছে লজ্জাময়ী ও দুষ্টুমি হাসি। মেহেদী দাতে দাত চেপে বললো,
– বোকা মেয়ে! দরজা লাগিয়ে রুমে প্রবেশ করবে না! এখন যদি কেউ চলে আসতো!
– এজন্যই তো বলি, অলওয়েজ সেন্সে থাকা দরকার।
– আমাকে কি ননসেন্স বলার চেষ্টা করছো! আমি ননসেন্স এ ছিলাম তাই না? দাড়াও দেখাচ্ছি।
মেহেদী দরজা লাগাতে গেলে এদিকে নাহিদা হাসতে হাসতে দ্রুত বাথরুমে ঢুকে পড়লো। মেহেদী রুমের দরজা লাগিয়ে বাথরুমের দরজায় টোকা দিয়ে বললো,
– জামাকাপড় নিয়ে গেছো তুমি?
নাহিদার কোনো জবাব এলো না তাই সে আবার বললো,
– শাড়ি কিন্তু চেঞ্জ করবে না আজ।
.
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলো মেহতাজ স্বাভাবিক আছে। রাগ তার মাঝে যা ছিলো সবটা রাতের অন্ধকারের সাথে সাথে শূন্যে মিশে গেছে। সকালে আয়াশকে নিয়ে মেহেদী স্কুলে গেছে। এরপর থেকে দুপুর পর্যন্ত মেহেদী বাসায়ই কাটালো। দুপুরে আসিফ ফেরার পর সিদ্ধান্ত নিলো এখন তারা ঘুরতে যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ। রাতের জন্য রান্না করে আসরের নামাজের পরপরই তারা বেড়িয়ে গেলো। বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত দুই বাচ্চাকে নিয়ে তারা চারজন ঢাকার আশপাশ ঘুরেফিরে রেস্টুরেন্টে ডিনার করে বাড়ি ফিরেছে। পরদিন সকাল হতেই মেহেদীর তাড়া,
“নাহিদা, দ্রুত তৈরি হও। বাসায় যাবো।”
আর মেহতাজের বারবার একই উক্তি,
“আজ যাবি না। আরও দুতিনদিন থেকে তারপর যাবি!”
প্রতুত্তরে মেহেদীর জবাব,
“নাস্তা দিলে দাও, না হয় না খেয়েই এখন চলে যাবো।”
এই মেহেদীকে মানানো দায়! যা একবার বলে তো বলে-ই! সে এমনিতেই কারো বাড়িতে থাকে না। এখানে দুই রাত কোনোভাবে কাটিয়ে এই সাজ সকালে শুরু হয়েছে তার ঘ্যানঘ্যান! নাহিদাকে নিয়ে সে চলে যাবে এখন। মেহতাজ তাকে বিকেলে যেতে বললো, তাতেও রাজি হলো না। এখন বাসায় যাবে তারপর সেখান থেকে অফিস যাবে! তার এতো তাড়া দেখে বিরক্তিসহিত মেহতাজ বললো,
“এজন্যই নাহিদাকে নিয়ে মাকে আসতে বলেছিলাম! তুই তো থাকবিই না, কাউকে শান্তিতে বেড়াতেও দিবি না।”
মেহেদীকে বকাঝকা করতে করতে মেহতাজ নাস্তা রেডি করে দিলো। তার ইচ্ছা অনুযায়ীই সে নাহিদাকে নিয়ে বাড়িতে চলে এলো। নাহিদাকে বাসায় রেখে গোসল করে অত:পর লেট করেই অফিস চলে গেলো।