“তৃ-তনয়া” পর্ব- ৪৭

0
2585

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৪৭
(নূর নাফিসা)
.
.
১লা ফাল্গুন ছুটির দিন হওয়ায় সকালে মেহেদী নামাজ পড়ে আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলো। রান্নার কাজকর্ম সেড়ে নাহিদা রুমে এসে দেখলো মেহেদী বিছানায় গড়াগড়ি দিয়ে আড়মোড়া ভাঙছে। নাহিদা বললো,
– নাস্তা করবে না। ওঠো। রুমটা গুছিয়ে ফেলি।
– হেপি স্প্রিং ডে।
মেহেদীর ঘুমঘুম কণ্ঠে বসন্তের শুভেচ্ছান্তে নাহিদা মৃদু হেসে জবাব দিলো,
– শুভ পহেলা ফাল্গুন।
মাথার নিচে দুই বালিশ একত্রিত করে বুকে ভর করে শুয়ে আছে মেহেদী। নাহিদা ড্রেসিং টেবিলের আসবাবপত্র গুছিয়ে নিচ্ছিলো। মেহেদী বললো,
– ভার্সিটি যাবে না?
– আজ ছুটির দিন।
– আজ ভার্সিটিতে প্রোগ্রামও।
– ভালো লাগে না প্রোগ্রামে যেতে।
– যাও না বলেই ভালো লাগে না।
– যেতে ভালো লাগে না বলেই যাই না।
মেহেদী উঠে এসে আলমারি খুললো। একটা প্যাকেট বের করে সে নাহিদার কাছে এসে সামনে প্যাকেট ও পেছনে সে দাড়িয়ে দুয়ের মাঝে জড়িয়ে ধরে কানে কানে ফিসফিস করে বললো,
– হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন্স ডে।
নাহিদা প্যাকেটের দিকে তাকিয়ে বললো,
– এটা কি?
– গিফট।
– ভ্যালেন্টাইন্স গিফট?
– বোথ অফ।
– উহুম, ভ্যালেন্টাইন্স হলে নিবো না। এসব ডে টে আমি উদযাপন করি না। বাঙালি বলে শুধু বাংলার অনুষ্ঠানগুলো মোটামুটি উদযাপন করি।
– ওকে, অনলি ফর স্প্রিং ডে।
নাহিদা আয়নায় তাকিয়ে দেখলো মেহেদী আয়নার বাইরে তার দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু একটা ইচ্ছে করছে তার, কিন্তু লজ্জা লাগছে খুব! সে প্যাকেটটা হাতে নিলে মেহেদী প্যাকেট ছেড়ে তাকে জড়িয়ে রেখে বললো,
– খুলে দেখো।
নাহিদা প্যাকেট খুলে ভেতরে হাত দিতেই কেমন তুলতুলে নরম অনুভব করলো এবং ঘ্যাঙরঘ্যাঙ শব্দ করে উঠলো! নাহিদা ছোটখাটো এক চিৎকার দিয়ে প্যাকেট ফেলে দিলো! আর হাত ঘষতে লাগলো মেহেদীর শরীরে! এদিকে মেহেদী হেসে কুটিকুটি! তার হাসি দেখে নাহিদা ভয়ার্ত চেহারা নিয়ে বললো,
– কি এটার ভেতর?
– বের করে দেখো।
– আমি পারবো না!
মেহেদী হাসতে হাসতে হাত বাড়িয়ে প্যাকেটটা উলটে দিলো ড্রেসিং টেবিলের উপর। বেরিয়ে এলো একটা হলদে রঙের শাড়ি। নাহিদা তার দিকে তাকিয়ে বললো,
– এটা না তো। অন্যকিছু ছিলো। কেমন যেন শব্দ হলো!
মেহেদী শাড়ি হাতে তুলে নিলে নাহিদা দেখলো ড্রেসিং টেবিলে একটা ব্যাঙ পড়ে আছে! কিন্তু এটা রাবার প্লাস্টিকের! মেহেদী ওটাতে আবার চাপ দিতেই ঘ্যাঙরঘ্যাঙ করে উঠলো! নাহিদা রাগী দৃষ্টিতে তাকালে মেহেদী বললো,
– শাড়িটা ফাল্গুনের জন্য আর এটা ভ্যালেন্টাইনের জন্য। কেমন লাগলো গিফট?
নাহিদা তাকে ঠেলে সরিয়ে বললো,
– খুব বাজে লোক একটা!
– মেহেদী হাসতে হাসতে আবার তার কাছে এসে ভাজ করা শাড়িটাই মাথায় ঘোমটা ন্যায় দিলো। নাহিদা এবার তার ইচ্ছেটা পূরণ করেই ফেললো। মেহেদীকে জড়িয়ে ধরে উন্মুক্ত বুকে উষ্ণ ছোয়া দিলো এবং চোখ বুজে মাথা ঠেকিয়ে রাখলো। এখন চোখ খুলতেও লজ্জা লাগছে তার। মেহেদী বললো,
“চলো না হয় আজ লাল হলুদ পড়ি,
আমি পাঞ্জাবী আর তুমি শাড়ি।
চলতে চলতে চলে যাই ফাল্গুনের বাড়ি!”
– কোথায় ফাল্গুনের বাড়ি?
– ভার্সিটিতে।
– যাবে তুমি?
– হুম।
নাহিদা তাকে ছেড়ে দিয়ে বললো,
– নাস্তা করবে, চলো।
– গোসল করে আসি।
গোসল সেড়ে নাস্তা করে দুজন তৈরি হয়ে গেলো প্রোগ্রামে যাওয়ার জন্য। দশটার দিকে তারা এসেছে। মেহেদীর ফ্রেন্ডরাও এসেছে। নাহিদা নাফিসাকে কল করেছিলো কিন্তু রিসিভ করেনি। কিন্তু ভার্সিটিতে এসে দেখা পেয়ে গেছে। নাহিদা একটু উঁচু স্বরে নাফিসাকে ডাকলো। নাফিসা তাকে দেখে উৎফুল্ল হয়ে এক প্রকার দৌড়ে এসে বললো,
– আপ্পি… ! বিশ্বাস হচ্ছে না তুমি এসেছো!
নাহিদা চিমটি দিয়ে বললো,
– এবার বিশ্বাস হয়েছে?
– ওফ্ফ! ভাবতেও পারিনি তুমি আসবে! খুব সুন্দর লাগছে তোমাকে!
– তোর এই অবস্থা কেন! তুই আবার রঙ মাখামাখি করস!
– আরে! আর বলো না! এশা দিয়েছে! বিপরীতে তাকে গণে গণে চারটা লাথি দিয়েছি!
হঠাৎ বিস্মিত কন্ঠে শুনা গেলো,
” চারটা! একটাও কম হলো না!”
নাফিসা অবাক হয়ে বললো,
– ভাইয়া! আপনিও এসেছেন! বাহ, ভালোই লাগছে লাল হলুদে দুজনকে দেখতে!
মেহেদী বললো,
– থ্যাংক ইউ।
আর মেহেদীর বন্ধুরা বললো,
– আমাদেরও একটু দেখো। আমরাও তো এসেছি।
– হু, দেখলাম। এসে গেছেন যখন, বসে পড়ুন।
– কিসে বসবো? অন্তত একটা পিড়িই এগিয়ে দাও।
– এতো বড় মাঠ সাজিয়ে রেখেছি আবার পিড়ির কি প্রয়োজন! খাটি মাটির মানুষ, মাটিতেই বসে পড়ুন।
সবাই একজোটে হেসে উঠলো। মেহেদী নাহিদাকে বললো,
– থাকো তুমি নাফিসার সাথে। আমি একটু অন্যদিকে ঘুরে আসছি। প্রয়োজনে ফোন দিও।
– আচ্ছা, যাও।
স্টেজে চলছে গানবাজনা নৃত্য। নাহিদা কিছুক্ষণ নাফিসার সাথেই ঘুরাঘুরির পর দেখা পেলো তার ফ্রেন্ডদের। তারা চলে যাবে এখন। তাদের সাথে সাক্ষাৎ করতে করতে এদিকে নাফিসাকে হারিয়ে ফেললো। ঘুড়ির মতো কোন দিক থেকে কোনদিকে চলে যায় মেয়েটা কোনো সংকেত নেই। ফ্রেন্ডদের বিদায় দিয়ে সে নাফিসাকে খুজতে লাগলো। সামনে পড়লো আশিক। বহুদিন পর আজ আশিকের দেখা পেলো। বিয়ের পর তাকে ক্লাসেও দেখেনি কোনোদিন। একপলক চোখাচোখি হয়ে গেলেও আশিক সাথে সাথেই দৃষ্টি নামিয়ে ফেলেছে হাতে থাকা ফোনের দিকে। নাহিদার সামনাসামনিই আছে সে। তুলনামূলক শান্ত স্বরে বললো,
– কেমন আছো?
নাহিদা বুঝতে পারছে না কথাটা তাকেই বলেছে নাকি ফোনে কাউকে বলছে! তাকে বললে তো নিশ্চয়ই তার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করতো!
সে চুপচাপ ভাবতে ভাবতে এদিকে আশিক তার পথে পা চালাতে চালাতে তাচ্ছিল্যের সাথে মৃদু হেসে বলতে লাগলো, “এতোটাই ঘৃণ্য আমি যে, এখন আমার সাথে কথা বলতেও রুচিতে বাধে!”
নাহিদা এবার নিশ্চিত তাকেই প্রশ্ন করেছিলো। তাই আশিকের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে একটু জোর গলায়ই বললো,
– বেশ ভালো আছি আমি। ফোনের দিকে তাকিয়ে বলেছেন বিধায় বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিলো কাকে জিজ্ঞেস করেছেন।
আশিক পেছনে ফিরে বললো,
– ওহ্! সরি। আমিও বুঝতে পারিনি যে বরাবরই তোমার বুঝতে অসুবিধা হয়ে যাবে! যাইহোক, তোমার হাসব্যান্ড আসেনি?
– এসেছে। আপনি কেমন আছেন?
– আলহামদুলিল্লাহ। হাসব্যান্ড এসেছে অথচ ওয়াইফকে এভাবে একা ছেড়ে দিলো কেন!
– আঁচল ধরে পিছু পিছু ঘুরার কথা ছিলো?
– বর্তমানে এমনটাই দেখা যায়।
– হতে পারে সেই বর্তমানটা কেবল লোক দেখানোর জন্য।
– হুম, হতে পারে! তা কোটিপতি তোমাকে সুখে রাখছে তো?
– ভাইয়া, আপনার কথার স্টাইল আমার পছন্দ হচ্ছে না।
– না-ই বা হতে পারে। এক্সট্রেমলি সরি, পার্সোনাল ম্যাটার নিয়ে কথা বলার জন্য! আসলে তোমার ভালো থাকার উত্তরে আজ “আলহামদুলিল্লাহ” শব্দটা মিসিং ছিলো। তাই কেন জানি মনে হলো তুমি সুখে নেই!
তার কথায় নাহিদাও একটু বিস্মিত হলো! আসলেই কি “আলহামদুলিল্লাহ” শব্দটা মিসিং ছিলো! মিসিং কেন থাকবে! সে তো সুখেই আছে! ভাবনা কাটিয়ে জবাব দিলো,
– আমি যেমন সুখে আছি, এতেই শোকর আলহামদুলিল্লাহ। ও তার বন্ধুদের সাথে গেছে। আমি তখন নাফিসার সাথে ছিলাম। মোহনার সাথে কথা বলতে বলতে এখন নাফিসাটাও কোথায় যেন চলে গেলো।
– নাফিসাকে ওদিকে দেখেছিলাম। এগিয়ে যাও, পেয়ে যাবে।
– ওকে। পড়াশোনা কেমন চলছে আপনার?
– চলছে চলার মতোই।
– ক্লাসেও দেখা যায় না আপনাকে!
– কেন, মিস করো?
আশিক আজ এমন কেন করছে নাহিদা বুঝতে পারছে না। যতটুকু চেনে, সে তো এমন স্বভাবের না! এতো কিছু না ভেবে অন্যান্য জবাবের মতো এবারও কথায় জোর দিয়ে জবাব দিলো,
– না।
তার জবাবে আশিক এবারও তাচ্ছিল্যের সাথে মৃদু হাসলো। নাফিসার খোজ পেতে আশিকের দেখানো পথে তাকাতেই মেহেদীকে দেখতে পেল নাহিদা। মেহেদীও যেন তার দিকে তাকিয়েছে মাত্র। নাহিদা হাতে ইশারা করে মেহেদীকে ডাকলো। মেহেদী এগিয়ে এলে নাহিদা আশিককে উদ্দেশ্য করে বললো,
– উনি আমার হাসব্যান্ড।
আশিক সালাম দিলে মেহেদী জবাব নিলো। নাহিদা আবার মেহেদীকে উদ্দেশ্য করে বললো,
– উনি আশিক ভাই। আমার ক্লাস ম্যাট আবার অন্যদিকে আরাফ ভাইয়ার ছোট ভাই।
মেহেদী বললো,
– চিনি তো। পরিচিত হয়েছি অনেক আগেই।
– অনেক আগে! কবে?
– রায়ানের বিয়েতে আরাফ ভাই পরিচয় করিয়ে দিয়েছে।
– ওহ!
মেহেদী হ্যান্ডশেক করার জন্য আশিকের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
– কেমন আছো?
আশিকও হ্যান্ডশেক করে জবাব দিলো,
– আলহামদুলিল্লাহ। আপনি কেমন আছেন ভাই?
– আলহামদুলিল্লাহ ভালো।
– আচ্ছা, থাকেন। আমি আসি। আল্লাহ হাফেজ।
– হুম।
আশিক চলে গেলে মেহেদী বললো,
– একা কেন তুমি? নাফিসা কোথায়?
– আমার এক ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলছিলাম। এর মধ্যে সে উধাও। তাকেই খুজছিলাম, আবার আশিক ভাইয়ের সাথে দেখা হয়ে গেলো।
– নাফিসাকে কল দিলেই তো পারো।
– রিংটোন শুনে নাকি এই সাউন্ডের জন্য!
– চলো।
এমনি নাফিসা এসে হাজির। নাহিদা তার কাধে এক থাপ্পড় দিয়ে বললো,
– ফাজিল, কোথায় গিয়েছিস?
– আমি তো ওয়াশরুমে গিয়েছিলাম।
– বলে যাবি না! আমি যে খুজছিলাম এদিকে!
– আমি ভাবছিলাম, তুমি বুঝি বান্ধবীর সাথে কথার ঝুড়ি খুলে বসেছো। যা ঘন্টাতেও শেষ হবে না।
– হু, তোর মতোই তো!
মেহেদী বললো,
– হয়েছে, ঝগড়া পরে করো। প্রোগ্রাম প্রায় শেষের দিকে। বাসায় চলে যাবে?
– হুম, চলেই যাবো।
– ওকে, তাহলে চলো নাফিসাকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করে পরেই যাই।
– আচ্ছা।
তার তিনজন ভার্সিটির পার্শ্ববর্তী এক রেস্টুরেন্টে এলো। চেয়ারে বসার সময় নাহিদার চোখ পড়লো তার শাড়ির দিকে! এবার তার মাথায় ধরা দিলো, আশিক নিশ্চয়ই তাকে হলুদ শাড়ি পড়নে দেখে এমন বিহেভ করেছে! করুক, তাতে কি আসে যায়! তার স্বামী গিফট করেছে, সেখানে পর পুরুষের কথা মানতে যাবে কেন! হাজার বার পড়বে হলুদ! শুধুমাত্র তার স্বামীর জন্য।
তিনজনই গল্পগুজব সহিত খাওয়া শেষ করে বেরিয়ে এলো। নাফিসা তাদের বললো,
– ভাইয়া, চলুন আজ বাসায়।
– গত সপ্তাহে না মাত্র এলাম!
– তো কি হয়েছে! আবার যাবেন। আপু চলো।
– আরে, না। তুমিই চলো আমাদের বাসায়।
নাহিদা এপাড় ওপার কোনোদিকেই কথা বলছে না! তারও ইচ্ছে করছে যেতে! কিন্তু গত সপ্তাহে মাত্র থেকে এসেছে তাই সাহস পাচ্ছে না বলার! তবুও একটু সাহস যুগিয়ে সে মেহেদীর দিকে তাকিয়ে বললো,
– চলো না, যাই। থাকবো না। মা বাবার সাথে দেখা করে চলে আসবো।
– যাও।
– যাও মানে! তুমি যাবে না?
– চলো।
নাফিসা বললো,
– দাড়াও বুট নিয়ে আসি। আর হেটে হেটে চলে যাই।
কারো প্রতিক্রিয়ার আশায় না থেকে সে বুট কিনে নিয়ে এলো। অত:পর তিনজন বুট খেতে খেতে এবং হাটতে হাটতেই চলে এলো বাড়িতে। যদিও বলেছে শুধু দেখা করে চলে যাবে। কিন্তু রুমানা বেগম যেতে দিলো না। যেতে যেতে তারা রাতে খেয়ে তারপর বাড়ি ফিরেছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here