“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৪৮
(নূর নাফিসা)
.
.
বাৎসরিক ভাবে বিলীন হয়ে গেছে শীত। রিক্ততা ছাড়িয়ে প্রকৃতিতে জেগেছে নতুন সজীবতা। নাজিয়ার প্রেগন্যান্সির সাড়ে তিন মাসের এক রাতে পেটে খুব ব্যাথা লাগছে। প্রচুর ঘামছেও সে। অস্থিরতায় তার ঘুম ভেঙে গেছে। আরাফ তার পাশেই আছে। নাজিয়া এক হাতে পেট চেপে ধরে রেখেছে। কেন হঠাৎ এমন লাগছে বুঝতে পারছে না কিছু। তার উপর থেকে আরাফের হাত সরিয়ে সে উঠে বসলো। লাইটটা অন করে মশারির বাইরে বেরিয়ে এসে অর্ধেক গ্লাস পানি পান করলো। দু এক মিনিটের মতো পায়চারি করে আবারও বিছানায় চলে এলো। ব্যাথা যেনো সেকেন্ডের কাটার সাথে তাল মিলিয়ে বেড়েই চলেছে! সে এখন না পারছে শুতে আর না পারছে বসে থাকতে! আর সহ্য করতে পারছে না! সে এক হাতে আরাফকে ঠেলতেই আরাফের ঘুম ভেঙে গেলো। আরাফ ঘুমঘুম চোখে তাকিয়ে বললো,
– কি হয়েছে? বসে আছো কেন?
– হঠাৎ করেই কেন জানি পেট ব্যাথা করছে।
– ঘুমিয়ে থাকো, ঠিক হয়ে যাবে।
– আরাফ, আমি আর পারছি না! মরে যাবো বোধহয়!
– কথাটা শুনে আরাফ চমকে উঠে বসলো! ঘুম তার পুরোপুরি ভেঙে গেছে নাজিয়ার কান্নাজড়িত কণ্ঠ শুনে! সে নাজিয়ার দিকে তাকিয়ে দেখলো দুচোখ গড়িয়ে পানি পড়ছে! এক হাতে পেট চেপে ধরে রেখেছে! সে ভয়ার্ত ভাবে বললো,
– কি হয়েছে তোমার? এভাবে ঘামছো কেন?
– পেটে প্রচুর ব্যাথা করছে! সহ্য হচ্ছে না আমার!
– খাওয়ার পর কোনো ওষুধ খেয়েছিলে?
– না।
আরাফ খাট থেকে নেমে পানি আনতে গেলে নাজিয়া বললো সে পানি খেয়েছে। আরাফ তাকে দাড় করিয়ে হাটতে বললো। সে একটু হেটেই আর পারছে না! আরাফ তাকে বসিয়ে রেখে দরজা খুলে মায়ের ঘরে এসে দরজায় টোকা দিলো এবং ডাকলো। আয়েশা বেগম দরজা খুলে বললেন,
– কি হইছে তোর?
– মা, নাজিয়া কেমন যেন করছে! ওর নাকি পেট ব্যাথা করছে প্রচুর!
– পেট ব্যাথা করে কেন! কি খাইছে?
– রাতে তো ভাত খেয়েছিলো, এর পর আর কিছু না।
আয়েশা বেগম বেরিয়ে আরাফের ঘরের দিকে আসছিলো। পিছু পিছু আলফাজ সাহেবও বেরিয়ে এসেছেন। আরাফকে উদ্দেশ্য করে বললো,
– শরীর বেশি খারাপ হইলে হাসপাতাল নিয়া যা।
– দেখি।
তাদের কথাবার্তা শুনে ওদিকে আশিকও বেরিয়ে এসেছে। নাজিয়া ব্যাথা সহ্য করতে না পেরে কান্না করছে। আরাফের আর সস্তি লাগছে না! সে আশিককে পাঠিয়ে দিলো পাশের বাড়ির সি এন জি ওয়ালাকে ডেকে নিয়ে আসতে। এছাড়া এতো রাতে আশেপাশে গাড়ি পাওয়া মুশকিল। আশিক দ্রুত চলে গেলো গাড়ির ব্যবস্থা করতে। এদিকে আয়েশা বেগম ভয় পেয়ে বিলাপ শুরু করেছেন, তার নাতি-নাতনি শেষ! কেননা নাজিয়ার ওয়াটার ফল শুরু করেছে! নাজিয়ারও ভয়ে দম বন্ধ হয়ে যাবার পালা হয়েছে। নাজিয়ার পাশাপাশি এদিকে আয়েশা বেগমও কান্না শুরু করেছেন। যেখানে অল্প কিছু হলেই তিনি কান্নাকাটি শুরু করেন সেখানে এতো বড় দুর্ঘটনার আভাস পেয়ে কান্নার জোয়ার তুলেছেন। আশিক সিএনজি ঠিক করে এলে নাজিয়াকে নিয়ে সবাই হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। বাসায় ছিলো আলফাজ সাহেব একা। হসপিটালে যাওয়ার সময় মাঝপথে নাজিয়া সেন্সলেস হয়ে পড়ে! সকলের ভয় বহুগুণে বেড়ে গেছে! আরাফ তাকে ডাকছে কিন্তু কোনো সাড়া পাচ্ছে না! আরাফের দেহ যেন নিস্তেজ হয়ে পড়ছে! এ কোন বিপদ এসে ধরা দিচ্ছে সুখের মুহুর্তে!
.
অন্ধকার ফুরিয়ে নব আলো ফুটতে শুরু করেছে। কিন্তু মনের ভেতরে যে অন্ধকারটা আরও ঘনিয়ে এলো! স্থির হয়ে বসে আছে নাজিয়া! বুকের ভেতরটা শূন্য হয়ে গেছে তার! শীতে যেমনটা পূর্ণতা এনে দিয়েছিলো ভেতরটায়, আজ বসন্তে ঠিক তেমনটাই শূন্যতা! কতটা স্বপ্ন বেধেছিলো, কয়েক মাস পরেই কোল ভরে উঠবে! তা আর হলো না। গঠন পরিপূর্ণ হওয়ার আগেই নবপ্রাণের পতন ঘটলো! গর্ভধারণের মাত্র সাড়ে তিন মাস বয়সে গর্ভপাত হলো! নাজিয়ার বাবা-মা ও শুনা মাত্র অন্ধকার ভোরেই চলে এসেছে হসপিটালে। এখন সব নীরব। যদিও কিছুক্ষণ আগে হট্টগোল বেধেছিলো! আয়েশা বেগম মরা কান্নার সাথে নাজিয়াকে অলুক্ষণে উপাধিতে ভূষিত করেছেন। যদিও এমন উপাধি আরও অনেক আগেই তার কাছ থেকে পেয়েছে সে, তবে এবারেরটা সত্য বলে মেনে নিয়েছে নাজিয়া! আর পরিনত হয়েছে এক মানব পাথরে! রুমানা বেগম মেয়ের বিরুদ্ধে এমন কথা সইতে না পেরে মুখের উপর জবাব দিয়েছিলো দু’একটা। আরাফ আজ ছিলো নির্বাক। আশিক তার মাকে থামিয়েছিলো। ভোরে আলফাজ সাহেব এসে সংঘটিত ঘটনা শুনে আয়েশা বেগমকে বকে হসপিটাল থেকে চলে যেতে বলেছেন আর এটাও বলে দিয়েছেন, যেনো তার বাড়ি না উঠে চিরতরে ভাইয়ের বাড়ি চলে যায়। শেষ বয়সে এসে স্বামীর ঘর ছাড়া হচ্ছে শুধু মাত্র ছেলের বউয়ের জন্য এটা খুবই অসম্মানজনক তার কাছে! আশিক তার মাকে নিয়ে বাড়িতে চলে গেছে। এদিকে মেহেদীসহ নাহিদা ও তার শ্বশুর শ্বাশুড়ি এসেছে হসপিটালে। নাফিসা আসতে পারলো না বাসা ফাঁকা থাকায়। কিন্তু কলের উপর কল করছে আপুর অবস্থা জানার জন্য। ডাক্তারের সাথে কথা বলে জানতে পারলো নাজিয়াকে হসপিটাল থেকে রিলিজ করে দেওয়া হবে। রুমানা বেগম জোর দিয়ে বললেন, তার মেয়েকে নিজের কাছে নিয়ে যাবে। অনেক সহ্য করা হয়েছে অপমান। আর পাঠাবে না আরাফের বাড়ি!
কথাটা শুনতেই যেন আরাফের ভেতরটা মুচড়ে গেলো! সে তখন নাজিয়ার দিকে তাকিয়েছিলো। নাজিয়াও চোখ ভরা অশ্রু নিয়ে তার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছিলো। আরাফকে এমন অসহায় ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে দৃষ্টি নামিয়ে নিয়েছে! দুজনেই আজ নির্বাক! কারো কিছু বলার সাধ্য, শক্তি, সামর্থ্য কিছুই নেই আজ! নিয়াজ উদ্দিন রুমানা বেগমকে থামিয়ে আলফাজ সাহেবের কাছে প্রস্তাব করলেন নাজিয়াকে এখান থেকে তাদের বাসায় নিয়ে যাবে। তার এখন যত্নাদির প্রয়োজন। আলফাজ সাহেবও সহমত।
সারাদিন হসপিটালে কাটিয়ে বিকেলে নাজিয়াকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে। দুপুরেই আরাফ তাদের বাসা থেকে নাজিয়ার কাপড়চোপড় নিয়ে এসেছিলো। আর এখন কাপড়চোপড়সহ নাজিয়াকে নিয়াজ উদ্দিনের বাড়িতে নিয়ে এসেছে। এতোটা সময়ে দুজনের মাঝে একটুও কথা হয়নি। নাজিয়াকে গাড়িতে তুলতে ও নামাতে যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, ব্যাথা পাচ্ছে কিনা তখন সে শুধু মাথা নেড়ে ইশারা করেছে।
দুপুরে নাহিদা তার শ্বশুর বাড়িতে চলে গেলেও সন্ধ্যায় এসেছে। কেননা, এমনিতেই বাড়ির সবার মনমেজাজ খারাপ! আপু অসুস্থ, বাসায় খামারে মুরগি, রান্নাবান্না আপুর সেবাযত্ন সহ সংসারের যাবতীয় কাজ তার মায়ের পক্ষে সামলানো দায় হয়ে পড়বে। নাফিসাও অতটা সামাল দিতে পারবে না। তাই সে মেহেরুনের কাছে বলে বাসায় আসতে চেয়েছে। মেহেরুন নিষেধ করেনি, বরং পরিস্থিতি সামাল দিতে আরও সাপোর্ট করেছেন। সন্ধ্যায় মেহেদী তাকে পৌছে দিয়ে আবার চলে গেছে। আরাফ বিকেল থেকে এখানেই আছে। আসবাবপত্র আনা নেওয়া, ওষুধপত্র কেনাসহ এই সেই কাজে সে ব্যস্ত। রাতে আরাফ রুমে আসায় পাশে বসে থাকা নাহিদা উঠে বেরিয়ে গেলো অন্য রুমের উদ্দেশ্যে। নাজিয়া আরাফের চেহারায় তাকিয়ে দেখলো, বিশ্বের সমস্ত ক্লান্তি যেন তার মুখে নেমে এসেছে! গতরাত থেকে এক মিনিটের জন্যও বিশ্রামের কথা ভাবেনি সে! সারাদিন এদিকওদিক ছুটেছে শুধু! আরাফ তার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
– কেমন লাগছে এখন?
– প্রথম সন্তান হারিয়ে ভালো কিভাবে থাকা যায়!
আরাফ জিজ্ঞাসা করলো দেহের অবস্থা আর নাজিয়া জবাব দিলো মনের অবস্থা! কথাই বাড়াতে ইচ্ছে করছে না আরাফের! নিজেই তো স্বাভাবিক না, তাকে স্বাভাবিক করবে কিভাবে! ইতোমধ্যে রুমে আগমন ঘটলো নাহিদার। এক গ্লাস পানি নিয়ে এসেছে আরাফের জন্য। পানির গ্লাস হাতে দিয়ে নাহিদা বললো,
– সারাদিন তো কিছুই খেলেন না। রান্না শেষ হয়নি এখনো। কেক, বিস্কুট দিবো ভাইয়া?
– না, খাবো না এখন।
নাহিদা আবার বেরিয়ে গেলো। আরাফ পানির গ্লাস নাজিয়ার মুখের সামনে ধরলে নাজিয়া খাবে না তাই মাথা দু’দিকে নাড়লো। পরক্ষণে আরাফ সম্পূর্ণ পানি পান করে গ্লাস রেখে দিলো। নাজিয়া নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ থেকে তার টুপটাপ পানির ফোটা পড়ছে। নাজিয়াকে একটু স্বাভাবিক করার চেষ্টা করতে আরাফ বললো,
– পেটে কি এখনো প্রচন্ড ব্যাথা আছে?
– না।
– কাদছো কেন তুমি। নিজেকে শক্ত করো। আল্লাহ ভাগ্যে যা রেখেছেন তা ঘটবেই। এভাবে ভেঙে পড়লে আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়বে। তাকাও আমার দিকে।
আরাফ এক হাতে নাজিয়ার মুখটা তার দিকে ঘুরিয়ে অন্যহাতে ভেজা গাল মুছে দিতে দিতে বললো,
– লক্ষ্মী মেয়ের মতো আর একটুও কাদবে না। আমি আছি তো তোমার পাশে।
– জানো, বড় ভাগ্য করে তোমার মতো একজনকে পেয়েছি! অথচ দেখো, এতো ভাগ্যবতী হয়েও আমি এক অভাগিনী! প্রথম সন্তানকেই দুনিয়াতে আনতে পারলাম না! আরাফ, সত্যিই আমি অলক্ষুণে।
– নাজিয়া স্টপ। এসব বলবে না কখনো। আর একটুও কাদবে না তুমি। আমরা আবার বেবি নিব, হুম?
– উহু, ভয় হয় আমার। পারবো না আমি। কিছুতেই পারবো না বারবার এমন নতুন প্রাণগুলোকে নষ্ট করে দিতে।
– নিজেকে এভাবে দোষারোপ করছো কেন! এটা ভাগ্য।
– একটা কথা রাখবে আমার?
– বলো।
– আরেকটা বিয়ে করো।
মুহুর্তেই আরাফের মুখে বিষন্নতার ছাপ নেমে এলো! এতোক্ষণ ধরে সে তাকে সামাল দিয়ে যাচ্ছিলো আর এখন কি করলো সে! এক কোপে হৃদপিণ্ডটাকে দুভাগ করে দিলো! নাজিয়া অশ্রুসিক্ত লোচনে আরাফকে আবার বললো,
– এবার আম্মার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করো। দেখো, আম্মা ঠিক লক্ষ্মী একজনকে নিয়ে আসবে তোমার জন্য। কোনো অলক্ষুণে কর্মকাণ্ড ঘটবে না আর ওবাড়িতে।
আরাফের চোখ ফেটে যেনো রক্ত বের হচ্ছে। এসময়টাতে কি এমন কিছুর সম্মুখীন হওয়ার কথা ছিলো! সে আর এক মিনিটও না বসে হনহন করে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। এদিকে নাজিয়ার বুকের ভেতরটাও ধুকধুক করে কাপছে! জানে সে কষ্ট পেয়েছে, তবুও এর চেয়ে ভালো কোনো উপায় সে খুজে পায় নি! সে মন থেকে চায়, প্রিয় মানুষটা সবসময় সুখে থাকুক। যতই ভালো থাকুক আর ভালোবাসুক এটা তো সত্য যে, গত দিনগুলোতে সে এক টুকরো সুখ এনে দিতে পারেনি সংসারে। একজন সুখী হলে তো আর সেটা সুখী পরিবার হলো না, পরিবারকে সুখী বানাতে হলে সকলকে সুখী করতে হবে। তাহলেই না সে সুখী পরিবারের এক আদর্শ বউ হতে পারবে। তার দ্বারা হয়তো সেটা সম্ভব না আর, তাই আজ আরাফকে নতুন জগতের দিকনির্দেশনা প্রদান করে নিজে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে নাজিয়া। আরাফ মোটেও প্রস্তুত ছিলো না এমন কিছু শোনার। তবুও তাকে আজ শুনাতে বাধ্য হয়েছে। গড়ে তুলুক সে নতুন সংসার, এতে যদি পরিবারে সুখ নেমে আসে তাহলে সমস্যা কোথায়! না, কোনোই সমস্যা নেই।