“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৫২
(নূর নাফিসা)
.
.
ভার্সিটির ক্লাস শেষ করে বাসায় এসে শুনতে পেলো আজ তার বাবা মা নাকি আরাফ ও জহিরুল ইসলামকে সাথে নিয়ে ইমরানের বাড়িতে গিয়েছিলো দেখতে। তাদেরও পছন্দ হয়েছে। আয়েশা বেগমের বোনের বাড়ি দেখে রুমানার একটু দ্বিধা হচ্ছিলো কিন্তু তাদের বর্তমান ভয়াবহ অবস্থার কথা ভেবে তিনিও একমত পোষণ করলেন। যদিও ওবাড়িতে তাদের আচরণ, আপ্যায়ন যথাযথ ভালো ছিলো আজ। নিয়াজ উদ্দিনের ভালো লেগেছে বেশ৷ তার প্রথম কারণ ইমরানের বাবা নেই। তিনি বরাবরই এতিমদের খুব ভালোবাসেন। এতিমদের জন্য অজান্তেই তার মনে মায়া জন্মে যায়। তাছাড়া ইমরানকেও ছেলে হিসেবে ভালো লেগেছে, মধ্যবিত্ত তাদের পরিবার। যা তাদের সাথে মানানসই।
কিন্তু সব রকম অপছন্দ কেবল নাফিসারই। কেননা তার এক কথা, সে এখন বিয়ে করবে না। বেশ কয়েকদিন ধরে নাহিদা এখানে আছে। আজ জহিরুল ইসলাম আসায় সে চলে গেলো সাথে।
পরদিন নাফিসা ভার্সিটি থেকে বাড়ি ফিরতেই তার মায়ের প্রশ্ন, “তুই ইমরানের কাছে কল করেছিস?”
এমন প্রশ্নে নাফিসা থমকে গেলো! মায়ের মুখ গম্ভীর। পাশে ছিলো নাজিয়া। তার মুখও গম্ভীর! নাফিসা ভাবছে, “গতকাল কি ওই ব্যাটা বিচার দিয়ে দিলো নাকি! তাহলে গতকাল কিছু জিজ্ঞেস করলো না কেন মা! নাকি আজ কল করে বিচার দিয়েছে!”
তার কোনো জবাব না পেয়ে রুমানা বললো,
– কি বলেছি, কথা কানে যায় নি?
– হ্যাঁ, কল দিয়েছিলাম।
সাথে সাথেই তার দুই গালে দুইটা কষিয়ে থাপ্পড় পড়লো! রুমানা বেগম আরও কয়েকটা দিতো হয়তো! কিন্তু নাজিয়া থামিয়ে দিয়েছে তার মাকে। অত:পর তিনি রাগান্বিত হয়ে বললেন,
“এমনিতেই আধমরা হয়ে আছে, এবার কি পুরোপুরি মেরে ফেলবি লোকটাকে! শেষ করে দে, আমাকে সহ একেবারে শেষ করে দে! ভালো লাগে না আর তোদের নিয়ে এই যন্ত্রণা! মেয়ে মানুষ বিয়ে দিবো না তো ঘরে খুটি বেধে সারাজীবন রেখে দিবো? শান্তির নিশ্বাস ফেলে বাচতে দিবি না একটু! ভাবতেও অবাক লাগে, আমার ঘরে এমন মেয়ে আছে যে নিজের বিয়ে নিজেই ভেঙে দিতে চায়! সবকিছুতেই বাড়াবাড়ির একটা লিমিট থাকা প্রয়োজন! পড়াশোনা করিয়েই আমার ভুল হয়েছে! মূর্খ রেখে দিতাম, আর বারো তেরো বছরে আরেক মূর্খের হাতে তুলে দিয়ে ঘর থেকে বিদায় করে দিতাম। সেটাই অনেক ভালো হতো। এমন শিক্ষিত হওয়ার তো কোনো দরকার নেই যে কিনা পরিস্থিতি বুঝতে জানে না!”
নাফিসা এক গালে হাত রেখে দাড়িয়ে আছে! থাপ্পড় দিতে দেড়ি হয়েছে কিন্তু চোখের পানিতে তার গাল ভিজতে দেড়ি হয়নি একটুও! কান্নাজড়িত কণ্ঠে সে চেচিয়ে বললো,
– মূর্খই রেখে দিতে। করিয়েছো কেন পড়াশোনা! মেয়ে হয়ে জন্মে তো বোজা হয়ে গেছি! ঘর থেকে বিদায় করলেই শান্তি তোমাদের! দিয়ে দাও বিয়ে কিছু বলবো না আমি। মুর্খের হাতেই তুলে দাও, তবুও কিছু বলবো না। জন্ম দিয়েছো সেটাই বেশি!
এভাবে কথা বলতে দেখে নাজিয়া নাফিসাকে ধমক দিলো! নাফিসা কাদতে কাদতে পাশের রুমে গিয়ে ঠাস করে দরজাটা লাগিয়ে দিলো এবং ব্যাগটা ঢিল মেরে ফেলে বালিশে মুখ চেপে কান্না করতে লাগলো। আর ওদিকে কষ্টে রুমানার বকাঝকা চলছেই!
প্রায় সপ্তাহ খানেক ছুটি কাটিয়ে নিয়াজ উদ্দিন আজ অফিস গিয়েছিলেন। আর বাসায় এসে দেখতে পেয়েছেন নাফিসা কাদছে। শুনেছে দুপুরে খায়ওনি সে। ঘটনা পুরোপুরি না শোনালেও তিনি বুঝতে পেরেছেন মেয়ের অভিমান কোথায়! কিন্তু আজ তিনিও যে নিরুপায়। ভাবনা যে তার পিছু ছাড়ছে না। তিনি হাতমুখ ধুয়ে নাফিসাকে ডাকলেন। আর যাই হোক, বাবার ডাক উপেক্ষা করতে পারে না কোনো মেয়ে। সে চোখ মুছতে মুছতে দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। কান্না করে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে। গালেও দু একটা আঙুলের ছাপ বসে আছে। তা দেখে তিনি আবার রুমানাকে বলতে লাগলেন, “বয়স হওয়ার আগেই বুড়ি হয়ে গেছো তুমি! দিনদিন আক্কেল কমে যাচ্ছে তোমার! আম্মার গায়ে আবার হাত তোলে কেউ! কি করেছো মেরে মেরে! জরিমানা করা হবে তোমার!”
ওদিকে কাজ করতে করতে রুমানার বিড়বিড় চলছে, “এমন আদরামে মাথার স্ক্রু ঢিলা করে দিয়েছে। এজন্যই সন্তানদের অতি আদর দিতে নেই। লাঠির আগায় রাখতে হয় শুধু! এগুলা আদরের যোগ্য না!”
“হইছে, চুপ থাকো! তোমার বাবার মতো এমন লাঠির আগায় রাখলে আমার শান্তশিষ্ট মেয়েরা আজ তোমার মতো সারাদিন শুধু ঘ্যানঘ্যানই করতো!”
প্লেটে খাবার নিতে নিতে নাজিয়া মিটিমিটি হাসছে তার বাবামায়ের কথা শুনে। নিয়াজ উদ্দিন নাফিসার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
– পিচ্চি আম্মা, যাও তো। চোখে মুখে পানি দিয়ে এসো। তুমি একদিনেই ফুলে মোটা হয়ে গেছো! এবার খেয়ে একটু চিকন হওয়া দরকার।
– খাবো না আমি।
– আমার তো ক্ষুধা লাগছে! আম্মাজান না খেলে আমার ক্ষুধা মিটবে কি করে! তারাতাড়ি যাও।
– তুমি এখনো খাওনি! ওষুধ দিয়ে দেয়নি যাওয়ার সময়।
– হ্যাঁ, খেয়েছি। বাসায় আসতে আসতে আবার ক্ষুধা লেগে গেলো! তারাতাড়ি যাও, হাতমুখ ধুয়ে এলে আবার তোমার সাথে খাবো।
নাফিসার একটুও ইচ্ছে নেই খাওয়ার। কিন্তু তার বাবা এখন খাবে বলে সে যেতে বাধ্য। হাতমুখ ধোয়ার পর প্লেট হাতে নিয়েছে ঠিকই এমনকি খাবার মুখেও দিয়েছে কিন্তু ভাত তার গলা দিয়ে নামছে না। বারবার কান্না আসছে শুধু! নাজিয়া বললো, “আমি খায়িয়ে দিবো?”
নাফিসা কোনো জবাব দিলো না। টুপটাপ তার চোখ থেকে পানি ঝরছে। নাজিয়া হাত ধুয়ে তার পাশে বসে প্লেট নিতে চাইলো কিন্তু নাফিসা প্লেট দিলো না। সে বসেই আছে ওভাবে। নিয়াজ উদ্দিন বললেন,
– তোমাকে এখন বিয়ে দিবো না। আরাফকে বলবো যেনো তাদের নিষেধ করে দেয়। খাও এবার।
নাফিসা নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক করতে চাইছে কিন্তু পারছে না! তবুও সে কাপানো কণ্ঠে বললো,
“আমি বিয়ে করবো। তবে বউ সাজবো না। কোনো লোক জানাতে পারবে না। ঘরোয়াভাবে বিয়ে হবে। কোনো অনুষ্ঠান হবে না, কাউকে দাওয়াত করতে পারবে না। আজকের পর থেকে তুমি অফিস যাবে না। অসুস্থ শরীর নিয়ে শুধু শুধু এতো পরিশ্রম করতে হবে না। চাকরি ছেড়ে দাও। খামারে যা আয় হবে তাতেই দিন চলবে। আর আজ কালের মধ্যেই বিয়ে দিয়ে দাও আমাকে।”
পেট ভরা থাকা সত্ত্বেও নিয়াজ উদ্দিন খেতে বসেছেন নাফিসার জন্য। অল্প খাবার নিয়েছে প্লেটে, অল্প অল্প মুখে দিয়ে হাত নাড়াচাড়া করছেন প্লেটে। নাফিসার মুখে এমন কথা শুনে নিয়াজ উদ্দিন থমকে গেলেন! হাতও চলছে না, মুখও চলছে না! নাজিয়াও ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে নাফিসার দিকে। নাফিসা বা হাতে চোখ মুছে একবার তার বাবার দিকে তাকিয়ে আবার নিচের দিকে তাকিয়ে বললো,
– কি ভাবছো! এখন কি এতেও না করবে! আমার কোনো কথাই কি রাখবে না! সবসময় আমার উল্টো দিকেই থাকো সবাই! বিয়ে করতে হলে আমি এভাবেই করবো। আর ওই ভদ্রলোককেই করবো যার সাথে তোমরা ঠিক করেছো।
– ভাত খাও। বিয়ে দিব না তোমাকে।
– তাহলে আর আজীবনেও বিয়ের কথা তুলতে পারবে না। বুড়ি হয়েও তোমার বাড়িতেই পড়ে থাকবো। লোকের মুখে নানান কথা শুনবে, তবুও তখন আমাকে কিছু বলতে পারবে না।
– আচ্ছা।
– আচ্ছা মানে কি! দুপুরে মাইর খেতে হয়েছে রাজি নই বলে! আর এখন আমি রাজি তো তুমি বলছো বিয়েই দিবে না! বারবার কথা ঘুরাতে পারবে না। ভাবার সময় আজকেই শেষ। বউ সাজবো না, লোকে বিয়ের দাওয়াত পাবে না, চুপচাপ বিয়ে হবে আজ বা কালের মধ্যেই। তুমি কোনো চাকরিও করবে না। প্রয়োজনে আমি উপার্জন করে খাওয়াবো।
নাজিয়ার হাসিও পাচ্ছে খুব আবার রাগও হচ্ছে। কিন্তু কোনোই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে না! চুপচাপ বসে আছে শুধু! নিয়াজ উদ্দিন বললো,
– আচ্ছা, খাওয়ার পর ভেবে দেখবো আমি। এখন খাও তুমি।
নাফিসা প্রতি লোকমার পরপর পানি মুখে দিয়ে ঢকঢক করে ভাত গিলে নিলো শুধু! নাজিয়া লক্ষ্য করে বারবার বলছিলো, “আস্ত ভাত গিলে নিলে পেট ব্যাথা করবে।”
কিন্তু নাফিসা সেদিকে ধ্যান না দিয়ে নিজের মতো করে প্লেট শূণ্য করে ফেললো। খাওয়া শেষে বাবার প্লেট সহ তার প্লেট নিয়ে চলে গেলো এবং ধুয়ে নিয়ে এলো।
ইমরানকে বলা কথাগুলো ইমরান আরাফকে জানিয়েছিলো। আর আরাফের কাছেই জেনেছে রুমানা বেগম। আজ সন্ধ্যায় আবার নাজিয়া আরাফকে জানিয়েছে বিকেলে বলা নাফিসার কথাসমূহ। তখন আরাফের পাশে ছিলো ইমরান। কিন্তু সেটা নাজিয়া জানতো না। আরাফও শুনে হাসছে নাজিয়াও তখন হাসতে হাসতে বলছিলো। নাফিসা নাজিয়ার হাসি শুনতে পেয়ে পেছন থেকে বললো,
“খুব মজা পাও তো সবাই আমাকে নিয়ে! এখন ঢাকঢোল পিটিয়ে পুরো মহল্লায় জানিয়ে দেও!”
কথাটুকু বলে নাফিসা সেখান থেকে অন্য রুমে ফিরে এসেছে। বই সামনে নিয়েও রেখে দিলো। পড়াশোনা করে আর কি হবে! বিয়েই তো দিয়ে দিবে! আর লাগবে না পড়াশোনা। সে খামারে চলে গেলো। আর পড়া হলো না বই!
.
বাসর ঘরে বসে আছে নববধূ। নেই তার মাঝে কোনো সাজুগুজু! না আছে পড়নে লাল বেনারসি আর না আছে কোনো গহনাদি! আছে শুধুই সাধারণ সুতি সেলোয়ার-কামিজ! দোপাট্টার পরিবর্তে মাথায় ঘোমটা টেনে আছে সুতি ওড়নাটা। বিনা পুষ্পে সজ্জিত বিছানা। বিনা বাজনার বিয়ে বাড়ি। নেই কোনো সমাগম আর না আছে কোলাহল! আছে শুধুই নিরবতা আর বিষন্নতা! সকলের মুখ গম্ভীর ও ফোলা ফোলা! নববধুর চোখে বইছে এক রাশ জলধারা! যার নেই কোনো অন্ত আর না আছে মন শান্ত!
না সেজেছে বউ আর না সেজেছে বরণ ডালা! জাকজমাকপূর্ণ সাজের পরিবর্তে বোরকা হিজাব পড়ে গৃহে প্রবেশ করেছে গৃহ বধু। বারযাত্রী বলতে ছিলো শুধু বর ইমরান ও ভাসুর আরমান। গতকাল সন্ধ্যায় নাফিসার ইচ্ছে জানার পর ইমরান বাসায় এসে বলেছে। তার মা অমত পোষণ করলেও তার বড় মা তাকে বলেছে পছন্দ হলে আপাতত বিয়ে পড়িয়ে রাখতে। পরবর্তীতে আয়োজন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বউ ঘরে তুলতে। ইমরানেরও এ প্রস্তাবটি ভালো লেগেছে। ব্যক্তিগত ভাবে সে-ও এটাই ভাবছিলো। অত:পর আরাফকে দিয়ে নিয়াজ উদ্দিনের কাছে এই প্রস্তাবটা রেখেছে ইমরান। মেয়ের পাগলামো ও শর্তের কথা ভেবে নিয়াজ উদ্দিনও এই প্রস্তাবেই সম্মত হলেন। তাই আজ সন্ধ্যায় ঘরোয়া ভাবে বিয়েটা পড়িয়ে রাখতে চেয়েছিলেন। পরবর্তীতে ঠান্ডা মাথায় বাকি দুই মেয়ের ক্ষেত্রে অনুষ্ঠানের ন্যায় ছোট মেয়ের বিয়েতেও অনুষ্ঠান করবেন। তখন নাফিসাও নিশ্চয়ই আর এমন পাগলামো করবে না। সে শান্তভাবে ভাববে।
কিন্তু ঘটেছে ভিন্ন কিছু৷ বরপক্ষ গহনাপত্র না আনলেও শুধু শাড়ি আর একটা আংটি নিয়ে এসেছিলো। দুই বোন জোর করেও সন্ধ্যায় তাকে সেই শাড়ি পড়াতে পারলো না! সে বলেছে বউ সাজবে না তো সাজবেই না! শুধু পড়নের জামা পাল্টে নতুন সালোয়ারকামিজ পড়েছে! বিয়ে পড়ানোর পূর্বে সে বাবাকে বলেছিলো আর চাকরি করবে না তার বাবা। রেজিষ্ট্রেশন পেপারে সিগনেচারের আগেও বলেছে তার বাবা যেন চাকরি ছেড়ে দেয়। নিজের অসুস্থতার কথা ভেবে নিয়াজ উদ্দিন রাজি হয়েছে। বিয়ে পড়ানোর পর খাওয়াদাওয়া চললো, হুজুর ও কাজী বিদায় হলো। যখন জহিরুল ইসলাম ও আলফাজ সাহেবের পাশাপাশি ইমরান ও আরমানকে বিদায় দিতে যাবেন তখন নাফিসা প্রস্তুত শ্বশুর বাড়ি যাবে! বিয়ে হলে কনে শ্বশুর বাড়ি যায় তাহলে সে বাবার বাড়ি কেন থাকবে! এখন তার বরের সাথে সে-ও শ্বশুর বাড়ি চলে যাবে! কথা বলে নিজেই গোছগাছ করতে শুরু করেছে! মা বোনের পক্ষে এই ক্ষেপানো পাগলীকে সামলানো দায় হয়ে পড়েছে! আর বাবা নিশ্চুপ এবং স্তব্ধ! সে বোরকা হিজাব পড়ে প্রস্তুত, আজ বিয়ে হয়েছে তো আজই বাবার বাড়ি ছাড়বে। ইমরান নতুন জামাই, সে কি বলবে এখানে ভেবে পাচ্ছে না। কিন্তু নাফিসার একঘেয়েমিতে আরমান বললো বউ সাথেই নিয়ে যাবে। আর ওভাবেই নববধূকে নিয়ে আসা হলো বাড়িতে!