“তৃ-তনয়া” পর্ব- ৫৩

0
2591

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৫৩
(নূর নাফিসা)
.
.
বোরকা হিজাব খুলে নাফিসা নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে ঘরে। নিরবে শুধু চোখ থেকে পানি পড়ছে। ইমরানের বড় মা ও ছোট বোন, পরপর দুজন মানুষ এসে ঘুরে গেলো রুম থেকে। সে কারো দিকেই তাকায়নি। তারা এসে নিজেদের পরিচয় দিয়েছে। দু একটা কথা বলেছে। নাফিসা না দিয়েছে তাদের কোনো জবাব আর না শুনেছে তাদের কথা! তার ধ্যান অন্যদিকে ছিলো। কোনো প্রতিক্রিয়াই জানালো না কারো উক্তিতে। ধ্যান ভাঙলো ইমরানের ডাকে। ইমরান তার বাহু ধরে ঝাকিয়ে ডাকলো, “নাফিসা?”
পরক্ষণে নাফিসা মাথা তুলে ভেজা দুই নয়নে দেখতে পেলো ইমরানকে। কখন থেকে ডাকছিলো তার জানা নেই। তবে এখন নড়াচড়াতে সে শুনতে পেয়েছে। ইমরান ছোটখাটো এক নিশ্বাস ফেলে বললো,
– এভাবে আছো কেন? কখন থেকে ডাকছিলাম!
নাফিসা তার দুহাত ঝাড়ি দিয়ে সরিয়ে দিতে চাইলে ইমরান বাহু ছেড়ে দিলো। অত:পর বললো,
– খাবার কখন দিয়ে গেছে। খাওনি কেন?
নাফিসা পাশে রাখা টেবিলের দিকে তাকিয়ে দেখলো খাবারের প্লেট। কে, কখন রেখে গেছে সে বলতেই পারবে না কিছু! ইমরান আবার বললো,
– এসো আমার সাথে। হাতমুখ ধুবে।
নাফিসা নড়ছে না তার জায়গা থেকে। ধ্যান ভাঙলেও স্থীর হয়ে বসেই আছে।
– কি হলো, চলো…
ইমরান তাকে টেনে উঠানোর জন্য তার হাত ধরতে গেলে নাফিসা হাত সরিয়ে নিলো এবং দু’হাতে চোখ মুছতে মুছতে নিজেই উঠে দাড়ালো। ইমরান তার আগে যাচ্ছে আর সে পিছু পিছু। রুমের বামপাশেই বাথরুম। বাথরুমে এসে সে ফ্রেশ হয়ে নিলো। পাশাপাশি দুইটা রুমের মাঝে বাথরুম। নাফিসা বের হয়ে বাথরুমের বামপাশের রুমের দিকে চলে যাচ্ছিলো, কেননা তার সেই খেয়ালও নেই কোন রুম থেকে এসেছিলো। ইমরান ডানদিক থেকে বললো,
– ওদিকে না, এদিকে এসো।
নাফিসা পেছনে ফিরে ইমরানকে বিপরীত রুমের দরজার সামনে দাড়িয়ে থাকতে দেখলো। অত:পর ওই রুমে চলে গেলো। ইমরান পিছু পিছু রুমে এসে নতুন তোয়ালে এগিয়ে দিলো কিন্তু নাফিসা সেটা না নিয়ে নিজের ব্যাগ থেকে খুজে খুজে তোয়ালে বের করে হাত মুখ মুছে নিলো। ইমরান ব্লেজার খুলে রেখে টেবিলে রাখা খাবারের প্লেটের ঢাকনা সরিয়ে গ্লাসে পানি দিলো। ওদিকে খাটের এক কোনে গুটিসুটি মেরে নাফিসা কম্বল টেনে শুয়ে পড়েছে। ইমরান বললো,
– শুয়ে পড়লে কেন? খাবে না?
নাফিসার কোনো প্রতিক্রিয়া এলো না! ইমরান তার কাছে এসে দাড়িয়ে বললো,
– ওবাড়িতে খেয়েছো তুমি?
এবারও কোনো জবাব নেই! নাফিসা চোখ বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে আছে। ইমরান তাকে টানতে শুরু করলো,
“নাফিসা, ওঠো। খেয়ে নাও। না খেয়ে থাকলে দুর্বল হয়ে পড়বে। নাফিসা?”
এবার নাফিসা হাত ঝাড়ি দিয়ে উচ্চস্বরে বললো,
– চাইছেন কি আপনি! বিয়ে করতে চেয়েছেন এখন বিয়ে করে শান্ত হননি? নাকি এখন জুলুম করে মেরে ফেলে তারপর শান্তি পাবেন? তাহলে গলাটিপে একেবারে মেরে ফেলুন! আমিও মানুষ, আমারও সহ্য হয় না এতসব জুলুম আর জালাতন!
ইমরান তার হাত ছেড়ে দিয়ে পলকহীন তাকিয়ে আছে। কপালে সূক্ষ্ম ভাজ পড়ে আছে। সে তার উপর কি জুলুম করলো সেটাই ভেবে পাচ্ছে না! সন্ধ্যা থেকে এ পর্যন্ত সব তো এই মেয়ের ইচ্ছাতেই হলো, তবুও সে এমন করছে কেন! সে বিয়ে করেছে বলেই কি তার দোষ হয়ে গেছে!
এদিকে ইমরানকে ঝাড়ি দিয়ে নাফিসা আবার চোখ বন্ধ করে শান্তভাবে শুয়ে আছে। বন্ধ চোখ থেকেও টুপটাপ অশ্রুবিন্দুর পতন ঘটছে। ইমরান তাকে আর কিছু না বলে খাবারের প্লেট নিয়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। নাফিসার দৃষ্টি এবং মস্তিষ্ক এখন সম্পূর্ণ সজাগ! ভাবতেও পারেনি সে আজ এই অবস্থানে থাকবে! খুব কাদতে ইচ্ছে করছে তার। কিন্তু পারছে না সে কাদতে! নিজেকে শান্তও করতে পারছে না। হঠাৎ বাইরে ইমরানের গলা শুনতে পেলো। সাথে একটি মেয়েলি গলাও। সে চোখ মুছে নিলো আবার। দু মিনিট পর দরজা খোলার শব্দে সে মাথা ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকালো। ইমরান রুমে প্রবেশ করে দরজা লাগিয়ে দিচ্ছে। ইমরান কি এখন তার কাছে আসবে! যদি তার কাছে আসে, জোর জবরদস্তি করে তাহলে মরে যাবে সে! কিন্তু মৃত্যুই যদি না থাকে তাহলে মরবে কি করে! ভয়ের পাশাপাশি এখন নিজের উপর প্রচুর রাগও হচ্ছে! বিয়ে হয়েছিলো তো হয়েছিলোই! সে জেদ করে এ বাড়িতে চলে এলো কেন! নাফিসা দোয়াদরুদ পড়তে পড়তে কম্বল টেনে কাচুমাচু হয়ে গেছে! ইমরান খাটে বসে বললো,
– এক কম্বল কি তোমার একাই লাগে! আমার এখানে একাধিক কম্বল নেই! একটু যদি মানবদরদী হয়ে থাকো তাহলে আমার উপরও মেহেরবানী হও।
তার কথায় নাফিসা চোখ খুলে নিজের দিকে তাকালো আবার পেছনের দিকে তাকালো। ভয়ে এবং নিজেকে রক্ষার্থে কখন যে পুরো কম্বলের মাঝে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে তার খেয়ালই নেই! সে ইমরানের দিকে তাকিয়ে দেখলো ইমরান তার দিকেই তাকিয়ে আছে। নাফিসা তার শরীর থেকে এবার পুরো কম্বল সরিয়ে ইমরানের দিকে দিয়ে দিলো। এবং ওড়না দ্বারা যতটুকু সম্ভব নিজেকে জড়িয়ে নিলো। ইমরান কম্বল ছড়িয়ে নাফিসার উপর দিয়ে বালিশটা একটু টেনে বললো,
– এতো কিনারায় শুয়েছো কেন! পড়ে যাবে তো!
নাফিসা রেগে পেছনে ফিরে বললো,
– আপনার সমস্যা!
– আমার বউ পড়ে যাবে, তো আমার সমস্যা হবে না!
– আমি আপনার বউ না।
– নিজের ইচ্ছাতেই এমন অপ্রত্যাশিত বিয়ে করে আমার ঘরে চলে এলে অথচ এখন বলছো তুমি আমার বউ না!
নাফিসা আর কিছু না বলে বালিশ টেনে আবার আগের জায়গায় নিয়ে গেলো। ইমরান আর কিছু বললো না। দুজন দুইপ্রান্তে শুয়ে আছে। বেশ কিছুক্ষণ সজাগ থেকে ইমরান ঘুমিয়ে পড়েছে। মাঝ রাতে আবার ঘুম ভেঙে গেলো তার৷ কানে ভেসে আসছে চাপা কান্নার আওয়াজ। চোখ খুলে তাকিয়ে বুঝতে পারলো নাফিসা ফুপিয়ে কাদছে এখনো! ইমরানের এবার প্রচুর রাগ হলো তবুও তেমনটা প্রকাশ করলো না। সে নাফিসার বালিশ টেনে খাটের মাঝামাঝিতে এনে নাফিসাকেও টেনে বালিশে নিয়ে এলো। নাফিসা তার দিকে তাকাতেই দেখলো চোখ ফুলে লাল হয়ে গেছে! চোখের ধারে পানি পড়ে কালচে ছাপ বসে গেছে! নাফিসা সরে যাওয়ার জন্য ছটফট করছে। ইমরান তার চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,
– সমস্যা কি তোমার? এতো কাদছো কেন! আজ যা হয়েছে সব তোমার ইচ্ছাতেই হয়েছে। তবুও এমন করছো কেন!
– এটাও আমার ইচ্ছা, ছাড়ুন।
– সব ইচ্ছা পূরণ করতে দেয়া যাবে না। কেদে কেদে দুর্বল হয়ে মরে গেলে তখন আমাকে জেলের ঘানি টানতে হবে এইজন্য যে, বিয়ের প্রথম রাতেই বউ মেরে ফেলেছি আমি!
অন্যসময় এমন কথা শুনলে হয়তো হাসতে হাসতে বিষম খেতো নাফিসা কিন্তু আজ তার মুখে হাসির ছিটেফোঁটাও নেই! বড্ড অসহ্য লাগছে তার! ইমরান কম্বলের উপর দিয়ে তাকে চেপে ধরে রেখেছে। যার ফলে নাফিসা নিজেকে ছুটাতে পারছে না। এতোটা জোরাজোরির শক্তিও যেন পাচ্ছে না। দুর্বল লাগছে তার নিজের কাছেই! কাদতে কাদতে ক্লান্ত সে!
বেশ কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে দেখলো নাফিসার চোখ বন্ধ এবং শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক। ইমরান বুঝতে পারলো সে হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। এবার তার ভেতরও একটু শান্তি লাগছে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে মাথায় প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করছে নাফিসা! বালিশ পিঠের নিচে রেখে সে চুপচাপ বসে আছে। চোখ ঘুরিয়ে পুরো রুমটাকে দেখলো। বারো ফিট অথবা চৌদ্দ ফিট বর্গাকৃতির রুম। আসবাবপত্র বলতে, একটা খাট, একটা ড্রেসিং টেবিল, একটা আলমারি, একটা বুক সেল্ফ আর দুইটা চেয়ার ও একটা টি টেবিল আছে রুমে। বিছানা বাদে আপাতত গুছানোই সবকিছু। দরজা চাপিয়ে রাখা হয়েছে। ইমরান রুমে এসে নাফিসাকে বসে থাকতে দেখে হাতের নতুন টুথ ব্রাশটা এগিয়ে দিয়ে বললো,
– ব্রাশ নিয়ে বাথরুমে যাও। ফ্রেশ হয়ে এসো।
নাফিসা ব্রাশ হাতে নিয়ে প্যাকেট ছাড়াতে ছাড়াতে বাথরুমে যাওয়ার জন্য বের হতে লাগলে পেছন থেকে ইমরান বললো,
– বাথরুম চেনো তো? রুমের বামদিকে। বাথরুম থেকে বেরিয়ে আবার রুম ডানদিকে।
নাফিসার এখন কথা বলার মুড নেই তাই পালটা জবাব দিলো না! ভাবে টা কি, রাতে একটু ভুল হয়েছে দেখে এখন দিনের এই আলোতে কি বুঝা যাবে না কোনটা বাথরুম আর কোনটা বসবাসযোগ্য রুম!
নাফিসা রুম থেকে বের হতেই দেখতে পেলো লম্বাটে বারান্দা আছে রুমের সামনে। গ্রিল দ্বারা সম্পূর্ণ বারান্দা আবদ্ধ। এটা টিন শেড বিল্ডিং। দুইটা রুম আর মাঝে একটা বাথরুম। আর এর সামনের দিকটা পুরোটাই বারান্দা। রাতে যখন গেইট ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করছিলো তখন মনে হয়েছিলো কোন বহুতল ভবনে বুঝি প্রবেশ করছে। কিন্তু তা নয়। এই ঘরটার সামনে ফাঁকা উঠুন। তার বিপরীতে আবার একটা একতলা ভবন দেখা যাচ্ছে। তাদেরই হবে হয়তো। নতুবা মা, ভাই, বোন এই দুই রুমে আবার থাকে কিভাবে! সকালের পরিবেশটা ভালোই দেখা যাচ্ছে তবে জনমানব শূন্য। নাফিসা বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বের হতেই পাশের রুম থেকে একটি মেয়ে বেরিয়ে এলো। নাফিসাকে দেখে হাসিমুখে মেয়েটি বললো,
– গুড মর্নিং, ভাবি।
কুশলাদি জানাতে নাফিসাও ঠোঁটের কোনায় জোরপূর্বক মৃদু হাসি ফুটিয়ে বললো,
– গুড মর্নিং।
মেয়েটি তার দিকে এগিয়ে এসে বললো,
– চেনো আমাকে?
নাফিসা চিনতে না পেরে চুপচাপ দাড়িয়ে আছে তাই মেয়েটিই বললো,
– আমি নিশাত। তোমার পিচ্চি ননদ। প্রথমে বড় ভাইয়া আরমান, তারপর ছোট ভাইয়া ইমরান আর অবশেষে আমি নিশাত।
– ওহ্! কিসে পড় তুমি?
– এইচএসসি এক্সামিনার। তুমি তো মেবি অনার্স ফার্স্ট ইয়ারের?
– হ্যাঁ।
– তোমার রুমের পাশেই এটা আমার রুম। এসো আমার রুমে…
– না, পরে যাবো। মুখ মুছতে হবে। মুখেই পানি শুকিয়ে যাচ্ছে।
– আচ্ছা। যাও।
নাফিসা ধীর পায়ে রুমের দিকে এগোতে এগোতে নিশাত বারান্দার গেইট খুলে উঠুনে বেরিয়ে বিপরীত ঘরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। নাফিসা দাড়িয়ে রইলো বারান্দায়। নিশাত ওই ঘরের গেইট খুলে ভেতরে প্রবেশ করতেই নাফিসা তার রুমে চলে এলো। ওটা তাদের ঘর কি-না দেখার জন্যই নাফিসা এতোক্ষণ দাড়িয়ে ছিলো। এবার সে নিশ্চিত। তবে ওই ঘর ছেড়ে দুই ভাইবোন আবার এই ঘরে কেন সেটাই এক মুহুর্তের জন্য ভাবনার বিষয় হয়ে উঠেছিলো। কেননা সেটা দেখতে প্রায় বড়সড় ঘর। এমন একটা ভবনে মিনিমাম চারটা রুম তো থাকারই কথা। তাদের পরিবারের সদস্য বেশি হলেও তো ওটা দোতলা করতে পারতো। এখানে এমন আলাদা টিন শেডের কি প্রয়োজন ছিলো! তা-ও ওটার তুলনায় এটা নতুনই মনে হচ্ছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here