“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৫৪
(নূর নাফিসা)
.
.
নাফিসা রুমে এসে দেখলো ইমরান বিছানাপত্র গুছিয়ে ফেলেছে। সে চুপচাপ মুখ মুছে খাটে বসে রইলো। মাথা যেন ঝিম ধরে আছে! ইমরান বললো,
– এভাবে আছো কেন। এখানে প্রসাদন সামগ্রী কিছু আছে। ইউজ করতে পারো। তা না হলে পাশের রুমে চলো, সেখানে সব পাবে।
– প্রয়োজন নেই। আমি অন্যের জিনিস ইউজ করি না৷
– তোমার জন্য আলাদা আনতেও তো সময় লাগবে। আপাতত ওটা ইউজ করো।
– না।
– আচ্ছা, তাহলে মাথাটা অন্তত আঁচড়ে রাখো। কেউ দেখতে এলে কি ভাববে!
– খবরদার কোনো লোক যদি আসছে দেখতে!
– নতুন বউ বাড়ি এলে তো আশেপাশের সবাই আসবেই!
– দরজা লাগিয়ে রাখুন। তাহলেই হবে।
ইমরান দুষ্টুমির সাথে বললো,
– ইশ! দুজন বন্দী হয়ে সারাদিন দরজা লাগিয়ে রাখলে লোকে কি বলবে, বলোতো!
– আপনাকে কে বলেছে থাকতে! বের হোন!
ইমরান, হাসতে হাসতে বললো,
– আচ্ছা, যাচ্ছি। প্রয়োজন হলে আবার ডাকবে না তো?
এমনিতেই মাথা ব্যাথা, তারউপর আবার এই লোকের মস্করা! বড্ড অসহ্যকর! ইমরান জানালা খুলে দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলো। নাফিসা বললো,
– মাথা ব্যাথার জন্য কোনটা ওষুধ আছে?
ইমরান পেছনে ফিরে বললো,
– মাথা ব্যাথা করছে?
– করছে বলেই তো চাইছি!
– আসছি আমি।
তিন চার মিনিট পর ইমরান এলো। সাথে এক মধ্যবয়সী মহিলা। প্রায় বৃদ্ধের কাতারে পা রাখছে। ইমরান বললো,
– উনি আমার বড় মা।
নাফিসা সালাম দিলো। মহিলাটি সালামের জবাব দিয়ে ইমরানের উদ্দেশ্যে বললো,
– পরিচিত হয়েছি রাতেই।
এদিকে নাফিসার মনোক্তি, “কখন পরিচিত হলেন! আমি তো এইমাত্র দেখলাম আপনাকে!”
মহিলাটি নাফিসার কাছে বসে বললো,
– শুনেছি, বউ মা নাকি খুব জেদি! বাবা মায়ের সাথে আবার রাগ করে কেউ। সবসময় বাবামায়ের মতামতে সহমত হওয়া উচিত। পিতামাতা সন্তানের ভালোর জন্যই করে সবকিছু। আর যদি ভুল ধরা পড়ে তবে বুঝিয়ে বলবে। এই ভুলের উপরও যদি যুক্তি থাকে তবে সেটা ভেবে দেখা উচিত। জেদ নিয়ে বিপক্ষে লড়া উচিত না। তোমার মাথা নাকি ব্যাথা করছে। দেখি।
– আমার কাছে দিন। আমি লাগিয়ে নিব।
– মায়ের হাতে জাদু আছে। আমি লাগালে তারাতাড়ি ব্যাথা উধাও হয়ে যাবে।
কথা বলতে বলতে বড় মা মলম হাতে নিয়ে কপালের দুপাশে মেসাজ করতে লাগলো। ইমরান বেরিয়ে গেছে। তিনি নাফিসার পরিবার সমন্ধে জিজ্ঞাসা করে জানতে লাগলেন। একটু পরেই আবার ইমরান এলো ফোন নিয়ে। নাজিয়া কল করেছে কথা বলার জন্য। বড় মা নাজিয়ার সাথে একটু কথা বলে চলে গেছে। নাফিসা ইমরানের কাছ থেকে ফোন হাতে নিলো না। সে বলে দিলো কথা বলবে না। ইমরান লাউড স্পিকারে রেখে দিলো৷ ওপাশ থেকে কথা বলছে, কিন্তু নাফিসা চুপ। নাজিয়া তার বাবা মায়ের কথা বললো তবুও সে কথা বলবে না। তাকে নিতে আসবে সেটা বলতেই নাফিসা বললো, “কেউ আসবে না আমার শ্বশুর বাড়ি। আমি বাড়ি যাবো না তোমাদের সাথে।” এটুকু বলেই সে নিজেই কল কেটে দিলো এবং ইমরানকে বললো,
– আরেকবার যদি আমার কাছে ফোন নিয়ে আসেন, আপনার ফোন টুকরো টুকরো করে ফেলবো বলে দিলাম!
– আচ্ছা, এমন করছো কেন তুমি? তুমি কারো সাথেই ভালোভাবে কথা বলছো না! কি চাইছো সেটা ক্লিয়ার বলো আমাদের!
– কিচ্ছু না, আমাকে আমার মতো থাকতে দিন। আর কিচ্ছু চাই না আমি। সবার কথা অসহ্য লাগে আমার! কেউ আমার সাথে কোনো কথা বলবেন না।
নাফিসা আবারও কাদতে লাগলো! ইমরানের ফোনে আবার কল আসছে। ইমরান রিসিভ করে বেরিয়ে গেলো। সারাদিন ঘরে বন্দী ছিলো নাফিসা। খাবার রুমে এনে দিয়েছে ইমরান। খেতে চাইছিলো না। অত:পর বড় মা এসে বুঝিয়ে খাওয়ালেন। ছুটির দিন হওয়ায় ইমরান আজ বাসায়ই ছিলো। যখনই নাফিসা একা থাকে রুমে, তখনই সে কাদে! ইমরান তাই নিশাতকে পাশে থাকতে বলেছিলো। একটু পরপর নিশাতেরই আগমন রুমে আর টুকটাক কথাবার্তা। বিকেলে আরাফ এসেছিলো। নাফিসার সাথে কথা বললো কিন্তু কোনো জবাব পেলো না! আরাফ নিশ্চিত, সবচেয়ে বেশি রেগে আছে তার উপর। ইমরান আরাফকে বলে দিলো, আরও দু-চার দিন থাকুক এখানে। তাকে বিরক্ত করার কোনো প্রয়োজন নেই। ইচ্ছে হলে সে নিজেই যেতে চাইবে। জেদ নিয়ে তো একজন মানুষ আর একা বসবাস করতে পারবে না।
সারাদিন কেটে গেলো বিরতি নিয়ে কেদে কেদে! আশেপাশের বাড়ি থেকে কোনো মানুষ আসেনি তাকে দেখতে। হয়তো জানেই না তারা! এমনকি বড় মা, ইমরান আর নিশাত ছাড়াও আর কেউ আসেনি তার রুমে। নাফিসা বাথরুমে যাওয়ার সময় একবার সেই ভাবিটাকে দেখেছিলো। উঠুনে বাচ্চার পিছু পিছু দৌড়াচ্ছে খাবার নিয়ে।
বিয়ের দ্বিতীয় দিন কেটে আজ তার তৃতীয় দিন। আজ এসেছে জেরিন এই ঘরে। ইমরান এই মাত্র ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে এর দুমিনিট পরই জেরিনের আগমন ঘটেছে। ঘরে প্রবেশ করে দেখলো নাফিসা বিছানাপত্র গুছিয়ে নিচ্ছে। সে বললো,
– নতুন বউ বাইরে বের হও না কেন? বিনা আয়োজনে বাড়িতে আসতে লজ্জা লাগেনি আর এখন ঘর থেকে বের হতে এতো লজ্জা! প্রতিদিন কি তোমার খাবার এইঘরে এনেই দিয়ে যেতে হবে আমাদের!
– এক্সিউজমি, আমি কাউকে খাবার নিয়ে আসতে বলিনি। আর কারো মুখে অতিরিক্ত কথাও শুনতে পারি না। আমার সাথে কথা কম বলবেন।
– বারে! দুদিন না হতেই চাপা! বাকি দিন টিকবে কি করে!
– সেই চিন্তা আপনার না করলেও চলবে।
এমনি নিশাত এলো রুমে।
– আপু, জিহান ডাকছে তোমাকে। ভাবি, তুমিও চলো ওই ঘরে।
জেরিন বেরিয়ে যেতে যেতে বললো,
– না, থাক। বের হতে বলিস না তাকে! ঘর থেকে বের হলে ঠোসা পড়বে! হুহ্!
ভেঙচি কেটে চলে গেলো জেরিন। নিশাত বললো,
– ভাবি তুমি চলো ওই ঘরে। একসাথে নাস্তা করি।
– না, আমি নাস্তা করবো না এখন। তুমি যাও।
– আরে এসো তো। বাড়িঘর ঘুরেও তো দেখবে একটু। এক ঘরে সারাদিন বসে থাকতে কি ভালো লাগে কারো। এসো।
নিশাত হাত ধরে টানতে লাগলে নাফিসা বললো,
– দাড়াও, চুল বেধে নেই।
– ওকে, তারাতাড়ি করো।
– ও তোমার বড় ভাবি হয় না?
– হ্যাঁ।
– তাহলে আপু বললে যে?
– সম্পর্কে আমার মামাতো বোনও হয়। আগে থেকে আপু বলি তাই এখনো আপু ই বলি।
– আপন মামাতো বোন?
– হ্যাঁ। আমার একমাত্র মামার দুইমাত্র মেয়ে।
নাফিসা মৃদু হেসে বললো,
– ভাবিরা দুই বোন?
– হুম।
– লাভ ম্যারেজ ছিলো ভাবির?
– না, এরেঞ্জই।
– ওহ্, চলো।
মাথায় ঘোমটা টেনে রুমের দরজা লাগিয়ে নাফিসা তাদের অন্যঘরে এলো। নিশাত তাকে নিয়ে প্রথমেই এলো কিচেনে৷ সামনের দিকটায় একটা ডাইনিং টেবিল পেছনের দিকটায় রান্নাবান্নার সামগ্রী। বড় মার সাথে আরও একজন মহিলা আছে কিচেনে। রান্না শেষ হয়ে গেছে। আসবাব গুছিয়ে রাখছে আর বড় মা ডাইনিং টেবিলের দিকে খাবারের বাটি নিয়ে যাচ্ছে। নিশাত বললো,
– উনি আমার মা। মানে তোমার শ্বাশুড়ি আম্মা।
নাফিসা সালাম দিলো। মহিলাটি এক পলক তাকিয়ে সালামের জবাব দিলো। কিন্তু অন্য কোনো কথা বললো না। মুখ যেন আয়েশা বেগমের মতো ফোলা ফোলা! চেহারাও দেখতে অনেকটা একইরকম! এছাড়া চেহারায় বিষন্নতার ছাপ স্পষ্ট! হতেই পারে ছেলের বিয়েতে ইনিও সন্তুষ্ট না। কিন্তু সেদিকে তোয়াক্কা করলো না নাফিসা। নিশাত তাকে পুরো ঘর ঘুরে দেখানোর জন্য নিয়ে গেলো। চারটা রুমের মাঝে একটা ড্রয়িং রুম যেখানে সোফা সেটের সাথে খাট পাতানো আছে। একটা আরমানের রুম, একটা মায়ের রুম আর একটা বড় মায়ের রুম। গোসল সেড়ে ইমরান রেডি হয়ে এ ঘরে এসেছে। বড় মা নাফিসাকে ডাকলেন খাওয়ার জন্য। আরমান তাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
– কেমন আছো?
– আলহামদুলিল্লাহ। আপনি?
– আলহামদুলিল্লাহ, ভালো। বসো।
আরমান চেয়ার টেনে বসলো। নিশাতও বসেছে। নাফিসার ইচ্ছে করছে না তবুও বসতে হলো বড় মা ও নিশাতের জোরাজোরিতে। ইমরান জিহানকে কোলে নিয়ে এখানে নামিয়ে দিয়ে গেছে আর জেরিন প্লেটে খাবার বেড়ে ইমরানের হাতে তুলে দিলে ইমরান খাবার নিয়ে চলে গেলো ড্রয়িং রুমে। নাফিসা বুঝতে পারলো না কিছু! সবাই টেবিলে আর সে অন্য রুমে চলে গেলো কেন! দেখে তো মনেও হচ্ছে না কারো সাথে ঝগড়াঝাটি আছে! সবার সাথেই প্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলছে। তাহলে সে আলাদাভাবে চলে গেলো কেন! থাকেও আলাদ আবার খায়ও আলাদা! এখানে সবকিছু গুছিয়ে দিয়ে ইমরানে মাকে “আবিদা” নামে ডেকে খেতে বসতে বললেন বড় মা ও নিজে প্লেট নিয়ে চলে গেলেন ইমরানের সাথে! জেরিন টেবিলে এটা সেটা এগিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও পানির গ্লাস, আলাদা বাটিতে ডাল নিয়ে আসছে আর যাচ্ছে ইমরানের কাছে। বড় মা সেখানে চলে গেলে সে-ও বসে পড়লো তাদের সাথে ডাইনিং টেবিলে। নাফিসা খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে লক্ষ্য করছে আরমানের কোলে বসে থাকা জিহান, নাফিসার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। নাফিসা তার দিকে তাকালে জিহান নিচের দিকে তাকায় আবার আড়চোখে তাকিয়ে দেখে নাফিসা তাকে দেখছে কিনা! যখনই নাফিসা তার দিকে তাকাচ্ছে তখনই সে দৃষ্টি নামিয়ে লুকিয়ে যাচ্ছে আর আড়চোখে আবার নাফিসাকে দেখছে! নাফিসার মজা লাগছে জিহানের সাথে এভাবে দৃষ্টিতে খেলতে। তাদের আগেই ইমরান খাওয়া শেষ করে কিচেনে প্লেট রেখে গেছে। নাফিসার খাওয়া শেষ হতেই সে-ও কিচেনে গিয়ে নিজের প্লেট নিজে ধুয়ে মিটসেফে রেখে দিলো। অত:পর একা একাই নিজের রুমে চলে এলো। ইমরান মাথা আঁচড়ে কোথাও যাওয়ার জন্য পুরোপুরি তৈরি। নাফিসাকে রুমে আসতে দেখে ইমরান বললো,
– অফিস যাচ্ছি আমি। নিশাতও কলেজে যাবে। সুতরাং এখানে তুমি একা। ভালো না লাগলে এই ঘর লক করে ওই ঘরে চলে যেও। মা ও বড় মা’র সাথে সময় ভালো কাটবে। আর পার্সোনালি তোমার কি কি লাগবে লিস্ট করে দাও। আসার সময় নিয়ে আসবো।
– ঘোড়ার ডিম লাগবে। আশা করি এবার খুঁজে নিয়ে আসবেন।
হঠাৎ তার মুখে এমন কথা শুনে ইমরান হতবাক! সে মজাটা আরও বাড়িয়ে দিতে বললো,
– এতোবড় ডিম তুমি খেতে পারবে!
– আমি খাবো না। আপনাকে খাওয়ানোর জন্য আনতে বলেছি।
– যাক, তা-ও তো বউয়ের হাতের রান্না খেতে পারবো! এবার বলো জামা, জুতো, স্নো, পাউডার, কসমেটিকস জাতীয় কি কি লাগবে?
নাফিসা মুখে বিরক্তিকর ছাপ এনে চুপচাপ আবার শুয়ে পড়ার ব্যবস্থা করছে। ইমরান তার কাছে এসে হাত টেনে দাড় করিয়ে বললো,
– শুধু শুধু এমন রেগে আছো কেন! রেগে থাকলে তো তোমারই লস।
– তাতে আপনার কি! হাত ছাড়ুন।
হঠাৎ করেই ইমরান তার ঠোঁটে আলতো করে ঠোঁট ছুয়ে দিয়ে মুখে দুষ্টুমি হাসি ফুটিয়ে বললো,
– এখন আমারই তো সব! আল্লাহ হাফেজ।
দরজার কাছে গিয়ে আবার পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখলো নাফিসা রেগে ঠোঁটে আঙুল ঘষে যাচ্ছে! তাই বললো,
– আরে আস্তে! এমন করলে তো ঠোঁট কাটা বউ হয়ে যাবে!
নাফিসা রেগে বালিশটা নিয়েই ঢিল দিতে যাচ্ছিলো! ইমরান হেসে দ্রুত চলে গেলো। তাকে মারতে না পেরে নিজের মুখেই বালিশ দিয়ে একটা মারলো নাফিসা!