“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৫৮
(নূর নাফিসা)
.
.
হলো না আর প্রোগ্রাম। নাফিসার কথাগুলো ভেবে ইমরানও প্রোগ্রাম না করা ই উত্তম মনে করেছে। যা ভাবার ভাবুক লোকে। বিয়েতো হয়েই গেছে এখন। এমনকি নাফিসা তাদের বাড়িতে থেকেছেও। এখন প্রোগ্রাম করতে গেলে লোকে রংঢং ছাড়া কিছুই বলবে না!
তাই ইমরান এমনিতেই নাফিসাকে বাড়ি নিয়ে যেতে চেয়েছে। তিনদিন পর পরীক্ষা শেষ হলে নিয়াজ উদ্দিন ইমরানের বাড়ির সবাইকে দাওয়াত করেছেন। ঘরোয়া অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মেয়েকে বিদায় করবেন বলে। নাজিয়াকে নাফিসা আর যেতে দেয়নি। তার যাওয়ার পর যেতে দিবে নাজিয়াকে।
.
শুক্রবার সকালে নাস্তা করে মেহেদী রেডি হচ্ছে কোথাও যাওয়ার জন্য। নাহিদা বললো,
– কোথায় যাচ্ছো?
মেহেদী কোনো জবাব দিলো না। নাহিদা আবারও জিজ্ঞেস করলো,
– বাবা বাসায় যেতে বলেছে আজ। যাবে না?
– তোমার বাবা বললেই চলে যেতে হবে! মানুষের আর কোনো কাজ থাকতে পারে না! ঢং পেয়েছো এগুলো, যখন ইচ্ছে ডাকবে আর তখনই ছুটে যেতে হবে! যত্তসব!
কথাটুকু বলেই বেরিয়ে গেলো মেহেদী। নাহিদার ভেতরটা জ্বালা করছে! গত কয়েকদিন যাবত মেহেদীর আচরণ সম্পূর্ণ ভিন্ন! বাবার অসুস্থতার সময় থেকে তার সাথে তেমন কথা হতো না। হসপিটালে মুখ গম্ভীর ছিলো। মাঝে মাঝে ফোন কলে পেলে সেখানে যাবে কিনা জিজ্ঞেস করলে ব্যস্ততা দেখাতো। নাফিসার বিয়েতেও যেতে চাইছিলো না। জহিরুল ইসলাম বলাতে তারপর গিয়েছে। আগের মতো আর মজা করে না নাহিদার সাথে, একা একাই রেডি হয়ে অফিস যায়, ডাকে না আর কাউকে তার সবকিছু এগিয়ে দেওয়ার জন্য! নাহিদা স্বেচ্ছায় তাকে রেডি করতে গেলে মেহেদী সরিয়ে দেয়। দুদিন ভার্সিটি গিয়েছিলো। সে সাথে না নিয়ে রিকশাভাড়া দিয়ে গাড়ি নিয়ে অফিস চলে গেছে। এমনকি দিনশেষে কোলবালিশ ন্যায় তাকে আর কাছেও টানে না। সে কি নিয়ে এমন রেগে আছে নাহিদা বুঝতে পারছে না! এতোদিন ওবাড়িতে থেকেছে বলেই কি সে রাগান্বিত! বাবা অসুস্থ বলেই তো থেকেছিলো। অযথা তো আর পড়ে থাকেনি সেখানে! আর নিজ বাড়িতে বেড়াতে যাবে তাতে এমন রাগেরই বা কি আছে! না, এভাবে চলবে না। তার কাছেই স্পষ্ট জানতে হবে, এমন কেন করছে সে!
দুপুরের আগেই জহিরুল ইসলাম, মেহেরুন ইসলাম, মেহতাজ ও আসিফের সাথে তাদের বাড়িতে গেলো নাহিদা। মেহেদী আগেই বলে দিয়েছে তার বাবার কাছে যে, সে যেতে পারবে না। বাড়িতে আসার পর নাহিদাকে বারবার একই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে, “মেহেদী আসেনি কেন?” সঠিক উত্তর তো তারও জানা নেই! তাই সে শান্তনামূলক উত্তর দিয়েছে, “মেহেদীর জরুরী কাজ আছে। তাই আসতে পারেনি।”
আজ আয়েশা বেগমও এসেছে তাদের বাড়িতে। এতোদিন মনমালিন্য থাকলেও রুমানা বেগম আজ একটু খুশি হয়েছে তিনি এসেছেন বলে। অতীত ভুলে বর্তমান মেহমানদের নিয়ে মেতে উঠেছেন আজ। তবে আয়াতও আসেনি আশিকও আসেনি! সারাদিন আয়োজন শেষে সন্ধ্যায় তিন মেয়ে তিন বাড়িতে চলে গেছে। বাড়ি আজ ফাঁকা! আছে শুধু দুজন পিতামাতার নিস্তব্ধতা আর বাইরে ঝিঝি পোকার গুঞ্জন।
ঘর শূণ্য, দুয়ার শূন্য, শূন্য জনক-জননীর মন!
ক্ষণে পূর্ণতা, ক্ষণে শূন্যতা কাদায় ভীষণ!
যুগে যুগে লালিত তনয়া হায়,
আজ অন্যের ঘরে পূর্ণতা আনতে পাড়ি জমায়!
যেতে নাহি দিব হায়, তবু চলে যেতে হয়!
তবুও চলে যায়!
.
বহুদিন পর আজ মানুষটার চেহারা মনযোগ দিয়ে দেখছে। কতদিন দেখে না তাকে, কতদিন থাকে না তার পাশে, কতদিন হলো হয়না মনের সাথে মনের আলাপন! কিন্তু আজ! আজ হয়তো সেই অতৃপ্তিতে তৃপ্তি আনার সময় এসেছে। ক্লান্তিকর ও বিষন্নতায় আচ্ছন্ন মুখে আজ অন্যরকম আনন্দ ভেসে আছে তার। হয়তো এই আনন্দ খালি চোখে দেখা দুষ্কর! কিন্তু যদি কেউ মনের দৃষ্টি দ্বারা দেখার চেষ্টা করে সে নিশ্চিত পুলকিত হয়ে উঠবে!
নাজিয়াকে এক জায়গায় স্থিরভাবে বসিয়ে অগোছালো ঘরটাকে গুছিয়ে নিচ্ছে আরাফ। কাজের ফাঁকে পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে ঠোঁটের এক কোনে মৃদু হাসি ফুটিয়ে আরাফ তার কাছে এসে বসলো এবং বললো,
– কি দেখো এমন করে?
টলমল করছে দুনয়ন তবুও পলকহীন দৃষ্টি! প্রতুত্তরে মৃদু হাসি ফুটানো মুখে নির্দ্বিধায় উচ্চারিত হলো,
– তোমাকে।
– কেন?
– অনেক দিন দেখিনা তাই।
– চোখের সামনেই তো ছিলাম।
– মনের সামনে তো আর ছিলে না! তখন যে দেখেও দেখতে পাইনি!
অবশেষে গড়িয়ে পড়লো টলমলে জল। বৃদ্ধা আঙুল দ্বারা অশ্রুবিন্দু মুছে নিয়ে আরাফ বললো,
– ভুলে যাও না ভয়াবহ মুহুর্ত গুলোকে! কেবল সুখগুলোকে আঁকড়ে ধরে বাচতে শেখো।
– বিপদ এলে কি লুকিয়ে থাকা যাবে?
– তখন না হয় সুখময় মুহূর্তের মনোবল দ্বারা মোকাবেলা করবে। বিপদের অন্তে আবারও সুখ দ্বারা দুঃখ গুলোকে ঢেকে ফেলবে।
নাজিয়া আরাফকে একটু কাছে টেনে কপালে কোমল স্পর্শ দিলো। বিপরীতে আরাফের হাসি আরও প্রশস্ত হয়ে গেছে।
.
রাত এগারোটায় বাড়ি ফিরেছে মেহেদী। নাহিদা তখন বই পড়ছিলো। বই থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দেখলো খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছে মেহেদীকে। দূর পথে ভ্রমণ করে এলে যতটা ক্লান্ত মনে হয় ঠিক ততটাই। কোথায় গিয়েছিলো সে!
মনে প্রশ্ন থাকলেও সেটা প্রকাশ করলো না নাহিদা। বই রেখে সে চুপচাপ নেমে এলো বিছানা থেকে। ওয়ারড্রব থেকে টিশার্ট আর ট্রাউজার বের করে দিয়ে মেহেদীর খুলে রাখা ব্লেজার ও শার্ট হাতে নিলো। ঘামে ভেজা শার্ট ও মোজা বাথরুমে রেখে এসে বাকিসব গুছিয়ে রাখলো চুপচাপ। মেহেদী হাতমুখ ধুয়ে এলে নাহিদা বললো,
– এসো, খাবার রেখেছি টেবিলে।
– খেয়ে এসেছি আমি।
রুমানা বেগম মেহেদীর জন্য খাবার পাঠিয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু খেলো না মেহেদী! নাহিদার মুখটা মলিন হয়ে গেছে। সে আবার খাবার তুলে রেখে রুমে চলে এলো। মেহেদী নাহিদার বইপত্র একপাশে চাপিয়ে রেখে বুকে ভর করে শুয়ে পড়েছে। নাহিদা বই গুছিয়ে রেখে মেহেদীর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
– মাথা কি ব্যাথা করছে?
মেহেদী কোনো জবাব না দিয়ে বিরক্তি নিয়ে হাত সরিয়ে দিলো। নাহিদা প্রায় কাদো কাদো কণ্ঠে বললো,
– এমন করছো কেন তুমি? ক’দিন ধরে শুধু রাগ আর জেদই দেখতে পারছি। কি হয়েছে বলবে তো?
এবারও মেহেদী কোনো জবাব দিলো না। নাহিদা চুপচাপ শুয়ে পড়লো। বুকের চিনচিন ব্যথা দুএক ফোটা অশ্রু হয়ে ঝরছে আর বালিশ তা শুষে নিচ্ছে। একা একা কি লড়াই করা যায়! কোনো কিছু না বললে কি করে জানবে কি হয়েছে তার!
.
ইমরান ওঘর থেকে নিজ রুমে এসে নাফিসাকে পেলো না। নিশাতের রুমে এসে দেখলো দুজন কথা বলছে ভার্সিটি আর কলেজ নিয়ে। কিন্তু তাদের কথপোকথনে পড়ার বিষয় নেই। শুধু পরিধি আর পরিবেশ নিয়ে জানাজানি করছে। ইমরান রুমে প্রবেশ করতে করতে বললো,
– তুমি এখানে কি করছো। আর নিশাত, তোর না এক্সাম! পড়া কোথায়?
– বইয়ে।
– বইয়ে থাকলে তোর রেজাল্ট ভালো হবে? পড়তে বস।
– আজ পড়বো না। ভালো লাগছে না।
– এজন্যই তো তোর বেড়াতে যাওয়া টোটালি অফ! কোথাও গেলেই সেদিন আর পড়াশোনা নেই। পড়তে না বসলে লিখতে বস। এক্সাম সামনে, কোনো হেয়ালিপনা চলবে না। নাফিসা তুমি রুমে যাও। পাশে কেউ থাকলে পড়বে না সে।
ইমরান নিশাতকে ধমক দিয়ে চেয়ার টেবিলে পড়তে বসতে বললো। নাফিসা বিছানা ছেড়ে নামতে নামতে নিশাতকে উদ্দেশ্য করে বললো,
– নিশাত, যত পড়ার পড়ো। কিন্তু এটা মাথায় রেখো, পড়াশোনা মোটেও রেজাল্ট ভালো করার জন্য হবে না। সেটা অবশ্যই প্রকৃত শিক্ষা অর্জনের জন্য হবে। প্রকৃত শিক্ষিত হতে না পারলে তোমার গোল্ডেন প্লাসও বৃথা! মানুষ প্রতিষ্ঠানে না গিয়েও প্রকৃত শিক্ষিত হতে পারে। আর বর্তমান মুর্খ সমাজ এটা বুঝে না! তাদের দরকার ভালো রেজাল্ট। ঘুম, বিশ্রাম, খাওয়াদাওয়া সব বাদ! শুধু পড়, পড়, আর পড়! পড়া হলেও আবার পড়, আরও পড়! মরে গেলেও আগে পড়ে তারপর মরে যা!
কথা শেষে ইমরানের দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে বেরিয়ে গেলো নাফিসা। আর নিশাত হেসে উঠলো!