“তৃ-তনয়া” পর্ব- ৬৩

0
2484

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৬৩
(নূর নাফিসা)
.
.
মধ্যরাতে নাফিসার ঘুম ভেঙেছে। বাইরে কুকুরের আর্তনাদ শুনা যাচ্ছে। নাফিসা উঠে বসে লাইট জ্বালিয়ে দিলো। বাইরে যাবে সে। কিন্তু সাহস পাচ্ছে না একা বের হওয়ার। বিছানা ছেড়ে নেমে এসেছে তবুও অতটা সাহস হচ্ছে না বাথরুম পর্যন্ত যাওয়ার! জানে ভুত বলতে কিছুই নেই, তবে চোর ডাকাত আছে। এখন বের হলে কোনো পাগলও যদি এসে উঁকি দেয় তবেই সে নিশ্চিত হার্ট অ্যাটাক করবে এটা তার ধারণা। নিজের বাড়িতেই বোন অথবা মাকে ডেকে তারপর বের হয়। আর এখানে বারান্দার গেইট তালা দেওয়া তা জেনেও মনে ভয় কাজ করছে। ইমরানের দিকে তাকিয়ে দেখলো কপালের উপর হাত রেখে ঘুমাচ্ছে। কয়েক মিনিট ভেবে নাফিসা নিচু শব্দে ইমরানকে ডাকলো। দুবার ডাকতেই যখন শুনছে না তখন সে কাছে এসে তার হাতটা সরিয়ে তারপর ঠেলে বললো,
– এই, শুনছেন?
ইমরান ঘুমঘুম চোখে তাকাতেই নাফিসা বললো,
– আমি ওয়াশরুমে যাবো একটু।
ইমরান দুহাত মেলে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলো এবং বললো,
– তুমি এতো সাহসী মেয়ে হয়ে ভুতকে ভয় পাও?
– আমি ভুতকে ভয় পাই না। তবে নিরিবিলি পরিবেশে কোনো কিছুর অস্তিত্ব অনুভব করলেই ভয় পেয়ে যাই।
ইমরান মৃদু হেসে বিছানা ছেড়ে নামতে নামতে বললো,
– ভয় পাও আর না পাও। একা বের হবে না কখনো। কাউকে সাথে নিয়ে বের হবে। পাশে কেউ না থাকলে প্রয়োজনে আশেপাশের কাউকে কল করে তারপর বের হবে।
নাফিসা বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখলো নিশাতও রুম থেকে বেরিয়ে আসছে। ইমরান বাথরুমে গেলে নাফিসা নিশাতকে বললো,
– তুমিও উঠে পড়েছো দেখছি! এমন নিরিবিলিতে মাঝরাতে বের হতে ভয় পাও না?
– কি বলো! ও ঘরে ভেতরে বাথরুম তা-ও একা যাই না আর এখানে একা বের হবো! আমি শুধুমাত্র রাতে বের হতে হবে বলে বেশিরভাগ সময় ওই ঘরে থাকি। আর এখানে থাকলে ভাইয়াকে কল করে বের হতে বলে তারপর বের হই।
– ভুতকে ভয় পাও?
– হু।
– দেখেছো কখনো?
– উহু, গল্প শুনেছি।
– ভুত বলতে কিছুই নেই।
– উহ! আছে। নানু থাকতে সত্যি ঘটনা বলতো ।
– ওগুলো ভুত না। জ্বিন-পরী। আগে ছিলো, এখন ঝোপঝাড় সমৃদ্ধ এলাকা ছাড়া ওসব নেই বললেই চলে।
নিশাত বাথরুমে গেলে নাফিসা রুমে চলে এলো। শুয়েছে ঠিকই কিন্তু ঘুম আসছে না। একবার এপাশ তো আরেকবার ওপাশ!
.
আজ ইমরান রেডি হয়ে যখন নাস্তা করতে যাবে তখন নাফিসা বললো,
– আপনি এখানেই বসুন, আমি খাবার এনে দিচ্ছি।
– এতোদূর টানাটানির কি প্রয়োজন!
– আমি আনতে পারলে আপনার সমস্যা কোথায়!
ইমরান আর কিছু বললো না। নাফিসা খাবার আনতে চলে গেলো বড় ঘরে। দেখলো জেরিন আগেই খাবার সাজিয়ে রেখেছে আরমানের জন্য টেবিলে আর ইমরানের জন্য ড্রয়িং রুমে! বাকিরা পরে খাবে। নাফিসা জেরিনকে জিজ্ঞেস করলো,
– ড্রয়িং রুমে খাবার কার ভাবি?
– ইমরানের।
– ওহ্! আচ্ছা।
নাফিসা খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসছিলো। তা দেখে জেরিন বললো,
– এসব কোথায় নিয়ে যাচ্ছো?
– উনি এখানে আসতে পারবেন না। ওই ঘরে খাবেন।
– কেন?
– ইচ্ছে হলো তাই।
– এতো টানাটানির দরকার নেই। ডাকলে এখানেই আসবে। আমি ডেকে আনছি।
– আপনার সমস্যা কোথায়, ভাবি? টানাটানি তো আমিই করছি!
কথাটা বলে নাফিসা প্লেট হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। নাফিসা ভাতের প্লেট রেখে আবার এ ঘরের দিকে আসার সময় দেখলো জেরিন বাটি নিয়ে আসছে। নাফিসা উঠুনে পথ আটকে দাড়িয়ে বললো,
– আমি নিয়ে যেতে পারবো, ভাবি। আপনাকে এতো কষ্ট করতে হবে না। আপনি বরং নিজের স্বামীর খেদমত করুন, যাতে সওয়াব হবে।
জেরিন দাত কিড়মিড়িয়ে বললো,
– ছোট ছোটর মতোই থাকো। আমার জায়গা দখল করতে এসো না।
– আপনার জায়গা কেন দখল করতে যাবো আমি! আমি আমার জায়গাতেই আছি। আপনি যেহেতু বড় সেহেতু বড়’র সম্মানটা বাচিয়ে সম্মানিত জায়গায়ই অবস্থান করুন। বড় হয়ে আপনিই যদি ঘরে স্বামী রেখে পরপুরুষের দিকে নজর দেন তাহলে আমি ছোট হয়ে আপনার কাছে কি শিখবো, ভাবি!
– নাফিসা!
– অযথা চোখ রাঙিয়ে কোনো লাভ নেই। সম্মান লঙ্ঘনকারীর ধমকে আমি মোটেও ভয় পাইনা।
– ইমরান আমার দেবর। আর সংসারের বড় বউ হওয়া সত্ত্বে সবার কাজ এগিয়ে দেওয়া আমার কর্তব্য।
– এ কেমন কর্তব্য, যেখানে স্বামীর চেয়েও অধিক লক্ষ্য রাখা হয় দেবরের প্রতি! আগে স্বামীর প্রতি কর্তব্য পালন করতে শিখুন। পরে না পরিবারের বাকি সদস্য! ইমরান এখন বিবাহিত, সুতরাং তাকে নিয়ে আপনার না ভাবলেও চলবে। তার কাজ এগিয়ে দেওয়ার জন্য সে আমাকে এনেছে। তার চিন্তা ছেড়ে নিজের দৃষ্টিকে সংযত করুন। যেটা আপনার জন্য মঙ্গলজনক!
নাফিসার স্পর্দা দেখে জেরিনের চোখ যেন কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসছে। নাফিসা তার হাত থেকে বাটি নিয়ে নিজের ঘরে চলে এলো। ইমরান নাফিসাকে বললো,
– তোমার প্লেট আনলে না?
– বাকিদের সাথে পরে খাবো।
– এখনই নিয়ে এসো। ভার্সিটি যাবে।
– যাবো না এখন।
– কেন?
– কাজ আছে।
– কি কাজ?
– সংসারে কাজের অভাব হয়!
– কাজের দোহাই দিয়ে শুধু শুধু বাসায় থেকে লাভ নেই। প্রতিদিন ক্লাস করবে। অবসর সময় সংসারে ব্যয় করবে। তুমি না করলেও পড়ে থাকবে না কোনো কাজ।
– হ্যাঁ, আপনার কথা মানি আর দিনরাত খোটা শুনি!
– কে দিচ্ছে তোমাকে খোটা! একমাত্র জেরিন ছাড়া কেউই কিছু বলবে না। আর জেরিনের কথায় তুমি কান দিবে না। নাস্তা করে রেডি হও দ্রুত। প্লেট নিয়ে এসো আর না হয় ভাতের বাটিতেই খেয়ে নাও।
নাফিসা আর প্লেট আনতে গেলো না। বাটিতেই অতিরিক্ত ভাত খেয়ে নিলো। নাফিসা রেডি হচ্ছে আর ইমরান বসে আছে। নাফিসা বললো,
– আপনি বসে আছেন কেন? অফিসের সময় হয়ে যাচ্ছে না?
– তোমার সাথে যাবো।
– আমার সাথে কেন! আপনার অফিস কি ওদিকে?
– না, ভার্সিটিতে যাবো তোমার সাথে।
– আবার এডমিশন নেওয়ার শখ জেগেছে?
– হুম।
– ঢং!
ইমরান হাহা করে হেসে উঠলো। নাফিসা আবার বললো,
– আমি একাই যেতে পারবো।আপনি অফিস যান।
– আজ আমার অফিস অফ। সপ্তাহে পাচ দিন আমার অফিস। দুদিন ছুটি। আর এই দিনে ভার্সিটিতে যাই স্যারের কাছে, যিনি আমাকে বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করেছেন সাথে যথেষ্ট সহযোগিতা করছেন। এজন্যই প্রতি সপ্তাহে স্যারের সাথে সাক্ষাৎ করতে আমার ভার্সিটি যাওয়া। আর হঠাৎ করেই একদিন এইদিনে তোমাকে পাওয়া।
নাফিসা আয়নায় তার দিকে এক পলক তাকিয়ে আবার নিজের কাজে মনযোগ দিলো। ভার্সিটির জন্য প্রস্তুত হয়ে সে ইমরানের সাথে বেরিয়ে এলো। বড় ঘরে এসে মা ও বড়মার কাছে বলে বের হতে যাচ্ছিলো এমন সময় জিহান পিছু নিলো। ইমরান বাসার পাশের দোকান থেকে চিপস কিনে তাকে বাড়িতে এনে নামিয়ে দিলো। আর জেরিনের উদ্দেশ্যে বললো,
– ভাবি, জিহানকে ধরুন।
পাশে ছিলো বড়মা। জেরিন প্রায় কাদো কাদো গলায় বললো,
– বড়মা, দেখো ইমরান কি শুরু করেছে কাল থেকে! তাকে বলে দাও, এসব ফাজলামো ছাড়তে!
নাফিসা বললো,
– ভুল কি বললো ভাবি!
– তুমি চুপ থাকো!
– আচ্ছা। আমি চুপ।
বড়মাও একই কথা বললো,
– ঠিকই তো জেরিন! ভুল কি বললো! ইমরান ঠিকই আছে। বয়সে ছোট হলেও সম্পর্কে তুই বড়। তোকে সম্মান দেওয়া উচিত। এটাই ভদ্রতা।
নাফিসা মৃদু হেসে বললো,
– আসি বড়মা।
আসার সময় একবার জেরিনের মুখভঙ্গি দেখতে ভুলেনি নাফিসা। জেরিনকে এমন রাগান্বিত ভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে হাটতে হাটতে নাফিসা তাকে দেখানোর জন্য ইমরানের হাত মুঠোয় ধরলো। ইমরান এতে একটু অবাক হলেও তা প্রকাশ করলো না। সে গেইটের বাইরে এসে ফিসফিসিয়ে বললো,
– রাতে ভয় পাও আমাকে, দিনে ভয় পাও না?
নাফিসা এবার তার হাত ঝাড়ি দিয়ে ছেড়ে ভেঙচি কাটলো! ভেঙচিতে তাল মিলিয়ে ইমরান বুকের বা পাশে হাত রেখে তীর বিদ্ধ ন্যায় ভঙ্গিতে বললো,
– হায়, মে মার যাবা!
না চাইতেও নাফিসা হেসে উঠলো ইমরানের কথায়। গাড়ির জন্য একটু সামনে হেটে আসতেই ফেক্সিলোডের দোকান দেখে নাফিসা বললো,
– আমার ফোনের ব্যালেন্স নেই তিন দিন ধরে। রিচার্জ করা প্রয়োজন।
– তিন দিন ধরে ব্যালেন্স নেই, এখন বল কেন!
– এখন ফেক্সিলোডের দোকান দেখলাম তাই বললাম।
– আমার বিকাশ ছিলো। যখন তখন রিচার্জ করে দিতাম।
কথা বলতে বলতে ইমরান ফোন বের করে নিলো এবং নাফিসার ফোনে রিচার্জ করে দিলো। নাফিসা গাড়িতে বসে নাহিদাকে কল করলো ভার্সিটি আসার জন্য। নাহিদা জানালো সে আসবে। ইমরানের সাথে ভার্সিটি আসার পর নাফিসার ফ্রেন্ডের মুখোমুখি হতেই নাফিসাকে নানা ইঙ্গিতে জিজ্ঞেস করতে লাগলো। নাফিসা বরাবরের মতো সোজাসাপ্টা উত্তর দিয়ে দিলো, “এ আমার উনি আর তোদের তিনি। আজ তো সামনাসামনি পেয়ে গেলি, তাই ট্রিট যা চাওয়ার চেয়ে নে। এরপরেও যদি কখনো আমার কাছে বিয়ের ট্রিট চাইবি কেউ। যার যতগুলো দাত আছে সব ফেলে দিবো!”
এরপর ইমরানের অবস্থা হয়েছে করুন! যা দেখে নাফিসার মনোক্তি, “এবার বুঝ ঠেলা! আজ বিয়ের স্বাদ মিটে যাবে মিস্টার!”
আর ওদিকে সবারই এক কথা, “দুলাভাই, আজ ট্রিট না দিলে আপনাকে ছাড়ছি না।”
আর তাদের প্রতুত্তরে ইমরানের উক্তি,
” ঠিক আছে, আমি পালিয়ে যাচ্ছি না। ধরে রাখো যত ইচ্ছে। দেখি, কে কতক্ষণ ধরে রাখতে পারো!”
ইমরান পকেটে দুহাত রেখে ঠেই দাঁড়িয়ে আছে এক জায়গাতেই। মাছির মতো তাদের ভ্যানভ্যান, ঘ্যানঘ্যান চলছেই কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। ইমরান বিরক্তহীন দাড়িয়ে আছে। আর যাই হোক, ওয়ালেট কেড়ে নিয়ে ট্রিট আদায় করার সাহস তো আর নেই কারো মাঝে! নাফিসাও দাড়িয়ে ছিলো তাদের কান্ড দেখার জন্য। এক পর্যায়ে ক্লাসের ঘন্টা পড়ে গেছে! আর ইমরানকে হার মানাতে না পেরে বাকিরাই বিরক্ত হয়ে নাফিসাকে হার কিপটের বউ বলে বকাঝকা করতে করতে ক্লাসের জন্য চলে গেলো। নাফিসা রেগে ইমরানকে বললো,
– সব তো শেষ করেছেন! এখন ফ্রেন্ডের কাছেও ইজ্জতটুকু বজায় রাখলেন না! চিনি ছাড়াই ফালুদা বানিয়ে দিলেন!
– তুমিই আমাকে ফাসিয়ে দিতে চাইছিলে আর উক্ত জালে নিজেই ফেসে গেছো! এতে আমার কি দোষ বলো!
– কোন পাগলের মুখ দেখে যে আজ ঘুম ভেঙেছে আল্লাহ জানে! কে বলবে আপনার সাথে ভার্সিটি আসার জন্য! তিল পরিমাণ ইজ্জতও বেচে রইলো না আমার! সব শেষ!
– ঘুম থেকে উঠে মনে হয় আমার মুখটাই দেখেছিলে!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here