“তৃ-তনয়া” পর্ব- ৬৪

0
2451

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৬৪
(নূর নাফিসা)
.
.
নাফিসা আর দাড়িয়ে না থেকে হনহন করে ক্লাসে যাওয়ার জন্য হাটতে লাগলে ইমরান হাসতে হাসতে তার পাশাপাশি হাটতে লাগলো। ওয়ালেট বেরএক হাজার টাকার একটা নোট বের করে নাফিসার হাতের মুঠোয় ঠেসে দিয়ে বললো,
– এটা নিয়ে যাও। যতটুকু সম্ভব ততটুকুই আয়োজন করো। এর বেশি দেওয়ার মতো আপাতত ক্যাশ নেই। পরে না হয় অন্য কোনো একদিন আবার আয়োজন করো।
– আর কোনো দরকার নেই!
নাফিসা নিতে চাইছিলো না। ইমরান জোরপূর্বক মুঠোয় দিয়ে বললো,
– আরে, নাও। আমি মজা করছিলাম। আর ওরাও কিন্তু সেটা ফান হিসেবে নিয়েছে। তুমি এতো সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছো কেন! রাখো।
নাফিসা চলে গেলে ইমরান আশিককে কল করেছিলো আসতে পারবে কি-না। ইমরান স্যারের সাথে সাক্ষাৎ-এর সময় আশিক এসেছে। দুজনেই কথাবার্তা শেষ করে যখন ক্যান্টিনের দিকে আসছিলো তখন নাহিদার দেখা পেল! নাহিদা সালাম দিয়ে কথা বললো। নাফিসার কথা জিজ্ঞেস করতেই ইমরান বললো সে ক্লাসে আছে। নাহিদা বাসার সকলের ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করেছিলো এমন সময় মাঠে তুর্যে ও হিমেলের সাথে মেহেদীকে দেখতে পেল। ইমরান সালাম দিতেই মেহেদী সালামের জবাব দিয়ে কাছে এলো। ইমরান হ্যান্ডশেক করে কুশলাদি বিনিময় করলো। সাথে আশিকও। নাহিদা এসময় তাকে ভার্সিটিতে দেখে একটু অবাকই হলো। কেননা তার তো এখন অফিসে থাকার কথা। নাহিদা ইতস্তত বোধ করেও হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো,
– তুমি এসময় এখানে?
– কেন? আমি এসে তোমাদের খুব ডিস্টার্ব করে ফেললাম!
সাথে সাথেই নাহিদার মুখভঙ্গি ফ্যাকাসে হয়ে গেলো! এ কেমন জবাব দিলো সে! তাদের সামনে কি এভাবে কথা বলার প্রয়োজন ছিলো! বাকিদের মুখও একটু বিস্মিত! তবুও নাহিদা মুখে জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে বললো,
– না, ডিস্টার্ব কেন হবে! অফিস যাওনি যে, তাই বললাম।
মেহেদী নাহিদার দিকে তাকিয়ে চাপা রাগ দেখিয়ে দাতে দাত চেপে বললো,
– যাবো, অফিস। থাক তোমরা।
মেহেদী চলে যাচ্ছিলো। ইমরান বললো,
– ভাইয়া, এক কাপ কফি খাওয়া যায় না?
– নাহ, তাড়া আছে।
নাহিদাও চাপা লজ্জা নিয়ে কৌশলে ইমরান ও আশিকের থেকে কেটে পড়লো। সে আর ক্লাস করলো না আজ। দুএকজন ফ্রেন্ড ও কোচিং-এর ব্যাপারে টিচারের সাথে কথা বলে নাফিসার জন্য অপেক্ষা করলো। নাফিসা ক্লাস শেষ করে বেরিয়ে এলে তার সাথে কিছুটা সময় কাটিয়ে বাড়ি ফিরে গেলো নাহিদা। আর নাফিসা কৌশলে ক্যান্টিনে গিয়েছে তার ফ্রেন্ডদের ট্রিট দিতে। কিছুক্ষণের জন্য ইমরান ও আশিক ক্যাম্পাসের বাইরে ছিলো। এখন এসে কল করে জানতে পারলো তারা ক্যানটিনে আছে। ইমরান আর সেদিকে যায়নি কিন্তু আশিক গিয়েছে। ক্যান্টিনে ট্রিট দেওয়া হচ্ছে, সে কেন তা মিস করবে!
আশিক নাফিসা গ্রুপকে পেয়ে চেয়ার টেনে তাদের পাশে বসে পড়লো। নাফিসা এসময় তাকে দেখে অবাক! নাফিসাকে উদ্দেশ্য করে আশিক বললো,
– ভাবি, এটা কেমন হলো! আমিও তো আপনাদের বিয়ে খাই নি! তাহলে আমার ট্রিট মিস হবে কেন!
– আপনি আবার কোত্থেকে উদয় হলেন!
– শূন্য থেকে মেবি!
– তো আবার শূন্যে মিশে যান।
– এইটা কিন্তু ঠিক না! সবাই এমন কিপটে হলে কিভাবে! প্রায় তিন ঘন্টা ধরে ভাই ঘুরেছে আমাকে নিয়ে অথচ এক ফোটা পানিও খাওয়ালো না! এখন আপনিও কিপটামী শুরু করলে তো একটু পর ভুখা থেকে মারা যাবো! কি বলো ছোট আপুরা!
নাফিসার ফ্রেন্ডরা হেসে উঠলো। তারাও আশিকের সাথে তাল মিলিয়ে নাফিসা ও ইমরানকে কিপটে ফ্যামিলি উপাধিতে ভূষিত করছে! খাচ্ছেও আবার কিপটেও বলছে এতে নাফিসা প্রচন্ড রেগে গেছে! আশিক নাফিসার কথা বলে খাবার অর্ডার করে ক্ষণে নাফিসার পক্ষে কথা বলছে, ক্ষণে তার ফ্রেন্ডদের!
এক পর্যায়ে আশিক হাতে স্পিড আর বার্গার নিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে এসেছে ক্যানটিন থেকে। ইমরান পরিচিত দুজন ছেলের সাথে কথা বলছিলো। সাথে একজন শিক্ষকও আছে। আশিক তাদের দেখে আর ইমরানের কাছে না গিয়ে অন্যদিকে চলে গেছে। ইমরান ডাকলে আশিক দূর থেকেই বললো, “ভাবি তাড়া করছে, ভাই! আমি পালাই!”
আর ওদিকে দেখলো নাফিসাও রেগে বেরিয়ে এসেছে ক্যান্টিন থেকে। সে সোজা ইমরানের কাছে চলে এসেছে। আর এসেই রাগান্বিত গলায় বললো,
– খুব প্রয়োজন ছিলো আপনার ভাইকে পাঠানোর! ধরতে পারলে এখন খুন করে ফেলতাম!
ইমরান তাদের সামনে নাফিসার এমন আচরণে বড় বড় চোখ করে জ্বিভ কাটলো! আর পাশের তিনজন হেসে উঠলো! নাফিসার এতোক্ষণ খেয়ালই ছিলো না এখানে একজন স্যার দাড়িয়ে! সে সালাম দিলো স্যারকে। জবাব দিয়ে স্যার বললেন,
– কি হয়েছে নাফিসা? রেগে আগুন কেন?
– তেমন কিছু না স্যার।
ইমরান বললো,
– বাসায় চলে যাবে এখন?
– হ্যাঁ।
ইমরান স্যারের কাছে বিদায় নিয়ে গেইটের দিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে নাফিসা তার শার্ট টেনে বললো,
– ওদিকে কোথায় যান! আগে এদিকে আসুন। কড়া হিসাবনিকাশ আছে।
ইমরান হাটতে হাটতে বললো,
– কেন? কি হয়েছে?
– কি হয়েছে তা জিজ্ঞেস করেন আবার!
– না জানলে জিজ্ঞেস করবো না!
– তিন ঘন্টা ঘুরিয়ে নাকি এক ফোটা পানিও খাওয়ান নি, তাই আমার হাত ফাকা করেছে! এখন বলুন, আপনার ভাই যে আমাকে ঋণী করে দৌড় দিলো, সেই দেনা পরিশোধ করবে কে?
– এই মাত্র সিঙ্গারা আর সস দিয়ে পুরি খেয়ে এলাম।
– দেখছেন, কত বড় মিথ্যুক!
– দুষ্টুমি করেছে। বাদ দাও, দেনা কত টাকা?
– এক হাজার থেকে কৌশলে দুইশো টাকা বাচিয়ে আটশো টাকা খরচ করেছিলাম। মাঝখান দিয়ে আপনার গিরগিটি ভাই এসে মোট এগারো শ সত্তর টাকা বিল করে ফেলেছে! এমনিতেই আমার পার্স ফাকা! যা ভাঙতি ছিলো আশি টাকা মিল করে পরিশোধ করতে পেরেছি। এখনো নব্বই টাকা বাকি।
ইমরান ওয়ালেট বের করে একশো টাকার নোট তার হাতে দিয়ে বললো,
– যাও, দিয়ে এসো। আমি এখানে আছি।
নাফিসা বিল পরিশোধ করে পার্স নিয়ে বেরিয়ে এলো সাথে তার ফ্রেন্ডরাও। পেট পুরে খেয়ে এক এক জনের দোয়া, ” স্বামী সংসার নিয়ে সুখী হও বাছা!” “নাফিসা তোদের এত্তোগুলা বাচ্চাকাচ্চা হোক!” “নাফিসা, আমি মন্ত্রী হলে তোদের বাচ্চাকাচ্চা সহিত দাওয়াত করবো ফাইভ স্টার হোটেলে!”
আর নাফিসার রিয়েকশন থাপ্পড়, লাথি দেওয়ার নাম করে তাড়া করা! অস্পষ্ট ভাবে বললেও ইমরানের কান পর্যন্ত এসেছে তাদের কথা। সবকিছুর বাইরেও ভালোই লাগছে নাফিসার ফ্রেন্ডের সাথে দুষ্টুমি দেখতে। ইমরানকে টাটা জানিয়ে তারা চলে গেলো। ইমরান নাফিসাকে বললো,
– চলো এবার?
– হুম।
– খেয়েছো তুমি কিছু?
– না খেলে খাওয়াবেন?
– খাওয়াতে তো হবেই। খাওনি?
– খেয়েছি।
হুট করেই আশিক এসে বললো,
– আমি খাইনি, ভাই!
নাফিসা চোখ রাঙিয়ে বললো,
– আপনি আবার আসছেন!
– ভাই, আমি জানতাম বিয়ে করলে নাকি সবাই নিঃস্ব হয়ে যায়। আর তোমার তো কপাল খোলা! এতো কিপটে ভাবি পাইছো! দশ বছরে দশতলা বিল্ডিং উঠবে তোমার বাড়িতে।
ইমরান হেসে তার হাত থেকে অবশিষ্ট অর্ধেক স্পিডের ক্যান টা নিয়ে বললো,
– না উঠলে কিন্তু তোকে ফুলফিল করে দিতে হবে।
– ধুর! দোয়া করছি যে সেটাই বেশি!
নাফিসা বললো,
– আপনার এমন বেশি দোয়া আপনার কাছেই রাখুন বেশি বেশি! রাজাকার একটা! পেট পুরে পুরি সিঙ্গারা খেয়েও বলে এক ফোটা পানিও নাকি খায়নি!
– ভাই, তুমিই বলো। পানি জীবনে খাওয়া যায়! আমি তো পান করছিলাম!
কথাবার্তা ও হাসিঠাট্টা করতে করতে তিনজনই ইমরানের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। মাঝরাস্তায় থাকাকালীন নিয়াজ উদ্দিনের কল এসেছে ইমরানের ফোনে। তিনি তাদের বাড়িতে আছেন। বাড়িতে এসে দেখলো নিয়াজ উদ্দিন বেয়াই বাড়ি মিষ্টি ও ফলফলাদির সাথে খামারের মুরগী নিয়ে এসেছে। তবে আসার মূল উদ্দেশ্যই ছিলো মেয়েকে দেখা ও মুরগী নিয়ে আসা। নাফিসার অনুপস্থিতিতেও তার বাবার আপ্যায়ন ভালোই ছিলো যেটা নাফিসার ভালো লেগেছে। দুপুরে একসাথে লাঞ্চ করে বিকাল পর্যন্ত ইমরান ও আশিকের সাথে সময় কাটিয়ে আরমানের সাথে দেখা করে চলে গেছেন তিনি। নাফিসার খুব ইচ্ছে করছিলো বাবার সাথে যাওয়ার কিন্তু ইচ্ছেটা কারো কাছেই প্রকাশ করলো না।
রাতে ঘুমানোর সময় ইমরানের এক হাত চিত করে রাখা দেখে কাল রাতের ঘটনা মনে হয়ে গেছে নাফিসার। অত:পর নিজের মনে নিজেই সাহস যোগাতে লাগলো,
ইমরান তো যথেষ্ট ভালো ছেলে। তবে তাকে কাছে অনুভব করতে পারলে সে এতোটা নার্ভাস কেন হয়ে যায়! এতোটা ভয়-ই বা কেন পায়! সে তো তার স্বামী, যেখানে একসাথে থাকতে পারে তারা সেখানে ভয়ের কি আছে! না, এসব আলতু-ফালতু ভাবলে চলবে না। তার উচিত ইমরানের সাথেও ফ্রি হওয়া। বাকিদের সাথে যেহেতু ফ্রি আছে তাহলে তার সাথে কেন নয়! এ পরিবারে তো সবচেয়ে আপন সে-ই, তার জন্যই তো আসা এখানে। তাহলে তাকে কেন ভয় পাবে।
এখন থেকে আর একটুও ভয় পাবে না ইমরানকে, এটাই নাফিসার সিদ্ধান্ত। কেননা কাল তার ভয়ার্ত চেহারা দেখে ইমরান নিজেকে অপরাধী ভাবছিলো যেটা নাফিসার চোখেও স্পষ্ট ধরা দিয়েছিলো। তখন থেকে বিষয়টি আজ কয়েকবার ভেবেছে সে। অত:পর এখন চুড়ান্ত ভেবে সিদ্ধান্তে অটুট হলো। নাফিসা আস্তে আস্তে তার হাতটা বাড়িয়ে ইমরানের হাতের উপর রাখলো। আঙুলের ভাজে আঙুল রেখে আলতো ভাবে মুঠোয় ধরলো। ইমরান তার একটু আগে শুয়েছে ঠিকই কিন্তু ঘুমায়নি। নাফিসার স্পর্শ পেয়ে সে চোখ খুলে তাকালো। নাফিসা তাকে হঠাৎ তাকাতে দেখে লজ্জা পেয়েছে ঠিকই কিন্তু সেই লজ্জার রেশ একটুও ভেসে উঠেনি মুখে! ইমরান বললো,
– আমি কিন্তু তোমায় স্পর্শ করিনি।
ইমরানের মুখে এমন কথা শুনে নাফিসা লজ্জায় চোখ বন্ধ করে ফেললো। ইমরান মৃদু হেসে বললো,
– লাইট অফ করবে না?
নাফিসা কোনো জবাব দিলো না। ইমরান লাইট অফ করার জন্য উঠতে গেলে হাতে টান পড়তেই নাফিসা শক্ত করে মুঠোয় ধরে নিলো সেই হাত। ইমরান অতিরিক্ত কোনো মনোভাব পোষণ করলো না। সে স্বাভাবিকই আছে। নাফিসা মুঠোয় ধরা সত্ত্বেও সে স্বাভাবিকভাবে তার হাত মেলে রেখে লাইট অফ করলো।
আজ আর ভার্সিটি যায়নি। সে ঠিক করে নিয়েছে সপ্তাহে তিনদিন যাবে ভার্সিটি। ইমরান অফিস যাবে সেজন্য রান্নার কাজ শেষ করে তার কাজকর্ম এগিয়ে দিচ্ছে। খাবার এই ঘরে আনতে চাইলে আবিদা বেগম এতো দূর টানাটানি করতে নিষেধ করলেন। নাফিসা আবিদা বেগমের মুখের উপর কোনো কথা বললো না। সে নিশ্চিত জেরিন কিছু বলেছে এ নিয়ে। তাই ইমরান এ ঘরেই খেতে এসেছে কিন্তু নাফিসা সম্পূর্ণ সময়টা তার পাশেই থেকেছে। খাওয়া শেষে ইমরান, নাফিসাকে নিজেদের ঘরে ডাকলো তাকে মিষ্টি করে বিদায় দেওয়ার জন্য। ইচ্ছা না থাকলেও জেরিনের জন্য আসতে বাধ্য সে! নাফিসা যতক্ষণ ছিলো এখানে ততক্ষণ পর্যন্ত মুখে হাত দিয়ে রেখেছিলো। ইমরান বুঝতে পেরে মুখ টিপে হেসেছিলো। বেরিয়ে যাওয়ার সময় বললো,
– মুখে হাত কেন? ব্রাশ কর নি?
নাফিসা মাথা নেড়ে হ্যাঁ জবাব দিলে ইমরান বললো,
– তাহলে?
নাফিসা মুখ ঢেকেই বললো,
– এমনি।
ইমরান মুচকি হেসে কাছে টেনে তার হাতের উপরই একটা চুমু একে বললো,
– এমনি এর কারণটাও আমি জানি। ফি আমানিল্লাহ।
ইমরানের মুখে হাসি থাকলেও তার এমন স্টুপিড মার্কা কর্মে নাফিসার মুখ রাগান্বিত!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here