“তৃ-তনয়া” পর্ব- ৬৬

0
2624

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৬৬
(নূর নাফিসা)
.
.
সারাদিন অফিসে কাটিয়ে বিকেলে বাড়ি ফিরেছে মেহেদী। নাহিদা তখন কিচেনে ছিলো। সেখান থেকে মেহেদীর গলা শুনে হাতের কাজ সেড়ে একটু পর রুমে এসেছে। মেহেদী হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে এসেছে মাত্র। নাহিদা খাট থেকে ব্লেজার হাতে নিতে নিতে বললো,
– ভাত খাবে এখন?
মেহেদী তাকে দেখে তাচ্ছিল্যের সাথে বললো,
– আরে, রাখো রাখো! আমার কাজ আমি নিজেই করে নিতে পারবো! তুমি বরং যেটাতে লাভ হবে সেটা করো। তা বলো শুনি, আশিকার দিনক্ষণ কেমন কাটছে আশিকের সঙ্গে?
– মানে!
– মানে আবার কি! আশিক ভাইয়ের সাথে তোমার দিন কেমন কাটলো সেটাই জানতে চাইলাম আরকি!
– কি বলছো এসব! আর তুমি এমন বিহেভই করছো কেন আমার সাথে!
– এসব ফালতু নাটক বাদ দাও। ওপেন রিলেশনে আবার এতো লুকোচুরির কি আছে! এসব অনেক আগে থেকেই আমার জানা! শুধু চিনতে ভুল করেছিলাম তোমাকে!
নাহিদার চোখে পানি চিকচিক করছে! মেহেদীর কথায় সে সন্দেহের অবকাশ দেখতে পাচ্ছে! তাই বললো,
– তুমি কি বলতে চাইছো ক্লিয়ার বলো। তোমার কথা আমার মাথায় আটছে না!
– তা কেন আটবে! ধরা পড়ে গেলে আঠালো জিনিসও মাথায় আটে না।
– মেহেদী, তুমি ভুল বুঝছো আমাকে। শুধু শুধু এমন আচরণ না করে আমার অপরাধটা কি সেটা তো একবার বলো!
– ভুল! তোমার ওই আশিক ভাই ভুল? তোমাদের সম্পর্ক ভুল? আশিকের আইডি থেকে মেসেঞ্জারের মেসেজগুলো ভুল? এনগেজড হওয়ার পরও নিজ চোখে দেখা দুজন গা ঘেঁষে ভার্সিটির ছাদে সময় কাটাও সেসব ভুল! নিজেকে কাক মনে করো? তোমার চোখ বন্ধ মানেই সবার চোখ বন্ধ? তুমি ছিলো তিন তলা ভবনে আর আমি চার তলা ভবনের ছাদে! তবে এতে আমার কোনো ইন্টারেস্ট ছিলো না। তখন যদি পালিয়ে যেতে না, আমার খুব ভালো হতো! আমি বরং খুশির ঠেলায় বন্ধুদের ট্রিট দিতাম! কিন্তু কতটা জঘন্য তুমি, একবার ভেবে দেখো! ওদিকে একজনকে ফিক্সড রেখে এদিকে আমাকে ফাসিয়ে তারপর এখন লাথিঝাটা দিচ্ছো! কিসের লোভ ছিল বলোতো আমাকে একটু? টাকার জন্য? বাহ! কি প্রেম, কি মহব্বত! কি সুন্দর ভালোবাসার ছন্দ! ছন্দে ছন্দে বাজে প্রেমের আনন্দ! আমি তো আর ছন্দে প্রকাশ করতে পারি না আমাকে! তা, এতো লুকোচুরির প্রয়োজন কি, চলে যাও না একেবারে। কেউ বাধা দিবে না তোমাকে। বলো তোমার আশিককে এসে নিয়ে যেতে।
– মেহেদী!
– শাট…..আপ! ওই নোংরা মুখে আমার নাম উচ্চারণ করবে না! তুমি ভার্সিটিতে তার সাথে ঘুরে বেড়াতে পারো আর আমি চোখে পড়লেই ডিস্টার্বড হয়ে যাও! বিশ্বাস করো, তোমার খোজ করতে আমি মোটেও যাইনি। রায়ান বলেছিলো ভার্সিটিতে সাইফুদ্দিন স্যার এসেছে তাই কেবল স্যারের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। আর তুমি! ছি! ক্লাস মিস করে প্রেমিক নিয়ে ঘুরাঘুরি! সাথে আবার ছোট বোনের হাসব্যান্ড! বাবার অসুস্থার অজুহাতে দু’জন একসাথে হসপিটালেও রাত কাটিয়েছো আবার বলছো ভুল ভাবছি আমি! কে জানে আর কি কি করেছো! আমি তো আর বউয়ের গোয়েন্দা নয়! বলতে গেলে চোখ বন্ধ করেই চলাফেরা আমার! তবুও চোখে আটকে যাও! ডিজগাস্টিং!
মেহেদী তোয়াল ঢিল মেরে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। যেন এমন একটা মুহুর্ত খুজছিলো তার রাগ গুলো প্রকাশ করার! আর এদিকে নাহিদা ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়লো! তার আচরণ ও কথাবার্তায় নাহিদা পুরোপুরি শকড! কি বলে গেলো মাথার খোলস ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করতে যেন খুব কষ্ট হচ্ছে! এতোটা সন্দেহ নিয়ে বসে আছে সে! এতোটা সন্দেহ কি করে করতে পারে তাকে! বাবা হসপিটালে ছিলো সেখানে কি এক বারের জন্যও আশিকের ব্যাপারে ভেবেছে সে! তার তো মাথায়ও ছিলো না তখন কে আছে হসপিটালে! তাছাড়া আশিক তো কেবল পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো। নিরুপায় থাকাকালীন সাহায্য গ্রহণও কি পাপ! যার ফলে মেহেদী তাকে নিয়ে এতো সন্দেহে আছে! কতটা ভয়াবহ ছিলো তখন তাদের পরিবারের অবস্থা, তা কি তার জানা নেই! আর ভার্সিটি! সে তো নাফিসার সাথে দেখা করতে ও কোচিং সম্পর্কে জানতে গিয়েছিলো! ভাবতেও পারেনি আশিক কিংবা মেহেদী কারো সাথে দেখা হবে! আর মেসেজ! সে কি ইনবক্স চেক করেছে!
নাহিদা চোখ মুছে দ্রুত উঠে তার ফোন হাতে নিলো। আশিকের আইডি চেক করে দেখলো বিয়েরও কত আগে সেই যে মাঝেমধ্যে ছন্দ লিখে পাঠাতো তা ছাড়া আর কোনো মেসেজ নেই। ওসব দেখে মেহেদী কি করে সন্দেহ করতে পারে! আশিকের সাথে তো তার কোনো যোগাযোগই নেই! বিয়ের পূর্বের কথা জানে তবুও তো এতোদিন সব ভালো ছিলো, এখন হঠাৎ এমন সন্দেহের উৎপত্তি কেন হচ্ছে! না, এভাবে চলবে না। এই আশিক নিয়ে মেহেদীর ভুল ভাঙাতে হবে! ছোটখাটো বিষয় থেকে বড় ধরনের জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। তারচেয়ে ভালো আগে থেকেই সবটা মিটমাট করে ক্লিয়ার করা। তাকে সবটা খুলে বলতে হবে যে, আশিকের সাথে তার কখনোই তেমন কোনো সম্পর্ক ছিলো না৷ সে কেবল ফ্রেন্ড ও ফ্যামিলির দিক থেকে রিলেটেড ছিলো। এর বাইরে কিছুই না।
নাহিদা চোখ মুছে নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক করে রুম থেকে বেরিয়ে এলো মেহেদীর খোজে। কিন্তু তাকে বাসায় পেল না! সে তখন বেরিয়ে গেছে বাসা থেকে। নাহিদা কাজকর্ম সেড়ে মেহেদীর অপেক্ষায় আছে। মেহেদী বাড়ি ফিরলেই আগে তার ভুল ভাঙাবে। তারপর বাকিসব। সন্ধ্যা থেকে সে একবারের জন্যও বই হাতে নেয়নি। ভেবেছে শুধু, মেহেদী তাকে বুঝবে কি-না। কিন্তু তাকে যে বুঝতেই হবে। এভাবে সুশৃঙ্খল জীবনের সূচনায় বিশৃঙ্খলতা আনার কোনো মানেই হয় না। সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে তাকে বুঝানোর।
সেকেন্ড কাটে, মিনিট কাটে, কাটে ঘন্টার পর ঘন্টা!
কিন্তু প্রহর যে কাটে না, আনচান করছে শুধু হৃদপিন্ডটা!
ডিনারের সময় হয়ে এলে নাহিদা কল করলো। ফোন সুইচ অফ! রাত এগারোটা বেজে যায়, জহিরুল ইসলাম কলের পরে কল করে ফোন সুইচ অফ! চিন্তায় পড়ে যায় বাড়ির স্বজন, তিনজন! জহিরুল ইসলাম তার ফ্রেন্ডদের কাছে কল করার জন্য প্রস্তুত হতেই কলিং বেল বেজে উঠলো। নাহিদা হাতমুখ ধোয়ার জন্য বাথরুমে ছিলো তখন। বেলের শব্দ শুনে সে যতদ্রুত সম্ভব বের হয়ে এসেছে দেখার জন্য যে, মেহেদী এসেছে কিনা! তোয়াল হাতে নিয়ে আলতো ভাবে মুখ মুছে যখনই দরজার দিকে আসতে যাবে তখনই মেহেদী হেলেদুলে গান গাইতে গাইতে রুমে এলো, “আমি এমন একটা তুমি চাই, এমন একটা তুমি চাই! যে তুমিতে আমি ছাড়া অন্য কেহ নাই!”
মেহেদীকে দেখে নাহিদার ভেতরটা ধুক করে উঠলো! তাকে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না! সে কি স্বাভাবিক নেই! তাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মেহেদী শার্ট খুলতে খুলতে বললো,
– ওই, আমার দিকে তাকাও কেন? হুম? ওই চোখ দিয়ে তোমার আশিককে দেখো, কেমন?
নাহিদা তার দিকে এগিয়ে এসে মেহেদীকে তার দিকে ঘুরাতে চেষ্টা করলে মেহেদী তার হাত ঝাড়ি দিয়ে সরিয়ে বললো,
– ডন্ট টাচ মি এগেইন! ডন্ট টাচ!
তাকে দেখার পর নাহিদা যা সন্দেহ করেছিলো তা-ই হয়েছে! মেহেদী আজ মদ্যপান করে এসেছে! সে বিস্ময়ের সাথে বললো,
– ড্রিংকস করেছো তুমি!
– ড্রিংকস!
মেহেদী তার দিকে এগিয়ে এসে নাহিদার দুই গাল একহাতে চেপে ধরে নাকে নাক লাগিয়ে বললো,
– দেখোতো আমি ড্রিংকস করেছি কিনা?
বিশ্রী গন্ধে যেন নাড়িভুড়ি উল্টে আসছে! নাহিদা শরীরের সর্বস্ব দিয়ে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো তাকে! মেহেদী টাল সামলাতে না পেরে খাটের ধারে ফ্লোরে পড়ে গেছে! খাটে ভর করে সে আবার উঠতে উঠতে বললো,
– তুমি কি জানো, তুমি অনেক বাজে হয়ে গেছো! হার্ট ফুটো করে এখন আবার আমাকে মারতেও শিখে গেছো! হোয়াট এভার, নট ইন্টারেস্ট উইথ ইউ।
মেহেদী শার্ট খুলে ফ্লোরেই ফেলে বিছানায় শুয়ে পড়লো। অত:পর ফোন ফেসের সামনে রেখে ভিডিও কল করলো। স্ক্রিনে ভেসে উঠলো জেনিফা নামের সেই মেয়েটি! মেহেদীকে দেখার পরপরই মেয়েটি চিৎকার করে বললো,
– হোয়াট এ সারপ্রাইজ ডিয়ার! তুমি কি ঘুমানোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছো!
– না, তোমার সাথে ড্রিম আউটে যাবো।
– যাহ, অনেক দুষ্ট হয়ে গেছো! আর অনেক পচাও! তুমি জানো কত মিস করি তোমাকে! একটা বার কলও করো না! আমি কল করেও পাইনা তোমাকে! এই তুমি আমাকে ব্লক করেছো না?
– না, তো! নিউ সিম নিয়েছি। তাইতো নিউ সিমে কল করলাম!
– দেখেছো, কত্ত বাজে তোমার ফ্রেন্ডস! কতবার বলেছি তোমার এক্টিভ নম্বর দিতে, কেউ দিলো না! সবাই বলে মেহেদীর সাথে ঝগড়া তাই সবাইকে নাকি ব্লক করেছো!
ভেতরটা ভেঙেচূড়ে মুচড়ে যাচ্ছে রুমে স্থীরভাবে দাড়িয়ে থাকা নাহিদার! এটা কি করে করতে পারলো সে! সে তো বলেছিলো আর কখনো স্পর্শ করবে না! তাহলে আজ আবার কেন মদ্যপান করলো! তার কথার কি কোনো মূল্য নেই! ঘরে স্ত্রী রেখে আবার বাইরের একটা দুশ্চরিত্রা মেয়ের সাথে ভিডিও চ্যাট করছে! আর সইছে না প্রান! নাহিদা মুখ চেপে ধরে দৌড়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে! সেখানে এসেও সে স্তব্ধ! জহিরুল ইসলাম বসে আছে চেয়ারে আর মেহেরুন টেবিলে কনুই ভর করে মাথা চেপে রেখেছে! নাহিদা চোখ মুছে ধীর পায়ে এগিয়ে এলো তাদের কাছে। জহিরুল ইসলাম খুব শান্ত গলায় বললো,
– আরও কখনো কি মাতাল অবস্থায় দেখেছো তাকে?
নাহিদা নিচের দিকে দৃষ্টি রেখে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললো,
– ফ্রেন্ডদের সাথে আড্ডা দিতে গেলে প্রায়ই খায়! বিয়ের রাতেও নেশাগ্রস্ত অবস্থায় বাসায় এসেছে, বাবা। এরপর আমি অনেক বুঝিয়ে নিষেধ করেছিলাম, মেনেছিলোও। এতোদিন পর আজ আবার হঠাৎ!
– বিয়ের দিন মাতাল অবস্থায় ফিরলে জানাওনি কেন কাউকে?
নাহিদা নিশ্চুপ হয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। কোনো জবাব নেই তার মুখে! জহিরুল ইসলামের গলা শান্ত থাকলেও তিনি একটুও স্বাভাবিক নেই সেটা নাহিদাও বুঝতে পারছে! তিনি যতটাই শান্ত গলায় কথা বলছেন ঠিক ততটাই ভয়ঙ্কর হয়ে আছেন! নাহিদার কান্না আসছে খুব! জহিরুল ইসলাম যাওয়ার অনুমতি দিলে নাহিদা দৌড়ে মেহতাজের রুমে চলে গেলো! দরজা লাগিয়ে সে ধপাস করে খাটে এসে পড়লো আর বালিশে মুখ চেপে কান্না করতে লাগলো! প্রচুর কাদছে যদিও বালিশে চাপা পড়ে শব্দ খুবই কম শোনা যাচ্ছে। ভাবতেও পারেনি মেহেদী আজ তার দেয়া কথা ভঙ্গ করবে! ভেবেছিলো সে ফিরলেই সবটা গুছিয়ে বলে ক্লিয়ার করে নিবে সন্দেহ। শুরু থেকে সবটা সাজিয়েও রেখেছিলো। কিন্তু কোনো লাভ হলো না! এখন বলেই বা আর কি হবে! ধ্বংস করে দিয়েছে লোকটা! জীবনকে সুন্দরভাবে সাজানোর পরিকল্পনায় ব্যঘাত সৃষ্টি করে সব ধ্বংস করে দিয়েছে। তাকে নিয়ে জীবনের যে নবখোয়াব দেখেছিলো, শুরুতেই সবটা বিলীন করে দিয়েছে। পিতামাতাকেও বড্ড আঘাত করে ফেলেছে। এর ক্ষমা হয় না। হবেও না!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here