“তৃ-তনয়া” পর্ব- ৬৭

0
2396

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৬৭
(নূর নাফিসা)
.
.
আলো ফুরিয়ে অন্ধকার ঘনিয়ে আসে,
এ যে রাতের অন্ধকার নয়!
ঘর আলো, মন কালো,
কালোতেই হয়ে গেছে, রঙিন জীবন ক্ষয়!
হলো রে হলো আজ, সমস্ত ধ্বংসের জয়!
দুনিয়া বড়ই আযব, তবুও মিছে নয়!
সারারাত কান্না করে কাটিয়ে দিলো নাহিদা! একটা মুহুর্তের জন্যও চোখে ঘুম নামেনি! আর না হয়েছে শান্ত মন! রাতের অন্ধকার কেটে গেছে কিন্তু মনে ঘনিয়ে এসেছে তা বহুগুণ! ফজরের নামাজ পড়ে সে বেরিয়েছে রুম থেকে। এমনিতেই বাড়ি নিরব থাকে তার মাঝেও আজ স্তব্ধতা ছেয়ে গেছে চার দেয়ালের অভ্যন্তরে! কোনো অচেতন প্রাণীরও সাড়াশব্দ নেই! কি করে থাকবে! এখানে যাদের অবস্থান, তারা সবাই চেতন!
মেহেরুন গালে হাত রেখে সোফায় বসে ছিলো। জহিরুল ইসলামকে ঘরে দেখা যায়নি। মেহেদী এলোমেলোভাবে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। অতিরিক্ত কোনো শব্দ না করে চুপচাপ ঘর ঝাড়ু দিলো নাহিদা। অতপর মেহেরুনের কাছে এসে বললো,
– মা, রান্না কি বসাবো?
– রুটি বানাবো তোর বাবার জন্য।
মেহেরুনের মুখও দেখার মতো না। কেউ ঘুমায়নি এই একটা রাত, অথচ সে ঘুমাচ্ছে শান্তিতে! কে জানে শান্তি পেয়েছিলো নাকি মাঝরাতে মাথা ব্যথায় ছটফট করেছে! ভাবতে ভাবতে নাহিদা চুপচাপ সব ব্যবস্থা করে এখন রুটি বেলছে। হঠাৎই দুইটা থাপ্পড়ের শব্দ পেলো সাথে জহিরুল ইসলামের রাগান্বিত কন্ঠ! নাহিদা দৌড়ে কিচেন থেকে বেরিয়ে এলো! বুকের ভেতরটা তার ধুকপুক করে কাপছে! জহিরুল ইসলাম মেহেদীকে থাপ্পড় দিয়েছে। বাবার সামনে দাড়ানো মেহেদীর দৃষ্টি এখন নিচের দিকে স্থীর! জহিরুল ইসলাম ধাধানো কণ্ঠে বললো,
– ছি! আজ এই প্রথম মন থেকে সত্যিটা বলছি। ঘৃণা লাগছে তোর মতো একটা জানোয়ারকে নিজের ছেলে বলে পরিচয় দিতে! এমন দিন দেখার আগে আল্লাহ দুনিয়া থেকে নিয়ে গেলো না কেন আমাকে! লজ্জা লাগছে ভাবতে যে, আমি তোর জন্মদাতা! ছি! জীবনের সকল প্রচেষ্টা যার জন্য সে নাকি এমন পিশাচ হয়! ছাপ্পান্ন বছর বয়সে আজও পর্যন্ত স্পর্শ করে দেখলাম না কোনো মাদক! আর সেই আমার ছেলে নাকি ফ্রেন্ডশিপ করে মাদকের সাথে! দিনের পর দিন, রাতের পর রাত এক হয়ে যায় তার কথা ভেবে! আর সে-ই ছেলে আমার মদ্যপান করে বন্ধুদের সাথে সময় কাটায়! এ আমার ছেলে কিছুতেই হতে পারে না! এক কাজ করবি বাবা? কাটারি দিয়ে আমাকে খুন করে তারপর সারাদিন বসে বসে মদ্যপান কর! এই বাড়ি গাড়ি যত ধনসম্পদ আছে আমি সব তোর জন্য গড়েছি। তুই সব ধ্বংস করে দে মদ্যপান করে, কিছু বলবো না আমি! অন্তত ওসব আমাকে দেখাস না! আমাকে দেখাস না ওসব!
এই বলে জহিরুল ইসলাম এলোপাথাড়ি থাপ্পড় দিতে লাগলো! মেহেরুন কান্না করতে করতে এসে থামানোর চেষ্টা করছে! জহিরুল ইসলাম ধমকের সাথে বললেন,
– আমার চোখের সামনে থেকে দূর হতে বলো। এই পাপকে পুষে আমি অনেক পাপ করে ফেলেছি, এখন এর মুখ দেখে আমি আর পাপ করতে চাই না!
অতি কষ্টে জহিরুল ইসলামের গলা ধাধিয়ে গেছে! মেহেরুন ঠেলে ঠেলে জহিরুল ইসলামকে রুমের দিকে নিয়ে গেলো। আর মেহেদী হাতের পিঠে চোখ মুছে রুমে এসে ফোন ওয়ালেট হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে! নাহিদা কিচেনের দরজায় হেলান দিয়ে মুখ চেপে কান্না করছে! ওদিকে মেহেরুন রুম থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এসেছে। মেহেদীকে রুমে খুজতে লাগলো কিন্তু পেল না! নাহিদা বললো, “উনি বেরিয়ে গেছে, মা।”
মেহেরুন কান্নার সাথে বললো,
– নাহিদা, আমার কিছু ভালো লাগছে না! ভেতরটা বড় অশান্ত লাগছে রে মা! ওদিকে তার বাবা ছেলের গায়ে হাত উঠিয়ে নিজে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে আর এদিকে ছেলে অভিমান নিয়ে চলে গেলো! আমার খুব ভয় লাগছে! এই পাগল ছেলে যদি উল্টাপাল্টা কিছু করে বসে কেউ ঠিক থাকতে পারবো না! কেউ না!
নাহিদা মেহেরুনকে ধরে শান্ত করার চেষ্টা করলো। কিন্তু তাতে কি লাভ হচ্ছে! মায়ের মন তো আরও বেশি ছটফট করে সন্তানের জন্য! নাহিদা মেহেরুনের ফোন থেকে তুর্যের নম্বরে ডায়াল করে মেহেদীর সাথে দেখা করতে বললো। আর তার পরিবারে তাকে নিয়ে একটা ঝামেলা হয়েছে, আপাতত যেন সে মেহেদীকে একটু সামাল দেয় সেজন্য অনুরোধ করলো।
সারাদিন কেটে গেলো সকলের অনাহারে! সকালে যে রুটি বানিয়েছিলো তাতেও খাওয়াদাওয়া চলেনি! না গিয়েছে আজ অফিস আর না বসেছে কারো মন কোনো কাজে। চলার মতো শুধু কান্নাটাই চললো বিরতি নিয়ে! মেহেদীর দেখাও মিললো না কোন এক মুহূর্তের জন্য। তবে তুর্য একবার জানিয়েছিলো সে মেহেদীর সাথে আছে। দিন শেষে আজ রাত পেরিয়ে গেলো কিন্তু মেহেদী বাড়ি ফিরলো না! ঘরের বাইরে এমন অঘটনের কোনো আচও লাগতে দেয়নি কেউ! এমনকি মোহতাজও জানে না কোনো কিছু! সবাই মনমরা হয়ে ঘরে বন্দী!
সকালে নামাজ পড়ে কুরআন পড়তে বসেছে নাহিদা, একটু শান্তির প্রত্যাশায়! হঠাৎই মেহেরুনের কান্নাজড়িত কণ্ঠে হাক শোনা গেলো। নাহিদা ভয় পেয়ে কুরআনের আয়াত শেষ না করেই কুরআন বন্ধ করে দৌড়ে বেরিয়ে গেলো। জহিরুল ইসলামের রুমে এসে দেখলো মেহেরুন জহিরুল ইসলামের বুকে মালিশ করছে আর কান্না করছে! নাহিদাকে দেখেই বললো,
– নাহিদা, তোর বাবা দেখ কেমন করছে! মেহেদীকে কল কর, মেহতাজকে কল কর! আল্লাহ তুমি রক্ষা করো!
নাহিদার পুরো শরীরে কম্পন ধরে গেছে! সে কি রেখে কি করবে মাথায় ধরছে না! ফোনের জন্য নিজের রুমের দিকে যেতে নিয়েও গেলো না! খাটে থাকা জহিরুল ইসলামের ফোন হাতে নিয়েই মেহেদীর ফোনে কল করলো। কিন্তু ফোন বন্ধ! অত:পর আসিফের ফোন নম্বর খুজে ডায়াল করতে করতে মেইন দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো। আসিফকে কল করেই নিচে এসে ড্রাইভারকে ডেকে নিয়ে গেলো। আর আসিফের বলা কথা অনুযায়ী জহিরুল ইসলামকে নিয়ে নিকটবর্তী ইসলামী ব্যাংক হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। ওদিকে আসিফ পৌছে গেছে হসপিটাল। সেখানে জরুরি বিভাগের ডাক্তার দেখালো। অত:পর পরিস্থিতি বুঝে হসপিটালে ভর্তি করা হলো। ছোট খাটো এক স্ট্রোক হয়ে গেছে জহিরুল ইসলামের। মেহতাজ কান্না করতে করতে দুপুরের দিকে হসপিটাল এসেছে। নিয়াজ উদ্দিনের মতো আবারও এলো এমন এক দিন! একের পর এক এমন ভয়াবহ দুর্ঘটনা যেন পিছু ছাড়ছে না!
পরিবারের লোকজন সব এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে। কখনো ডাক্তার, কখনো রিসিপশন কখনো বা ওষুধপত্রের অনুসন্ধান! নিজেদের জন্য ভাবনা যেন তাদের হারাম হয়ে গেছে! সারাদিন পেরিয়ে বিকেল হয়ে গেছে। ভর্তির ফি নিয়ে একটু ঝামেলা হয়েছিলো, সেটা মিটমাট করা হয়েছে কিনা তা দেখার জন্য যখন নাহিদা রিসিপশনের দিকে আসছিলো তখন মেহেদীকে দৌড়ে হসপিটালে প্রবেশ করতে দেখলো। এখনো ঠিক সেই পোশাকেই আছে যেই পোশাকে কাল ঘর ছেড়ে বেরিয়েছে। এলোমেলো অবস্থা প্রায়! মেহেদী নাহিদাকে দেখে তার কাছে এসে বললো, ” আব্বু কোথায়?”
কিন্তু নাহিদা কোনো জবাব দিলো না। সে ঝাপসা হয়ে আসা চোখ মুছতে লাগলো। জবাব না পাওয়ায় মেহেদীও আর তার জবাবের আশায় না থেকে রিসিপশনেই জিজ্ঞেস করে রুম নম্বর জেনে নিলো। অত:পর দৌড়ে সেদিকে ছুটলো। নাহিদা রিসিপশনে কথা বলে জানতে পারলো আসিফ সবটা মিটিয়ে গেছে। সে-ও আবার কেবিনে চলে এলো। মেহেদী তার বাবাকে দেখে স্তব্ধ! ফোলাফোলা গম্ভীর মুখ নিয়ে বেডে শুয়ে আছেন জহিরুল ইসলাম। মা পাশে বসেই শব্দহীন কাদছে! মেহেদীর উপস্তিতি টের পেয়ে তাকালো মেহেরুন ইসলাম। মেহেদী অপরাধী মনোভাবের সাথে পদার্পণ করলো কেবিনে। জহিরুল ইসলামও দেখেছেন কিন্তু প্রত্যক্ষ দৃষ্টি নিক্ষেপ করেনি! মেহেদী মেহেরুনকে উদ্দেশ্য করে বললো,
– আব্বু এখন কেমন আছে, আম্মু?
মেহেরুন ইসলাম দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। কোনো জবাব দিতে পারছে না তিনি! মনে হচ্ছে কেউ গলা টিপে ধরে রেখেছে! মেহেদী দু’হাতে চোখ কচলাতে কচলাতে বেরিয়ে এলো। নাহিদাকে দরজার ওপারে দেখতে পেয়ে দু’হাতে বাহু চেপে ধরে দাতে দাত চেপে বললো,
– এসব ঘটছে আজ তোমার জন্য। শুধুমাত্র তোমার জন্য আমি আজ ঘৃণিত সন্তান! কেউ আমাকে এখন সহ্যই করতে পারছে না! শুধুমাত্র তোমার জন্য আব্বু আজ এখানে! আই হ্যাট ইউ! যাস্ট হ্যাট ইউ, ইয়ার!
মেহতাজ ডাক্তারের কেবিন থেকে আসছিলো। মেহেদীকে নাহিদার বাহু চেপে ধরতে দেখে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে ধাক্কা দিয়ে ছাড়ালো মেহেদীকে। এবং বললো,
– হ্যাঁ, তার জন্যই বাবা আজ এখানে। তোর মতো এতো বড় এক ছেলে থাকতেও এইটুকু একটা মেয়ে হয়ে যথাসময়ে হসপিটালে এনেছে বাবাকে! সকাল থেকে এ পর্যন্ত বিনা ক্লান্তিতে দৌড়াদৌড়ি করছে কেবল একজন বাবাকে বাচাতে! তা না হলে যে কি হতো তা কেবল আল্লাহই ভালো জানেন! এ নাকি সন্তান আর সে নাকি পুত্রবধূ! কোথায় কার থাকার কথা আর সেখানেই তার অভাব! সকাল দুপুর গড়িয়ে বিকেল গড়িয়ে গেছে আর এখন আসছে বাবার কাছে! লজ্জা করে না আবার তাকে দোষারোপ করতে! প্রতিটি জীবন ধ্বংস করার জন্য প্রত্যেক ঘরে ঘরে তোর মতো সন্তান হওয়া চাই! ছি! সময় হয়তো আল্লাহ রাখছে তোর হাতে। ভালো হয়ে যা। ভালো হতে তেমন পরিশ্রমের প্রয়োজন হয় না, যতটা পরিশ্রম হয় খারাপ হতে! একমাত্র ছেলে তুই, সেখানে পিতামাতার মুখে এক টুকরো হাসি না ফোটাতে পারলে কিসের সন্তান হইলি তুই? আর কীজন্যই বা বেচে আছিস? ওর মতো মেয়েকে দোষারোপ করতে!
মেহতাজ চোখ রাঙিয়ে নাহিদাকে টানতে টানতে চলে গেলো। মেহেদী এক হাতে নিজের মাথার চুল আঁকড়ে ধরলো! আজ এই প্রথম সবকিছু এমন অসহ্যকর মনে হচ্ছে তার কাছে। দুহাত একত্রে মুখে বুলিয়ে অত:পর ডাক্তারের কাছে এসে বাবার অবস্থা বিস্তারিত জানলো। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে! তার জন্যই আজ তার বাবার এই অবস্থা!
সন্ধ্যায় আরাফ ও নিয়াজ উদ্দিনও এসেছেন খবর পেয়ে। বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে তারা চলে গেছে। কিন্তু ঘরের লোক ছাড়া বাইরের কেউ জানে না হঠাৎ কেন বয়ে গেলো এমন ঝড়! আজ সবাই হসপিটালে। আরিশার জন্য মেহতাজকে বাড়ি যেতে হয়েছে। তাকে বাড়িতে রেখে আসিফ আবার মেহেদীর বাড়িতে এসেছিলো, সাথে মেহেদীও। প্রয়োজনীয় কিছু কাপড়চোপড় নিয়ে এ বাড়ি তালা দিয়ে তারা আবার হসপিটালে চলে গেলো। সকলেরই কাটছে নির্ঘুম রাত।
মাঝরাতে নাহিদা মেহেদীকে চিন্তিত হয়ে কেবিনের বাইরে পায়চারি করতে দেখে মুখোমুখি হয়ে দাড়ালো। মেহেদী তার দিকে তাকাতেই নাহিদা বললো,
– কি, মাথা কাজ করছে না বাবার অবস্থা দেখে? সেদিন তো খুব কাজ করছিলো ঢকঢক করে গিলতে, তাহলে আজ কেন কাজ করছে না! আমাকে তো সুন্দর অপবাদও দিতে পেরেছেন। আজ বুঝতে পারছেন কিছু? একটুও কি উপলব্ধি করতে পারছেন, সেদিন আমার অবস্থাটা কেমন ছিলো! অসুস্থ বোনকে বাড়িতে রেখে আবার বাবাকে নিয়ে হসপিটালে দৌড়াদৌড়ি! কতটা ভয়াবহ ছিলো তখন আমার পরিবারের অবস্থা! আর আপনি সুন্দর সাজিয়ে ফেলেছেন আমি প্রেম জমিয়ে নিয়েছি! এটা প্রেম জমানোর উত্তম মুহূর্ত, তাই না? তাহলে আপনি এখন এতোটা চিন্তিত কেন? যান না, ফ্রেন্ডদের সাথে আড্ডা দিন গিয়ে, গার্লফ্রেন্ডের সাথে প্রেম জমিয়ে তুলুন! দেখি কেমন পারেন!
কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে কথাগুলো বলে নাহিদা চোখ মুছতে মুছতে চলে গেলো! মেহেদীও তার কথার প্রেক্ষিতে কড়া দৃষ্টিতেই তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here