“তৃ-তনয়া” পর্ব- ৬৯

0
2496

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৬৯
(নূর নাফিসা)
.
.
সকালে সবার আগে উঠুন বাড়িঘর ঝাড়ু দিলো নাফিসা। এবাড়িতে কাজে হাত লাগানোর পর থেকে প্রতিদিন সে-ই বাড়িঘর ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার রাখে। জেরিনের হাতে কখনো ঝাড়ু দেখেছে কিনা সন্দেহ! বড় ঘর ঝাড়ু দেয় হয়তো আবিদা বেগম নতুবা বড়মা। আর নাফিসা যদি দেখে তাহলে সে-ই ঝাড়ু দিয়ে দেয়। জেরিন কাজ বলতে শুধু রান্নার কাজটাই এগিয়ে দেয়। আর যদি নাফিসাকে আগে যেতে দেখে তো তার অসুস্থতার রেশ নেমে আসে আর যদি পরে যেতে দেখে তো আঁকাবাঁকা কথা বলে খোচা দেয়। তখন নাফিসারও ইচ্ছে করে কিছু একটা বলে দিতে। কিন্তু আবিদা বেগম পাশে থাকলে কিছু বলতে পারে না। যতই হোক, বাবা মায়ের সম্মানটা একটু বুঝতে শিখেছে। তাই আগের মতো সর্বদা পাগলামি না করে এখন সুযোগ বুঝেই উল্টো ধাওয়া দেয় সে।
ঝাড়ু দেওয়া শেষে সে হাতমুখ ধুয়ে রান্নার আয়োজন করতে বড় ঘরে এলো। বড়মা তাকে দেখে রুমে ডাকলেন। নাফিসা রুমে এসে বড়মাকে সালাম দিলো। তিনি জবাব দিয়ে বসতে বললো। আলমারি থেকে একটা বাক্স নিয়ে নাফিসার কাছে এসে বসলো। বাক্স খুলে একজোড়া বালা বের করে বললো,
– দেখতো মাপ টা ঠিক আছে কি-না?
– এটা কার?
– তোর।
– স্বর্ণের?
– হ্যাঁ। পড়।
– আমি এসব পড়বো না, বড়মা। অলংকার আমার ভালো লাগে না।
– মেয়ে মানুষের আবার অলংকার ভালো না লাগে! তাছাড়া বউদেরও তো একটা সৌন্দর্যের ব্যাপার আছে। নাক কান গলা হাত সব খালি। বউয়ের সৌন্দর্যের অভাব আছে তোর মাঝে। পড়ে দেখ ভালো লাগবে। জেরিনকে একজোড়া দিয়েছি, বিয়ের পর তোর হাতের মাপ দেখে এটা গড়ে নিয়েছি। আয়োজন করলে তো আরও আগেই ব্যবস্থা করা হতো।
নাফিসা বালা জোড়া হাতে পড়ে নিলো। সাইজ ঠিকই আছে। বড়মা হাসিমুখে বললো,
– এবার বউ বউ লাগছে। নাকে একটা পিনও তো পড়তে পারিস আপাতত।
– বড়মা, এসব কি বাধ্যতামূলক! আগের দিনের লোকেরা কুসংস্কারে বিশ্বাস করতো তাই এসব পড়তো। এর কিন্তু কোনো রীতিনীতি নেই।
– কুসংস্কারে বিশ্বাস করতে কে বললো! আমি তো শখ করে দিলাম। তবে একটা জিনিস কিন্তু মানতে হয়, অলংকারে মেয়েদের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়। তুই এটাই ভেবে দেখ, জেরিনকে দেখে যে কেউ বলবে সে এবাড়ির বউ আর তোকে দেখে বলবে নিশাতের মতো তুইও এ বাড়ির মেয়ে! এর কারণ কি হতে পারে বলতো?
– সাজসজ্জা ?
– হ্যাঁ, আর এই সাজসজ্জা ধারণ করলে নিজের মধ্যেই একটা আলাদা ভাব আসে। নিজেকে দায়িত্বশীল মনে হয়। সবসময় পড়ে থাকবি, দেখতে ভালো লাগে।
– হু, স্বর্ণের বালা সবসময় পড়ে থাকি আর দিনদুপুরে ডাকাতি হয়ে যাক!
বড়মা হেসে বললো,
– ধুর! আমরাও তো পড়ি, কই? হয় নাকি এমন কিছু! আর একটু সাবধানে থাকলেই হয়, আল্লাহ ভরসা।
– রান্না কি বসাবো?
– যা, আসছি আমি।
নাফিসা চলে গেলো কিচেনে। জেরিন কাজ থেকে ছুটি নেওয়ার জন্য এসে একবার বুলি ছেড়ে গেলো তার জ্বর জ্বর লাগছে। নাফিসা ভেবে পায় না মানুষ এমন কেন হয়! কিছু করবি না যখন এতো বাহানার কি প্রয়োজন! মনে মনে কারো সাথে হিংসে করারই বা কি প্রয়োজন! এতে ক্ষতি ছাড়া তো কোন লাভ হচ্ছে না! এ কেমন স্বার্থপরতা! মানুষের মাঝে এতোটা ভেজাল কেন! স্পষ্টবাদী হতে পারে না তারা!
নাফিসা বড়মাকেও কাজে হাত লাগাতে নিষেধ করে একা একাই সব করতে চেষ্টা করলো কিন্তু বড়মা হাত লাগিয়েছে। আবিদা বেগম এসে কিছুক্ষণ বসেছিলো এবং কথা বলেছিলো বড়মার সাথে। আর বারবার নাফিসার হাতের দিকে তাকাচ্ছিলো যেটা নাফিসা লক্ষ্য করেছে। তাকাবেই না কেন! নাফিসাকে কাজ করতে বড্ড বিরক্ত করছিলো বালা দুটো! বারবার উপরে উঠায় আর ঢলঢল করে নেমে যায় হাতের কবজিতে! হাড়িপাতিল ধরতে গেলে ঠকঠক আওয়াজ হয়! বড়মাও বিষয়টি দেখে হেসে বলেছিলো, “খুব বিরক্ত করছে? আস্তে আস্তে অভ্যাস হয়ে যাবে।”
কাজকর্ম শেষে রুমে এসে বালা দুটো খুলে ড্রেসিং টেবিলে থেতলে রাখলো! চোখে মুখে বিরক্তিকর ছাপ স্পষ্ট! ইমরান দেখে বললো,
– কি হয়েছে?
– কোনো জড় পদার্থও যে এতো বিরক্ত করতে পারে আজ প্রথম উপলব্ধি করলাম!
– কে দিয়েছে?
– বড় মা।
ইমরান হাতে নিয়ে দেখে আবার রেখে বললো,
– সুন্দরই তো।
– সুন্দর হলেই কি, এসব পড়ে কাজকর্ম করা যায়! কেন যে মানুষ এসব পড়ে আল্লাহ জানে!
– কেন আবার! ভালো লাগে তাই পড়ে।
– না পড়লে কি হয়! কই আমার তো একটুও ভালো লাগলো না!
ইমরান তার মুখে এমন বিরক্ত ভাব দেখে বললো,
– বড় মা দিয়েছেন শখ করে, ইচ্ছে হলে পড়বে ইচ্ছে না হলে পড়বে না!
নাফিসা আর পড়লো না। চুপচাপ সে আলমারিতে তুলে রেখে দিলো। তার মতে যদি হাত-পা গুটিয়ে ঘরে বসে থাকা যায় তাহলেই কেবল এসব পড়ে থাকা যায়!
ইমরান অফিস চলে গেলেও নাফিসা ভার্সিটি যায়নি। কেন জানি ইচ্ছে করছে না যেতে। তাছাড়া নিশাতের এক্সাম সামনে হওয়ায় নিশাত এখন বাড়িতে আছে। বাড়িতেই তার সাথে সময় কাটবে ভালো।
বিকেলে ইমরান বাড়ি ফিরেছে আরমান ও অন্য এক লোকের কাধে ভর করে। নাফিসা নিশাতের সাথে পড়ছিলো রুমে। বাইরে হইচই শুনে তারা উভয়েই বেরিয়ে এলো। উঠুনে মাথায় ও পায়ে ব্যান্ডেজ করা ইমরানকে দেখে ভেতরটা ধুক করে উঠলো! নিশাত দৌড়ে উঠুনে বেরিয়ে এলো আর নাফিসা বারান্দার গেইট পর্যন্ত এসে দাড়ালো। আবিদা বেগমের কান্নাজড়িত কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে আর বড়মার একের পর এক প্রশ্ন! ইমরানকে রুমে এনে বসিয়ে আরমান ঘটনা খুলে বললো। আরমানের আগে সে অফিস থেকে বেরিয়ে রিকশা করে বাড়ির দিকে ফিরছিলো। জ্যামময় রাস্তায় কোনো এক ট্রাককে সাইড দিতে গিয়ে রিকশা একদম চাপিয়ে ফেলেছে ফুটপাতে। তবুও ধাক্কা লেগে রিকশা উলটে গেছে! আর ইমরান ছিটকে পড়েছে দোকানপাটের উঁচুনিচু সিড়িতে। সেই সূত্রে মাথায় আঘাত লেগেছে আর পায়ের উপর রিকশার চাকা পড়ায় চামড়া কেটে মাংসে দেবে গেছে কিছুটা! পরিচিত লোকজন আরমানকে খবর দিলে আরমান ছুটে যায় ঘটনাস্থলে। আর নিয়ে যায় হসপিটালে।
বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত ইমরানের ধারে কাছেই আছে সবাই। ওদিকে রান্নাবান্নাও যে পড়ে আছে। তার সবটা দুহাতে সামলে নিয়েছে নাফিসা। ইমরানকে সে যখনই দেখছে তখনই যেন তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে! কেন এমন হচ্ছে তার অজানা। জেরিন প্রায় পুরোটা সময়ই ইমরানের রুমে আছে অথচ সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই নাফিসার! সম্পূর্ণ সময়টা যেন তার অন্যমনস্কভাবেই কেটেছে! ঘুমানোর পূর্বে নাফিসা রুমে প্রবেশ করলো। ইমরান বসে আছে এখনো। নাফিসা অন্যমনস্ক থাকলেও বাড়িতে ফেরার পর থেকেই ইমরান লক্ষ্য করছে তার মুখ গম্ভীর। চোখ ভেজা ভেজা! কারো সাথে কোনো কথাও বলতে দেখেনি। সে নিজ থেকেই এখন জিজ্ঞেস করলো,
– খেয়েছো?
নাফিসা কোন জবাব না দিয়ে আলমারি খুললো। বালা জোড়া হাতে পড়ে তারপর আলমারি লক করলো। ইমরানের দিকে এগিয়ে এসে বললো,
– বসে আছেন কেন? শুতে পারবেন না?
– হুম, আবার এটা পড়লে যে?
– পড়িনি বলেই তো আজ আপনার এই অবস্থা হলো! তা না হলে কি আর হতো!
– কিসব আজেবাজে বলছো! গুজবে বিশ্বাস করো না। বিপদ এলে এমনিতেই আসে।
– হ্যাঁ, এমনিতে হলে আজই কেন আসতে হলো!
ইমরান কিছুক্ষণ তার দিকে স্থিরভাবে তাকিয়ে রইলো ! কেননা ক্ষণিকের জন্য নাফিসারও আজ কুসংস্কারে বিশ্বাস এসে গেছে! তার ধারণা এটা রেখে দিয়েছিলো বলেই আজ ইমরানের সাথে এমন দুর্ঘটনা ঘটলো! মশারী টানিয়ে নাফিসা বললো,
– খাওয়ার পর ওষুধ খেয়েছেন আপনি?
– হ্যাঁ। রান্না কি আজ তুমি করেছো?
– কেন?
– লবন মনে হয় একটুও বেশি পড়েনি!
– কই, কেউই তো খেয়ে কিছু বললো না!
কথাটুকু বলে নাফিসা নিজেই বোকা বনে গেলো! ইমরান তো সেটাই বললো একটুও বেশি পড়েনি! তারমানে ঠিকই ছিলো! নাফিসা ইমরানের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো ইমরানের ঠোঁটের এক কোনে মৃদু হাসি লেগে আছে। নাফিসা খাটে উঠে মশারী ঠিক করতে করতে বললো,
– এমন ব্যাথা পেয়ে এসেছে তবুও হাসে কিভাবে মানুষ!
– ব্যাথা আমি পেয়েছি, তুমি কাদছো কেন! তাইতো একটু হাসানোর চেষ্টা করলাম!
– এতো বেশি কথা বলবেন না। এসব মস্করা আমি মোটেও পছন্দ করি না।
ইমরান বাম হাত বাড়িয়ে একটা মলম নিয়ে বললো,
– এটা লাগিয়ে দিতে হবে তোমার। পিঠে একটু কেটে গেছে।
শার্ট খোলা থাকলেও ইমরানের পড়নে আছে সেন্টু গেঞ্জি। নাফিসা মলম হাতে নিয়ে বললো,
– গেঞ্জি খুলুন।
ইমরান বামহাতে একটু টেনে বললো,
– তোমার হেল্প লাগবে।
– হাতেও ব্যাথা পেয়েছেন?
– কাত হয়ে পড়েছিলাম বিধায় ডান হাতের কনুই মচকে গেছে।
– মাথা থেকে পা পর্যন্ত সব শেষ করে আসছে! একটু সাবধানে চলাফেরা করা যায় না! এতো তাড়া কিসের! দোয়াদরুদ তো মনে হয় মুখেই আনে না!
বিড়বিড় করতে করতে নাফিসা তার গেঞ্জি খুলে দিলো। পিঠের ছোট ছোট কাটাগুলোতে মলম লাগিয়ে দিতে গিয়ে সে নিজেই কেপে উঠছে! ইমরান তার বিড়বিড় শুনে জবাব দিলো,
– গাড়িতে যতবার উঠি আর যতবার নামি ততবার দোয়া পড়ি। এছাড়াও গাড়িতে থাকাকালীন দোয়া ইউনুস পড়ি।
নাফিসা তার দিকে তাকিয়ে বললো,
– আজও পড়েছিলেন?
– হুম।
– তাহলে এক্সিডেন্ট হলো কেন!
– তোমার হয়েছে কি, বলোতো! কেমন যেন আজব টাইপের কথাবার্তা বলছো আজ! মানুষ হয়ে পৃথিবীতে এসেছি বিপদ-আপদ তো থাকবেই! এ সবই যে আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত আমাদের ধৈর্যের পরীক্ষা সেটা তুমি জানো না?
নাফিসা আর কোনো কথা বললো না। বিছানা ছেড়ে নেমে গামছা ভিজিয়ে মচকে যাওয়া কনুইয়ে জলপটি দিলো। একটা কাথা পেচিয়ে উচু করে ইমরানের আঘাতপ্রাপ্ত পায়ের নিচে রেখে দিলো। তারপর ঘুমানোর জন্য নিজের ক্লান্ত দেহ বিছানায় এলিয়ে দিলো।
গতরাতে হালকা জ্বর অনুভব করছিলো ইমরানের দেহে। তাই ঘুম থেকে উঠেই আগে তার গালে ও গলায় হাত দিয়ে জ্বর পরিমাপ করলো নাফিসা। বেড়ে গেছে কিছুটা। দেহ থেকে হাত সরিয়ে নেওয়ার সময় চোখ পড়লো বুকের বাঁ পাশটায়! কেমন গতিতে হৃদস্পন্দন হচ্ছে সেটা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে বাইরে থেকে। এ পাশটা কাপছে। সেদিন রাতের কথা মনে হতেই ভেতরটা চিনচিন করে উঠলো নাফিসার! ইমরান যখন হাত টেনে নিয়ে চেপে ধরেছিলো তখন যেন শকড লেগেছিলো তার দেহে! কিন্তু আজ বড়ই লোভাতুর হয়ে গেছে তার মন! সাহস দেখাতে সে কাপা কাপা ডান হাতটা আলতোভাবে রাখলো ইমরানের বুকের বাঁ পাশে। ভেতরের ঢিপঢিপ স্পন্দন যেন সরাসরি তার মস্তিষ্কে সাড়া দিচ্ছে! তা অনুভব করতে করতে কখন যে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলো তার খেয়াল নেই! কিন্তু চোখ খুলে দেখতে পেয়েছে ইমরান তাকিয়ে আছে তার দিকে! প্রত্যক্ষ লজ্জা পেয়ে নাফিসা দ্রুত হাত সরিয়ে নেমে গেলো বিছানা ছেড়ে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here