“তৃ-তনয়া” পর্ব- ৭০

0
2571

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৭০
(নূর নাফিসা)
.
.
পরদিন সকালেই রুমানা বেগম ও জহিরুল ইসলাম এসেছেন ইমরানকে দেখতে। ওদিকে আয়াত ও তুর্যসহ আরাফের পরিবারের সবাই এসেছে। দেখা সাক্ষাতের পর দুপুরের দিকে নিয়াজ উদ্দিন ও রুমানা বেগম চলে গেছেন আর আরাফরা বিকেলে চলে গেছে যদিও আয়েশা বেগম থেকে গেছেন। জেরিনের বড় বোনও এসেছিলো। স্কুল পড়ুয়া দুইটা ছেলে আছে তার। তার আচার-ব্যবহার জেরিন থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। নাফিসার কাছে বেশ ভালোই লেগেছে মারিয়াকে। সন্ধ্যার পর যখন আবিদা বেগমের সাথে আয়েশা বেগম ড্রয়িং রুমে বসে কথা বলছিলো তখন নাফিসা রুমের সামনের ফাকা জায়গাটুকু ঝাড়ু দিচ্ছিলো। জিহান ও তার খালাতো ভাইয়ের খেলাধুলা করে ধুলোবালিতে ময়লা করে ফেলেছে। নাফিসাকে দেখে আয়েশা বেগম ঝাঝালো গলায় বললো,
– তোর ঘরের বিপদ-আপদ দূর হইবো কেমনে! দেখ দেখ কি করে! এই সাজ সন্ধ্যায় ঘর ঝাড়ু দেয় কেউ! বিয়া কইরা অলক্ষ্মী তুলছে ঘরে! বারবার মানা করছিলাম, শুনছিলি আমার কথা! এমন বউ ঘরে থাকলে তো অঘটন ঘটবোই! ওইদিকে একটা আমার ঘর জ্বালাইতাছে এইদিকে এইবার তোর ঘর ছাড়খাড় করবো!
আয়েশা বেগম নাফিসাকে মোটেও সহ্য করতে পারে না। এখানে আসার পর যখন সামনাসামনি হয়েছিলো তখনই তার ব্রু কুচকে মুখে বিরক্তিকর ছাপ নেমে এসেছিলো। তখন সেদিকে নাফিসা ভ্রুক্ষেপ না করলেও এখন আর চুপ থাকতে পারলো না। মুখের উপর জবাব দিয়েই দিলো,
– সাবধানে কথা বলুন! উল্টাপাল্টা কিথা আমি বলিও না আর কারো মুখে শুনতেও পারিনা! নিজের সংসারে তো আমার বোনটাকে একটু শান্তি দেনই না, এখন আবার আসছেন আমার সংসার জ্বালাতে!
– নাফিসা!
আবিদা বেগম একটা ধমক দিলো নাফিসাকে আর আয়েশা বেগম রেগে তেলে বেগুন জ্বেলে উঠলো! আর কর্কশ কণ্ঠে বললো,
– কি? কি কইলা? আমি জ্বালাই? তোমাগো মতো দুই একটা কাল থাকতে আমার জ্বালাইতে হয়!
– তা নয় তো কি! আপনার মতো এমন বদ মহিলা দুনিয়াতে আমার চোখে আর একটাও পড়েনি! মেহমান হয়ে আসছেন, মেহমানের মতো থাকেন! সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুল বাকা করতে আমিও জানি! আমি কিন্তু নাজিয়া না! সুতরাং নাফিসা হইতে সাবধান থাকেন খালা….আম্মা!
– দেখছোস, দেখছোস খালি ক্যামনে কথা কয়!
আবিদা বেগম ধমকে উঠলেন,
– কত্ত বড় স্পর্ধা তোমার! আদব কায়দা শিক্ষা দেয় নাই! জেরিন কইছিলো পরেই মানা করছিলাম আমি! পোলা কি আর আমার কথা শুনছে! ক্যামনে বশ কইরা রাখছে কেডা জানে!
– আম্মা, আপনি দয়া করে এমন উল্টাপাল্টা কিছু বলবেন না! যথেষ্ট সম্মানিত দৃষ্টিতে মর্যাদা দিয়েছি আমি। আপনার বোনের মতো আচরণ করে সেই মর্যাদার ক্ষুন্ন করবেন না আশা করি!
– চুপ করো! বেয়াদব মাইয়া! আবার মুখে মুখে তর্ক করে! ব্যাবহারেই নাকি বংশের পরিচয় পাওয়া যায়। খুব ভালাই পরিচয় করায় দিছো!
আয়েশা বেগম আবার গলা বাড়িয়ে বললো,
– থাক, চুপ কর আবিদা!
– বুবু গো, পোড়াকপালি আমি! কি পাপ যে করছিলাম আল্লাহ জানে! মান সম্মান তো যা যাওয়ার গেছেই এহন দেখছি শান্তিও উইড়া যাইবো! একটার পর একটা অঘটন ঘইট্টাই যায়! একজনরে তো চিরতরে উঠাইয়াই নিছে এহন কি সন্তানদেরও কাইরা নিয়া নিঃস্ব করবো আমারে! নামাজ পড়ি আর আল্লাহর কাছে কই, আমার বাচ্চাগুলারে যাতে বিপদ মুক্ত রাখে! আল্লাহ কি আমার ডাক শোনে না! এত বিপদ দেয় কে!
কথা বলতে বলতে আবিদা বেগম কান্না শুরু করেছে। বংশের কথা বলায় নাফিসা চুপসে গেছে! খুব লেগেছে মনে! পরিবার নিয়ে কোনো বাজে কথা শুনতে পারে না সে! কান্না চলে আসে তার! এখন যদি কোনো জবাব দিতো হয়তো মা বাবার নাম ধরেও বকা দিয়ে যেতো যেটা মোটেও সহ্য করতে পারতো না সে! তাছাড়া কথায় কথা বাড়ে। এর উপর বাড়িতে একজন অসুস্থ ব্যক্তি। এখানে তার একমাত্র শক্তি সেই ব্যক্তি। কথা যদি প্রকট আকার ধারণ করে তাহলে হট্টগোল বেধে যাবে! হয়তোবা ইমরানও তার পরিবারের সাপোর্ট করবে। তখন তার কি হবে সবাই যদি তার বিপক্ষে কথা বলে! বাবা-মাও তো তার উপর ভরসা না করে ভেবে নিবে অতিরিক্ত চঞ্চলতার সাথে বেয়াদবি করেছে তাদের মেয়ে! যেটা করতে বরাবরই সাবধান করা হয়েছিলো তাকে! পৃথিবীর প্রাণগুলো এমন কেন! মনুষ্যত্ব শব্দটার সাথে তারা এতো অপরিচিত কেন! কি হয় যদি একটু ভালো কাজ করে! কি হয় সবার সাথে যদি একটু ভালো আচরণ করে! এতে কি খুব ক্ষতি হয়ে যায়! মানুষ এতোটা স্বার্থপর কেন! তারা নিজেরা অন্যের ভালো আচরণ লাভের প্রত্যাশা ঠিকই করে অথচ নিজেরা তা অন্যের সাথে বিনিময় করতে পারে না! যেটা আমি পারবো না সেটা অন্যের কাছ থেকে পাওয়ার প্রত্যাশা কি করে করতে পারি! এই বোধটুকু কি মানুষের মগজে আটে না! ভাবতে ভাবতে নাফিসা চুপচাপ তার কাজের বাকিটুকু সম্পন্ন করে নিলো এবং এঘর ত্যাগ করে তাদের ঘরের দিকে অগ্রসর হলো। ইমরানের কাছে বড়মা, আরমান ও জেরিন আছে। আরমান সাথে এক লোককে নিয়ে এসেছে দেখা করতে , তাদের আশেপাশের কেউ হবে হয়তো। তারা এক্সিডেন্ট নিয়েই কথা বলছে। তাই নাফিসা নিজ রুমে প্রবেশ না করে নিশাতের রুমে চলে গেলো। এখানে নিশাত ও জিহান আছে। নিশাত পড়ছে আর জিহান একা একা খেলা করছে। নাফিসা কারো সাথেই কোনো কথা বললো না। মনমরা হয়ে চুপচাপ শুধু খাটের কোনে বসে রইলো।
কিছুক্ষণ পর জিহানকে ডাকতে জেরিন এলো এই রুমে। নাফিসাকে এখানে বসে থাকতে দেখে বললো,
– এ-ই বউয়ের দায়িত্ব! হাসব্যান্ড এর কিছু প্রয়োজন আছে কি-না সেটা দেখার জন্য তো রুমে উঁকিও পড়লো না!
নাফিসা বিরক্তিকর মনোভাব নিয়ে জবাব দিলো,
– আমার আর কি প্রয়োজন! ভাবি কি কম সেবাযত্ন করছে তার দেবরের! বাকিসব ছেড়ে তো ভাবি দেবরের সায়াহ্নে বসে আছে সারাদিন। সেখানে নিশ্চয়ই সেবার কোনো ঘাটতি থাকার কথা নয়! আমাকে তো আনা হয়েছে চাকরানী হিসেবে যার কাজ, কেবল ঘরের কাজকর্ম করা!
কথাটুকু বলে নাফিসা তার রুমে এলো। আরমান চলে গেছে, শুধু বড়মা বসে আছে এখনো। নাফিসাকে দেখে তিনি উঠে পড়লেন। ইশার আযান দিয়েছে তাই নামাজ পড়তে যাবেন। যাওয়ার সময় নাফিসাকে বললেন,
– রান্নাবান্না শেষ নাফিসা?
– হ্যাঁ।
– কি হয়েছে তোর? মুখটা এমন মলিন কেন?
– কিছু না।
– ইমরানের জন্য টেনশন করছিস? চিন্তা করিস না। ইনশাআল্লাহ, সুস্থ হয়ে যাবে তারাতাড়ি।
বলতে বলতে বেরিয়ে গেলো বড়মা। নাফিসা বাইরে জেরিনের কথা শুনছিলো। তার মনে হলো সে জিহানকে নিয়ে আসছে হয়তো এ রুমের দিকে। তাই এসে দরজা আটকে দিলো নাফিসা। সব কিছু বিরক্তিকর মনে হচ্ছে এখন তার কাছে। ইমরান বললো,
– কি হয়েছে গো মহারানী?
– এতো ন্যাকামোর কি প্রয়োজন! সরাসরি চাকরানী বলে ডাকতে পারেন না!
নাফিসার মেজাজ দেখে ইমরানের কপালে সূক্ষ্ম ভাজ পড়ে গেলো! নাফিসা কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কথাটুকু বলে অগোছালো আসবাবগুলো গুছিয়ে রাখলো। কিছু একটা হয়েছে ইমরান নিশ্চিত। নাফিসাকে এভাবে কাজ করতে দেখে বললো,
– ওই বইটা একটু দাও তো।
নাফিসা সেল্ফ থেকে বই নিয়ে প্রায় ঢিল দিতে যাচ্ছিলো কিন্তু ইমরানের অবস্থা দেখে আবার থেমে গেলো। কাছে এসে ঠিকভাবেই দিয়ে চেয়ারগুলো ঠিক করে রাখলো। অতপর বিছানার একপাশে এসে শুয়ে পড়লো। ইমরান তার দিকে একটু চেপে বসে কাধে হাত রেখে ফিসফিস করে বললো,
– মনটা এতো বিষন্ন কেন? কি হয়েছে তোমার? বলো আমাকে?
নাফিসা মাথা ঘুরিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বললো,
– আপনার মা নিষেধ করেছিলো না আমাকে বিয়ে করতে?
ইমরানের ব্রু হালকা কুচকে গেলো! নাফিসার দুচোখ টলমল করছে! অশ্রু গড়াতেও সময় নিলো না তার! ইমরানকে জবাবহীন তাকিয়ে থাকতে দেখে আবার বললো,
– বলছেন না কেন?
– হ্যাঁ।
– তাহলে বিয়ে করেছেন কেন?
– তার কারণ তো আগেও একবার বললাম!
– এখন যদি আপনার পরিবারের বাকি লোকজন আমাকে পরিবার থেকে বহিষ্কার করতে চায় তাহলে আপনি কি করবেন?
– কিসব বলছো! এমন কিছুই হবে না।
– না হওয়ার কি আছে! আমি অলক্ষ্মী, আর অলক্ষ্মীকে কি কেউ ঘরে জায়গা দেয়!
– পাগল হয়ে গেছো! এসব কি বলছো!
– আমি পাগল হইনি! এসব বলাতে যদি পাগল মনে করা হয় তাহলে আপনার মা আর খালা পাগল হয়ে গেছে! বারবার আপনাকে নিষেধ করেছিলো তবুও আপনি কেন আমাকে বিয়ে করতে গেলেন! বউ কি এখন পরিবারের বাইরে রেখেছেন? এমন পাগলময় পরিবারে সংসার করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়!
– আমি তোমার কথার আগা গোড়া কিছুই বুঝতে পারছি না! ক্লিয়ার বলো।
– সারাদিন আপনার ভগ্নীরা খেলাধুলা করে ঘর ময়লা করে ফেলেছে। একা একা রান্না শেষ করে সন্ধ্যায় ঘর ঝাড়ু দিচ্ছিলাম বলে আপনার খালাম্মার উক্তি, আমি অলক্ষুণে তাই এমন সব কাজকর্ম করছি! আমি অলক্ষুণে তাই আপনি এমন দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন! আমি অলক্ষুণে তাই এ পরিবারে কখনো শান্তি আসবে না। মুখের উপর জবাব দিতে গেলেও আমি বেয়াদব! আর এক দুশ্চরিত্রা ডাইনী তো আছেই আঁকাবাঁকা কথা শুনানোর জন্য। একটা কথা খুব ভালো করে জেনে রাখুন, এসব অত্যাচার আমি কখনোই সহ্য করতে পারবো না। চোখের সামনে কোনো অন্যায় এই নাফিসা সহ্য করতে জানে না! যদি খুনখারাবিরও প্রয়োজন পরে, নিশ্চিত লড়াই করার জন্য প্রস্তুত থাকে! এরপর যা হওয়ার হবে! তবে আজ কেবল চুপ ছিলাম, কেননা আপনার খালার মতো জঘন্য মানুষ সোজা আঙুল তুলবে আমার পিতামাতার দেওয়া শিক্ষার উপর! শুনতে খারাপ লাগলেও একটা সত্য কথা জানেন তো? আপনার এই আন্টি একজন স্টুপিড মহিলা! কখনো কারো ভালো চাইতে জানে না! কেবল মানুষের অমঙ্গল কামনা করতে জানে আর অভিশাপ দিতে জানে! ওদিকে আমার বোনটাকে একটুও শান্তি দেয় না আর এদিকে আমার সংসারে আসছে আগুন ধরিয়ে দিতে! আপনার মা-ও ঠিক সেই তালেই নেচে যাচ্ছে! আর আপনার কাছেও একটা অনুরোধ, কখনো আমার পক্ষ নিয়ে কোনো কথা বলবেন না! আপনার এই পরিজন বিন্দু মাত্র অপেক্ষা করবে না এটা বলতে যে, ছেলে বিয়ে করে বউ পাগলা হয়ে গেছে আর বউয়ের কথায় এখন নেচে যাচ্ছে! অন্যথায় আমাকে যদি উল্টাপাল্টা বলে শ্বাসাতে আসেন তো আপনি বলেও ছাড় দেবো না মাইন্ড ইট। এখন বউ রাখবেন কি রাখবেন না সেটা আপনার ব্যাপার! আর আপনার পরিবার দ্বারা যদি আমার বাবা-মা বিন্দুমাত্র কষ্ট পায় তো নিজ হাতে শেষ করে দেবো আপনার এই পরিবার। নারী গড়তেও পারে আবার ধ্বংসও করতে পারে!
দুহাতে চোখ মুছে বিপরীতমুখী হয়ে গেছে নাফিসা। চোখ মুছলেই কি হবে, বালিশ তো ঠিকই ভিজে যাচ্ছে! আর ইমরান নিস্তব্ধ! এতোক্ষণ বলা কথাগুলো শুনে তার কখনো কষ্ট লেগেছে, কখনো রাগ হয়েছে আবার কখনো হাসিও পেয়েছে! কিন্তু কোনটাই বাইরে প্রকাশ পায় নি! সে সোজা হয়ে বসে চুপচাপ বইটা খুলে মনে মনে পড়তে লাগলো। আর এদিকে একটু পরপর নাফিসার নাক টানার শব্দ শোনা যাচ্ছে! কিছুক্ষন পর নিশাত বাইরে থেকে ডাকলো,
“ভাবি, বড়মা তোমাকে ডাকছে ভাইয়ার খাবার নিয়ে আসার জন্য। ভাবি?”
নাফিসা কোনো জবাব দিলো না। ইমরান বললো,
“নিশাত, নাফিসার মন খারাপ। তুই নিয়ে আয় খাবার। নাফিসারটা সহ।”
নিশাত কোনো জবাব না দিয়ে চলে গেলো। শুনেছে কি-না কে জানে! একটু পরেই আবার নিশাতের ডাক পড়লো। খাবার নিয়ে এসেছে সে। ইমরান নাফিসাকে দরজা খুলতে বললো কিন্তু নাফিসা কোনো সাড়া দিলো না। ঘুমের ভান করে শুয়ে আছে। অথচ একটু পরপর নাক টানছে! বাধ্য হয়ে ইমরান নিজেই বিছানা থেকে নামতে যাচ্ছিলো। টের পেয়ে নাফিসা দ্রুত উঠে ওড়না দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে এসে দরজা খুলে দিলো। ইমরান আবার বিছানায় উঠে বসলো। নিশাত প্লেট নিয়ে রুমে ঢুকতে ঢুকতে বললো,
– কি হয়েছে ভাবির?
নাফিসা কোনো জবাব দিলো না। ইমরান বললো,
– মন পিছলে পড়ে অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে তোর ভাবির!
নিশাত হেসে উঠলেও নাফিসা কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলো না। দরজার বাইরে জেরিনকে বাটি নিয়ে আসতে দেখে নাফিসা এসে তার হাত থেকে বাটি নিয়ে নিলো। জেরিন বললো,
– তোমার আবার কি হলো! ভঙ ধরে আজ খাবার আবার এঘরে আনতে বললে কেন! এইটুকু যেতে পায়ে ঠোসা পড়ে যায়?
– কথা যত কম বলবেন তত ভালো থাকবেন। বেশি কথা বললে আবার দন্তহীন হয়েও যেতে পারেন!
– মানে!
– আমি কাউকে বলিনি আমার জন্য খাবার নিয়ে আসতে! নিজের পেট ভরে শান্তি থাকুন। আর অন্যের পেছনে লাগা বন্ধ করুন। না হয় উল্টো তীর নিক্ষেপ হবে!
– ইমরান, দেখেছো দেখেছো কত বড় স্পর্ধা এইটুকু মেয়ের মাঝে! আগেই বলেছিলাম একটুও ভালো হবে না এই মেয়ে!
– বললেই কি হবে ভাবি? দুনিয়াতে ভালো মানুষ খুজে পাওয়া যে দুষ্কর! একটাও তো খুজে দিতে পারলেন না ভালো মেয়ে!
– খুজতে সময় দিয়েছো তুমি?
– আপনি এখন দয়া করে যান তো ভাবি! বউকে বকেছি, তাই বউ এমনিতেই লাল মরিচ হয়ে আছে! অযথা কথা বাড়িয়ে এখন পচন ধরানোর কোনো প্রয়োজন নেই!
নিশাত তাদের কথা শুনে একদম নিশ্চুপ হয়ে আছে! বেশ ভালোই বুঝতে পারছে তার ভাবিরা একে অপরকে দেখতে পারছে না! তবে এখানে জেরিনের দোষটাই একটু বেশি আটলো তার চোখে। কেননা খাবার নিয়ে নাফিসাকে এমন খোচা দিয়ে কথাটা নাও বলতে পারতো সে! কথা সংক্ষেপ করতে নিশাত বললো,
– আপু, চলোতো! অযথা কথা বাড়িয়ো না!
– আমি কথা বাড়াই! খুব ভালো পক্ষ নিয়ে কথা বলতে পারিস এক একজন! আর আমিই সবার চোখে খারাপ!
রাগান্বিত হয়ে জেরিন বেরিয়ে গেলো। নাফিসাও ঠাস করে আবার দরজাটা চাপিয়ে দিলো। খাবারদাবার ঠিক করে ইমরানের সামনে দিয়ে সে আবার শুয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুত। ইমরান বললো,
– তুমি খাবে না?
নাফিসা কোনো জবাব দিলো না। চুপচাপ শুয়ে আছে। তাকে শুনিয়ে ইমরান নিজের সাথেই বলতে লাগলো ,
– সকালে মা খায়িয়ে দিয়েছে, দুপুরে বড়মা খায়িয়ে দিয়েছে। কারণ তো একটাই, ডান হাতটা যে মচকে গেছে! কিন্তু এখন কি যে করি! পেট তো গুরুম গুরুম করছে! আবার ওষুধও খেয়ে হবে!
হঠাৎ করেই নাফিসা বলে উঠলো,
– শান্তি দিবেন না নাকি একটু! সবসময় আমাকে জ্বালাতন করে খুব মজা পান!
– সরি? আমি তো তোমাকে কিছু বলিনি!
নাফিসা রাগান্বিত হয়ে উঠে বসলো। হাত ধুয়ে প্লেট হাতে নিয়ে ভাত মাখতে লাগলো। এক হাতে ভাত মাখছে আর অন্যহাতে ওড়না দ্বারা চোখ মুছছে! ইমরান তাকিয়ে শুধু দেখছে তাকে! আর এদিকে নাফিসার খুব অসস্তি লাগছে! ছোট বাচ্চাদের খায়িয়ে দেওয়া যায় কিন্তু এতো বড় লোকের ক্ষেত্রে সেটা কিভাবে সম্ভব! তবুও কাপা কাপা হাতে লোকমা তুলে ধরলো ইমরানের মুখের সামনে। ইমরান বললো,
– ডাক্তার বলেছে লবন মরিচ ঠিক পরিমানে খেতে। দেখতো তো আছে কি-না!
– আপনি এখন খাবেন নাকি খাবেন না?
– একের পর এক এমন ধমকি দিলে তো ক্ষুধা এমনিতেই মজে যাবে! তুমি আগে মুখে দাও তারপর আমি খাবো।
– কোনো প্রয়োজন নেই তো! আপনাদের কথাবার্তা শুনেই আমার পেট ভরে যায়। তাছাড়া খাবার আমার গলা দিয়ে নামবে না।
– তাহলে কিন্তু আমি খাবো না।
– না খেলে নাই!
নাফিসা প্লেট রেখে হাত ধুয়ে নিলো। এ যে অসম্ভব জেদী! তাই ইমরান আবার বললো,
– আমার ওষুধ খেতে হবে।
– তো আমি কি করবো!
ইমরান তার হাত ধরে টেনে নিজের কাছে বসিয়ে দু-হাতে জড়িয়ে ধরে বললো,
– এমন কেন করছো তুমি! ভালো খারাপ মিলেই তো এই জগৎ। সেখানে এসব আলতু ফালতু বিষয় নিয়ে নিজের ক্ষতি করা কি বোকামি না? নিজে একটু ইজি হও, দেখবে সব ঠিক আছে। আমি তো জানিই তুমি একজন সাহসী মেয়ে। পরিস্থিতি সামলে নিতে খুব ভালো জানো। তবে এতোটা রিয়েক্ট করছো কেন! আর আমার এতে কি দোষ আছে সেটা বল, যার কারণে আমার সাথেও এতো রাগ দেখাচ্ছো! নিজের তো ক্ষতি করছোই আমারও বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছো। এতো নড়াচড়া করছো কেন? আমার হাতে ব্যাথা তো!
প্রথমে ছোটার জন্য চেষ্টা করলেও এখন থেমে গেছে নাফিসা। পারতো জোরাজুরি করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে। কিন্তু ইমরান অসুস্থ হওয়ায় করেনি সেটা। তাছাড়া তারই বা কি দোষ! তা ভেবে অবশেষে ইমরানকে আকড়ে ধরেই আরও জোরে কান্না করে দিলো সে! কাদতে কাদতে কিছু বলছেও সে কিন্তু কি বলেছে তা অস্পষ্ট! তবে ইমরান এটা বুঝতে পেরেছে তার মনের কষ্টটাই কান্নার সাথে প্রকাশ করছে। কয়েক মিনিট কান্নার পর ইমরান যথাসম্ভব তাকে শান্ত করলো। এবং দুজনেই খেয়ে নিয়েছে। অত:পর প্লেট ধুয়ে নিজেই চুপচাপ রেখে এসেছে বড়ঘরে। বহু প্রতিক্ষার পর আজ রাত ইমরান অভিমানী নাফিসার মাথা বুকে জড়িয়ে কাটাতে পেরেছে!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here