“তৃ-তনয়া” পর্ব- ৭২

0
2577

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৭২
(নূর নাফিসা)
.
.
নাহিদা বাসায় ফেরার পাচ সাত মিনিট পরেই মেহেদী ফিরেছে। গাড়ি নিয়ে এসেছে তবুও তার পরে! কোনোদিকে গিয়েছিলো হয়তো। নাহিদা শাড়ি চেঞ্জ করে শুকনো কাপড়চোপড় এনে গুছিয়ে রাখছিলো। মেহেদী হনহন করে রুমে প্রবেশ করেছে। ঘড়ি ও ব্রেসলেট খুলে এক প্রকার ঢিল মেরে ফেললো ড্রেসিং টেবিলের সামনে! অত:পর শার্টের বোতাম এমনভাবে খুলছে যেন ছিড়ে ফেলবে! নাহিদা আড়চোখে তাকিয়ে লক্ষ্য করেছে বিষয়টি। এটাও লক্ষ্য করেছে গাড়িতে তার চোখে সানগ্লাস দেখেছিলো কিন্তু রুমে প্রবেশ করার সময় তার চোখে সানগ্লাস ছিলো না! রেগে ভেঙে এসেছে নাকি রাস্তায়!
নাহিদা ভাবতে ভাবতে এদিকে দেখলো মেহেদী ঘামে ভেজা শার্ট মুড়ে ওয়ারড্রবে রেখে দিলো! পরক্ষণে প্যান্টের পকেট থেকে সানগ্লাস ও ফোন বের করে ওয়ারড্রবের উপর রেখে টিশার্ট আর ট্রাউজার নিয়ে বাথরুমে চলে গেলো।
সন্ধ্যায় সকল কাজকর্ম শেষ করার পর জহিরুল ইসলাম নাহিদাকে অফিসের কার্যাদি সম্পর্কে অনেক কিছু জানালেন। আর এটাও বললেন সপ্তাহে তিনদিন যেন ক্লাস করে আর ভালো লাগলে বাকি দিন গুলো অফিসে কাটাবে। নাহিদা তার পরামর্শে একমত হলো।
প্রতিদিনের মতো আজও মেহতাজের রুমে ঘুমিয়েছে নাহিদা। অশ্রুতে ভিজিয়েছে বালিশ! দিনশেষে ক্লান্ত চোখে ঘুমের আগে কষ্টগুলো সব নেমে আসে। ভুলতে পারে না কোনোমতে! সংঘটিত ঘটনা গুলোকেই যেন আঁকড়ে ধরে বেচে থাকতে হবে তাকে!
দুদিন পর জহিরুল ইসলাম অফিস গিয়েছেন। গত দিনগুলোতে নাহিদা একা রিকশা করে গেলেও আজ গাড়িতে যাচ্ছে। মেহেদী ড্রাইভ করেছে। সময়টা কেটেছে সম্পূর্ণ নিরবতায়! কেননা মেহেদীর সাথে কোনো কথা নেই কারো! অফিসে এসে জহিরুল ইসলাম নিজে নাহিদাকে কাজকর্ম শিখিয়েছেন। তিনি ছেলের উপর ভরসা করতে পারবেন না কিন্তু নাহিদার মাঝে তিনি প্রচেষ্টা দেখে আনন্দিত! মেয়েটার জীবন এমনিতেই নষ্ট করে দিয়েছে, এবার তাকে নিজস্ব একটা অবস্থানে বসিয়ে দিতে পারলে তিনি শান্তি।
কেটে গেছে আরও এক সপ্তাহের মতো! এর মাঝে জহিরুল ইসলাম তিনদিন গিয়েছিলেন অফিসে। সেদিনের পর থেকে মেহেদী নাহিদার সাথে একেবারেই কথা বলে না। কোনো প্রয়োজন হলে ম্যানেজারকে দিয়ে বলিয়ে নেয়।
লাঞ্চের পর মেহেদী তার ডেস্কে এসে কাজে ব্যস্ত। কথা না বললেও লক্ষ্য করেছে নাহিদা লাঞ্চ করার জন্য ক্যানটিনে যায়নি আজ। কিন্তু মেহেদী তা নিয়ে মাথা ঘামালো না। একজন স্টাফ এসে মেহেদীকে ফাইল সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস করলে মেহেদী বলে দিলো,
-আমি ব্যস্ত, ম্যানেজারকে দেখান।
– স্যার তো নিচে গেছেন।
– তাহলে মেডামকে দেখান।
লোকটা কেবিনের দিকে চলে গেলো। প্রবেশ করেছে দৃঢ় পায়ে কিন্তু বেরিয়ে এলো দৌড়ে!
– স্যার, মেডাম মেঝেতে পড়ে আছে!
– কেন, চেয়ারে জায়গা কম ছিলো!
লোকটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছে মেহেদীর কথায়! পরক্ষণে আবার বললো,
– স্যার, মেডাম মনে হয় সেন্সলেস হয়ে পড়ে আছে।
মেহেদী ফাইল থেকে দৃষ্টি সরিয়ে লোকটার দিকে ব্রু কুচকে তাকালো! এবং বললো,
– মানে!
– না, মানে যেভাবে পড়ে আছে তা দেখে আমার মনে হলো আরকি।
মেহেদী ফাইল রেখে উঠে এবার দ্রুত পায়ে কেবিনে চলে এলো সাথে সেই লোকটা এবং তাদের কথপোকথন শুনে পাশের ডেস্কের দুজনও উঠে এসেছে। নাহিদাকে টেবিলের কোনের কাছে পড়ে থাকতে দেখে মেহেদী দরজার কাছ থেকে দৌড়ে এলো। মেঝেতে হাটু ভেঙে বসে নাহিদার মাথাটা ঝাকিয়ে ডাকলো। সাথে আসা মেয়ে স্টাফটা গ্লাসের পানি এনে মেহেদীর হাতে দিলো। মুখে পানি ছিটিয়ে মেহেদী আরও দু-তিনবার ডাকতেই নাহিদা নিভু নিভু চোখে তাকালো। পরক্ষণে আবারও চোখ বন্ধ হয়ে গেছে! চোখে মুখে দুর্বলতার ছাপ স্পষ্ট! সকালেও খেতে দেখেনি, দুপুরেও খেতে যায়নি। যার ফলে দুর্বল হয়ে পড়েছে! মেহেদী ভয় পেয়ে গেছে তার বর্তমান অবস্থা দেখে! বাকিরা বলছে হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার জন্য। মেহেদী তা-ই করলো। নাহিদাকে নিয়ে মেয়ে স্টাফের সাহায্যে উঠিয়ে এবং হাটিয়ে লিফটে উঠলো। এবং সেই স্টাফকে সাথে নিয়েই হসপিটাল চলে এলো। কেননা সে ড্রাইভ করেছিলো তাই নাহিদার পাশে কাউকে প্রয়োজন ছিলো।
নাহিদা কেবিনে আর দুজন বাইরে অপেক্ষা করছে। ডাক্তার চেকাপ করে বেরিয়ে এসে বললো,
– উনি কি হয় আপনার?
– ওয়াইফ।
– আপনার ওয়াইফ প্রেগন্যান্ট। কিন্তু উনার শরীর অতি দুর্বল। আমি স্যালাইন দিয়েছি এখন। খাওয়াদাওয়ার প্রতি একটু বেশি লক্ষ্য রাখতে হবে। এমনিতেই আশপাশের যা অবস্থা, ভালো মানুষও টিকে না। আপনাদেরও সচেতন থাকা প্রয়োজন।
– ওকে। বাসায় নিয়ে যেতে পারবো না?
– হ্যাঁ, স্যালাইন শেষ হলেই নিয়ে যাবেন।
ডাক্তার চলে গেলো। মেয়ে স্টাফটা মেহেদীকে অভিনন্দন জানিয়ে নাহিদার কাছে কেবিনে চলে গেলো। আর মেহেদী একজায়গায়ই দাড়িয়ে আছে। ভেতরটা কেন জানি চিনচিন ব্যাথা করছে! এটা আসলেই ব্যাথা নাকি সুখ, বুঝতে পারছে না সে! কিন্তু অনুভব করতে পারছে কিছু একটা!
ফোনটা হাতে নিয়ে সময়টা দেখলো মেহেদী। পরক্ষণে কেবিনে এসে দেখলো মেয়েটা নাহিদার সাথে কথা বলছে। মেহেদী বললো,
– সাবিহা, অফিস চলে যান আপনি। আমি ওকে বাসায় রেখে তারপর যাবো।
– ওকে, স্যার।
মেহেদী একশো টাকার একটা নোট তার হাতে ধরিয়ে দিলো রিকশা ভাড়ার জন্য। মেয়েটি চলে গেলে মেহেদী নাহিদার পাশে এসে বসলো। নাহিদা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। মেহেদী তার দু’পাশে বেডে দুহাত রেখে তার দিকে একটু ঝুকে বললো,
– অভিনন্দন, বাবুর আম্মু।
নাহিদা দাত চেপে চোখের পাতা বন্ধ করে দুচোখে দুই ফোটা পানি ফেললো। পরক্ষণে এক হাতে চোখের ধার মুছে মেহেদীর দিকে তাকিয়ে বললো,
– আজ বলবেন না, বাচ্চা আশিক কিংবা অন্য কারো?
এইমুহূর্তে এমন কথা শুনে মেহেদীর চোখ জোড়া বড় আকৃতির হয়ে গেছে! সে ধমকের সুরে বললো,
– নাহিদা!
নাহিদা আবার অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো এবং বললো,
– সেদিন তো খুব ভালো করেই অপবাদ দিতে পেরেছেন। তাহলে আজ কেন নয়? আজও বলুন, আমি শোনার জন্য প্রস্তুত আছি। সেদিনও মুখ বুজে সহ্য করে নিয়েছি আজও নেবো!
মেহেদীর রক্ত যেন আগুন হয়ে সর্বাঙ্গে চলাচল করছে! না পারছে কিছু বলতে আর না পারছে সইতে! বসে বসে নাহিদার কান্নাও দেখতে পারছে না! সে উঠে জানালার দিকে চলে এলো। ফোনটা বেজেই চলেছে! সে হাতে নিয়ে রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে মেহেরুন ইসলাম বললো,
– মেহেদী? কি হয়েছে নাহিদার?
– তোমাকে কে বললো?
– ম্যানেজার কল করলো তোর আব্বুর কাছে! কি হয়েছে? এখন কেমন আছে?
– এখন ভালো আছে। আর তেমন কিছু হয়নি, তবে হবে।
– হবে মানে!
– হঠাৎ সেন্সলেস হয়ে পড়েছিলো। হসপিটালে এনে জানতে পারলাম নাহিদা প্রেগন্যান্ট।
ওপাশ থেকে আর কোনো শব্দ শোনা গেলো না! সবটা নিরব! যার মর্মার্থ মেহেদীর বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে! তার আম্মু কি জেনে খুশি হয়নি! এভাবে চুপ হয়ে গেলো কেন! সে কিছুটা বিস্মিত হয়ে বললো,
– আম্মু?
ওপাশ থেকে খুব শান্ত গলায় মেহেরুনের কন্ঠে ভেসে এলো,
– বাসায় ফিরবি কখন?
– স্যালাইন লাগানো হয়েছে, ওটা শেষ হলেই বাসায় ফিরবো।
মেহেরুন সাথে সাথেই কল কেটে দিলো। মেহেদীর ভেতরে যেন একের পর এক যন্ত্রণা চেপে যাচ্ছে! সবদিক থেকে এতো যন্ত্রণাময় চাপ কেন আসছে তার উপর! না জানি কভু সে পাগলই হয়ে যায়! একটা ভুলের জন্য কি তাকে এভাবেই প্রায়শ্চিত্ত করে যেতে হবে!
ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখলো নাহিদা তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। এইমাত্র দৃষ্টি সরিয়ে নিয়েছে। ছোটখাটো এক নিশ্বাস ছেড়ে আরও কিছুক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে রইলো। পরক্ষণে ডাক্তারের সাথে কথা বলে তাকে নিয়ে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে এলো। মেহেদী তাকে ধরলে নাহিদা হাত সরিয়ে দিয়েছিলো। এবং একা একা হেটে আসার চেষ্টা করেছিলো। সেই মুহুর্তে প্রচুর রাগ হলেও মেহেদী রাগ কন্ট্রোল করে নাহিদার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই তাকে ধরে হেটে হেটে বেরিয়ে এলো। গাড়িতেও সামনের সিটে বসিয়ে সিট বেল্ট পড়িয়ে দিলো। বাসায় ফিরে দেখলো মেহতাজ এসেছে। নাহিদাকে অসুস্থ ব্যক্তির ন্যায় হেটে আসতে দেখে মেহেরুন এগিয়ে এলো এবং তাকে ধরে নিয়ে রুমে বসালো। মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
– এখন কেমন আছিস, মা?
– ভালো।
– পড়ে গিয়ে কি ব্যাথা পেয়েছিস খুব?
– বাঁ হাতের দিকে একটু লেগেছে। তেমন কিছু হয়নি।
তাদের পিছু পিছু রুমে এসে মেহেদী বললো,
– আম্মু, ওর শরীর অনেক দুর্বল। দুপুরেও খায়নি কিছু। খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো করতে বলেছে ডাক্তার আর সবদিক থেকেই সচেতন থাকতে বলেছে।
মেহেরুন কিছু বললো না তার কথার প্রেক্ষিতে। টেবিলের কাছে এসে এক গ্লাস পানি খেয়ে মেহেদী বেরিয়ে গেলো অফিসের জন্য। আয়াশ দৌড়ে এসে খাটে লাফিয়ে উঠলো এবং নাহিদার কাছে বসে বললো,
– তোমার কি হয়েছে মামি?
– কই, কিছু হয়নি তো!
মেহতাজ এসে বললো,
– আয়াশ, বাইরে যাও। মামি অসুস্থ।
– মামা চলে গেলো কেন?
– মামার অফিসে কাজ আছে। আরিশার কাছে যাও। কার্টুন দেখছে আরিশা।
আয়াশ চলে গেলো। মেহতাজ নাহিদার কাছে বসে বললো,
– কেমন আছো এখন?
– আলহামদুলিল্লাহ।
– তোমাদের আরেকটু সময় নেওয়া প্রয়োজন ছিলো। অন্তত অনার্সটা কমপ্লিট করতে!
নাহিদা দৃষ্টি নিচের দিকে নামিয়ে নিলো। মেহতাজ আবার বললো,
– মেহেদী কিন্তু বাচ্চাদের অনেক ভালোবাসে। তোমাদের মাঝে কি আদৌ ঠিক হয়েছে কিছুটা?
নাহিদা মাথা নিচু করে রেখেছে। কোনো জবাব নেই তার কাছে! কি বলবে! এমন প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো কি কোনো জবাব আছে তার কাছে! নাহিদাকে চুপ থাকতে দেখে মেহতাজ বললো,
– নতুন কিছু ঘটতে চলেছে। একটা সংসার পরিপূর্ণ হয় সন্তানসন্ততি নিয়ে। তোমাদের সংসারও পরিপূর্ণ হতে যাচ্ছে। এবার সুধরে নাও সবটা।
নাহিদা চাপা কান্নার সাথে কম্পিত কণ্ঠে বললো,
– শুধরেই তো নিয়েছিলাম আপু! কই, সেটা তো আর স্থির হলো না! ক্ষণিকের শুধরানো!
মেহতাজ আর কোনো কথা বললো না। মেহেরুনও নিশ্চুপ! কে কি বলবে, ঠিকই তো! নাহিদা তো গোপন রেখে একা একা চেষ্টা করেছিলো তাকে শুধরে নেওয়ার। কিন্তু সে তো শুধরালো না নিজেকে! নাহিদার চোখ থেকে টুপটাপ পানি পড়ছে। মেহেরুন বেরিয়ে গেলো। মেহতাজ প্রসঙ্গ পাল্টে প্রেগ্ন্যাসি সম্পর্কে কিছু পরামর্শ দিলো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here