“তৃ-তনয়া” পর্ব- ৭৩

0
2594

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৭৩
(নূর নাফিসা)
.
.
রাতে খাওয়ার পর মেহতাজ মেহেদীকে তার রুমে ডাকলো। মেহেদী এসে বসলো। মেহতাজ বললো,
– মাতাল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবি না পরিবার সামলে নিবি?
এমন প্রশ্নে মেহেদী বিরক্তি নিয়ে তাকালো বোনের দিকে! মেহতাজ আবার বললো,
– এখনো ছোট রয়ে যাসনি যে কদমে কদমে তোকে বোঝাতে হবে! যথেষ্ট জ্ঞান আছে তোর। ক’দিন পর বাবা বলে ডাকবে কেউ আর তোকেই বুঝিয়ে দিতে হবে তোর সন্তানকে কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ! কোনটা উচিত আর কোনটা অনুচিত! এখনো যদি নিজেকে আর তোর পরিবারকে না সামলে নিতে পারিস আর নিজেই অবুঝ সেজে বসে থাকিস তাহলে কিভাবে হবে! আগে যা করেছিস পরে আর তা করার চিন্তা করিস না। তোর একটা ভুলের জন্য আজ কতগুলো সম্পর্ক নষ্ট হতে চলেছে। আগেও বলেছিলাম, এখনো বলছি, শুধরে নে নিজেকে। তোর জীবনের সাথে সংযুক্ত এতোগুলা জীবনকে কষ্ট দিস না এভাবে। সবাই প্রিয়জনের ভালোটা চায় এবং প্রিয়জনের কাছ থেকে ভালো কিছু প্রত্যাশা করে। তুই ভালো হলে অনেকগুলো জীবন নিশ্চিন্তে কাটবে, অনেকগুলো প্রাণ শান্ত হয়ে ঘুমাতে পারবে। অশ্রু মুছে তারা আবারও হাসতে জানবে। যদি তুই একটু সুখ এনে দিস তো..
– কি করে আনবো সুখ? এটা কি প্যাকেট আকারে বিক্রয় করা হয়? যে কিনে এনে ঘরে রেখে দিলাম! কি করে ভালো হবো আমি, বলো তো? সেদিনের পর থেকে আব্বু একটা শব্দও বলে না আমার সাথে, দেখলেই যেন মুখ ফিরিয়ে নেয়! আম্মু যেন বাধ্য হয়ে আমার সাথে একটু আধটু কথা বলে! যেন কথা না বলতে পারলেই ভালো হতো উনার কাছে! বউ কথা বলে না, চোখের সামনে পড়লেই যেন আমি পোকা হয়ে তার চোখে পড়েছি! একই রুমে থাকতেও পারে না আমার সাথে! প্রতিদিন তোমার রুমে এসে ঘুমায়! আবার অফিস যাওয়া শুরু করেছে যেন অনাহারে মারা যাচ্ছে তাই তাকে উপার্জনে নামতে হবে! আব্বু আম্মুও কি সুন্দর তার সাপোর্টার হয়ে দাড়িয়েছে! ছেলে থাকতে ছেলের বউকে অনুপ্রাণিত করে তুলেছে রোজগার করার জন্য! আমি না থাকলেই যেন তারা শান্তি পেতো! কেউ সহ্যই করতে পারে না আমাকে! আমিও তো মানুষ, নাকি? মানুষ কি ভুল করে না? একটা ভুলের জন্য কতবার ক্ষমা চেয়েছি আব্বু আম্মুর কাছে, কই? কেউ কি করেছে আমাকে ক্ষমা? তাদের কাছে ভালো হওয়ার একটুও কি সুযোগ পাচ্ছি আমি? এতো অবহেলার মধ্যে কিভাবে আমি ভালো থাকবো আর কিভাবে সুখ এনে দিবো সংসারে, বলো?
– তোর ছোটখাটো ভুল গুলোকে তো আব্বু আম্মু কখনোই ভুল বলে গন্য করেনি! এটা তো প্রকটভাবে আঘাত করেছে, এতো সহজেই কি ক্ষমা পেয়ে যাবি তুই? না জানি আবারও সেই ভুল করে বসবি তা কে জানে! তোর উপর থেকে তো বিশ্বাসটাই উঠে গেছে! বাধ্য হয়েছে নাহিদাকে অফিসে নিযুক্ত করতে! কি করবে, তোর উপর একবার ভরসা করে তো মেয়েটার জীবন নষ্ট করে দিয়েছে! সেই ভেবে তাকে একটা সম্মানিত জায়গায় বসাতে চাইছে বাবামা। আর সুযোগের কথা বললি না? সুযোগ তুই কখনোই পাবি না। সুযোগ তোকে তৈরি করে নিতে হবে। যদি ভালো হওয়ার চেষ্টা থাকে তো সকলের মনে নতুন করে জায়গা করে নে। দ্বিতীয় বার বিশ্বাস ভেঙে দিস না আবার। পাকাপোক্ত ভাবে বিশ্বাস স্থাপন কর। সন্দেহ নিয়ে কখনো সংসার সুখী হয় না সেটা জানিস তো? তোর এই সন্দেহের জন্যই বৃহৎ আকৃতির ধ্বংসের প্রভাব পড়েছে! নিজেকে নিয়ে মিথ্যে অপবাদ কারোই সহ্য হয় না। তোরও হবে না। ওসব ভেবে এখন লাভ নেই। যদি ভালো হতে চাস তো এটা মনে রাখ বাবা-মা, স্ত্রী, সন্তান সবার দায়িত্ব এখন তোর হাতে। ভেবে দেখিস আমার কথাগুলো।
মেহেদী নিশ্চুপ হয়ে বেরিয়ে এলো রুম থেকে। হাটতে হাটতে রুমের বাঁ দিকে ফাঁকা রুমটা তে এসে দু’হাতে জানালার গ্রিল আঁকড়ে ধরে দাড়ালো। ঘড়ির কাটা হয়তো এগারোটার কাছাকাছি। বাইরে অন্ধকারে ঢাকা ভুবন! যদিও উঁচু নিচু ভবনে ভবনে বৈদ্যুতিক বাতিতে আলোকিত হয়ে আছে তবুও তা প্রকৃতির অন্ধকার কাটাতে সক্ষম নয়। বিনা আভাসে মনের সাথে আজ প্রকৃতি বন্ধুত্ব করে ফেলেছে। খুশির খবর পেয়েও আজ মানব মনে অন্ধকার ছেয়ে আছে, শত শত বাতি পেয়েও প্রকৃতির অন্ধকার ঠিকই রয়ে গেছে! বাতাসটা দেহ ঠান্ডা করতে পারলেও ভেতরটা ঠান্ডা করতে পারেনি! আজ এমন কেন লাগছে! এতো বছর কেটে গেলো কষ্ট কি জিনিস তা তো উপলব্ধিও করতে পারেনি। আজ কেন এতো কষ্ট এসে ভীড় জমিয়েছে! দেহ রোগাক্রান্ত হলে তো মেডিকেল ট্রিটমেন্ট আছে কিন্তু মনে! এ কেমন রোগ, যার কোনো মেডিকেল ট্রিটমেন্ট নেই!
নাহ! এভাবে তো চলতে দেওয়া যায় না! সবটা মিটমাট করে পূর্বের ন্যায় হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করবে। তার জন্য পরিস্থিতি এতোটা গম্ভীর হয়ে গেছে সুতরাং তাকেই আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে।
মাথায় ও চোখে মুখে হাত বুলিয়ে রুমে এলো মেহেদী। খাটে হেলে বসা নাহিদা পলকহীন তাকিয়ে আছে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় নিজের দিকে! দুই গাল ভিজে আছে অশ্রুতে। মেহেদী যে রুমে এসেছে সেই খেয়ালও নেই। সে পুরোপুরিভাবে অন্যমনস্ক হয়ে আছে! মেহেদী দরজা লক করে ফোনটা ড্রেসিং টেবিলে রাখলো। এতোক্ষণে নাহিদার ভাবনার ছেদ ঘটেছে! ফোন রেখে মেহেদী বাথরুমে চলে গেছে। তখন নাহিদাকে বসা অবস্থায় দেখলেও এখন বাথরুম থেকে বেরিয়ে শুয়ে থাকতে দেখলো৷ লাইট অফ করে মেহেদী নাহিদার গা ঘেঁষে শুয়ে পড়লো এবং নাহিদাকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিতে চেষ্টা করলো। হঠাৎ এমন কিছুতে নাহিদা আৎকে উঠেছে! সে মেহেদীর হাত সরিয়ে দিলো। উঠার চেষ্টা করতেই বহুদিন পর মেহেদী তার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই কোলবালিশ ন্যায় হাতে পায়ের বন্ধনে বেধে ফেললো! নাহিদার ছোটার জন্য আপ্রান চেষ্টা চলছেই! সাথে নীরব কান্না! মেহেদী এক হাতে অশ্রু মুছে দিতে দিতে বারবার বলতে লাগলো “সরি, সরি ফর এভরিথিং”। কানের নিচে ঠোঁটের স্পর্শ পড়তেই নাহিদার মুখে উচ্চারিত হলো, “ছি! আপনার ভুল হচ্ছে মিস্টার! আমি কোনো মাদকদ্রব্য নই! আর না কারো ব্যবহার যোগ্য গার্লফ্রেন্ড!”
কথাটি আঘাত হেনেছে মেহেদীর মনে! ড্রিম লাইটের আলোতে রুমে আবছা আলো আর আবছা অন্ধকার। মেহেদী নাহিদার চোখের দিকে তাকিয়ে বেশ নরম গলায় উচ্চারণ করলো, “নাহিদা!”
হাত পায়ের বাধন হালকা হয়ে আসায় নাহিদা তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বিছানা ছেড়ে নামতে নামতে কান্নার সাথে বললো,
– আই হ্যাট ইউ! আই হ্যাট ইউর টাচ! হ্যাট ইউর এভ্রিথিং!
নাহিদা কাদতে কাদতে ড্রেসিং টেবিলে হেলে বসে পড়লো! আর মেহেদী খাটে বসে আছে! দুতিনমিনিট নীরব থেকে নাহিদার উদ্দেশ্যে বললো,
– সরি বললাম তো সবকিছুর জন্য! আমার এসব একদম ভালো লাগছে না! আমাদের সবাইকেই স্বাভাবিক হওয়া প্রয়োজন! আগের মতো লাইফটা এনজয় করতে চাই।
– হ্যাঁ, করুন না! নিষেধ করলো কে! আগের মতো গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ঘুরে বেড়ান, বন্ধুদের সাথে মাদক আড্ডায় মেতে উঠুন! আর বাবা-মাকে আবার কষ্ট দিন! আমাকে আবারও হাজার হাজার মিথ্যে অপবাদ দিন। নিষেধ করছে না তো কেউ!
– নেগেটিভে নিয়ে যাচ্ছো কেন! একটু পজেটিভ হও। আমি আর কোনো খারাপ কাজে জড়িত হতে চাচ্ছি না! একবার বিশ্বাস করো, নিজেকে পুরোপুরিভাবে শুধরে নেব।
– বিশ্বাস! তাও আবার আপনাকে! হুহ! আমিও মানুষ! কষ্ট আমারও হয়! বারবার ধোকা খেতে কে চায় বলুন তো? আর আপনার সাথে কথা বলতেই আমার রুচিতে বাধে! সেখানে বিশ্বাস কিভাবে করা যায়!
– অপ্রত্যাশিত ঘটনা গুলো ভুলে যাও না! আবার না হয় সবটা নতুন করে গুছিয়ে তুলি।
– সম্ভব না। সম্ভব না আপনার সাথে এক মুহুর্তেও থাকা! শুধুমাত্র মা বাবার মুখ চেয়ে এখনো আমি এই অবস্থানে আছি! যদি পারতাম তো যন্ত্রণাময় জীবনটাই শেষ করে দিতাম! আপনার এই স্পর্শ আমার দেহে আগুন হয়ে জ্বালা করে! যদি পারতাম তো স্পর্শ করা স্থান কেটে কেটে নিজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতাম! শুনতে পেয়েছেন কি! এতোটা ঘৃণা করি আপনাকে!
মেহেদী রেগে ঝটপট রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। আর নাহিদা কাদতে কাদতে ফ্লোরে বসে পড়েছে! না চাইতেও মুখ থেকে যা তা উচ্চারণ করতে বাধ্য হচ্ছে সে! একদমই ভুলতে পারে না মেহেদীর কথা ভঙ্গ করার বিষয়!
এক সময় নিজে শান্ত হয়ে একটা বালিশ নিয়ে ফ্লোরে শুয়ে পড়লো। না চাইতেও কষ্টগুলো স্মরণ করতে করতে ক্লান্ত চোখে ঘুম নেমে এসেছে। ফজরের আযান পড়লে ঘুম ভেঙে গেছে তার। বিছানায় তাকিয়ে মেহেদীর দেখা পায়নি আর! নামাজ পড়ে বাইরে এসে ড্রয়িং রুমে চোখ পড়তেই দেখলো কুশন কোলে নিয়ে আঁকড়ে ধরে সোফায় ঘুমাচ্ছে মেহেদী! সারারাত কি এখানেই থেকেছে! কারো উপস্তিতি টের পেয়ে পেছনে ফিরে দেখলো মেহতাজও তাকিয়ে আছে ঘুমন্ত মেহেদীর দিকে। পরক্ষণে নাহিদার দিকে একবার তাকিয়ে আবার চলে গেলো কিচেনের দিকে।
নাস্তা শেষে নাহিদা অফিসের জন্য তৈরি হচ্ছে। কাল অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো বিধায় মেহেরুন নিষেধ করেছিলো। কিন্তু সে আজ সুস্থতার সাথে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করলো। মেহেদী রুমে তাকে একা পেয়ে বললো,
– অফিস যাবে না তুমি। আমি একাই সামলে নিতে পারবো সবটা।
নাহিদা কোনো জবাব দিলো না। সে তার কাজ করেই যাচ্ছে! মেহেদী তার পাশে এসে তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বললো,
– এতোটা ইগনোর করছো কেন! আমার কথা না-ই ভেবো, বেবির কথা একবার ভাববে না?
– যা ভাবার সব ভেবে নিয়েছি। আমাদের নিয়ে আপনাকে না ভাবলেও চলবে।
– একটু বেশি বেশি করছো না?
– হয়তোবা।
– নাহিদা, আমি বারবার একই কথা বলে যাচ্ছি। এতোটা এভোয়েড ঠিক না! একটা বার বুঝতে চেষ্টা করো আমাকে। আমি থাকতে প্রয়োজন নেই তো তোমার কোনো কাজ করার! তোমার কি প্রয়োজন হয় সেটা আমাকে বলো। এমনতো নয় যে আমি তোমাদের প্রয়োজন মেটাতে অক্ষম!
– আপনি বরং আপনার প্রয়োজন মেটান। আর কাজের প্রয়োজনীয়তার কথা বললেন না? আমার খুবই প্রয়োজন আছে কাজের! এখন আমি একা নই। ঘরে দুজন পিতামাতা আছে তারা আমাকে বিশ্বাস করে বিধায় তাদের কথা আমাকে ভাবতে হবে। আমার সন্তান আসতে চলেছে, একজন মা হওয়া সত্ত্বে আমাকে তার কথাও ভাবতে হবে। খুবই প্রয়োজন আমার উপার্জনে। আমার এতো প্রয়োজন মেটানোর প্রচেষ্টায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করবেন না প্লিজ! যদি মানুষ হয়ে থাকেন তো এইটুকু দয়া করুন অন্তত!
– বাহ! অতি সহজেই পর করে দিলে! সব আপন আর আমি পর! স্ত্রী নাকি পুরুষের কর্মের শক্তির উৎস হয়, আর এই তুমি আমার শক্তি উৎস হয়ে থাকছো! দারুন বলেছো! যাও, বাধা দিবো না তোমার কর্মে! আমি আর কার জন্য লড়ব! তুমিই উপার্জন করো আর আমি না হয় ঘরে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকি!
– সেটা সম্পূর্ণই আপনার ইচ্ছে!
মেহেদীর কথায় ভেতরটায় আঘাত হেনেছে ঠিকই তবুও নিজেকে কঠিন করে নাহিদা চোখ মুছে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। এতো ইমোশনাল কথায় কাজ হলো না তা দেখে মেহেদী ব্যর্থতার নিশ্বাস ছেড়ে নিজেও বেরিয়ে গেলো অফিসের জন্য। যদিও একটু আগে বলেছিলো সে ঘরে বসে থাকবে! তা কি আর হয়! তাকে যে সকলের মনে নতুন করে জায়গা করে নিতে হবে!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here