“তৃ-তনয়া” পর্ব- ৭৪

0
2353

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৭৪
(নূর নাফিসা)
.
.
আজ জহিরুল ইসলাম ও আয়াশ অফিস গেছে। যাওয়ার সময় সবাই একসাথে গেলেও আসার সময় মেহেদী আর নাহিদা একসাথে ফিরেছে। কেননা দুপুরে জহিরুল ইসলাম ও আয়াশ চলে এসেছে। নাহিদা বাসায় ফিরে দেখলো মেহতাজ চলে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। মেহেদী ফ্রেশ হয়ে আরিশাকে কোলে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে এসেছে সাথে আয়াশও। আর মেহতাজ গোছগাছ করছে। নাহিদা ফ্রেশ হয়ে তার কাছে এসে বললো,
– আপু, থাকো আরও কিছুদিন।
– না, আয়াশের পড়াশোনা মিস হচ্ছে।
– ভাইয়াকে আসতে বললে না?
– বলেছিলো তো আসবে। কি যেন কাজ পড়ে গেছে তাই জানিয়েছে আসতে পারবে না এখন। কিছু কথা ছিলো, বাবার রুমে এসো।
মেহতাজের পিছু পিছু নাহিদা জহিরুল ইসলামের রুমে এলো। মেহেরুনও এসেছে। মেহতাজ বললো,
– বাবা কিছু কথা ছিলো।
– হ্যাঁ, বলো?
– ছেলে তো তোমার একটাই। অবহেলা করে নিজেরাও কম কষ্ট পাচ্ছো না! আর তাকে শিক্ষা দিতেও একটু বেশিই ইগনোর করে যাচ্ছো সবাই মিলে! এবার একটু নরমাল হও।
– ওকে নিয়ে কোন কথা বলার প্রয়োজন নেই।
– যতই অভিমান নিয়ে থাকো, তার ভালোটা তো এখনো চাও। আমাদের চেয়ে কোনো কিছুই কম জানো না। তোমাদের দেওয়া শিক্ষা থেকেই তবুও বলছি, অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো না। বেশি চাপে আবার এমন না হয়ে যায় ভালোর জায়গায় জঘন্য খারাপ! আমার মনে হয় ওর শিক্ষাটা যথেষ্ট হয়েছে। তোমাদের অবহেলার মাধ্যমে এখন নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে আর নিজেকে খুব ভালো করেই সামলে নিচ্ছে। সে চায় সবটা সুন্দর স্বাভাবিক চলুক। এখন তো একটু কমিয়ে নিতে পারো অভিমানটা! অতি আস্কারা না ই বা দাও, কিন্তু স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে তো রাখতে পারো! আর কত! তোমাদের মানানোর চেষ্টা করতে করতে তো একসময় সে-ই অধৈর্য হয়ে যাবে! যখন আরও ভয়ানক পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হবে! নাহিদা, আমি কিন্তু শুধু বাবা-মাকে বলছি না কথাগুলো। তোমাকেও বলছি। আমরা সকলেই পরিবারের সুখটা কামনা করি। এভাবে এক একজন এক একদিকে মুখ ফিরিয়ে থাকলে অশান্তি তো কোনো দিনও শেষ হবে না!
– আমিও এটাই ভাবছিলাম আপু। আমারও মনে হচ্ছে হয়তোবা সে আর ওসব কাজে অগ্রসর হবে না। নিজেকে শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করছে। এখন স্বাভাবিক হওয়াটাই প্রয়োজন যদি বাবা মা চায় তো..
এরইমধ্যে কলিং বেল বেজে উঠলো। নাহিদা এগিয়ে এসে দরজা খুলে দিলো। আয়াশ আরিশা দুহাত ভর্তি চিপসের প্যাকেট নিয়ে এসেছে। নাহিদাকে দেখে আরিশা মেহেদীর কোলে থেকেই হাত বাড়িয়ে দিলো। নাহিদা হাসিমুখে তাকে কোলে নিয়ে রুমে এলো। মেহেদী একটা প্যাকেট ছিড়ে আরিশার হাতে ধরিয়ে দেওয়ার সময় মেহতাজ বললো,
– মেহেদী, আমাকে বাসায় পৌছে দিয়ে আয়।
– ব্যাগ গুছিয়েছো?
– হুম।
– এসো তাহলে। সন্ধ্যার আগেই যাও।
মেহতাজ বোরকা পড়ে বেরিয়ে গেলো মেহেদীর সাথে। মেহেদী তাদের বাড়িতে পৌছে দিয়ে আবার সাথে সাথেই চলে এসেছে বাসায়। সেদিনের পর থেকে আজ পর্যন্ত বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া বাইরে যায় না মেহেদী। ফ্রেন্ডের সাথে মাঝে মাঝে ফোনেই কথা বলে কিন্তু দেখা করে না। অফিস বাদে বাকিটুকু সময় বাড়িতেই কাটায়। নামাজও পড়ছে নিয়মিত। আজ রাতে খাওয়ার সময় জহিরুল ইসলাম অফিসের বিষয় নিয়ে কথা বলেছে মেহেদীর সাথে। মেহেদী অবাক হয়েছে বটে, তাছাড়াও জবাব দেওয়ার সময় তার গলা কেন জানি ধাধিয়ে আসছিলো। কেন তার এমন লাগছিলো সে জানে না! এমন অনুভূতি তার মাঝে আর কখনোই আসেনি! আজই প্রথম ছিলো! খাওয়ার পরপরই মেহেদী আজ সবার আগে মেহতাজের রুম লক করে দিলো! চাবি তার পকেটে! ভেবেছে নাহিদা আজ আবার মেহতাজের রুমে ঘুমাতে যাবে কিন্তু তা আর হলো না! নাহিদা একবারের জন্যও ওই রুমের সামনে যায়নি! সে কি দরজা লক করতে দেখে ফেলেছিলো নাকি! তা না হলে এখন একবারও গেলো না কেন! কাজকর্ম সেড়ে সোজা নিজেদের রুমে চলে এলো! মেহেদী এ নিয়ে ভাবছে আর ভাবছে! পরক্ষণে যখন দেখলো নাহিদা ঘুমানোর জন্য বিছানা গুছিয়ে প্রস্তুত হচ্ছে তখন সে বললো,
– এখন কি পড়তে বসবে?
দেখেছে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে তবুও জিজ্ঞেস করলো পড়ার কথা! এমন উল্টাপাল্টা কথপোকথনে নাহিদা কোনো মন্তব্য রাখলো না! শুধু মুখটা পেঁচার মতো করে তাকিয়েছিলো একবারের জন্য। মেহেদী ঝটপট আলমারি খুলে কিছু খুজে আবার ঝটপট ওয়ারড্রব খুলে ল্যাপটপটা হাতে নিলো। নাহিদা মাত্র শুয়েছে এমনি মেহেদী এসে তার পাশে বসে ল্যাপটপে ব্যস্ততা দেখিয়ে বললো,
– এই কাজটা কমপ্লিট করো তো! আজকের মধ্যেই করা প্রয়োজন। আগামীকাল মিটিংয়ে লাগবে। সময়ের স্বল্পতার কারনে করতে পারিনি আমি। এখনো আরও অনেক কাজ বাকি।
নাহিদা শুয়ে থেকেই বললো,
– কিসের কাজ?
– এক্সেলে কাজ করবে। কিছু হিসেবনিকেশ বাকি ছিলো। পেজটা কমপ্লিট করো। উঠো, আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।
– দেখিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। এক্সেলের কাজ আমি পারি।
– ওয়ার্কার্সের লিস্ট তো লাগবে নাকি? ওটা কি জানো?
নাহিদা আর কিছু না বলে উঠে বসলো। খাটে হেলান দিয়ে সে ল্যাপটপ নিলো। মেহেদী কাজ দেখিয়ে দিলে সে করতে লাগলো। ঘুম পেয়েছে প্রচুর, তবুও আর্জেন্ট হওয়ায় করতে হচ্ছে! আগে বললে তো সন্ধ্যায়ই করে রাখতো!
নাহিদার হাতে ল্যাপটপ ধরিয়ে দিয়ে ওদিকে মেহেদী আলমারি থেকে ফাইল নিয়ে ঘাটাঘাটি করছে। নাহিদা কাজ করতে করতে একটা বিষয় লক্ষ্য করেছে, মেহেদী কাজের ফাঁকে ফাঁকে ঘড়ি দেখছে। সে কি টাইম ধরে কাজ কমপ্লিট করে নাকি! বিষয়টা একটু ভেবে নাহিদাও একই কাজ করছে। প্রতি মিনিটের টার্গেট নিয়ে সে কাজের গতি বাড়িয়ে নিয়েছে। এবার মেহেদী তাকে লক্ষ্য করেছে! সে কয়েক মিনিট পরপর ঘড়ি দেখলেও নাহিদা প্রতি মিনিটে ঘড়ি দেখছে! যা দেখে মেহেদীর বুঝতে একটুও অসুবিধা হয়নি যে নাহিদা ঘড়ির সাথে তাল মিলিয়ে কাজ করছে। কিন্তু সে নিজে তো এজন্য ঘড়ি দেখছে না!
নাহিদার কর্মে মেহেদী মৃদু হেসে নিজের কাজে মনযোগ দিলো। ঘড়িতে সময় যখন এগারোটা উনষাট মিনিট, তখন মেহেদী খাট থেকে লাফিয়ে নেমে ছো মেরে নাহিদার হাত থেকে ল্যাপটপটা নিয়ে কাজ স্থির করে ওয়ারড্রবের উপর রেখে দিলো। সাথে তার হাতের ফাইল গুলোও। হঠাৎ এমন কান্ডে নাহিদা হতবাক! মেহেদী ঝটপট ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা প্যাকেট বের করে টেবিলের উপর রাখলো। যত দ্রুত সম্ভব বাক্সটা খুলে একটা বার্থডে কেক বের করলো! নাহিদার দৃষ্টি স্থির হয়ে গেছে কেকের উপর! চোখ দুটোও ছলছল করছে। মেহেদী নাহিদার হাত ধরে টেনে খাট থেকে নামিয়ে দাড় করালো। সময় এখন বারোটা এক মিনিট। নাহিদাকে কেকের সামনে দাড় করিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো, “হ্যাপি বার্থডে সুইটহার্ট। ইট’স বার্থডে শুড মোর স্পেশাল ফর আওয়ার বেবি। লাভ ইউ।”
অত:পর একটা হাত পেটে রেখে কাধে ঠোঁটের আলতো স্পর্শ দিয়ে আবারও বললো, “লাভ ইউ মোর!”
তখন তো বাবা মা ও বোনের সামনে ঠিকই বলেছিলো মেহেদীকে এবার স্বাভাবিকভাবে মেনে নিবে! কিন্তু এখন! এখন যে না চাইতেও বড্ড অসহ্য লাগছে তাকে! যখনই কাছে আসে, বারবার মনে পড়ে যায় সে কথা দিয়ে কথা রাখেনি! এই হাতে, এই মুখে সে মদ স্পর্শ করেছে! তার এই স্পর্শ দেহ সয়ে গেলেও যে মনে সইছে না! কি করবে সে! কি করা উচিত! একদমই অসহ্য লাগছে সব! এতোক্ষণে মেহেদী তার গলায় একটা চেইন থাকা সত্ত্বেও তার উপর আরও একটা লকেট ঝুলিয়ে দিলো! অত:পর ছুরিটা এগিয়ে ধরলো কেক কাটার জন্য। নাহিদা হাত মুঠিবদ্ধ করে রেখেছে! মেহেদীর হাসিমাখা মুখটা মলিন হয়ে গেলো! অত:পর সে নিজেই হাতে ছুরিটা চেপে দেওয়ার জন্য হাত টানতেই নাহিদা সরে এলো। এবং গলা থেকে চেইন খুলতে খুলতে বললো,
– কে বলেছে এসব ন্যাকামো করতে? বিরক্তিকর! যত্তসব ফাজলামো!
– আমি ফাজলামো করছি?
– তা নয় তো কি! এভাবে রাত বারোটা পর্যন্ত বসিয়ে রাখার কোনো মানে হয়! কে বলেছে আপনাকে এসব বার্থডে সেলিব্রেট করতে!
– কেক কাটবে না এখন?
– না।
কথাটুকু বলে নাহিদা লকেট খুলে মেহেদীর হাতে ধরিয়ে দিলো। মেহেদীর মেজাজ প্রচুর খারাপ হয়ে গেছে! সে লকেট ফ্লোরে ঢিল মেরে ফেলে বললো,
– এতো কষ্ট করে আমি এতো কিছুর আয়োজন করলাম আর এসব ফাজলামো বলছিস! কিসের এতো দাপট নিয়ে আছিস যে তোকে মানাতে হলে আমাকে যুগ যুগ ধরে তোর পিছু পিছু ঘুরতে হবে! এতো ঠেকা পড়েনি তোর পেছনে ঘুরার! যেখানে তোর মতো এমন হাজারটা মেয়ের লাইন পড়ে আমার পেছনে সেখানে তোর পেছনে আমি ঘুরবো কিসের লোভে! রাবিশ!
– হ্যাঁ, ঘুরবেন কেন আমার পেছনে। আমি আপনার কিছু হই নাকি! আপনার পেছনে হাজার মেয়ের লাইন পড়ে তাহলে তাদের ঘরে তুললেন না কেন? আমি তো আর জোর করে আসিনি। আর ঘরে তুলে কি হবে, আপনি তো ওপেনলি-ই সব করতে পারেন! বউ দেখিয়ে গার্লফ্রেন্ডের সাথে আলাপ করতে পারেন, গলাগলি হয়ে হাটতে পারেন! কে জানে বেড শেয়ার হয়েছে কজনের সাথে!
– নাহিদা!
মেহেদী অতি রেগে হাত উঠিয়ে ফেলেছিলো থাপ্পড় দেওয়ার জন্য। কিন্তু দেয়নি! হাত নামিয়ে দাত কিড়মিড় করে বললো,
– আমার সাথে কথা বলতে হলে মুখ সামলে কথা বলবে, না হয় জিভ ছিড়ে ফেলবো!
নাহিদার দিকে চোখ রাঙিয়ে অত:পর কেকটা হাতে নিয়ে উপুড় করে আছড়ে ফেললো ফ্লোরে। এবং বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। আবারও হয়ে গেলো এক ঝগড়া! ভেবেছিলো মেনে নিবে তাকে, কিন্তু মন কেন মানছে না! বারবার সেই কষ্টগুলোই এসে মনকে ঘিরে ধরে! আর সে! সে হাত তুলেছিলো কিন্তু থাপ্পড় দিলো না কেন! একটা তো দেওয়া প্রয়োজন ছিলো! কে জানে, হয়তোবা এতেই মনটা একটু শান্ত হতো!
মনের সাথে আলাপ করতে করতে নাহিদা ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো লকেটের দিকে। হাটু ভেঙে মেঝেতে বসে হাতে নিয়ে দেখলো চেইনটা দুভাগ হয়ে গেছে। আর লকেটটা সিম্পল একটা রিং। দেখতে খুবই সুন্দর। মনের অজান্তেই মিলিয়ে নিলো চেইনের দুই খন্ড তারা দুজন যারা ঝগড়া লেগে বিভক্ত হয়ে থাকে, আর রিংটা তাদের সন্তান! চোখ ভরা অশ্রু, মন ভরা কষ্ট আর মুখে মৃদু হাসির রেখা! ভাবনা শুধু একটাই, কখনো কি হবে তাদের মন মিল?
মেহেদী বাইরে বেরিয়ে গেলেও তিন চার মিনিটের মধ্যেই রুমে চলে এসেছে। পকেট থেকে চাবিটা বের করে ফ্লোরে বসে থাকা নাহিদার সামনে ঢিল মেরে ফেললো। অত:পর লাইট অফ করে বিছানায় শুয়ে পাশের বালিশটাও মেঝেতে ফেলে দিলো। নাহিদা চোখ মুছে চাবিটা হাতে নিয়ে দেখলো রুমের চাবি! ধরে নিয়েছে মেহতাজের রুমেরই হবে হয়তো! চাবি ড্রেসিং টেবিলে তুলে রেখে নষ্ট কেক প্যাকেটে মুড়ে কিচেনে ঝুড়িতে ফেলে দিলো। মেঝে পরিষ্কার করে সে বালিশ নিয়ে মেঝেতেই শুয়ে রইলো! ভালো লাগে না আর চোখের পানিতে বালিশ ভেজাতে, ভালো লাগে না আর কোনো কষ্ট সইতে! নিজের কাছেই অসহ্য হয়ে পড়েছে জীবন! কবে অবসান ঘটবে এই জীবনের ধারাবাহিক কষ্টগুলোর!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here