“তৃ-তনয়া” পর্ব- ৭৭

0
2508

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৭৭
(নূর নাফিসা)
.
.
– আহা! পেটটা ইদানিং পেটুক হয়ে গেছে! খালি খাই খাই করে!
নিশাতের রুমে প্রবেশ করতে করতে নাফিসার মুখে এমন উক্তি শুনে নিশাত হেসে উঠলো! পরক্ষণে বললো,
– ভাবি, হঠাৎ এতো খাই খাই করে কেন? পেটে কি জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাইছে?
– একটা দিবো মাইর, পুচকে মেয়ে! শুধু উল্টাপাল্টা বিষয় মাথায় ঘুরে! কবে বিয়ে হবে, কবে সংসার করবে আর কবে এক গাদা বাচ্চাকাচ্চা জন্ম দিবে, এসব নিয়েই চিন্তা করো, তাই না? দাড়াও, বড়মার কাছে বলে নেই!
– ইশ! আমি মোটেও এসব নিয়ে ভাবি না।
– আহা! ভাবেন না? দেখি তো কেউ এলে যে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকেন! আর ভাবনা কতদূর এগিয়েছে সেটা তো আমার ভাবনারও বাইরে!
– কোথায়? কার দিকে তাকিয়ে থাকি?
– সে আর আমার বলতে হয় নাকি! তা তো তুমিই ভালো জানো। অবশ্য তোমাকেও দোষ দেওয়া যায় না। শুনেছি এ নাকি বয়সের দোষ! কেউ নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারে আবার কেউ পারে না। যে নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারে, সে-ই উত্তম।
নিশাত তুলনামূলক নিচু স্বরে বললো,
– তোমার কথা কিন্তু সবটা আমার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।
– হ্যাঁ, আমার কথা তো মাথার উপর দিয়েই যাবে! আমি কি আর আশিক, যে কান দিয়ে আমার কথা মগজ পর্যন্ত যাওয়ার রাস্তা খুঁজে পাবে!
নিশাত খাতার দিকে মাথা নিচু করে কয়েক সেকেন্ডের জন্য চোখ খিচে বন্ধ করলো। পরক্ষণে চুপচাপ লিখালিখি করতে লাগলো। খাটে বসে পা নাচাতে নাচাতে নাফিসা তা স্পষ্ট লক্ষ্য করেছে। নিশাতকে এবার চুপ থাকতে দেখে নাফিসা বললো,
– কি, ভুল বললাম কিছু?
নিশাত কোনো জবাব দিলো না। নাফিসা এবার তার দুষ্টুমি ভঙ্গি ত্যাগ করে স্বাভাবিকভাবে বললো,
– নিজ থেকে কাউকে পছন্দ করা, অর্থাৎ জীবনসঙ্গী হিসেবে প্রত্যাশা করা সম্পূর্ণ হারাম। সবার আগে তোমাকে মনে রাখতে হবে তুমি একজন মুসলিম কন্যা। আর কারো উপর এসব ক্রাশ ঘাস খাওয়া সম্পূর্ণ হারাম। তুমি কেবল তোমার প্রিয়জনকেই উঁকি মেরে দেখতে পারো, প্রিয়জনের উপর মুগ্ধ হতে পারো। এ সেই প্রিয়জন যার সাথে তোমার হালাল সম্পর্ক বিদ্যমান। সেখানে ইসলামসহ কেউই তোমাকে আর বাধা দিচ্ছে না, কারো অপছন্দও হচ্ছে না। যদিও আমরা অতটা পর্দা করে অভ্যস্ত নই কিন্তু হালাল হারাম বেছে চলতে ও শালীনতা বজায় রেখে ছোট ছোট পাপ থেকে মুক্তি পেতে তো সক্ষম? তাহলে হারাম দিকে কেন অগ্রসর হবো?
নিশাত চুপচাপ লিখছে। কখনো কলম থেমে যাচ্ছে আবার কখনো অতি দ্রুত চলছে। নাফিসা আবারও বললো,
– আমার কথা শুনতে নিশ্চয়ই ভালো লাগছে না তোমার, তবুও জানানো প্রয়োজন মনে করলাম। যদি পারো তো কথাগুলো একটু ইতিবাচকভাবে ভেবে দেখো। আমার মতে মেয়েদের ছোট থাকতেই বিয়ে দিয়ে দেওয়া উচিত। তাহলে আর পর পুরুষের দিকে কারো নজর পড়তো না। সবাই তো আর ঝড়ের সময় খুটি আঁকড়ে ধরতে পারে না! আমিও ভেবে রেখেছি, ভবিষ্যতে আমার বাচ্চাকাদের ছোটকালেই ঘরোয়াভাবে বিয়ে দিয়ে দিবো। এরপর চুকিয়ে প্রেম কর, আর কোনো হারাম থাকবে না তোদের প্রেম!
নিশাত ফিক করে হেসে উঠে বললো,
– এমন হলে আর তোমার বাচ্চাকাচ্চা প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে না কোনোভাবে! শুরুতেই সংসারে মজে যাবে। সেই প্রাচীনকালের মতো দেখবে ঘর ভরা তোমার নাতি-নাতনি!
– ধুর, আমি কি আর বিয়ের সাথে সাথেই সংসারে পাঠিয়ে দিবো নাকি! বিয়ে দিবো ছোটকালে আর শ্বশুর বাড়ি পাঠাবো উপযুক্ত বয়সে। ওই যে, স্কুলের নাম করে বয়ফ্রেন্ডের সাথে সিনেমা হলে চলে যাবে, সেই সুযোগ যেন না পায় তার জন্যই শুধুমাত্র বিয়ে দেওয়া হবে। নিজের সাধ্যমতো প্রতিষ্ঠিত করে তারপর যা, সংসার কর। বুঝো নাই?
– তাহলে তো আরও বেশি বেশি যাবে। যদি একই স্কুলের হয় তো ক্লাস রেখে বলবে, “চলো আজ সিনেমা হলে যাই, চলো আজ তেতুল তলায় আড্ডা দেই।”
– একেবারেই নাই বুদ্ধি! ক্যামনে দিচ্ছো এইচএসসি পরীক্ষা! আমি কি সমবয়সীর হাতে তুলে দিবো নাকি! মেয়ে পড়বে প্রাইমারি স্কুলে তো ছেলে হাইস্কুলে। মেয়ে হাইস্কুলে তো ছেলে কলেজে আর মেয়ে কলেজে তো ছেলে ভার্সিটিতে! তখন আর এতো ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ থাকবে না। ছেলে বড় থাকলে নিজেকে একটু দায়িত্বশীল মনে করে পিচ্চি বউকে শাসন করবে, চোখে চোখে রাখবে।
“কে পিচ্চি বউ?”
হঠাৎ আগমন ঘটলো ইমরানের! নিশাত খিলখিলিয়ে হেসে বললো,
– বাচ্চাকাচ্চা না আসতেই ভাবি এখনই বাচ্চাকাচ্চাদের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে!
ক্লিয়ার কিছু না বুঝতে পেরে ইমরান ব্রু হালকা কুচকে ঠোঁটের এক কোনে মৃদু হাসলো আর নাফিসা তাকে দেখে বললো,
– তুমি চলে এসেছো! আমি তো কল করতাম!
ইমরানের দৃষ্টি তাৎক্ষণিক উজ্জ্বল হয়ে গেছে! চেহারায় একটা হাসিমাখা ভাব ফুটে উঠেছে। সে স্বাভাবিকভাবেই জিজ্ঞেস করলো,
– কেন?
– কবে থেকে বাইরের খাবার খাই না! আজ খেতে ইচ্ছে করছিলো। তাই পিয়াজু কিংবা সিঙ্গারা আনতে বলতাম।
ইমরান নিজের রুমে যাওয়ার জন্য বেরিয়ে যেতে যেতে বললো,
– ঘরে তৈরি করে খাও। বাইরের খাবার অস্বাস্থ্যকর।
নাফিসা মেজাজ খারাপ করে তার পিছু পিছু হনহন করে যেতে যেতে বললো,
– ঘরে তৈরি করে খাওয়াবে কে? আপনি?
– আমি কেন খাওয়াবো!
– তবে?
– অবশ্যই তুমি।
– আমি এতো ঝামেলা করতে পারবো না। কিপ্টুস একটা, বললেই হয় পকেট খরচ করতে চান না!
– বলবো কেন এটা! ঘরে তৈরি করলে কি পকেট খরচ হবে না?
– লাগবে না খাওয়া। পেট এমনিতেই ভরে গেছে।
– মাগরিবের পর এনে দিবো।
– না, লাগবে না।
– এখন মাত্র এলাম, আবার যাবো!
– বললাম তো খাবোই না!
ইমরান শার্ট খুলে নাফিসার মুখের সামনে ধরে বললো,
– দেখো, আজ অনেক বেশি গন্ধ ছড়িয়েছে না?
নাফিসা পেছনে হেলে খপ করেই শার্ট হাতে নিয়ে বললো,
– হ্যাঁ, ছড়াবেই তো! আমি আছি না ধুয়ে দেওয়ার জন্য! প্রথম প্রথম কি ভাব, নিজের কাজ নিজেই করতে জানি! হুহ্! ঘোড়ার ডিম করতে জানে!
– আমার কি দোষ! বউ নিজেই তো আমাকে অলস বানিয়ে দিয়েছে!
নাফিসা লুঙ্গি এনে ইমরানের হাতে দিয়ে বললো,
– কথা কম বলেন, চেঞ্জ করেন দ্রুত। শার্ট ঘামে ভিজছে প্যান্ট কি আবার এসির নিচে ছিলো!
ইমরান দুষ্টুমির সাথে হেসে বললো,
– জান, গোসল করেছো নাকি এখন আমার সাথে করবে?
নাফিসার এতোক্ষণ খেয়ালই ছিলো না! আর এখন মনে হতেই সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
– চোর! আপনি আমার আইডি হ্যাক করছেন কেন?
– আমি কখন তোমার আইডি হ্যাক করলাম!
– তা না হলে জানলেন কিভাবে ওটা আমি ছিলাম! ঘরে বসে বসে আমার ফোন নিয়ে সারাক্ষণ তদারকি করেন আমি কি করছি না করছি!
ইমরান হেসে বললো,
– আমার তদারকি করা লাগে, বউ তো নিজেই বলে দেয় সব!
– আমি কখন বলছি আমার ওই আইডির কথা?
– নূর নাফিসার সাথে ম্যাচুয়াল দেখেই একটু সন্দেহ হয়েছিলো। পরে যখন নিশ্চিত হওয়ার জন্য কথায় তাল মেলালাম, তখনই অফিসের কথা জিজ্ঞেস করলে! অপরিচিত কেউ হলে তো আর এমন কিছু আন্দাজ করতে পারতো না যে আমি তখন অফিসে আছি কি নেই!
নাফিসা মনে মনে নিজেকে বোকা মেয়ে বলে বকা দিতে দিতে শার্ট-প্যান্ট নিয়ে বাথরুমে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। ইমরান তার পথ আটকে বললো,
– মেসেঞ্জারে তুমি ছিলাম, নিশাতের রুমেও তুমি ছিলাম, এই রুমে আবার আপনি কেন হলাম?
– আপনাকে আপনি বলবো না তো কি বলবো!
– অবশ্যই তখনকার মতো তুমি বলবে।
– পারবো না। আপনি ই বলবো।
– উহু, জান। তুমি বলবে।
– না। আপনি বলবো।
– না, তুমি।
– সরুন তো! তা না হলে এগুলো ধুয়ে দিবো না।
– না, দাও। তবুও তুমি বলবে।
– না, আপনি।
– না, তুমি।
– না, আপনি।
– না, তুমি।
– না, আপনি।
– না, আপনি।
– না, তুমি।
ইমরান হাহাহোহো করে হেসে বললো,
– ওকে, এবার ঠিক আছে।
কথার প্যাচে পড়ে শেষ পর্যন্ত তুমিই বলে ফেললো নাফিসা! সাথে অটোমেটিক লজ্জা স্পষ্ট ধরা দিয়েছে তার মুখে! ইমরান এটা ইচ্ছে করেই করেছে। স্টুপিডটা বারবার তাকে প্যাচিয়ে দেয়! কি বলবে তা ভেবে না পেয়ে তার পেটে একটা মেরে নাফিসা হনহন করে বেরিয়ে যেতে যেতে বললো,
– স্টুপিড! অফিসে বসে বসে কাজে ফাঁকি দিয়ে অনলাইনে টাইম নষ্ট করে! দাঁড়ান, ভাইয়ার কাছে বিচার দিবো। ফাকিবাজের বিরুদ্ধে যাতে কঠিন ব্যবস্থা নিতে পারে সেই আবেদন করা প্রয়োজন বসের কাছে।
হাতমুখ ধোয়ার জন্য ইমরান তার পিছু পিছু যেতে যেতে বললো,
– ভাইয়ার কাছে বিচার দেওয়া কি প্রয়োজন! তুমি নিজেই আবেদন করো বসের কাছে।
– আমি অফিস থাকলে ঠিকই করতাম! হুহ্! এমন অনৈতিক কাজ আমার সামনে, ইম্পসিবল!
– মেডাম, অনৈতিকের কিছু নেই এখানে। যখন আমার কাজ থাকবে, তখন সম্পাদন করে দিতে পারলেই হয়। বাকিটা ফ্রী টাইম। সেটাও নষ্ট করি না। আউটসোর্সিং-এ ব্যয় করি।
– আপনি ফ্রিল্যান্সিং জব করেন?
– করি তো মাঝে মাঝে।
– আমারও খুব ইচ্ছে শিখার।
– কিছুদিন পর কম্পিউটার আনবো, তখন শেখো।
– ওই ঘরে না একটা আছে।
– ভাইয়ার টা? ওটা নষ্ট। ঢাকঢোল পিটিয়ে, আছাড় মেরে, হিসু করে আরও একবছর আগেই জিহান একেবারে শেষ করে দিছে! এখন ওটা বিক্রি করে পাপন ভাজা খেতে পারবে।
নাফিসা হাসতে হাসতে নিজের কাজে মনযোগ দিলো। এতোক্ষণে ইমরান হাতমুখ ধুয়ে নিয়েছে। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললো,
– নাফিসা, আউটসাইড রিলেশন নিয়ে তুমি কি আমাকে সন্দেহ করো?
হঠাৎ এমন প্রশ্নে নাফিসা তার দিকে এক পলক তাকালো। কিন্তু কিছু বললো না। ইমরান জবাব না পেয়ে আবার বললো,
– আমার সব বিষয়ে কিন্তু জানার অধিকার আছে তোমার আর আমিও স্পেশালি কিছু গোপন রাখতে চাইনা। তোমার এরকম কোনো সন্দেহ থাকলে জিজ্ঞাসা করে ক্লিয়ার করে নিতে পারো। সন্দেহের বশে সংসার টিকে না, সংসার টিকিয়ে রাখতে হলে প্রয়োজন হয় বিশ্বাসের।
নাফিসা কাপড় কাচতে কাচতে বললো,
– আমি তখন ফান করার জন্য মেসেজ দিয়েছিলাম। সন্দেহের বশে না।
– না, ওটা বাদেও আমি নরমাল সিচুয়েশনের কথা বলছি।
– না, করি না সন্দেহ।
– বউ…. ভালোবাসি।
কথাটা বলার পর ইমরান দশ সেকেন্ডের বেশি অপেক্ষা করেনি এখানে। কেননা সে বুঝতে পেরেছে নাফিসা লজ্জা পেয়েছে। তাই তাকায়ও নি একবার তার দিকে! এদিকে ইমরান চলে যাওয়ার পর নাফিসার ঠোঁটের কোনায় লজ্জাময়ী হাসির রেখা স্পষ্ট হলো! আর সাথে মনোক্তি,
“নির্দিষ্ট কোনো সময়, সুযোগ, স্থান নেই তার! যখন তখন ভালোবাসা প্রকাশ করে ফেলে! অবশেষে আজ বাথরুমটাও বাদ রাখলো না! বাথরুমে এসে কেউ ভালোবাসা প্রকাশ করে! আর ভালোবাসিস সেটা বারবার ঢাকঢোল পিটানোর কি আছে! আস্ত একটা গাধা ইমরাইন্নার বাচ্চা! হিহিহি…!”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here