“তৃ-তনয়া” পর্ব- ৭৮

0
2465

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৭৮
(নূর নাফিসা)
.
.
মাগরিবের নামাজ পড়ে ইমরান পাঁচটা সিঙ্গারা ও হাফ কেজি পিয়াজু নিয়ে এসেছে। জন প্রতি একটা করে সিঙ্গারা খেলেও পিয়াজু নিলো না তারা। নাফিসার জোরাজুরিতে বড়মা একটা মুখে দিয়েছে, আবিদা বেগম নিলোই না। নাফিসাও তাকে জোরাজুরি করলো না। ইমরানকে বললে ইমরান বললো,
– উহুম, তুমিই খাও!
নাফিসা ভেঙচি কেটে বলে গেলো,
– হুহ্! এজন্যই সাধি না কাউকে। বাঙালির বদ অভ্যাস, সাধলে দাম দেখায়। আর মনে মনে পোষে “আরেকবার সাধিলে খাবো!”
ইমরান হেসে উঠলো তার কথায়। এবং বললো,
– আরেকবার সাধিলেও খাবো না। তুমিই খাও আর খাওয়াদাওয়ার পর পড়তে বসো।
নাফিসা রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। নিশাতের রুমের দরজার কাছে গিয়ে আবার ফিরে এলো। ইমরান পড়তে বসেছিলো। আর পড়ার মাঝেই নাফিসা ঠেলে তার মুখে একটা পিয়াজু দিয়ে বললো,
– না দিয়ে খেলে আবার আমার পেট ব্যাথা করবে। তাই আমি আগে থেকেই সাবধান।
নাফিসা আবার নিশাতের রুমে চলে গেলো। দুজন গল্পগুজব করতে করতে পিয়াজু খাচ্ছে। নিশাতের গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা থাকায় বেশি খায়নি কিন্তু নাফিসা সবটা ফিনিশ করেছে একাই! অত:পর ইমরানের ডাক পড়লে ঢেকুর তুলতে তুলতে রুমে এলো।
– কি?
– এতোক্ষণ লাগে খেতে! ইশার আযান পড়ে যাবে এবার। এখনো বই হাতে নাওনি! পড়াশোনায় এতোটা অমনোযোগী হয়ে গেছো কেন তুমি!
– কই, অমনোযোগী?
– এ মাসে ভার্সিটিতে ক’দিন ক্লাস করেছো?
– এ অবস্থায় ক্লাস করতাম কিভাবে!
– আমি তো অফিস জয়েন করেছি সেই কবে থেকে! আর আমার অসুস্থতার অযুহাতে তোমার ভার্সিটি মিস!
– এহ, অযুহাত বলবেন না একদম! আপনার জন্য আমি আমার বাপের বাড়ি পর্যন্ত যাইনি! আর গত সপ্তাহে তো ভার্সিটি অফ ছিলো!
– আচ্ছা, সময় অনেক নষ্ট হয়েছে। সব দোষ আমারই, এখন তুমি একটু মনযোগী হয়ে পড়তে বসো।
– আমি বাড়ি যাবো।
– এখন!
– এখন আর তখন কি! যেখানে নতুন বউ ঘনঘন বাপের বাড়ি বেড়াতে যায় সেখানে আমি মাত্র একবার গিয়েছি! এতোদিন পর আবার বলছি যাবো আর তখন আপনার এখন আর তখন বেরিয়ে গেলো!
– তাই বলে এখন রাতের বেলা যাবে!
– আমি রাতের কথা বলেছি! এজন্যই বেশি জ্ঞানী লোক দেখতে পারি না! অযথা দু’লাইন বেশি বুঝে!
ইমরান শরীর কাপিয়ে হেসে উঠলো। নাফিসার মোটেও পছন্দ হলো না তার হাসি! সে গোমড়া মুখু হয়ে বললো,
– কাল যাবো?
– শুক্রবার তো বাবা-মা ই আসবে। তো কাল গিয়ে তুমি কি করবে?
– ওহ্! আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম! তাহলে বাবামায়ের সাথে সেদিনই চলে যাবো। ওকে?
– হুম, সে তোমার বলার আগেই জানি। বাবা-মা এলে আর তোমার মন টিকবে নাকি!
– হুম, টিকবে না মন। এবার তাহলে কনফার্ম যাবো। হুম? কি হলো, বলুন?
– আমি নিষেধ করলে যাবে না?
নাফিসা কিছু বললো না। শুধু আহ্লাদী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। ইমরান মুচকি হেসে নিজের পড়া দেখতে দেখতে বললো,
– পড়তে বসো আগে।
নাফিসা বই নিয়ে নিশাতের রুমে যেতে লাগলে ইমরান বললো,
– এই, এদিকে এসো। এখানে পড়তে বসো। দুইজন একসাথে হলে কারোই পড়া হবে না। নিশাতের পরীক্ষা চলছে। তারও ক্ষতি তোমারও ক্ষতি!
রাতে আর ভাত খায়নি নাফিসা। সিঙ্গারা আর পিয়াজু খেয়ে তার পেট ভরে গেছে। আর ঘুমাতে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর শুরু হয়েছে ডাইরেক্ট একশান! প্রথমে পেট ব্যাথায় ছটফট আর কান্নাকাটি! পরক্ষণে রুম থেকে বাথরুম দৌড়াদৌড়ি! ইমরান বললো,
– পিয়াজু কি সব একাই খেয়েছো তুমি?
– একা কোথায় খেলাম! আপনাকে দেইনি? নিশাতকে দেইনি?
– আর বাকিগুলো?
– আমি।
– আগে আরও হয়েছে এমন?
নাফিসা ভিজাবিড়াল ন্যায় স্বরে বললো,
– সবসময়ই হয়!
ইমরানের চেহারায় এবার রাগ স্পষ্ট!
– সবসময় হয় তো জেনেশুনে রাক্ষসের মতো খেলে কেন সব!
– আমি রাক্ষস? আপনি রাক্ষস, আপনার চৌদ্দগোষ্ঠী রাক্ষস।
– তাহলে আমার চৌদ্দগোষ্ঠীর কিছু হলো না কেন?
– আমি কি জানি!
– তো আমিও জানি না কিছু। গুড নাইট।
– বেড নাইট…
ইমরান লাইট অফ করে শুয়ে পড়লো। আর নাফিসা পেট চেপে রেখে বসে বসে কান্না করছে! একটু পর আবারও পেটে মোচড় পড়লো! নাফিসা লাইট জ্বালিয়ে বাইরে যাওয়ার জন্য নেমেছে বিছানা ছেড়ে। কিন্তু দরজা খুলে একা যাওয়ার সাহস হচ্ছে না! এদিকে ইমরান চোখ বুজে থাকলেও ঘুমায়নি। পাশে বসে কেউ এমন ছটফট করলে কি ঘুমানো যায়! নাফিসা এসে আবার ইমরানকে ঠেলতে লাগলো।
– এই, শুনছেন?
ইমরান তার হাত সরিয়ে দিলো। নাফিসা বুঝতে পেরেছে সে ঘুমায়নি। আবারও একবার ঠেলে বললো,
– আমি বাইরে যাবো।
ইমরান এবারও কথা কানে নিলো না। নাফিসা এবার রেগে গিয়ে বললো,
– বউ ভালোবাসি? এই তোর ভালোবাসা? আমি কেদে মরি আর তুই শান্তিতে ঘুমাস! বাইরে গিয়ে এখন ভয় পেয়ে যদি স্ট্রোক করি তো তুই দায়ী থাকবি বলে দিলাম!
এবার আর অপেক্ষা না করে নাফিসা হনহন করে বেরিয়ে গেলো। ইমরান চোখ খুলে তাকিয়ে ছিলো তার যাওয়ার দিকে। আর কিছু জানুক আর না জানুক, জেদটা ঠিকই খুব ভালো দেখাতে জানে! ছোটখাটো এক নিশ্বাস ফেলে ইমরান বাইরে এসে দাড়ালো। নাফিসা বেরিয়ে এসে তাকে বারান্দায় দেখতে পেল। সে গোমড়া মুখু হয়ে নিশাতের রুমের দিকে এসে দেখলো দরজায় তালা ঝুলছে। পরক্ষণে মনে হলো নিশাত আজ বড়ঘরে আছে। সে আবার নিজের রুমে চলে এলো। ইমরান রুমে এসে গেইটের চাবি ও ফোনটা হাতে নিয়ে বললো,
– তুমি বসো, আমি আসছি।
ইমরান বেরিয়ে গেলে নাফিসার ভয় করতে লাগলো! এই ঘরে এখন সে একা। চোর ডাকাত এসে যদি হামলা করে তো সে নিশ্চিত এই প্রথম হার্ট অ্যাটাক করবে! তাই সে দ্রুত দরজা লাগিয়ে দিলো। ইমরান নিশাতকে কল করে বড় ঘরের গেইট খুলতে বললো। লবন আর গুড় নিয়ে আবার গেইট লাগিয়ে দিতে বললো। নিজের ঘরে এসে দেখে দরজা বন্ধ! সে নাফিসার নাম ধরে ডাকতেই নাফিসা আচমকা কেপে উঠলো। ইমরানের গলা শুনে সে দরজা খুললো। ইমরান চুপচাপ ঘরে এসে স্যালাইন তৈরি করে নাফিসার হাতে দিলো। কিন্তু নাফিসা যে এটা গলা দিয়ে নামাতে পারবে না! গুড় দেখলেই তার গা গুলিয়ে আসে। ইমরান বললো,
– এভাবে বসে আছো কেন? তারাতাড়ি গিলে ফেলো।
– আমি এটা খেতে পারবো না।
– না খেলে সুস্থ হবে? তারাতাড়ি খাও।
– সম্ভব না। মিঠাই খাই না।
– এছাড়া তো এখন কোনো উপায়ও নেই। এতো রাতে দোকান খোলা আছে নাকি! চেষ্টা কর খাওয়ার।
– পারবো না।
– এখন কিন্তু মাইর খাবে!
– তবুও সম্ভব না!
– নাক চিপে ধরে তারপর খাও।
নাফিসা তার কথায় নাক চিপে ধরে তারপর মুখের সামনে নিয়ে গেলো। কিন্তু মুখে নেওয়ার আগেই বারবার নাক ছেড়ে দিচ্ছে! ইমরানের আর সহ্য হচ্ছে না তার ন্যাকামো! তাই সে নিজেই জোরে নাক চেপে ধরে বললো, “তারাতাড়ি সবটা গিলে ফেলো, নয়তো নাক ছাড়বো না। এরপর দম আটকে ইন্না-লিল্লাহ!”
জবরদস্তিতে এবার ঢকঢক করে গিলতে বাধ্য নাফিসা! নাক ছেড়ে দেওয়ার পর আয়নার সামনে এসে দেখলো তার নাক টকটকে লাল হয়ে আছে! রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকালে ইমরান বললো,
– পাউডার আছে না, মেখে দাও। সাদা হয়ে যাবে।
সারারাত কাটলো তার ছটফটিয়ে! নিজেও ঘুমায়নি, ইমরানকেও ঘুমাতে দেয়নি! তবে একটা জিনিস খুব ভালো লক্ষ্য করেছে, সে নিজে রাগ দেখালেও ইমরান তার প্রতি একটুও বিরক্ত হয়নি। বরং তাকে একটু শান্তিতে রাখার চেষ্টা করেছে। নির্ঘুম রাত পার করেছে। নিজে দোয়াদরুদ পড়ে নাফিসাকেও পড়িয়েছে। অবশেষে শেষ রাতে নাফিসা একটু শান্ত হয়েছে। আর তখন ঘুমিয়ে পড়েছিলো ইমরানের বুকে। ইমরানেরও চোখ জোড়ায় ঘুম নেমে এসেছিলো মাত্র। আর এমনিতেই আযান পড়ে গেছে! তার আর ঘুম হলো না। কিন্তু সকাল আটটা পর্যন্ত নাফিসা ঘুমিয়েছে। ঘুম ভাঙতেই ইমরান বললো,
– উঠে নাস্তা করো৷ তারপর এই ট্যাবলেটটা খেয়ে নাও।
– ঘুমাও নি?
তুমি করে বলাতে ইমরান তার দিকে একবার তাকালো কিন্তু কিছু না বলে আবার নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। নাফিসা গোসল সেড়ে এসে দেখলো ইমরান নাস্তা করে অফিসের জন্য তৈরি। আজ নিজের কাপড়চোপড় নিজেই ধুয়ে রেখেছিলো।
হাফ ডে হওয়াতে দুপুরে বাসায় ফিরেছে ইমরান। সারাটাদিন আজ তার ঘুম ঘুম পাচ্ছে! তাই দুপুরে খাওয়ার পরই ঘুমিয়ে পড়েছে। নাফিসারও ভালো লাগছিলো না কিছু। রুমে এসে দেখলো ইমরান ঘুমাচ্ছে। সে-ও ঘুমানোর চিন্তা করলো। তাই দরজা লাগিয়ে এসে ইমরানের কাছে এসে বসলো। অন্য দিনের তুলনায় লোকটাকে আজ একটু বেশিই ভালো লাগছে। সারারাত ঘুমায়নি, এখন বিরক্ত না করাই ভালো। তা ভেবে আর তার বুকে মাথা রাখলো না। কিন্তু কপালে আলতো পরশ দিতে ইচ্ছে হলে তা পূরণ করে ফেললো। আর অমনি ইমরান তাকে জড়িয়ে ফেললো বাহুডোরে। যদিও একটু আগে এসে শুয়েছে কিন্তু দেখে মনে হয়েছিলো গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে! এ তো বড্ড পাজি! তা ভেবে নাফিসা হেসে উঠলো! আর বললো,
– ঘুমাওনি এখনো!
ইমরান চোখ বন্ধ রেখেই জবাব দিলো,
– উহুম, ঘুমাবো৷
সারা দুপুর ঘুমিয়ে বিকেলে ঘুম ভাঙলো চেচামেচিতে! জিহান ফিরে এসেছে বাড়িতে। আর উঠুনে খেলায় নেমে গেছে পাশের বাড়ির সঙ্গীর সাথে। আর জেরিন চেচিয়ে ডাকছে যাতে ময়লা না ধরে! বাড়ির ছেলে বাড়িতে ফেরায় ফাঁকা বাড়িটা এবার পূর্ণ হলো৷ একদিকে ভালো লাগলেও অন্যদিকে বিরক্তিকর! ইমরান আড়মোড়া ভেঙে উঠে চলে গেলো। আর নাফিসা উঠে বসে মনে মনে বললো,
“নাইওর শেষে এসে গেছে আবার অশান্তি! আয়, তো কি হয়েছে! আমিও চলে যাবো কিছুদিনের জন্য। এরপর দেখি, তোকে শুধরানোর কোনো ব্যবস্থা করা যায় কিনা! হুহ্!”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here