“তৃ-তনয়া” পর্ব- ৭৯

0
2548

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৭৯
(নূর নাফিসা)
.
.
শুক্রবার নাজিয়া ও নাহিদার পরিবারসহ সবাই এসেছে ইমরানের বাড়িতে। বিয়ের পর নাফিসার বাড়িতে দাওয়াত করা হলেও ইমরানের বাড়িতে আজ প্রথম। আরও আগেই হতো এই আয়োজনটা কিন্তু ইমরানের এক্সিডেন্টের জন্য স্থগিত ছিলো। এদিকে আয়াতসহ ইমরানের মামার বাড়ি থেকেও লোকজন এসেছে। ঘরোয়া ভাবে মোটামুটি বড়সড়ই এক আয়োজন হলো। সেই সুবাদে একে অপরের সাথে দেখা হলো, সাক্ষাৎ হলো। বেশ ভালোই লাগলো সবার।
নাহিদার পরিবারের বাকি সদস্য এলেও মেহেদীকে দেখা গেলো না! ইমরান নাহিদাকে জিজ্ঞেস করলে জানালো মেহেদীর জরুরী কাজ আছে তাই আসতে পারেনি। ওদিকে তুর্য এসেও একই কথা জিজ্ঞেস করলো,
– মেহেদী আসেনি, ভাবি?
– না, ভাইয়া। ওর একটু জরুরি কাজ আছে অফিসে। তাই আসতে পারেনি।
– আমিতো আসার সময় তাকে রিকশা করে বাড়ির দিকে যেতে দেখলাম।
– প্রয়োজনে গেছে হয়তো।
শেষ কথাটা একটু চিন্তিত ভাব প্রকাশ করলো নাহিদা। তুর্যের চোখে ধরা না পড়লেও ইমরানের চোখে ধরা পড়েছে সেটা। আর নাহিদা মনে মনে ভাবছে, “তার তো এসময় অফিসই থাকার কথা। তাহলে বাড়ির দিকে যাবে কেন! তাহলে কি এখানে না আসার জন্য মিথ্যে বলেছে সে! আসবে না-ই বা কেন! আশিকের জন্য?”
নানান কথা ঘুরপাক খেলেও সে মা বোনদের সাথে মিশে তা ভুলে গিয়েছিলো। প্রায় অনেকদিন পর সবাই একসাথে হয়েছে। তাই ওসব ভাবনা একপাশে ফেলে বর্তমান মুহুর্তটা উৎফুল্লতার সাথেই উপভোগ করলো। দুপুরে খাওয়ার পর যখন নাজিয়ার সাথে কথা বলছিলো তখন মেহেদীর ফোন এলো। নাহিদা রিসিভ করে সালাম দিতেই মেহেদী সালামের জবাব দিয়ে বললো,
– তোমার বোরকার সাইজ কত?
বোরকার কথা জিজ্ঞেস করাতে নাহিদা একটু অবাকই হলো। কিন্তু নাজিয়া পাশে থাকায় অতিরিক্ত কিছু জিজ্ঞেস করলো না। সে-ও স্বাভাবিকভাবে বলে দিলো, “৫৪”
“ওকে”
জানার পর আবার মেহেদী সাথে সাথেই কল কেটে দিলো।
বাকি মেহমানদের খাওয়াদাওয়া শেষ হলে ইমরান, আশিক প্লেট নিয়ে নিশাতের রুম ফাঁকা পেয়ে সেখানেই চলে এসেছে। নাফিসা তার আপুদের সাথে খেতে বাধ্য হয়েছিলো। আর আপ্যায়ন করতে করতে অবশেষে বাকি এই দুইজন। তাদের আপ্যায়নে এবার নেমেছে নাফিসা। সাথে হেল্প নিয়েছে নিশাতের। আজ জেরিন একটু দূরেই আছে। নিজের বাবার বাড়ির লোকজন নিয়ে সে ব্যস্ত। ইমরানের প্লেটে খাবার বেড়ে দিতে গেলে ইমরান অল্প দিতে বললো। কেননা, সে বাকিদের খাওয়ানোর সময় টুকটাক খেতে খেতে পেট এখন অর্ধেক ভরা ই আছে।
আশিকেরও একই উক্তি। কিন্তু নাফিসা ইচ্ছে করে একটু বেশি দিয়েই বললো,
– আরে খান ভাইয়া। অভ্যাস করতে হবে তো। নতুবা পরবর্তীতে ঠিকমতো জামাই আদর পাবেন না বলে দিলাম!
ইমরান ও আশিক উভয়ের দৃষ্টিই নাফিসার দিকে! আর নাফিসার মুখে দুষ্টুমি হাসি! এদিকে নিশাত পানির জগ রেখে দাড়িয়ে ছিলো, আর এখন নাফিসার কথা শুনে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে! তারা দুইভাই একে তো নাফিসার কথা কিছুই বুঝতে পারেনি, এখন আবার নিশাতের যাওয়ার দিকেও একটু অবাক হয়ে তাকালো! কিছু কিছু সন্দেহজনক আবার কিছু কিছু গোলমাল! নাফিসা বললো,
– ওইদিকে কি দেখেন? খাবার তো প্লেটে! এদিকে তাকিয়ে খান। আমি লেবু শসা নিয়ে আসছি।
আশিকের মুখভঙ্গিতে একটু চিন্তিত ভাব দেখতে পেল নাফিসা। আর ইমরান তাকে চোখে ইশারা করে জানতে চাইলো। নাফিসা বেরিয়ে যেতে যেতে ঠোঁট নাড়িয়ে ইশারা করলো পরে বলবে।
দুজনেই অন্য প্রসঙ্গে আলাপ করতে করতে খাওয়া শেষ করে নিলো।
বিকেলের দিকে সবাই যার যার বাসায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। ইমরান তার মামার বাড়ির লোকজনকে রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এলো। আয়াতও চলে গেছে। আর বাকিরাও যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। নাফিসা তার মাকে বেশ কয়েকবার বলেছে তাকে যেনো আজ নিয়ে যায়। এখনো বড়মার সাথে কথা বলার সময় জিজ্ঞেস করলে রুমানা বেগম বললো,
– আমার কাছে এসে যাবো যাবো বললেই কি নিয়ে যেতে পারবো আমি? এ পরিবারের কারো কাছে কি একবার পারমিশন চেয়েছিস?
নাফিসা বড়মার দিকে আহ্লাদী সুরে বললো,
– বড়মা, যাবো না?
– যাবি না কেন। যা, থেকে আয়। নিষেধ করবে না কেউ।
এবার তার মাকে বললো,
– শুনেছো তো এবার?
– তবুও সব কিছুর একটা নীতি আছে, নাফিসা। সবসময় নিজের মর্জিতে সব হয় না। তাই বলেছি। বেয়াইনের কাছে বল, ইমরানের কাছে বল। ইমরান যেতে চাইলে এরপর গিয়ে রেডি হ…
নাফিসা আবিদা বেগমের কাছে এসে দেখলো মাত্র আসরের নামাজ পড়ে উঠলেন। আর আয়েশা বেগম নামাজ পড়ছে। সে দরজার কাছে দাড়িয়েই বললো,
– আম্মা, আজ বাবামায়ের সাথে বাসায় যেতে চাইছিলাম। বড়মা বলেছে যেতে। আপনি কি বলেন, যাবো?
– যাও। শুক্রবারের আগে আগে আইসা পইড়ো। দাওয়াত আছে।
– ওকে।
নাফিসা এবার খুশিমনে তাদের ঘরের দিকে যেতে লাগলো। উঠুনের একপাশে চেয়ারে বসে আছে আরমান, আরাফ, নিশাত, নাজিয়া এবং নাহিদা। আর ইমরান, জিহান ও আশিক মাত্রই রাস্তার দিক থেকে বাসায় প্রবেশ করেছে। হাতে স্পিড ও সেভেন-আপ। নাফিসা ইমরানকে বললো,
– এদিকে এসো তো একটু।
– কেন?
– প্রয়োজন আছে বলেই তো বললাম!
ইমরান আশিকের হাতে বোতল দিয়ে আসতে যাবে এমনি নাফিসা বললো,
– এই দাড়ান দাড়ান দাড়ান….
বলতে বলতে ইমরানের হাত টেনে আবার আশিকের সাথে দাঁঁড় করিয়ে করিয়ে উচ্চতা মেপে বললো,
– এল্লা! বাট্টু! হিহিহি….
নাফিসা হাসতে হাসতে আবার তার ঘরের দিকে চলে গেলো। ওদিকে আশিক বুঝতে পেরে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো! আর ইমরান আশিককে তাড়া করে ঘরে চলে এলো। নাফিসা এখনো হাসছে! ইমরান তাকে কাছে টেনে নিজের সাথে মিশিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়িয়ে বললো,
– কোথায় বাট্টু? দেখোতো…. তোমার থেকে সাড়ে চার ইঞ্চি লম্বা আছি। আর দেড় ইঞ্চি হলে ছয় ফুট হতাম!
– দেড় ইঞ্চি আর হাফ ইঞ্চি। নিজের ছোটভাই থেকে তো বাট্টুই তাই না?
– মাত্র দুই ইঞ্চি শর্ট।
– হিহিহি… দুই ইঞ্চি মাত্র হয়! তাছাড়া শর্ট তো শর্ট ই!
– এই, ভালো কথা। তখন তুমি আশিককে ওটা কি বললে? জামাই আদর মানে?
– এতো কিছু বুঝতে হয় না। বেশি বুঝলে জ্ঞানী লোকের আবার জ্ঞান কমে যাবে!
– কথা এড়িয়ে যাচ্ছো। আমি কিন্তু সিরিয়াস হয়ে জানতে চাইছি।
– নিশাত আশিক ভাইয়াকে পছন্দ করে।
– কে বলেছে এই কথা?
– কাউকে বলতে হবে কেন। আমি কি দেখে বুঝি না কিছু!
– কি ভাবছো এসব! মোটেও এমন কিছু না। আমাদের কাজিনদের মধ্যে খুব ভালো রিলেশন। আলতু ফালতু টাইপ কিছু নেই।
– হ্যাঁ, ভালো রিলেশন বলেই তো জেরিন পড়ে আছে তোমার পিছে। তাই না?
ইমরানের মুখটা সাথে সাথেই ফ্যাকাসে হয়ে গেছে! তার মনেই ছিলো না জেরিনের কথা! তবুও বললো,
– জেরিন যেমন তেমন, নিশাত কিন্তু এমন না। আর না আশিক। তুমি ভুল ভাবছো।
– আশিক এমন কিনা সেটা আমি শিওর না। আর জেরিনের সাথে নিশাতের তুলনাও করছি না। তবে এটা সত্যি, আশিক ভাইয়া পছন্দ না করলেও নিশাত পছন্দ করে। ধরা পড়েছে আমার চোখে। এ নিয়ে কথাও হয়েছে তার সাথে।
– কি কথা হয়েছে? নিশাত বলেছে সে পছন্দ করে?
– না। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম। কিন্তু সে কোনো স্পষ্ট জবাব দেয়নি। নিরব ছিলো। আর জানো তো, মাঝে মাঝে নিরবতাই সব জবাব দিয়ে দেয়!
– ছোট হলেও আশিক আমার সাথে সব বিষয়ে ফ্রি। এরকম কিছু আমি তার মাঝে আদৌও দেখিনি।
– বোকার মতো কথা বললে না? তোমার বোনকে যদি পছন্দ করেও থাকে তাহলে কি সেটা তোমার কাছে এসে সরাসরি বলে দিবে? আর এসব কিছু আবার জিজ্ঞেস করতে যেওনা নিশাতকে। ভাই হোক আর যে-ই হোক, একটা মেয়ে একটা মেয়ের সাথে যতটা ইজি হয়ে কথা বলতে পারবে একটা ছেলের সাথে তেমন ভাবে কথা বলতে পারবে না। আমার কাছেই চাপা রেখেছে আর তোমার কাছে মোটেও বলবে না। আর যদি উল্টাপাল্টা কিছু বলো তাহলে হয়তো সেও ভয়ে উল্টাপাল্টা কিছু করে ফেলবে। তার বর্তমান বয়সটাই আবেগের। আবেগের বশেই এমন ভালো লাগা কাজ করছে। আবার আবেগের বশেই হয়তো উল্টাপাল্টা কিছু করে ফেলবে। তাছাড়া তোমাদের দুইভাইকেই যথেষ্ট সম্মান করে। তোমার বোনটা কিছুটা ভীতুও বটে। তার উপর চাপা স্বভাবের। তাই একটু নরমালই থেকো।
– যদি এমন কিছু হয়ে থাকে তো কথা বলে মিটমাট করতে হবে না? আগে থেকে ব্যবস্থা না নিলে তো আরও বেশি খারাপ পথে এগিয়ে যেতে পারে!
– ভুল বলনি, কিন্তু তোমার কাছে বলবে না তো সবটা। দেখি, সুযোগ পেয়ে না হয় আমি আবার জিজ্ঞেস করবো। নতুবা বড়মার সাহায্য নিবো। পরীক্ষাটা শেষ হোক। এখন ওসব কথা তুলো না।
ইমরান ছোটখাটো নিশ্বাস ফেলে বললো,
– ওকে।
– যে জন্য ডেকেছিলাম। বাসায় যাবো না?
– আমি না বললে যাবে না?
ইমরান আবারও একই কথা বললো তাই নাফিসার রাগ হলো! তাই সে কড়া কণ্ঠে বললো,
– এখন যাবো কি-না, সেটা বলুন?
– যাও।
নাফিসা তার পেটে কনুই দিয়ে মেরে বললো,
– তাহলে এবার শুনুন মিস্টার, আপনি না বললেও যেতাম। হিহিহি…
নাফিসা আলমারি খুলে জামাকাপড় নিতে লাগলো। ইমরান নিজের পেটে হাত বুলাতে বুলাতে বললো,
– সত্যি তো?
– উহুম।
– হাহাহা, জানি মিসেস। নূর, আমার পেটটা কি ইদানীং বড় হয়ে গেছে?
– জানি না।
– না, সত্যিই। দেখো তো। সকালে ওজন মেপেছিলাম। এক কেজি বেড়ে গেছি!
– আসুন, তবে মাথা কেটে ফেলে দেই। দশ কেজি কমে যাবেন।
– দাও…
– রেডি হও। সন্ধ্যার আগেই বের হবো।
– আমি যাবো না তো।
নাফিসা একটু বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকালে ইমরান বললো,
– এভাবে তাকাও কেন? অফিস যেতে হবে না? যতদিন ইচ্ছে তুমি থেকে এসো। যখন চলে আসবে তখন না হয় আমি গিয়ে নিয়ে আসবো।
– তাহলে সেটা বাবা-মাকে বলে এসো। আমি কারও কাছে কোনো জবাবদিহি করতে পারবো না।
নাফিসা ইমরানের জামাকাপড় আবার রেখে নিজের কাপড়চোপড় গুছিয়ে নিলো।
নিয়াজ উদ্দিন, আলফাজ সাহেব ও জহিরুল ইসলাম ঘুরতে বেরিয়েছিলো বিকেলের শুরুতে। এখন সন্ধ্যায় তারা ফিরে এলে মেহেরুন জহিরুল ইসলামের সাথে রাগারাগি শুরু করলো। নাহিদার এই অবস্থার জন্য তিনি সন্ধ্যার আগেই ফিরতে চেয়েছিলান। তা আর হলো না জহিরুল ইসলামের জন্য! পরক্ষণে সন্ধ্যার পরই সবাইকে যেতে হলো। প্রথমে নাহিদা, তারপর নাজিয়া, এরপর নাফিসা। দুপুরের কোলাহল পূর্ণ বাড়ি এখন শান্ত! শুধু জিহানের চেচামেচিতেই যতটুকু অশান্ত হওয়ার কথা, ততটুকুই। সবাই চলে গেলেও ইমরান জোর করে আশিককে রেখে দিয়েছে আজ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here