“তৃ-তনয়া” পর্ব- ৮৯

0
2451

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৮৯
(নূর নাফিসা)
.
.
নাফিসা রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিয়েছে। জানে একদিন না একদিন মরতে হবেই। তবুও মরণ যদি এতোটা নিকটে এসে জানিয়ে যায় সেটা কতটা কষ্টকর হতে পারে! আপনজনদের ছেড়ে হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে যাবে, সেটা ভাবতেই বুক ফেটে কান্না আসছে তার! ভিন্ন জগতে কিভাবে থাকবে একা একা! সে চলে গেলে তার প্রিয়জনরাই বা কেমন করবে কিছুই ভাবতে পারছে না। ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে! এটা ওষুধের প্রতিক্রিয়ার কারণে নয়, কেবল ভাবনার প্রেক্ষিতেই এমন অনুভব হচ্ছে! খুব মনে পড়ছে মা বাবা কে, খুব মনে পড়ছে ইমরানকে। খুব মনে পড়ছে তার দুই বোনকে! খুব দেখতে ইচ্ছে করছে তাদের।
এদিকে জেরিন এসে দরজায় নক করছে দরজা খুলার জন্য। আবিদা বেগমও ডাকছে। নিশাত তাদের হইচই শুনে বেরিয়ে এলো রুম থেকে। জানতে চাইছে কি হয়েছে। আবিদা বেগম ক্ষণে জেরিনকে বকছে, ক্ষণে নাফিসার জন্য বিলাপ করছে। নাফিসা সময় নষ্ট না করে নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে ইমরানের কাছে কল করলো। ইমরান রিসিভ করেই সালাম দিলো এবং নাফিসা জবাব দিলো। পরক্ষণে বললো,
– কি করছিলে?
– এই তো, বেশিক্ষণ হয়নি কাজে হাত লাগিয়েছি। খেয়েছো তুমি?
– হুম।
– ঘুমাওনি কেন এখনো?
– ঘুমাবো। তুমি কি কোনো কারণে রেগে আছো আমার উপর?
– না তো।
– আমি যা ভুল করেছি তুমি ক্ষমা করেছো তো?
– কি বলছো এসব? ঘুম মনে হয় একটু বেশিই কাবু করেছে তোমায়৷ একটা ঘুম দিয়ে ফ্রেশ হও।
– মস্করা কেন করছো! আমি অনেক ভুল করেছি না? অনেক কষ্ট দিয়েছি না তোমাকে? এবার ক্ষমা করে দিও। আর কখনো কষ্ট দিবো না।
– কি হয়েছে তোমার, বলোতো?
– কিছু না।
– মনটা বেশিই খারাপ মনে হচ্ছে।
– মিস করছি খুব।
– দেখি, ছুটি নিয়ে আগে ফিরতে পারি কি-না।
– তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে খুব।
– দেখা করে আসিনি?
– আরও দেখতে ইচ্ছে করছে।
– পাগলামো কম করে ঘুমাও একটু ।
– সিরিয়াসলি, দেখতে ইচ্ছে করছে।
– ব্যস্ত আছি একটু। কিছুক্ষণ পর ভিডিও কল দিচ্ছি হুম?
তারা যখন কথা বলছে, জেরিন ইমরানের ফোনে কল করে বিজি পাচ্ছে। অত:পর আরমানের ফোনে কল করলো। দুইবার রিং হলো কিন্তু রিসিভ হলো না! পরক্ষণে মনে হলো আরমান রাগ করে আছে তার উপর। তাই হয়তো রিসিভ করছে না! নিশাতকে বললো তার ফোন থেকে কল করতে। নিশাতের ফোনে ব্যালেন্স ছিলো না তাই ইমার্জেন্সি ব্যালেন্স এনে তারপর ডায়াল করলো। প্রথমবার রিং হতেই রিসিভ করলো আরমান। নাফিসার অবস্থা বলার পর সাথে সাথেই সে ইমরানের কর্মস্থলে ছুটে এলো। ইমরান মাত্রই কল কেটে কাজে মনযোগ দিয়েছে। আর অমনি আরমানের মুখে এমন কথা শুনে তার যেন দুনিয়া উলট পালট হয়ে যাচ্ছে! নাফিসা কেন এতোক্ষণ এমন করছিলো সবটা পরিষ্কার তার কাছে! সে আর দিকবিক না তাকিয়ে কাজকর্ম যেমন ছিলো তেমনই ফেলে রেখে ছুটলো বাড়ির উদ্দেশ্যে। আশেপাশের কয়েকজনও তাকিয়ে ছিলো তাদের দিকে। ইমরান ছুটছে আর নাফিসার ফোনে কল করছে। কিন্তু ফোন বিজি! ইমরানের সাথে কথা বলে কল কেটেই সাথে সাথে মায়ের কাছে কল করেছে নাফিসা। রুমানা বেগমও তার অদ্ভুত আচরণে একটু বিস্মিত হয়েছে। যখন জিজ্ঞেস করলো কিছু হয়েছে কি-না, তখন নাফিসা কান্না চাপা রাখতে পারেনি। কান্নার সাথে বলে উঠলো তার ওই বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করছে। হঠাৎ করেই অনেক খারাপ লাগছে আর ইচ্ছে করছে সেখানে যেতে। রুমানা বেগম এই বলে মেয়েকে সান্ত্বনা দিলেন, ইমরানকে বলবে বিকেলে নিয়ে আসতে। নাফিসা যে-ই এখন যাওয়ার ইচ্ছে পোষণ করলো, রুমানা বেগম বললেন তার বাবাকে পাঠাবে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আরও কিছুক্ষণ কথা হলো মা মেয়ের মধ্যে। বাবা বাসায় ছিলো না বিধায় কথা হলো না। আর মায়ের সাথে কথা বলে তো তৃপ্তিও মিটছে না যে বাবাকে আলাদাভাবে কল করে একটু কথা বলবে!
বাইরে থেকে জেরিন, নিশাত ডাকছে কিন্তু কোনো সাড়া নেই নাফিসার! ডানপাশের জানালাটাও বন্ধ! সারা রাস্তা কল করতে করতে এবং সূরা ইউনুস পড়তে পড়তে ইমরান বাসায় হাজির। সে কিভাবে রাস্তা অতিক্রম করে এসেছে আল্লাহ ই ভালো জানেন। দরজায় নক করছে কিন্তু দরজা খুলছে না! জানালায় নক করলো তাতেও লাভ হলো না। আবার দরজার কাছে এলো৷ স্টিলের বক্স ডোর যেটা ভেঙে ফেলারও উপায় নেই! একমাত্র কাটার মেশিনই প্রয়োগযোগ্য। কিন্তু সেটা এখন পাবে কোথায়! যখন মায়ের মুখে জানতে পারলো জেরিন খিচুড়ির সাথে টেবলেট মিশিয়ে দিয়েছে তখন জেরিনকে চোখে পড়লে জেরিনের গলা চেপে ধরলো সে! নিশাত তাকে টেনে ছোটানোর চেষ্টা করা মাত্র ছেড়ে দিয়েছে ইমরান। কেননা তার এখন নাফিসাকে প্রয়োজন। একে তো পরেও দেখে নেওয়া যাবে। ইমরান নাফিসাকে ডাকতে ডাকতে এবার পেছনের জানালার দিকে নজর দিলো। সেই জানালা খোলা আছে। সে ঘরের পেছন দিকের জানালার কাছে এসে ডাকলো। নাফিসা ফোন হাতে নিয়ে খাটে হেলান দিয়ে মেঝেতে বসে আছে। তার যেন আশেপাশের কোনো খেয়াল নেই। কথা কানে যাচ্ছে ঠিকই কিন্তু মস্তিষ্কে পৌছাতে পারছে না। কিছু শুনছে না বিধায় যখন ইমরান চিৎকার করে ডাকলো তখন নাফিসার ধ্যান ভাঙলো। নাফিসা তাকে জানালা দিয়ে দেখা মাত্র হু হু করে কেদে উঠলো! ইমরান দরজা খুলতে বললে সে উঠে দাড়ালো। মাথাটা কেমন যেন ভারি ভারি লাগছে। সে দরজা খুলতেই ইমরান দ্রুত পায়ে রুমে প্রবেশ করলো। নাফিসার চোখ মুখ ফোলে গেছে। ইমরান তার মুখখানা দু’হাতে ধরে বললো,
“কি হয়েছে?”
নাফিসা কোনো কিছু না বলে তাকে জড়িয়ে ধরে ভীষণ কাদছে। ইমরানের ভেতরটা আর মানছে না! কি করবে সেটাও বুঝতে পারছে না! আবিদা বেগম বলছে হসপিটাল নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু কিভাবে! সে তো নাফিসাকে সোজা করেও দাড় করাতে পারছে না। চেচামেচি শুনে আশেপাশের কয়েকজন জমা হয়ে গেছে বাড়িতে।
এদিকে আরমান অফিসের ভার অন্য একজনের হাতে দিয়ে ইমরানের পরপরই বেরিয়ে এসেছে। সে রিজার্ভ সিএনজি নিয়ে বাসায় চলে এসেছে। ইমরানকে বলে তারা নিকটবর্তী হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। ইমরান আরমান ও সাথে নিশাত গেছে। নাফিসার চোখ নিভু নিভু হয়ে আসছে! ইমরানের প্রায় কাদো কাদো অবস্থা! সে বারবার কথা বলতে চাইছে চোখ খুলে রাখার জন্য। কিন্তু তার যে সেই শক্তি বিদ্যমান নেই! ইমরান বললো,
– খারাপ লাগছে খুব?
– মাথাটা প্রকটভাবে চক্কর দিচ্ছে!
– নাফিসা, বমি করার চেষ্টা করো।
– আসে না তো।
– মুখের ভেতর হাত দাও।
নাফিসা মুখে হাত দিয়ে চেষ্টা করলো। কিন্তু চেষ্টা বৃথা! মাঝ রাস্তায় এসে নাফিসার চোখ বন্ধ হয়ে গেছে! ইমরান ডাকছে কিন্তু চোখ খুলছে না! ভয়ে তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে! নিশাত কান্না ই শুরু করে দিয়েছে! ইমরান খুব ভয়ার্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করলো,
– ভাইয়া, নাফিসা চোখ খুলছে না!
সামনের সিটে বসা আরমান চমকে পেছনে তাকালো! তার ভেতরেও ভয় চেপে গেছে! সে কিছু বলার আগেই ইমরান নাফিসার নাকের কাছে হাত রাখলো। শ্বাস প্রশ্বাস চলছে কিন্তু অস্বাভাবিক! ইমরান চেচিয়ে বললো,
– গাড়ি এতো আস্তে চলছে কেন!
যদিও গাড়ি যথেষ্ট জোরে চলছে। ড্রাইভার আরও একটু স্পিড বাড়িয়ে দিলো ইমরানের পাগল পাগল অবস্থা দেখে! আরমান ড্রাইভারকে ইশারা করলো বেশি তারাহুরো না করতে। এক বিপদ কাটাতে না আবার অন্য বিপদ ডেকে আনে!
কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা হসপিটালে চলে এলো। প্রায় এক ঘন্টার মতো হয়েছে নাফিসা খাবার খেয়েছে। এখন সে সেন্স লেস! তারউপর হসপিটালে এসে ফি পরিশোধ করে ভর্তির কার্যক্রম আগে সম্পাদন করতে বলা হলে ইমরান খেপে গেলো!
“আপনারা রোগীর সেবা দিতে হসপিটাল চালু করেছেন না ইনকাম করতে? মানুষ মরে যায় আর আপনাদের কাছে টাকা বড় হয়ে গেছে! টাকা কি না দিয়ে চলে যাবো? মানবিকতা বলতে কিছু নেই নাকি? এমন হলে হসপিটাল ধুলোয় মিশিয়ে দিতে দ্বিধা করবে না পাবলিক!”
রিসিপশনিস্ট ভয় পেয়ে গেছে তার চিৎকারে! আশেপাশের লোকজনও তাকিয়ে আছে ইমরানের দিকে। আরমান তাকে থামতে বলে তার এক ফ্রেন্ডের কাছে কল করলো যে এই হসপিটালেরই একজন চিকিৎসক। কিন্তু সেই ব্যক্তি এখন হসপিটালে নেই, তবুও তিনি কল করে ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।
চিকিৎসা চলছে নাফিসার। বাইরে অপেক্ষারত তিন ভাইবোন। নিশাত বড়মা কে কল করে জানিয়েছে, আরাফকে জানিয়েছে।
কিছুক্ষণ পর ইমরান একটু এগিয়ে এসে থিয়েটারের দরজার উপরের অংশ দিয়ে ভেতরে তাকালো। স্বচ্ছ কাচের বিপরীতে দৃষ্টি দেখতে পেল নাফিসার নাকে মুখে নল লাগানো! দৃশ্যটা দেখার মতো নয়! তার কলিজাটা যেন কেউ খুব শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছে। কখনো ভাবতেও পারেনি এমন দিন আসবে! কিভাবে ভাববে! সম্পূর্ণ জীবনটাই যে ভাবনার আড়ালে! সকালটা তো খুব সুন্দর ছিলো, সে বাড়ি ছাড়তেই কেন সুন্দর রূপটা কুৎসিত রূপে পরিণত হলো! মেয়েটার গত কয়েকদিন শুধু কান্নাকাটির মাঝেই কাটছে, আর আজ যে তা ভয়ংকর রূপ ধারণ করলো! বিপদ আপদ দুঃখ কি পিছু ছাড়বে না কভু!
ইমরানের কাধে কারো হাতের স্পর্শ পড়তেই ইমরান ঘুরে তাকালো। আরাফকে দেখে সে ঝাপটে ধরে এবার কান্নাই করে দিলো!
– পারলাম না ভাইয়া! তোমার বোনের খেয়াল রাখতে পারলাম না আমি! বরং তার সুন্দর জীবনটাকে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতিতে ফেলে দিলাম!
– চুপ কর। নিজেকে শক্ত কর। আল্লাহ ভরসা, কিছু হবে না।
আরাফ যথাযথ শান্ত করে জিজ্ঞেস করলো বাবা মা কে জানিয়েছে কি-না? উত্তরে ইমরান “না” বললো। আরাফ একটু ভেবে জানাতে নিষেধ করলো। কেননা নিয়াজ উদ্দিন ব্রেইন স্ট্রোক করেছেন কিছুদিন আগে। হঠাৎ এমন কিছু শুনলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। ইমরান যখন বললো তাদের না জানালেও তো অপরাধ হয়ে যাবে, তখন আরমান বললো ডাক্তারের ইনফরমেশন দেওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে। তারা তা-ই করছে। কিছুক্ষণ পর ডাক্তারের সাথে কথা বলে জানতে পারলো, তাদের মতে পরিপাকতন্ত্র খাবার সম্পূর্ণ ভাবে শোষণ করতে পারেনি বিধায় দেহে ওষুধের প্রতিক্রিয়া কম কার্যকর হয়েছে। যার ফলে সুস্থ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
ইতোমধ্যে বড় মা তার ভাইয়ের বাসা থেকে সোজা হসপিটাল চলে এসেছে। ডাক্তারের কথায় কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে আরাফ রুমানার কাছে কল করে জানালো নাফিসা হসপিটাল আছে। কিন্তু সম্পূর্ণ ঘটনা বলেনি, শুধু জানিয়েছে ঘুমের ট্যাবলেট খাওয়াতে সমস্যা হয়েছে তার।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here