“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৯
(নূর নাফিসা)
.
.
একমাস শেষ হতে আরও দুদিন বাকি। টাকার ব্যবস্থা এখনও পুরোপুরি হয়নি। আলফাজ সাহেবের দোকানটা বিক্রি করে দেওয়ার প্রচেষ্টা চলছে। ওটা বিক্রি করতে পারলে হয়ে যাবে।
আরাফ রাতে খাওয়ার পর রুমে বসে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার খাতা দেখছিলো। এমন সময় আশিক এসে নক করলো,
– ভাইয়া আসবো?
– হুম, আয়। কোথায় থাকছ আজকাল! দেখাই যায় না তোকে! এক্সাম না চলছে?
– হুম।
– কেমন হচ্ছে?
– হচ্ছে আলহামদুলিল্লাহ।
– খেয়েছিস?
– না, যাবো এখন। তার আগে ভাবলাম টাকাটা দিয়ে যাই তোমার কাছে।
– কিসের টাকা!
আশিক টাকা এগিয়ে দিয়ে বললো,
– নাও, ধরো। এখানে বিশ হাজার টাকা আছে। বাবার ঋণ পরিশোধের জন্য যোগাড় করলাম।
আরাফ ব্রু কুচকে বললো,
– এতো টাকা কোথায় পেলি?
আশিক মৃদু হেসে বললো,
– চুরি ছিনতাই করিনি। কাজ করেই এনেছি।
– ওইদিন না দশ হাজার দিয়েছিস, এখন আবার বিশ হাজার! এতো টাকা কি কাজ করে পেলি তুই?
– গার্মেন্টসে যোগ দিয়েছিলাম।
আশিকের কথা শুনে অবাক হয়ে তাকালো আরাফ! আশিক দৃষ্টি নিচের দিকে নামিয়ে বলতে লাগলো,
– এমন করে তাকিয়ে আছো কেন! গার্মেন্টসে কাজ করা কি অপরাধ! পরিস্থিতি বুঝেই তো যোগ দিয়েছিলাম।
– গার্মেন্টসে এ-ই ক’দিন কাজ করে নিশ্চয়ই বিশ হাজার টাকা আসবে না!
– ফ্রেন্ডের সহযোগিতায় তার মামার গার্মেন্টসে যুক্ত হতে পেরেছি। সপ্তাহে ৩০০০টাকা মজুরি ছিলো। চার সপ্তাহে ১২০০০ টাকা পেয়েছি। বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তিনটা টিউশনি করেছি, তিনহাজার করে ৯০০০টাকা। আর একটা টিউশনি ফি এডভান্স নিয়েছিলাম বিশ হাজার টাকা মিল করার জন্য।
আরাফ হতবাক হয়ে গেছে আশিকের কথায়! এতোটা পরিশ্রম করে চেহারার অবস্থা করেছে নাজেহাল! অথচ সেদিকে কোনো খেয়াল নেই, ভেবেছে শুধু বাবার ঋণ পরিশোধের কথা! খুব গর্ব হচ্ছে তার ছোট ভাইকে নিয়ে! পরিশ্রম করতে জানে তার ভাইটা! ভাবনা একদিকে ফেলে জিজ্ঞেস করলো,
– আর পড়াশোনার খরচ?
আশিক আরাফের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের এক কোনে হাসি ফুটিয়ে বললো,
– পড়াশোনার খরচ তো এমন পরিস্থিতিতে ধাবিত হওয়ার আগেই পুষিয়ে নিয়েছিলাম টিউশনি করে। সেখান থেকেই তো অবশিষ্ট দশ হাজার টাকা দিয়েছিলাম। এখন খরচ বলতে শুধু পরীক্ষার যাতায়াত খরচটাই। এক্সাম সেন্টার দূরে না হওয়ায় সেটা বাকি টাকাতেই হয়ে যাচ্ছে। টাকাটা নিবে না? না নিলে তো আমার প্রচেষ্টা ব্যর্থ! পরিবারের কোনো কাজে আসতে পারলাম না আমি!
আরাফ হাত বাড়িয়ে টাকাটা নিয়ে বললো,
– পরিবারের গর্বিত সন্তান তুই। এতো ব্যস্ততার মাঝে পড়াশোনা নিশ্চয়ই করতে পারছিস না! এক্সাম কিভাবে দিচ্ছিস!
– আগের পড়া আছে না, সেটাতেই চলে যাচ্ছে। তাছাড়া একটু আধটু রিভিশন তো আছেই।
নাজিয়া রুমে এসে বললো,
– আশিক তুমি এখানে! আমি রুমে খুজে এলাম তোমাকে। খাবে না? খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
– হ্যাঁ, আসছি।
আরাফ বললো,
– যা খেয়ে নে। আর হাপাতে হবে না উপার্জনের জন্য। তোর টাকা নিয়ে এবার পরিপূর্ণ ব্যবস্থা হয়ে গেছে।
– আচ্ছা।
সবার খাওয়া শেষ হয়ে গেলে নাজিয়া সব গুছিয়ে তার রুমে চলে এলো। আরাফ এখনো খাতা দেখছে। নাজিয়া পাশে বসে বললো,
– আমি দেখে দিব?
– কোনো প্রয়োজন নেই। ঘুমাও।
– কেন, দেখলে কি হয়! তোমার কাজই তো একটু সহজ হয়ে যাবে।
– আমার হাত-পা মাথা সবই আছে। সুতরাং তোমার অতিরিক্ত সহযোগিতার কোনো প্রয়োজন নেই। একটা কথাও আর বলবে না। কাজে প্রব্লেম হচ্ছে আমার!
গত কয়েকদিন ধরে লক্ষ্য করছে আরাফ তার সাথে তেমন একটা কথাবার্তা বলছে না! তাকে যেন ইগনোর করে চলছে। ধরে নিয়েছে আরাফ টেনশনে আছে তাই এমন করছে। কিন্তু একটুখানি ভালোভাবে কথা বললে কি এমন হয়ে যায়! প্রিয় মানুষের কাছে অবহেলা কি ভালো লাগে! তবুও নাজিয়া কোনো প্রতিবাদ করে না। প্রতিবারের মতো এবারও অবহেলা মেনে নিয়ে চুপচাপ বিছানার এক কোনে শুয়ে পড়লো। নিরবে এক ফোটা দু ফোটা চোখের জল গড়িয়ে বালিশ ভিজে যাচ্ছে যেটা আরাফের চোখে পড়ছে না। পড়বেই কিভাবে! সে তো বিপরীতমুখি হয়ে শুয়ে আছে! কিছুক্ষণ পর কাথা টান পড়তে বুঝতে পারলো আরাফ শোয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। আরাফ শুয়ে পড়তেই নাজিয়া চোখমুখ মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করলো। অত:পর, বালিশটা খাটের মাঝামাঝি টেনে নিলো। তবুও বালিশ ছেড়ে আরাফের বুকের উপর মাথা রাখতে গেলো কিন্তু আরাফ বরাবরের মতো সরিয়ে দিতে চাইলো। নাজিয়া আরাফের হাত ধরে ফেললো এবং বললো,
– এমন করছো কেন আমার সাথে? এতো টেনশন কেন তোমার! ব্যবস্থা তো হয়েই গেছে তাই না!
– তাই বলে কি তোমাকে আমার উপর থাকতে হবে!
– এক সময় তো নিজেই টেনে নিয়ে আমাকে লোভ ধরিয়ে দিয়েছো! তাহলে এখন ছুড়ে ফেলে দিচ্ছো কেন!
– সেটাই ভুল করে ফেলেছিলাম আমি! বুঝা উচিত ছিলো আমার, কাউকে এতো বেশি কাছে টেনে আপন করে নিতে নেই!
নাজিয়া কান্নাজড়িত হয়ে বললো,
– কি বলছো এসব! আমার অপরাধটা কি সেটাই তো আমি বুঝতে পারছি না!
– গলার চেইন কোথায়?
নাজিয়া হতবাক হয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে আরাফের চোখের দিকে তাকালো। এই জবাব সে কিভাবে দিবে! সাথে সাথেই আবার দৃষ্টি সরিয়ে সে নিজের বালিশে চলে যাওয়ার জন্য আরাফের উপর থেকে হাত সরিয়ে নিতে লাগলো। কিন্তু আরাফ সেটা হতে দিলো না। বাহু চেপে ধরে আবার বললো,
– চেইন কোথায়, বলো? নিষেধ করেছিলাম না তোমাকে? শুনেছিলে আমার কথা! বাবার কাছে নিয়ে লুকিয়ে দিয়ে এসেছিলে বেচে দেওয়ার জন্য! শুনবেই কিভাবে! আমাকে কখনো আপন ভেবেছো নাকি! এই মেয়ে, বাবা-মায়ের দেওয়া উপহার এভাবে নিশ্চিহ্ন করতে তোমার হাত কাপলো না! আমার কথা বাদই রাখলাম, তুমি বালা জোড়া কিভাবে দিতে পারলে!
নাজিয়ার বুঝতে বাকি নেই আরাফ সবটা জেনে গেছে! নিশ্চয়ই তার শ্বশুর আলফাজ সাহেব জানিয়ে দিয়েছে! আরাফের কথা অমান্য করেছে বিধায় তার দৃষ্টিতে দৃষ্টি নিক্ষেপ করার মতো সাহস নেই নাজিয়ার! সে চোখ খিচে বন্ধ করে কাদতে কাদতে বললো,
– কি করবো আমি! দেখতে পারছিলাম না তোমার দুশ্চিন্তা! সহ্য হচ্ছিলো না তোমাকে পাগলের মতো চিন্তায় পড়ে থাকতে দেখে! শুধু হাত কাপেনি আমার, হৃদপিণ্ডটাও কেপেছে মা ও স্বামীর দেওয়া উপহার হারিয়ে ফেলেছি বলে! কেননা, পরিবারটা তো আমারই তাই-না! বিয়ের পরদিন মা আমাকে বলেছিলো বিয়ের পর মেয়েদের আসল ঠিকানা স্বামীর বাড়ি। এখানে যেন সকলের মন রক্ষা করে চলি। সকলের যত্নাদির খেয়াল রাখি! পরিবারের বিপদে যেন সময় সর্বদা পাশে থাকি! কারো কটু কথার উপর যেন কখনো জবাব না দেই। তাহলে কিভাবে আমি মা বাবার দেওয়া শিক্ষা অমান্য করি বলো! কিভাবে আমি সেই পিতামাতার আদেশ অমান্য করে তাদের অসম্মান করি! বিপদেই তো পাশে থাকতে চেয়েছি। খুব অল্প সময়ে আমি তোমাকে নিজের থাকেও ভালোবেসে ফেলেছি আরাফ! তাই সহ্য হচ্ছিলো না চোখের সামনে দেখা তোমার করুন অবস্থা! এটা কি আমার অপরাধ! তাহলে দাও আমাকে শাস্তি, মাথা পেতে নিবো আমি।
আরাফ নাজিয়ার মাথাটা টেনে বুকে চেপে ধরলো। নাজিয়া এখনো চোখ বন্ধ করে আছে তবে আরাফকে ধরে কান্নার বেগ বেড়ে গেছে অনেক! বাধা দিচ্ছে না আরাফ। যত পারে কান্না করুক! মনটা হালকা করুক বুকের পাথর ঠেলে ফেলে! বাধা দিবে কেন, সৃষ্টি করুক না তার বুকে প্রেমজোয়ার! তাকে নিয়ে সেই জোয়ারে ভেসে যেতে চায় আরাফ! চাইবেই না কেন, এমন একজনকে নিয়ে তো অনন্তকাল পাড়ি দেওয়া যায়! যে এতো সহজে মানুষজনকে আপন করে নিতে পারে, অন্যকে ভেবে সর্বদা আত্মবিসর্জন দিতে প্রস্তুত থাকে! দুহাতে একক ভাবে সবাইকে সামলে নিতে পারে! কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই! আর না আছে প্রতিবাদ!
নাজিয়ার কান্নার বেগ কমে এলে আরাফ মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
– বিক্রি হতে দেইনি তোমার ভালোবাসা। বাবা তোমাকে ফিরিয়ে দিতে না পেরে আমার কাছে দিয়েছে সেগুলো। আলমারিতে রাখা আছে। আর কখনো এমন কাজ করতে যাবে না। প্রয়োজন হলে আমিই চেয়ে নিব তোমার কাছে।
নাজিয়া মাথা তুলে বললো,
– তাহলে এতো টাকা পরিশোধ করবে কি ভাবে!
আরাফ নাজিয়ার চোখ মুছে দিতে দিতে বললো,
– হয়ে গেছে তো। দুভাই নেমেছি উপার্জনে। জমা, বকেয়া, অগ্রিম সব মিলিয়ে যোগাড় হয়ে গেছে আলহামদুলিল্লাহ। আর কোনো চিন্তা নেই। এবার আস্তে আস্তে আবার সচ্ছলতায় অগ্রসর হতে পারলেই হবে।
– টিশার্ট খুলে ফেলো। ভিজে গেছে।
– ওকে।