“তৃ-তনয়া” পর্ব- ৯০

0
2570

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৯০
(নূর নাফিসা)
.
.
স্বজনরা সারাদিন পেরিয়ে সন্ধ্যার পূর্বে কাছে থেকে দেখতে পেয়েছে নাফিসাকে। মা বাবা, আপু, ভাইয়া, স্বামী, ভাসুর, ননদ সবাই হসপিটালে আছে। এতো মানুষজনকে তার আশেপাশে দেখে চোখের দুই ধার বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। অনেকের চোখই ভেজা ভেজা। রুমানা বেগম নাফিসার মাথার পাশে বসে বললো,
– কেমন লাগছে মা?
নাফিসা শুধু চোখে পলক ফেললো। বাবার চোখটাও যেন ভেজা ভেজা, মুখটা গম্ভীর! সবার মাঝে ইমরানকে খুঁজে দেখলো ইমরান অপলক তাকিয়ে আছে তার দিকে। কেমন যেন অপরাধী মনোভাব নিয়ে দাড়িয়ে আছে সে!
নাফিসার পরিবারের লোকজন কমবেশি সবাই জেনে গেছে জেরিন এমনটা করেছে। আরমান নিজেই জানিয়ে দিয়েছে। আরাফ সকলের মন হালকা করতে এর কারণটা গুটিয়ে নিয়েছে। আর ইমরান ছিলো নিশ্চুপ! কি বলবে! তার বলার মতো কিছুই নেই! তার উপর থেকে জেরিনের নজর তুলতে গিয়ে নাফিসার জীবনটা নষ্ট করে দিলো, বারবার এই ভেবেই নিজেকে সব কিছুর জন্য দোষারোপ করছে সে। জেরিন এতোটা জঘন্য কাজ করবে সেটা সম্পূর্ণ ধারণার বাইরে ছিলো!
সন্ধ্যায় আরাফ, ইমরান, বড় মা ও রুমানা বেগম ছাড়া বাকি সবাই চলে গেছে। খামারে মুরগী থাকায় নিয়াজ উদ্দিনকে চলে যেতে হয়েছে আর তিনি একা বাসায় থাকবেন বলে রান্নাবান্নার জন্য নাজিয়া বাবার সাথে বাসায় চলে এসেছে। রাত ন’টার দিকে আরাফ বড় মা ও রুমানা বেগমকে খাওয়ার জন্য নিয়ে গেলে ইমরান নাফিসার সাথে কথা বলার সুযোগ পেয়েছে। নাফিসার মাথায় হাত বুলিয়ে ধাধানো স্বরে বললো,
– তুমি সকালে আমাকে কল করেছো অথচ তোমার এই অবস্থার কথা বলোনি কেন?
নাফিসা চুপ করে আছে। ইমরান আবার বললো,
– খুব বেশি বিরক্ত হও আমার প্রতি? এতোটাই অপছন্দের আমি? আচ্ছা, আমি না হয় অপছন্দের, তো বাবা মা? উনারা কি তোমার প্রিয়জন না? তাহলে এতোটা জঘন্য কাজ কিভাবে করতে পারলে?
ইমরান যখন কথাগুলো বলছিলো নাফিসা একটু অবাক হয়ে অবুঝের মতো তাকিয়ে ছিলো! কি বলছে এসব! তার এসব কথার মর্মার্থ কি! কিন্তু যখন বললো,
– কিভাবে পারলে সকলকে ছেড়ে এভাবে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে! মরে যাওয়া কি এতোটাই সহজ? তুমি যদি সাথে সাথে আমাকে কল করে বলতে, আমি কি ছুটে আসতাম না? সাথে সাথে হসপিটাল নিয়ে এলে কি এতোটা অসুস্থ উপলব্ধি করতে হতো এখন?
এবার নাফিসা বুঝতে পারলো তাকে জানায়নি বলে এতোটা রেগে কথা বলছে। তাই সে দৃষ্টি নত করে চুপচাপ হয়ে আছে। ইমরানও অভিমান নিয়ে কিছুক্ষণ নিরবে বসে রইলো। পরক্ষণে নিজেকে একটু শান্ত করে বললো,
– কেমন লাগছে এখন তোমার, বলোতো একটু?
– মাথা খুব ব্যথা করছে, আর হঠাৎ হঠাৎ যেন আমিসহ সব উল্টে যাচ্ছে।
– এরকম কিছু হতে পারে সেই ধারণা যদি বিন্দুমাত্রও থাকতো তাহলে আমার জীবনের সাথে কখনোই জড়াতাম না তোমাকে।
যদিও ইমরান তার জন্য ব্যথিত হয়ে বলছে তবুও কথাটা নাফিসার মোটেও পছন্দ হলো না। সে বললো,
– আপনার জীবনে এসে কি খুব ভুল করে ফেলেছি আমি? যার জন্য এখন ছাটাই করতে চাইছেন!
এই মুহূর্তে তার মুখে এমন কথা শুনে ইমরান বিস্মিত হলো! এবং সাথে সাথেই বেড ছেড়ে মেঝেতে হাটু ভেঙে বসে নাফিসার মুখোমুখি হয়ে বললো,
– তুই কেন ভুল করবি? ভুল তো আমি করেছি তোকে আমার জীবনে এনে! এই ভুলটা শুধরে নেওয়ার একটা সুযোগ দে আমায়। জীবনটাকে উৎসর্গ করে দিবো তোর তরে। ছাটাই হতে হলে নিজে সবকিছু থেকে ছাটাই হয়ে হারিয়ে যাবো তোর মাঝে। সত্যি বলছি, একটু সুযোগ দে। আর সুযোগের সাথে আমাকেও একটু প্রিয় করে নে।
নাফিসা অতি সুখে কাদছে এখন। হঠাৎই চোখ ঘোলাটে হয়ে গেছে, এবং মাথাটাও এক ঝাটকায় চক্কর দিয়ে উঠেছে! নাফিসাকে কপালে ভাজ ফেলে এভাবে চোখ খিচে বন্ধ করতে দেখে ইমরান চমকে বলে উঠলো,
– কি হলো?
নাফিসা দুইবার দীর্ঘ শ্বাস টেনে মাথা নাড়িয়ে ইশারা করলো কিছু হয়নি। পরক্ষণে আবার নিভু নিভু চোখে তাকিয়ে ইমরানের উক্ত কথার প্রেক্ষিতে বললো,
– তুই তো আমার সেই প্রিয় ই।
– মিথ্যে বলছিস কেন? আমি প্রিয় হলে তুই এতোবড় ভয় দেখাতে পারতি আমাকে! লুকিয়ে রাখতে পারতি এতো বড় ঘটনা!
নাফিসা কান্নাজড়িত কন্ঠে বললো,
– আর লুকিয়ে রাখবো না কখনো।
ইমরান হাত বাড়িয়ে বৃদ্ধা আঙুলে চোখের ধার মুছে দিয়ে বললো,
– কি থেকে কি হয়েছিলো, সবটা কি মনে আছে? হসপিটাল থেকে বাসায় গিয়ে আমি থানায় ডায়েরি করবো। তোমার হেল্প লাগবে। আজই করতাম, কিন্তু পুলিশ এখানে এসে বিরক্ত করবে তাই ইনফর্ম করিনি। ডাক্তারকেও নিষেধ করেছি বাইরে এসব বিষয় না ছড়াতে।
– কার বিরুদ্ধে ডায়েরি করবে?
– তুমি জানো না কার বিরুদ্ধে? ভাইয়ার কাছে আমি অলরেডি পারমিশন পেয়ে গেছি, তুমি কিন্তু বরাবরের মতো ভালো সাজতে এসো না। বেশি ভালো ভালো না। এতো সহজে সব ভুলতে বসো না। এসব মার্ডারারের জন্যই জেলখানা তৈরি হয়েছে।
– মার্ডারারের জন্য জেলখানা, তার আগে মার্ডারারের অবস্থানটা তো দেখো একবার। এলাকা জুড়ে নিজের বাড়ির বদনাম করে ফেলবে বাড়িতে পুলিশ এনে। যেটা মোটেও ভালো দেখায় না। তাছাড়া, আইন সবসময় সঠিক শাস্তি দিতে পারে না। আজ ইন, তো কাল আউট। আর এভাবে কোনো মানুষকেও শুধরে নিতে দেখিনি আমি। বরং আরও খারাপ হতে দেখেছি।
– এক কথা ই না বললাম, বেশি ভালো ভালো না!
নাফিসা বিড়বিড় করে বললো,
– ঘরোয়াভাবেও শাস্তির ব্যবস্থা করা যায়। সেটাই বলছিলাম, মানুষ ভালো হলেই তো সবার জন্য ভালো।
এমনি নার্স প্রবেশ করলো কেবিনে। নাফিসাকে দেখে বললো,
– ঘুম ভেঙেছে তাহলে আপনার!
নাফিসা জবাব দিলো,
– না, এখনো তো ঘুমিয়েই আছি।
ইমরান মুচকি হেসে বসা থেকে উঠে দাড়ালো। নার্সও মৃদু হেসে বললো,
– বাহ! ফ্রেশ মাইন্ডে আছেন বলে মনে হচ্ছে! বডিতে পেইন আছে?
– মাথায়।
বড় মা ও রুমানা বেগমকে কেবিনে নিয়ে এসে আরাফ ইমরানকে নিয়ে গেলো ডিনারের জন্য। দুপুরেও খাওয়া হয়নি তাদের। এদিকে নাফিসা একটু পরেই আবার ঘুমিয়ে পড়েছে।
দুইদিন হসপিটালে কাটিয়ে তারা তৃতীয় দিন বাড়িতে ফিরে এলো নাফিসাকে নিয়ে। রুমানা বেগম নিজের কাছে নিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু নাফিসা যায়নি। এমনিতেই বাবা অসুস্থ, খামারে মুরগী, আবার সে গেলে তার খেয়াল রাখতে হবে। মা একা হয়ে আর কতদিক সামলে নিবে! নাফিসা যখন বলেছিলো সে মায়ের সাথে যাবে না, তখন ইমরানের চেহারায় যেন উৎফুল্লতা কাজ করছিলো। যেটা খুব সহজেই ধরা পড়েছে নাফিসার চোখে। আরাফও খামারের ঝামেলার কথা বলে নাফিসাকে ইমরানের বাসায় যেতেই সাপোর্ট করলো।
হসপিটালে এই দুইদিন রুমানা বেগম ও ইমরান থেকেছিলো নাফিসার সাথে। আজ বাড়িতে ফিরে গোসল এবং খাওয়াদাওয়া করলো নাফিসা। আবিদা বেগমও নাফিসার শরীর কেমন আছে তা জিজ্ঞেস করলো। সবই ঠিক আছে কিন্তু জেরিনকে দেখা যাচ্ছে না। জিহান সহ সবাই বাড়িতে, তাহলে জেরিন কোথায়! ইমরানকে তো তার বিষয়ে কিছু জিজ্ঞাসাও করা যায় না৷ কিছু বললেই কেমন যেনো ক্ষেপে যায়! আজ খাওয়াদাওয়া বাদে বাকিটুকু সময় ঘুমেই কাটলো। পরদিনও ইমরান অফিসে গেলো না নাফিসার জন্য। এক সপ্তাহের মতো ছুটি নিবে সেটাই ভাবছিলো সে। কিন্তু নাফিসা নিষেধ করলো। সে অচল নয়। নিজ নিজে চলতে পারে। তাছাড়া বাড়িতে বড় মা, আবিদা বেগম নিশাত যথেষ্ট খেয়াল রাখছে তার। সুতরাং ইমরানের ছুটি কাটানোর কোনো প্রয়োজন নেই। সে পরিস্কার বলে দিলো, আগামীকাল থেকে যেন অফিস যায়।
আজ বিকেলে ঘুম থেকে উঠলে জিহানকে নিয়ে নিশাত এলো তার কাছে। অন্যান্য বিষয়ে কথা বলতে বলতে সে কথার ছলেবলে জেরিনের কথা জিজ্ঞেস করে ফেললো। নিশাত তো বাড়িতে ছিলো, সে নিশ্চয়ই সবটা জানবে আর ইজিলি শেয়ার করবে। নিশাত জিহানকে বড় ঘরে পাঠিয়ে দিয়ে নাফিসার সাথে কথা বললো। নাফিসা খুটিয়ে খুটিয়ে প্রশ্ন করে তার কাছে জেনে নিলো,
সেদিন জেরিনই আরমানকে কল করে ইমরানকে নাফিসার কথা জানিয়েছিলো। নিজ হাতে ভয়ানক কার্য সম্পাদন করে আবার নাফিসাকে নিয়ে ভয় পেয়ে কান্নাও করেছিলো। সন্ধ্যায় যখন আরমান নিশাতকে সাথে নিয়ে বাসায় ফিরে এসেছে, তখন আরমান মেরেছে জেরিনকে। আবিদা বেগমও বকেছে দিনে। আরমান নাকি আগে থেকেই জানতো ইমরানের প্রতি সে দুর্বল আর ইমরান তার প্রতি বিরক্ত। কেউ তাকে কিছু না জানালেও তার চোখে পড়েছে জেরিনের আচরণগুলো। আর যখন পড়েছে তখন ওয়ার্নিংয়ে রেখেছিলো তাকে। এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে মাঝে মাঝে কথা কাটাকাটিও হয়েছে। কাউকে বুঝতে দেয়নি সেটা। নিজের সাধ্যমতো সে চেষ্টা করেছে তাকে শুধরে নেওয়ার। কিন্তু বারবার সাবধান করা সত্ত্বেও জেরিন সীমা লঙ্ঘন করেছে। তাই তাকে আর সুযোগ দেওয়া যায় না। জেরিন আরমানের পা ঝাপটে ধরে ক্ষমা চেয়েছিলো। কিন্তু আরমান তাকে উপেক্ষা করে সরাসরি তার মায়ের কাছে কল করে বলেছে তাদের মেয়েকে নিয়ে যেতে। রাতেই তার বাসা থেকে লোকজন আসে। আরমান এভাবে জেরিনকে মেরেছে বিধায় তার পরিবার আরমানের উপর ক্ষেপে গেছে। এবং আরমান ও আবিদা বেগমের সাথে রাগারাগি করে নিজেদের মেয়েকে নিয়ে চলে গেছে। যদিও জেরিন তার পরিবারের বিরুদ্ধে থেকে বারবার আরমানের কাছে ক্ষমা চেয়ে চিৎকার করছিলো সে যাবে না। কিন্তু কেউ তাকে একটা বারের জন্যও আটকালো না। বরং আরমান পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে তাকে ডিভোর্স দিবে! তা দেখে এবং শুনে তার পরিবার আরও জোরপূর্বকই তাকে নিয়ে গেছে এখান থেকে। এর একটা ভালো সমাধান চাইলে না হয় তারা একজোট হয়ে ভাবতো, কিন্তু এমন ডিরেক্ট ইগনোর আর সইতে পারেনি। জেরিন জিহানকে ঝাপটে ধরে রেখেছিলো, সে যাবে না এখান থেকে, তার ছেলেকেও সে দূরে সরাবে না। কিন্তু আরমান জিহানকে কখনোই দিবে না তার কাছে। জেরিনকে মারতে দেখে জিহান প্রথমে কান্না করলেও পরে ভয়ে চুপসে গেছে। সে এখনো তার বাবার কাছে যায় না। ভয় পায় বাবাকে। আরমান তাকে কোলে নিতে চাইলেই সে কান্না করে। দাদু, কিংবা ফুপির গলা ঝাপটে পড়ে থাকে। মাঝে মাঝে মন ভালো থাকলে মায়ের কথা জিজ্ঞেস করে। জেরিন পরদিন সকালে জিহানের কথা জানতে কল করেছিলো নিশাতের কাছে। রিসিভ করে কথা বলতেই আরমান বুঝতে পেরে নিশাতকে ধমক দিয়েছিলো। এরপর থেকে নিশাতও কল রিসিভ করে না। তবে শুনেছে বড় মা নাকি ফোনে কথা বলেছিলো। জেরিন যখন কান্না করে ক্ষমা চাইছিলো তখন বড় মা জিজ্ঞেস করেছিলো, নাফিসা যদি মরে যেতো তাহলে সে জীবন ফিরিয়ে দিতে পারতো কি-না? উত্তরে জেরিনের কান্নার আওয়াজ ছাড়া কিছুই আসেনি। সেই কল কাটার পর আর কথা হয়নি ও বাড়ির কারো সাথে।
নিশাত সেদিনই প্রথমবারের মতো আরমানকে এতোটা রাগতে দেখেছে আর নাফিসা এখন শুনেছে। নিজ পরিবার ছাড়া অসহায় জেরিনের জন্য যতটা না খারাপ লাগছে, তার চেয়েও ভীষণ কষ্ট লাগছে জিহানের কথা ভেবে। মা যেমনই হোক, সন্তানের জন্য তার মন প্রতিনিয়ত ঠিকই কাদে। সেদিনই জিহান খিচুড়ি খেয়েছে ভেবে যেই কান্না শুরু করেছিলো। আর এইটুকু বাচ্চা মাকে ছাড়াই বা থাকবে কি করে! যেখানে বাবার গলা ঝাপটে থাকে সারাক্ষণ, সেখানে সে বাবার কাছও ঘেঁষছে না আজ!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here