“তৃ-তনয়া” পর্ব- ৯২

0
2483

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৯২
(নূর নাফিসা)
.
.
নামাজ পড়ে দুপুরে খেয়ে নাফিসা ইউটিউবে ভিডিও দেখতে লাগলো কি কি করলে চিকন হওয়া যাবে এবং স্বাস্থ্য পারফেক্ট থাকবে। বেশিরভাগই ডায়েট মাস্ট! সে তো খাওয়া দাওয়া আগের মতোই করছে। শুধু ঘুমটা একটু বেশি। এটা কমাবে কি করে! সে তো আর ইচ্ছে করে এমন করে না! সারাক্ষণ ঘুম পায়!
ইমরান তার হাত থেকে ফোন রেখে দিয়ে তাকে সহ নিজে শুয়ে পড়লো ঘুমানোর জন্য। এবং বললো,
– এসব দেখে লাভ নেই, ঘুমের পরিমাণ কমিয়ে সাত-আট ঘন্টায় আনো। এমনিতেই ফিট হয়ে যাবে। এখন চুপচাপ ঘুমাও।
একদিকে ঘুম কমানোর কথা বলে অন্যদিকে তাকে ঘুমের জন্য আহ্বান করলো! তা দেখে নাফিসা তাকে সরানোর চেষ্টায় ধাক্কা দিয়ে বললো,
– এটা কি ঘুম কমিয়ে আনতে বলা হলো নাকি বেশি করে ঘুমাতে বলা হলো!
ইমরান শরীর কাপিয়ে হেসে বললো,
– এখন ঘুমাও, ঘুম কাটানোর জন্য কাল বেড়াতে যাবো। দেখি ঘুম দূর হয় কি-না!
– কোথায় যাবো?
– দেখি কোথায় যাওয়া যায়।
আবারও এক ঘুম দিয়ে আসরের পর উঠলো। নামাজ পড়ে মাগরিব পর্যন্ত নাফিসা শ্বাশুড়িদের সাথে সময় কাটালো। মাগরিবের নামাজ পড়ে আবার তার চোখে ঘুম নেমে আসছে। তাই ইমরান অফার করলো বাইরে হাটাহাটির জন্য। নিশাত উৎফুল্ল হলেও নাফিসা ঝিমাচ্ছে! পরক্ষণে নাফিসা, নিশাত বোরকা পড়ে জিহান ও ইমরানের সাথে বেরিয়ে গেলো সন্ধ্যায় বেড়াতে। ফুচকা, বাদাম, পেয়ারার ভর্তা খেতে খেতে তারা ফুটপাতে হাটলো ঘন্টাখানেক। ইশার আযান পড়লে আবার বাসায় ফিরে এলো সাথে ভুট্টা নিয়ে। ইশার নামাজ পড়ে আবার ভুট্টা ভেজে খেতে খেতে রাত দশটা বাজিয়ে দিলো। পরদিন ইমরান নাফিসাকে নিয়ে দূর পথে যাত্রা শুরু করলো। উদ্দেশ্য একটাই, তার ঘুমের ঘোর কাটানো। নতুবা এমন হুটহাট যাওয়ার কোনো প্ল্যান ছিলো না। দুপুর বারোটায় কমলাপুর স্টেশন থেকে দিনাজপুরের ট্রেনে উঠেছে। নাফিসা জিজ্ঞেস করতেই ইমরান জানালো তার নানার পৈত্রিক নিবাস দিনাজপুর। কিন্তু বর্তমানে সেখানে তেমন ঘনিষ্ঠ কোনো আত্মীয় নেই। তবে এক বন্ধুর বাড়ি আছে, তারা সেখানেই উঠবে। প্রায় একদিন সময় লাগলো তাদের দিনাজপুর পৌছাতে! স্টেশনের পর স্টেশনে ট্রেন থামছে, তারা নামছে, ফ্রেশ হচ্ছে খাবার কিনছে, খাওয়াদাওয়া করছে। সম্পূর্ণ পথ ইমরান জেগে থাকলেও নাফিসা কখনো ঘুমিয়ে আবার কখনো জেগে! ইমরান তাকে ডেকে ডেকে এটা সেটা দেখাচ্ছে, স্টেশন চেনাচ্ছে। রংপুর স্টেশনে যখন ট্রেন থেমেছিলো তখন এক ভয়ানক ঘটনা ঘটেছে! নাফিসা ঘুমিয়ে ছিলো। ইমরান তাকে জাগিয়ে জানালার বাইরে তাকাতে বললো। নাফিসা যেই তাকালো অমনি মস্ত এক হাতি তার অতি নিকটে জানালায় সুর ঠুকলো! নাফিসা ভয়ে চিৎকার করে উঠে! তার চিৎকার শুনে হাতিও গর্জন তোলে! আর নাফিসা হুমড়ি খেয়ে ইমরানের উপর পড়ে তাকে ঝাপটে ধরেছে। ইমরান বারবার বলছে কিছু হবে না, কিন্তু তার ভয় দূর হচ্ছে না। যত দ্রুত সম্ভব ইমরান জানালা দিয়ে টাকা দিয়ে হাতি বিদায় করলো এপাশ থেকে। নাফিসা ভয়ে কুকড়ে গেছে, আশেপাশের সবাই তাকিয়ে আছে। হাতি দেখে সে কিছুটা ভয় পেতে পারে সেটা ইমরান জানতো। কিন্তু হাতিটা যে এখনই গর্জন তুলে তাকে এতোটা ভয় পায়িয়ে দিবে সেটা ধারণার বাইরে ছিলো! ভেবেছিলো তার হাতে হাতিকে টাকা দেওয়াবে। কিন্তু তা আর হলো না! ইমরান তাকে স্বাভাবিক করতে বললো,
– চলে গেছে তো, সোজা হও।
ইমরান এটা ইচ্ছে করেই করেছে তা বুঝতে সময় লাগেনি নাফিসার! ফলশ্রুতিতে ইমরানকে কিল ঘুষি চিমটি উপভোগ করতে হয়েছে এবং নাফিসার গাল ফুলানো সহ্য করতে হয়েছে পরবর্তী স্টেশন পর্যন্ত! ইমরানের সাথে চলছে, পথঘাট হাটছে কিন্তু কোনো কথা বলছে না! ইমরান বললো,
– সরি বললাম তো! এতো ভয় পাও তুমি আগে জানলে ডাকতামই না।
নাফিসা কোনো কথা বলছে না। আশপাশ দেখছে ঠিকই কিন্তু এমন একটা ভাব নিয়ে আছে যেন ইমরানের উপর এখনো প্রচন্ড রেগে আছে! ইমরান বললো,
– বেড়াতে এসেছি আমরা। এমন গাল ফুলিয়ে থাকলে কি উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে না?
নাফিসার কোনো জবাব না পেয়ে এবার বললো,
– ওইযে ধান ক্ষেত দেখছিস? এখন কাদায় চুবিয়ে তারপর গন্তব্যে যাবো।
– তোর সাহস থাকলে আয় তো দেখি, কে কাকে চুবায়!
নাফিসার হাসিমাখা মুখে কথা শুনে ইমরান হেসে এক হাতে তাকে কাছে টেনে হাটতে হাটতে বললো,
– না থাক, এমনিতেই কেডস সো পড়ে এসেছি। তার উপর কাদায় চুবালে আমার ধলা বউ কালো হয়ে যাবে।
নাফিসা তার পেটে কনুই মেরে বললো,
– পাম দেওয়ার আর জায়গা পাও না! তোমার বউ আবার ধলা হলো কবে!
– প্রশংসা করলেও দোষ! নিজের প্রশংসা নিজেই কাদায় মাখামাখি করে ফেলে নাকি কেউ!
– হু, আমি করি। যেটা সত্য সেটা অবশ্যই বলবো।
– আচ্ছা, যাও। আমার কালী বউ।
– ওই, মুখ সামলে কথা বলো। আমি কালীও না!
– ধলাও না, কালীও না! তাহলে কি, শুনি?
– শ্যামলী।
– কালো বরের শ্যামলী বউ?
– উহু, শ্যামলের শ্যামলী।
দুজনেই হেসে উঠলো। তাদের বর্তমান অবস্থান দিনাজপুরের বিরল। গ্রাম্য এলাকায় বেশ কিছুক্ষণ হাটছে দুজন। রাস্তায় রিকশা চলছে তাই নাফিসা বললো,
– রাস্তায় রিকশা চলছে তাহলে আমরা হাটছি কেন?
– শ্যামলীর ঘুম তাড়ানোর জন্য।
নাফিসা নাকমুখ ফুলিয়ে রেগে তাকিয়ে বললো,
– আমি পা ব্যাথায় মরি, আর তুমি ঘুম তাড়াও!
– টাকাটাও তো বেঁচে গেলো। এক ঢিলে দুই পাখি।
নাফিসা তাড়া করতেই ইমরান হেসে তার থেকে কিছুটা এগিয়ে গেলো। নাফিসার পা যেন এবার আর চলছেই না! তার সত্যিই পা ব্যাথা করছে নাকি অভিনয় করছে বুঝা মুশকিল। তারা একটা আধ ভাঙা বিল্ডিংয়ের কাছে এসে বেঞ্চিতে বসলো। নাফিসা বললো,
– তোমার ফ্রেন্ডের বাড়িতে এসেছো তাহলে রিসিভ করতে এলো না কেন!
– জানাই নি, সারপ্রাইজ দিবো বলে।
– কিহ! ব্যবস্থা না করেই এখানে এসেছো! যদি তারা কোনো কারণে অন্যকোথায় গেলো তো?
– তো কি? বাড়িঘরের অভাব আছে নাকি! ভাড়া নিয়ে থাকবো।
– তো বসে আছো কেন এখানে! তাদের বাড়িতে চলো। না পেলে তো আবার ভাড়া নিতে হবে।
– চিনি না তো বাড়ি।
– কিহ! তাহলে এলে কেন অচেনা জায়গায়!
– চেনার জন্য এলাম।
এই মুহূর্তে ইমরানকে একদম পাগল পাগল লাগছে নাফিসার কাছে! সে দাত কিড়মিড় করে তাকাতেই ইমরান হেসে তার বন্ধুকে কল করলো। নাফিসা আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো আধ ভাঙা বিল্ডিংয়ে একটা অর্ধেক লেখা দেখা যাচ্ছে, “রিষদ”! এর আগে পরে কি হতে পারে বুঝা মুশকিল। তবুও নাফিসা ধরে নিলো শব্দটা ” ইউনিয়ন পরিষদ বা উপজেলা পরিষদ” হবে হয়তো। যার বাকি অংশ ধসে গেছে! ইমরান কল করার চার-পাঁচ মিনিটের মধ্যেই হাটু পর্যন্ত প্যান্ট ফোল্ড করা, সেন্টু গেঞ্জির সাথে কাধে গামছা ঝুলানো এক যুবক প্রায় দৌড়ে আসছে এদিকে। পায়ের গোড়ালির উপর পর্যন্ত কাঁদা লেগে আছে! রোদে পোড়া চেহারা, মাথার চুলগুলো যে উষ্কখুষ্ক হয়ে কপালের দিকে লেপ্টে আছে তা দূর থেকেই বুঝা যাচ্ছে! এসে থামেও নি, অতি খুশিতে ইমরানের পিঠ চাপড়ে বললো,
“ব্যাটা, তুই আসবি একবার কল করবি না! এমন হুটহাট বাড়ির তলে এসে সারপ্রাইজ দিলে হার্ট অ্যাটাক হয় না!”
ইমরান জবাব দিতে দিতে এদিকে নাফিসাকে জিজ্ঞেস করলো, “আসসালামু আলাইকুম, ভাবি। কেমন আছেন?”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। আলহামদুলিল্লাহ, আপনি?”
“আছি, আলহামদুলিল্লাহ।”
পরক্ষণে তাদের নিয়ে বাড়ির পথে হাটা ধরলো। ইমরানের মুখে মুখে তার নাম শুনে বুঝতে পারলো লোকটার নাম শিপন। আরেকটু সামনে এগিয়ে যেতেই কিছু একটার দিকে নজর আটকে গেলো নাফিসার। সে পেছন থেকে ইমরানের শার্ট টানলে ইমরান তাকালো তার দিকে। সে ওই জিনিসটা ইশারা করে বললো,
– ওইটা কি?
– গরুর বা মহিষের গাড়ি।
প্রথমে নৌকার ছইয়ের মতো দেখা গেলেও এবার একটু ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলো নিচে চাকা দেখা যাচ্ছে। অর্ধেক ড্রেনের ভেতর পড়ে থাকায় নজরে পড়েনি সেটা। তবে এবার তার কাছে ক্লিয়ার। এটা দেখতে দেখতে যে তার পথ চলা থেমে গেছে সেটা খেয়ালই করেনি। কথা বলতে বলতে ইমরান একটু এগিয়ে গিয়ে পেছনে ফিরে বললো,
– এখন কি এটাই দেখবে দাড়িয়ে দাড়িয়ে?
নাফিসা আবার হাটতে লাগলে শিপন বললো,
– ভাবি আসেন, ভাঙা গাড়ি দেখে কি করবেন। ভালো গাড়িতেই চড়তে পারবেন।
নাফিসা উৎফুল্ল হয়ে বললো,
– গরুর গাড়ি চলে এখনো?
– হু।
নাফিসা ইমরানকে উদ্দেশ্য করে বললো,
– আমি কিন্তু গরুর গাড়িতে চড়বো। জীবনেও চড়িনি। এমনকি চোখের সামনে দেখিও নি কখনো!
– ওইযে, ড্রেনে পড়ে আছে। চড়ো গিয়ে।
ইমরান মস্করা করাতে নাফিসা বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকালো। বাসায় এসে তারা পরিচিত হলো পরিবারের লোকজনের সাথে। যৌথ পরিবার তাদের। মা, বাবা, ভাই সবারই একসাথেই বসবাস। বাড়িটা মোটামুটি বিশাল। তিনদিকে ঘর আর মাঝখানে উঠুন। এক দিকে মাটির ঘর আর দুইদিকে টিনের ঘর। প্রত্যেকটা ঘরই লম্বাটে। তিনটা করে রুম তো অবশ্যই হবে! শিপনের দুইটা বাচ্চা আছে। মেয়েটার বয়স চার-পাঁচ বছর হবে আর ছেলেটা মাত্র হাটতে শিখেছে। ভাবিদের চেয়ে শিপনের বউটা বেশ মার্জিত। নাফিসা ভাবলো এতো মার্জিত বউ কিভাবে এমন মেঠো লোকের বউ হয়! আর ইমরানের বন্ধু হলে সে মেঠোই হয় কিভাবে! ব্যাপারটি একটু বেমানান লাগলেও পরে ক্লিয়ার হলো। তখন রোদে পুড়ে নিজ জমিতে সেচের কাজ করছিলো বিধায় এমন দেখা গেছে। বাসায় ফিরে যখন গোসল করে স্বাভাবিক বেশ ধারণ করলো, এবার বুঝা গেলো সে ইমরানের বন্ধু! এছাড়া এতোক্ষণ মনে হচ্ছিলো বয়সে আরমানের চেয়েও বেশি বড় হবে। এখন ইমরানের মতোই। তবে এবার আরও একটা বিষয় বেমানান লাগলো! এতোক্ষণ শিপনকে দুই বাচ্চার বাপ বুঝা গেলেও এখন মনে হচ্ছে বাচ্চাদের বড় ভাই! ভাবতেই নাফিসা মুখ চেপে হাসলো! এছাড়া তারা কাপল হিসেবে পারফেক্ট! নাফিসাকে মুখ চেপে হাসতে দেখে ইমরান কারণ জিজ্ঞেস করলো। উত্তরে নাফিসা ফিসফিসিয়ে বললো,
– ভাইয়া যদি তোমার বয়সের হয়, তবে দুই বাচ্চার বাপ হয় কি করে!
ইমরান হেসে ফিসফিসিয়ে জবাব দিলো,
– আমিও যদি বিশ একুশ বছরে বিয়ে করতাম তবে এখন দুই বাচ্চার বাপ থাকতাম।
– যাহ! ভাইয়া এতো অল্প বয়সে কেন বিয়ে করলো?
– পরিবারের ইচ্ছে।
সেদিন আর ভ্রমণ হলো না। খেয়েদেয়ে বিশ্রামে কাটিয়েছে তারা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here