“তৃ-তনয়া” পর্ব- ৯৩

0
2377

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৯৩
(নূর নাফিসা)
.
.
রাতে ঘুমানোর সময় নাফিসা আলসেমি করে মশারী বিছানায় গুজে দেয়নি। ইমরান বললে সে উল্টো ইমরানকে বললো। সে এমন আলসেমি করায় ইমরানও আলসেমি করে শুয়ে রইলো।
ইমরানের হাতের উপর মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে নাফিসা। হঠাৎই খুব কোমলতা অনুভব করলো সে। খুব তুলতুলে নরম কিছুর স্পর্শ পাচ্ছে তার হাত। ঘুমে থেকেই অনুভব করতে পারছে ইমরানের কনুই ভাঙা এক হাত তার মাথার নিচে, অন্যহাত তাকে জড়িয়ে রেখেছে। আর পা তো পায়ের ধারেই, তাহলে নাফিসার হাতে এমন স্পর্শ কে করছে! তাও এতোটা তুলতুলে! মৃদু স্বরে “মেও” শব্দ হতেই নাফিসা চমকে উঠে চোখ খুলে তাকালো। তার হাতের উপর কালো বিড়াল শুয়ে আছে! চোখের সামনে কালো বিড়াল দেখে সে চিৎকার করে উঠলে ইমরানের ঘুম ভেঙে গেলো! আর বিড়াল এক লাফে বিছানা ছেড়ে দৌড়ে পালানো! ইমরান চোখমুখ কুচকে তার দিকে তাকিয়ে বললো,
– কি হয়েছে?
নাফিসা তার হাত ইমরানের শরীরে ঘষতে ঘষতে কান্নার সাথে বললো,
– বি..বিড়াল আমার হাতে শুয়ে ছিলো! আ…উহু… উহু!
ওদিকে বিড়াল মেঝেতে দাড়িয়ে আবার “মেও” শব্দ করলে ইমরান তাকালো এবং হেসে উঠলো! তার হাসিতে যেন নাফিসার কান্না আরও বেড়ে গেছে! ইমরান হাসতে হাসতে বললো,
– বলেছিলাম না মশারী দিতে! শুনেছিলে? যা হয় ভালোর জন্যই হয়! তুমি আমার হাতে ঘুমাচ্ছিলে আর বিড়াল তোমার হাতে! ভালোই তো..!
নাফিসা কান্না করতে করতে ইমরানকে ঠেলে উঠে বসলো। মশারী ভালো করে বিছানায় গুজে দিয়ে তারপর বালিশে শুয়ে পড়লো। সে হাত চুলকাতে চুলকাতে এখনো কাদছেই আর ইমরান হাসছেই! অত:পর ইমরান হাসি থামিয়ে বালিশ থেকে তাকে কাছে টেনে নিলো। নাফিসা তাকে সরাতে চেয়েও ব্যর্থ! ইমরান তাকে এভাবে হাত চুলকাতে দেখে হাত সরিয়ে দিয়ে বললো,
– চামড়া ছিলে যাবে তো! কিছু হবে না, ঘুমাও।
– উহু..! আমার কেমন কেমন যেন লাগছে!
– আরে, কিছু হবে না। মানুষ বিড়ালকে কোলে নিয়ে ঘুমায় আর তুমি এইটুকুতে চামড়া কেটে ফেলছো!
– ছি! আমি কখনো ধরিই নি! মুরগী ধরতেই ভয় পাই আবার বিড়াল!
– মুরগী পালক আবার মুরগী ধরতেও ভয় পায়!
– খামারের ভদ্র মুরগী ধরতে পারি, কিন্তু দেশী অভদ্র মুরগী একদম না!
ইমরান হেসে বললো,
– আরেকবার চুলকাতে দেখলে এখন বিড়াল ধরে এনে বিড়ালের সাথে বেঁধে ঘুম পাড়িয়ে দিবো! ঘুমাও চুপচাপ!
সকালে দাঁত ব্রাশ করার সময় নাফিসার চোখ পড়লো ঘরের কোনে মাঝারি আকৃতির লিচু গাছের দিকে! গাছ ভর্তি লিচু! সে একটু এগিয়ে গেলো। গাছের তুলনায় এতো বেশি লিচু দেখে যেন আত্মহারা হয়ে গেছে! লিচু গাছ দেখেছে, ঝুলন্ত লিচুও দেখেছে। কিন্তু গাছভর্তি লিচু এই প্রথম দেখা! সে ক্ষণিকের জন্য ভুলেই গিয়েছিলো দিনাজপুর লিচুর জন্য বিখ্যাত! যেটা এখন মনে পড়লো! যদিও লিচু খাওয়ার উপযুক্ত হয়নি কিন্তু তার মাঝে খুব উৎফুল্লতা কাজ করছে! সে ব্রাশ করা রেখে যতটুকু সম্ভব সবগুলো লিচু ছুয়ে দিলো! ইমরান বাথরুম থেকে বের হতেই নাফিসা তাকে ইশার করলো এদিকে আসার জন্য। ইমরান বুঝতে পেরে বললো,
– আমি থাকতে লিচুতে আকৃষ্ট হয়ে গেলে!
– ওফ্ফ! চুপ থাকো তো! আমার এত্তো ভালো লাগছে গাছটা ইচ্ছে করছে মাথায় তুলে রাখি!
– পারলে রাখো।
– আমার যদি এই গাছটা থাকতো না, একটা লিচুও ছিড়ে ফেলতাম না৷ পারলে সারাজীবন চোখের সামনে সাজিয়ে রেখে দিতাম! পলকে পলকে শুধু তাকেই দেখতাম! সব ছেড়ে দিনরাত শুধু তারই সেবা করতাম। আমি তো তার মায়ায় পড়ে গেছি!
– ওরে বাব্বাহ! গাছের সাথে এতো প্রেম!
– হুম! অনেক অনেক! এই, গাছটা কিনে নাও না! ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করো যেকোনো ভাবে।
– মাথা খারাপ! পাগল হইছি তো এতো বড় গাছ উঠিয়ে ঢাকায় নিয়ে যাবো! আর যে প্রেম দেখলাম তোমার, সুব্যবস্থা থাকলেই নিয়ে যাবো না-কি! আল্লাহ জীবনেও এমন গাছ তোমার না করুক! তাহলে আমি শেষ!
নাফিসা বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালে ইমরান চলে যেতে যেতে বললো,
– ওযু করো এসে। আর গাছের উপর থেকে নজর উঠিয়ে আমার দিকে নজর দাও একটু।
নাফিসা ভেঙচি কেটে আবার লিচু স্পর্শ করলো। এমনি আবার শব্দ হলো, “মিও!” নাফিসা দেখলো লিচু গাছের গোড়ায় বসে আছে সেই কালো বিড়াল! ইচ্ছেতো করছে এক ঘায়ে মাথা ফাটিয়ে দিতে! মাঝরাতে যেই ভয়টাই না দেখিয়েছে বিল্লু! মাথা না ফাটালেও সে ছোট ইটের টুকরো নিয়ে তাড়া করলো তাকে! নাফিসা নামাজ পড়ে বাইরে এসে লিচু গাছের সাথে সেল্ফি তুললো। আবার ঘরে যাওয়ার সময় দেখলো উঠুনে বসে শিপনের ভাতিজি সেই কালো বিড়ালকে ভাত খাওয়াচ্ছে! দেখে নাফিসার ঘিনঘিন লাগলো! তারা সকাল সকাল নাস্তা করার পর আশপাশ ঘুরে দেখার জন্য তৈরি। শিপন, তার পাঁচ বছরের মেয়ে এবং ইমরানের সাথে নাফিসা যখন বেড়াতে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হচ্ছিলো তখন আবার দেখলো বিড়ালকে শ্যাম্পু দিয়ে ঘষেমেজে গোসল করানো হচ্ছে! এই বিড়াল কুকুর পোষণের ব্যাপারটা নাফিসার একদম ভালো লাগে না! দেখলেই ঘিনঘিন লাগে! হাটতে হাটতে নাফিসা বললো,
– আমরা গরুর গাড়িতে চড়বো কখন?
শিপন জবাব দিলো,
– বিকেলে চড়বেন ভাবি। বলে রাখছি একজনকে।
– অহ, আচ্ছা। কিন্তু কাল থেকে একটাও চলতে দেখলাম না কেন রাস্তায়! বিকেলেই কি সবাই বের হয়?
– উহুম। মানুষ তো প্রযুক্তির সাথে এগিয়ে চলেছে দিনদিন। যার ফলে পুরোনো ঐতিহ্য সব আজ বিলুপ্তির পথে। যেখানে সবকিছুই ইঞ্জিন চালিত, সেখানে আর গরুর গাড়ির প্রচলন থাকবে নাকি! যে-কোন ক্ষেত্রেই সবাই এমন দিক বেছে নেয় যেটায় কষ্ট কম হবে।
– হুম, আরাম প্রিয় মানুষ বাঙলার ঐতিহ্যকে প্রযুক্তির নিচে চাপা দিয়ে ফেলেছে। আমরা তো তা-ও দু’একটা দেখছি, নেক্সট জেনারেশন সেটাও দেখতে পাবে না।
কথা বলতে বলতে তারা মেইন রোডে এসে গাড়িতে উঠে গেলো। বিরল থেকে যাত্রা শুরু করলো ধর্মপুর ফরেস্টের দিকে। কিছু সময়ের জন্য আশপাশের জায়গা ঘুরে আবার চলে গেছে মহনপুর। সেখানে কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করে এবার দীঘিপাড়া, রামসাগর জাতীয় উদ্যানে। অসম্ভব ভালো লাগছে নাফিসার। ঘুম কাটানোর জন্য এসেছে তারা আর ঘুম কি জিনিস সেটা যেনো একেবারেই ভুলে গেছে! মনে মনে ইচ্ছা পোষণ করে, সারাক্ষণ চোখ মেলে যেন এই প্রকৃতিই দেখুক! সারাক্ষণ প্রাণ ভরে শুধু এই প্রকৃতির ঘ্রাণেই মাতোয়ারা হয়ে থাকুক! জীবন কেন এতো ক্ষুদ্র! তা কি প্রকৃতির বিশালতার মতো বিশাল হতে পারে না? যুগ যুগ ধরে এই প্রকৃতি কেন চিরতরে মায়ায় জড়িয়ে মানব মনকে সতেজ রাখতে পারে না? ভালো লাগে না তো সেই ধুলাবালি, জ্যামময় জীবন! কেবল প্রকৃতির সাথে মিত্র হয়ে মিশে থাকতে ইচ্ছে করে সারাক্ষণ!
বাঙলার বেঁচে থাকা সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে তারা সকাল ও দুপুর কাটিয়ে দিয়েছে! ঘুরাঘুরি করে তারা একটু লেট করেই লাঞ্চ করতে রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করলো। রেস্টুরেন্টের নাম দেখে নাফিসা মুখ টিপে হাসলো। ফরমান ভাঙা হোটেল! ইমরানের চোখ যেন সারাক্ষণ নাফিসাকেই পর্যবেক্ষণ করে! যার ফলে এই মুখ টেপা হাসি দেখেও ব্রু নাচিয়ে হাসির কারণ জানতে চায়! নাফিসা ফিসফিসিয়ে ইমরানকে বললো,
– এতো সজ্জিত রেস্টুরেন্ট অথচ নাম ভাঙা হোটেল কেন! দুনিয়াতে নামের অভাব পড়ছে নাকি!
ফিসফিস করে বললেও শিপনের কানে চলে গেছে কথা। তাই শিপনই হেসে জবাব দিলো,
– আগে ভাঙা ছিলো, এখন জোড়া লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে ভাবি। কিন্তু নামটা জোড়া লাগাতে পারেনি, তাই সেটাই রয়ে গেছে৷
নাফিসা নিচু শব্দে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। মেয়েটার এতো দুষ্টুমি দেখে ইমরানের মুখেও লেগে আছে প্রশান্তির হাসি। ইমরান খাবার অর্ডার করলো। তারা গল্প করতে করতে খাওয়া শেষ করে বেরিয়ে এলো। নসন দিঘির পাড় ঘুরে তারা এবার সোজা বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো।
আসরের আযান পড়ে গেছে। তারা বাড়িতে নামাজ পড়ে আবার বেরিয়ে গেলো নিজ এলাকায়। দেহ যেন একটু বিশ্রাম করতেও ভুলে গেছে! তবে এবার তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শিপনের বউ এবং দুই বাচ্চা। সাথে বড় ভাইয়ের এক মেয়েও। গরুর গাড়ি আনা হয়েছে চড়ার জন্য। গাড়ির চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছে বেশ পুরনো গাড়ি। কিন্তু পাকাপোক্ত! নাফিসার বেশ আনন্দ হচ্ছে নতুন কিছু দেখে! সারাদিন বোরকা হিজাব পড়ে ঘুরলেও এখন মাথায় ওড়নায় ঘোমটা টেনে থ্রিপিস পড়নে সে। গাড়িতে উঠে সামনের দিকে গরু সহিত এবং গাড়ির পেছন দিক থেকে ছবি তুললো ইমরান৷ সিঙ্গেল এবং কাপল উভয় ধরনের পিকই! বেড়াতে এসেছে, মুহূর্তগুলো ক্যামেরা বন্দী না করলে সার্থকতা আছে নাকি! তবে নাফিসার বড্ড আফসোস হচ্ছে এই ভেবে, কেন সে শাড়ি পড়ে গ্রাম্য বধূ সেজে গরুর গাড়িতে চড়তে পারলো না! শখ জাগলেও তা পূরণ সম্ভব না। সে এই বেশেই সবার সাথে গরুর গাড়িতে চড়ে মজা করে পথঘাট ভ্রমণ করলো। মাগরিবের আজান পর্যন্ত তারা ঘুরাঘুরি করেছে। এরপর বাকি সময় বাসায় কাটিয়েছে। ইমরান সন্ধ্যায় বেরিয়েছিলো শিপনের সাথে, ইশার নামাজ পড়ে আবার ঘরে ফিরে এসেছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here