“তৃ-তনয়া” পর্ব- ৯৫

0
2421

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৯৫
(নূর নাফিসা)
.
.
কাজ একটু তারাতাড়ি সেড়ে গার্মেন্টস থেকেই আশিক দুপুরে জিহানকে নিতে এসেছে। তার হাতে একটা বই। আরাফ যখন এবাড়িতে আসার কথা বলেছিলো তখন সে এই বই নিয়ে অফিস গিয়েছে। নিশাত আজ বাড়িতেই আছে। তাকে দেখে সালাম দিয়ে কেমন আছে তা জিজ্ঞেস করলো। আশিক স্বাভাবিকভাবেই জবাব দিলো। অতপর খালামনিদের সাথে দেখা করে জিহানকে রেডি করতে বললো। আরমান এসময় অফিসে। সে কল করে বললো জিহানকে ঘুরতে নিয়ে যাবে তাদের বাড়িতে। রাতে আরাফ আসবে, তখন আবার নিয়ে আসবে। আরমান অনুমতি দিয়ে দিলো। আবিদা বেগম আশিককে লাঞ্চ করতে বাধ্য করলেন। আশিক খেয়ে আরমানের রুমে এলো। নিশাত এখানে জিহানকে রেডি করছে। আশিকের সাথে বেড়াতে যাবে বলে জিহান বেশ উত্তেজিত! বাবা এবং চাচ্চুদের সাথে তার ভাবটা সবসময় উত্তেজিত হয়, যদিও বাবার ব্যাপারে বর্তমানে সেটা কম। তবুও বাইরে বেড়াতে গেলে সে বাবার সাথে মোটামুটি ফ্রিই থাকে, আর তাই আরমান প্রতিদিনই অফিস থেকে ফিরে তাকে নিয়ে ঘুরতে বের হয়। আশিক খাটে বসে নিশাতকে বললো,
– তোর এক্সাম কেমন হচ্ছে?
নিশাত আগের মতো এতোটা দুষ্টুমি করে না আশিকের সাথে। এখন যেন তার চোখে চোখ রেখে কথা বলতেও ইতস্তত বোধ করে। যদিও দূর থেকে আবার পলকহীন তাকিয়ে দেখে! সে জিহানকে রেডি করতে করতেই বললো,
– আলহামদুলিল্লাহ।
– আয়াতের নাকি একটা খারাপ হয়েছে।
– হুম, ইংলিশে। কিন্তু এতোটা খারাপ হয়নি। পাশ আসবে, সে নিশ্চিত।
– আর ক’টা বাকি আছে?
– দুইটা।
– কবে শেষ হবে?
– কাল দিবো একটা। আরেকটা তৃতীয় রোজায়।
– এইটা ধর।
আশিক বইটা এগিয়ে দিলে নিশাত বিস্মিত হয়ে একবার বইয়ের দিকে তাকালো, পরক্ষণে আবার আশিকের দিকে তাকিয়ে বললো,
– এটা কার?
– আমার। এক্সাম শেষ হলে তুই পড়বি এবং পড়া শেষে আমাকে রিটার্ন করবি।
নিশাত বইটা হাতে নিলো। বইয়ের নাম “অনন্ত রাজকুমার”! এর মানেটা নিশাত বুঝলো না। কিন্তু এটা উপলব্ধি করতে পারছে যে এটা রাজকুমার সম্পর্কিত বই। সে বইটা একপাশে রেখে জিহানকে জুতা পড়িয়ে দিলো। অত:পর আশিক বেরিয়ে গেলো জিহানকে নিয়ে।
বহুদিন পর ছেলেকে কাছে পেয়ে বুকে জড়িয়ে কেদে উঠলো জেরিন। যদিও জিহান প্রথমে তার মাকে দেখে খুশি হয়ে দৌড়ে এসেছিলো নিকটে। কিন্তু তাকে এভাবে কাদতে দেখে হাসিমাখা মুখটা গম্ভীর হয়ে গেছে! কেমন যেন ভয়ার্ত দেখাচ্ছে তাকে! নাজিয়ার চোখে পানি চলে এসেছে। মানুষ হিসেবে যেমনই হোক সে একজন মা। তার না দেখা সন্তানের জন্যই এখনো মনটা যেভাবে কাদে সেখানে জেরিন তো পেটে ধরে লালনপালনও করেছে! নাজিয়া জেরিনকে বললো,
– জিহান ভয় পাচ্ছে, জেরিন। চুপ করো। এভাবে কাদে না। এই বললাম না চুপ করতে!
নাজিয়া বলে থামতে পারেনি এদিকে জিহান ভয়ে কান্না শুরু করেছে। আশিক জেরিনের প্রতি বিরক্ত হয়ে জিহানকে কোলে নিয়ে আবার বেরিয়ে গেলো। আয়েশা বেগম জেরিনের মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করছেন। নাজিয়া কিছুক্ষণ বুঝিয়ে তারপর রান্নাঘরে চলে গেলো। জিহানের জন্য কম মশলা দিয়ে নুডলস রান্না করলো। রাস্তায় কিছুক্ষণ হাটাহাটি করে আশিক আবার জিহানকে নিয়ে এসেছে। জিহান এখন শান্ত। সে আর জেরিনের কাছে যায়নি। কিচেনে নাজিয়ার কাছে চলে এসেছে।
– ওয়াও! ভাবি, নুডলস রান্না করছো আমার জন্য!
নাজিয়া মুচকি হেসে বললো,
– উহুম, জিহান বাবাটার জন্য।
– না, জিহান খায় না। জিহানের দাত উঠেনি।
আশিকের কথায় জিহান জেলাসি হয়ে বললো,
– আমি খাবো! এই দাত।
– উহুম, আমি খাবো।
– আমি!
নাজিয়া হেসে জিহানকে কোলে নিয়ে বললো,
– উহুম, জিহানই খাবে।
আশিক কড়াই থেকে এক চিমটি নুডলস নিয়ে মুখে দিয়ে বললো,
– আহ, কি টেস্ট!
জিহান কান্নার ভঙ্গিতে বললো,
– ই.. আমি খাবো!
নাজিয়া তাকে নিয়ে বেরিয়ে আসতে আসতে বললো,
– ওফ্ফ! গরম। ঠান্ডা হোক একটু পরে খাবে।
– চাচ্চু খায়!
– চাচ্চু খাবে না। আশিক নাড়া দাও নুডলস। আমি আসছি।
নাজিয়া তাকে নিয়ে জেরিনের কাছে এলো। এবার জেরিন নিজেকে শান্ত রেখে তারপর কোলে নিলো। জিহান তার কাধে মাথা রেখে গলা ঝাপটে পড়ে আছে। জেরিন টুকটাক কথা বলছে ছেলের সাথে। জিহান নিজের মর্জিতে কখনো জবাব দিচ্ছে কখনো দিচ্ছে না। নুডলস খেয়ে খেলাধুলা করলো কিছুক্ষণ। জিহানের জন্য আশিক আর বের হয়নি বাসা থেকে। বাকিটুকু সময় এখানে কাটিয়ে সন্ধ্যায় আরাফ জেরিনকে তার বাড়িতে রেখে এসেছে। ইচ্ছে করছিলো না জিহানকে ছাড়তে তবুও সে ছাড়তে বাধ্য! আরমান জানতে পারলে কিছুতেই দেখার সুযোগও দিবে না আর! জিহানও আসতে চাইছিলো না। আরাফ এক প্রকার জোর করেই তাকে নিয়ে আবার উল্টো পথে যাত্রা শুরু করলো। জেরিনকে তাদের বাসায় পৌছে দিয়ে আসায় লেট হয়েছে ফিরতে। এর মাঝে আরমান দুবার কল করেছে আর আরাফ বলেছে সে রাস্তায় আছে। আরাফ এলে আরমান একসাথে ডিনার করলো। জিহান ঘুমিয়ে পড়েছে। সকাল থেকে এ পর্যন্ত আর বাবার সাথে কথাবার্তা হলো না তার। খাওয়ার পর আরাফ আরমানের সাথে রাস্তায় হাটতে বের হলো। জেরিনের দোষ স্বীকার করে কিছুটা তার পক্ষ নিয়ে যথাসম্ভব বুঝালো আরমানকে। আজ যে জেরিনের সাথে জিহানের সাক্ষাৎ হয়েছে সেটাও জানিয়ে দিয়েছে। যদিও জেরিনের ব্যাপারে শুনতে ইচ্ছে করছিলো না তবুও আরমান চুপচাপ শুনে গেলো। বড় ভাই বলে মুখের উপর নিষেধ করতে পারলো না। রাত দশটা বেজে গেছে। যা বললো তা নিয়ে একটু ভাবতে বলে আরাফ গাড়িতে উঠে চলে গেলো। আরমান তাকে বিদায় দেওয়ার পরপরই বাসায় ফিরে এসেছে।
আশিক বইটা দিয়ে যাওয়ার পরই মনের ভেতর উশখুশ করছিলো! এটা একটা গল্পের বই। কিন্তু কিসের গল্প! আর আশিকই বা তাকে কেন দিলো! ইচ্ছে তো করছে এখনই পড়ে ফেলতে! কিন্তু আগামীকাল এক্সাম থাকায় সে বইটা একপাশে রেখে দিলো।
নাফিসা ইমরান আজ বিরলেই ঘুরে বেড়ালো। বিরল ডিগ্রি কলেজের সামনের পথ ধরে হাটাহাটি, অত:পর কড়াই বিলে ভ্রমণ। অসম্ভব সুন্দর একটি জায়গা কড়াই বিল। আম, জাম, লিচু, মেহগনি, আকাশমনি সহ নানান প্রজাতের বৃক্ষ! পর্যটকদের জন্য একটি আকর্ষণীয় জায়গা এটি। সরকার উদ্যোগ নিলে এটি দেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করতে সক্ষম।
দুপুরের পরপরই তারা শিপনের বাড়ি ত্যাগ করলো। শিপন আরও দুতিনদিন থাকতে বলেছিলো কিন্তু রমজান মাস অতি নিকটে হওয়ায় ইমরান থাকতে রাজি না। বাসায় যাওয়ার তাড়া তাদের। তারা বিরল ছেড়ে ফুলবাড়িয়া চলে এসেছে। খাওয়ার উপযুক্ত না হলেও নাফিসা সেই গাছের লিচু নিয়ে এসেছে কয়েকটা! টক এবং তেতো স্বাদযুক্ত! শিপন জানিয়ে দিয়েছে আরেকটু বড় হলে লিচু পাঠিয়ে দিবে। রাতে থাকার জন্য হোটেলে ব্যবস্থা করলো ইমরান। রাতটা কাটিয়ে তারা সকালেই ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেলো। আশেপাশের জায়গায় একটু ঘুরাঘুরি করলো। নিকটবর্তী এক শপিং সেন্টারে প্রবেশ করলো কিন্তু তেমন কিছু কিনলো না। নাফিসার ইচ্ছায় কাপল ব্রেসলেট কিনলো এবং ইমরানও সানগ্লাস দেখে বিনা পরিকল্পনায় কাপল সানগ্লাস কিনলো। নিশাতের জন্য এক জোড়া জুতা কিনে তারা এবার রওনা হলো ফুলবাড়িয়া স্টেশনের দিকে। অনলাইনে টিকিট কিনেছে ইমরান। সকাল দশটায় ট্রেন। এরই মধ্যে ভোর থেকে তারা স্বপ্নপুরী, কয়লাখনি, যমুনার তীর সহ অনেকটা পথ ভ্রমণ করে নিয়েছে। বাস স্ট্যান্ড, রেলস্টেশন, শপিংমল, বন্দর, ফ্লাইওভারের নিচে, স্কুল কলেজের সামনে চোখ বুলালে দেখা যায় কতো অসহায় মানুষ পথে দিন কাটায়! কারো অঙ্গপ্রতঙ্গের অভাব, কারো শক্তির অভাব। সব মিলিয়ে সবারই আশ্রয়স্থলের অভাব! নাফিসা দুজন অচল লোককে সাধ্যমতো দান করে ট্রেনে উঠলো। কমলাপুর থেকে যাত্রা শুরু করে তারা নেমেছিলো কাঞ্চনজাংশন রেলস্টেশনে। কিন্তু এবার ঢাকা ফিরছে ফুলবাড়িয়া স্টেশন থেকে কমলাপুরে। মাঠ পেরিয়ে, বন হারিয়ে, স্টেশনের পর স্টেশন ত্যাগ করে, দিন কাটিয়ে, রাত কাটিয়ে, দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে অবশেষে পরদিন সকালে ঢাকায় পা রাখলো তারা। এতোটা পথ ভ্রমণ করে নাফিসা ক্লান্ত। যাওয়ার সময় যতটা ঘুম হয়েছিলো তার, আসার সময় তার এক-তৃতীয়াংশ ঘুম হয়েছে। এখন বাসায় এসে গোসল করে খেয়ে অনেকটা সময় তার ঘুমে কাটলো! সাথে ইমরানেরও।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here