“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৯৯
(নূর নাফিসা)
.
.
সন্ধ্যায় রাগারাগি করে ইমরান বেরিয়েছে বাসা থেকে। ফেরার আর খবর নেই! ডিনারের সময় হয়ে গেছে, না এসেছে ইমরান আর না এসেছে আরমান! নাফিসা কাউকে বুঝতে দেয়নি যে তাদের মাঝেও কিছু হয়েছে! ইমরানের কথা জিজ্ঞেস করা হলে বলেছে তার ফিরতে দেরী হবে। আর এদিকে আরমানকে কল করে ফোন বন্ধ পায়! দুই মায়ের মনেই অশান্তি কাজ করছে। বড়মা তাদের খেয়ে নিতে বললো। নাফিসার পেট ব্যাথা করছে তাই সে খেয়ে নিলো। আর জেরিন খেতে চায়নি তবুও তার খাবার নিশাতের হাতে তার রুমে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। খাওয়া শেষে টেবিল গুছিয়ে রাখছে নাফিসা। আরমান এসে গেইটে নক করলো। নিশাত গেইট খুলে দিলো। জিহান ঘুমিয়ে পড়েছে আরমানের কাধে। আরমান তাকে নিয়ে রুমের দিকে যাচ্ছে। আবিদা বেগম খাওয়ার জন্য বললে সে বলে দিলো বাইরে থেকে খেয়ে এসেছে। আবিদা বেগম গম্ভীর মুখ নিয়ে রুমে চলে গেলো। আরমান রুমে এসে জিহানকে খাটে শুয়িয়ে দিয়ে জেরিনকে একপ্রকার টেনে ধাক্কা দিয়ে দরজার বাইরে পাঠিয়ে দরজা ভেতর থেকে লক করে দিলো আরমান! যা কেবলমাত্র নিশাত ও নাফিসার চোখে পড়েছে! জেরিন আর ভেতরে যাওয়ার প্রচেষ্টা না করে লজ্জিত দৃষ্টি নিয়ে ড্রয়িং রুমে চলে গেলো। নাফিসা ইমরানের জন্য নেওয়া খাবারের প্লেট হাতে নিচ্ছিলো আর নিশাত দ্রুত পায়ে বড়মার রুমে গেলো। বড়মা সহ নিশাত আবার বেরিয়ে এলো। বড়মা দু-তিনবার ডাকলো আরমানকে। কিন্তু আরমানের কোনো জবাব এলো না। তাই তিনিও আর বিরক্ত না করে সকালে সাক্ষাৎ করার আশায় রইলেন। বাড়ির এই পরিস্থিতি একদমই ভালো লাগছে না কারো কাছেই! নিশাত এবং নাফিসা গেইট খুলে ইমরানের খাবার নিয়ে তাদের ঘরে এসে পড়লো। বড়মা গেইট লাগিয়ে জেরিনকে ডেকে তার রুমে নিয়ে গেলো।
সবাই ঘুমানোর জন্য প্রস্তুত, শুধু নাফিসাই বসে আছে ইমরানের অপেক্ষায়। নাফিসা কল করছে আর বারবার কেটে দিচ্ছে। রাত এগারোটার দিকে দরজায় টোকা পড়লে নাফিসা প্রথমে আঁতকে উঠল এবং বললো,
– কে?
বাইরে থেকে কোনো জবাব এলো না, বিপরীতে দরজায় জোরে থাপ্পড় পড়লো। নাফিসার মনে হচ্ছে ইমরান। কেননা সে গেইট তালা দিয়ে এসেছে। যার ডুবলিকেট চাবি আছে ইমরানের পকেটে। তবুও সে দরজা খুলতে ভয় পাচ্ছে। ফোন নিয়ে ইমরানের নম্বরে ডায়াল করতেই দরজার বাইরে রিংটোন বেজে উঠলো। এবার সে শতভাগ নিশ্চিত হয়েই দরজা খুলে দিলো। ইমরান হনহন করে ঘরে প্রবেশ করে দরজা লাগিয়ে দিলো। অত:পর টিশার্ট খুলে আবার বেরিয়ে গেলো বাথরুমের দিকে। সে হাতমুখ ধুয়ে এলে নাফিসা গ্লাসে পানি ঢেলে প্লেট এগিয়ে দিতে দিতে বললো,
– এতোগুলো কল দিলাম রিসিভ করোনি কেন?
ইমরান কোনো জবাব না দিলে নাফিসা আবার বললো,
– খাবার এখানেই নিয়ে এসেছি। খেয়ে নাও।
ইমরান মশারী টানাচ্ছে, নাফিসা বললো,
– খাবে না?
ইমরান লাইট অফ করে চুপচাপ গিয়ে শুয়ে পড়লো। নাফিসা প্লেট ঢেকে রেখে দিলো। ফোনের টর্চ জ্বালিয়ে সে লাইট জ্বালিয়ে দিলো। অত:পর সে-ও বিছানায় চলে গেলো। পেছন থেকে ইমরানকে জড়িয়ে ধরে বললো,
– আমার সাথে রাগ করে নিজে না খেয়ে আছো কেন? সরি, আর কখনো তোমাকে না জানিয়ে কিছু করবো না।
ইমরান তার হাত ঝাড়ি দিয়ে সরিয়ে দিলো। নাফিসা কান্নাজড়িত কন্ঠে বললো,
– সরি বলছি তো। এমন করছো কেন তুমি? রাগ ভাঙানোর সুযোগ তো দাও একবার।
ইমরান ঘাড় ঘুরিয়ে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
– চুপচাপ থাকতে পারলে থাকবি নতুবা রুম থেকে বের হো।
– বেরিয়ে যাবো?
– হ্যাঁ, যা..
নাফিসা কয়েক সেকেন্ড তার দিকে তাকিয়ে থেকে গাল মুছতে মুছতে নেমে গেলো বিছানা ছেড়ে। দরজা খুলে বেরিয়েও গেলো সে। খুব কান্না আসছে তার, তবে এটাও মানছে অপরাধ যেহেতু করেছে একটু শাস্তি তার পাওয়া দরকার। আবার এতেও বিশ্বাস রেখেছে যে সে উল্টো রাগ করলে ইমরানই আবার তার রাগ ভাঙাবে। দু মিনিটের মতো বারান্দায় দাড়িয়ে থেকে পরে আবার নক করলো নিশাতের রুমে। নিশাত দরজা খুললে সে ভেতরে চলে গেলো। ঘুমিয়ে পড়লো নিশাতের রুমেই। ঘুম ভাঙলোও নিশাতের রুমেই! আজ ঘুম ভাঙতে একটু দেরী হয়েছে তার। ঘুম থেকে উঠে সে নিশাতকে জিজ্ঞাসা করেছিলো ইমরান রাতে এসে ডেকেছে কি-না? কিন্তু নিশাত জানালো ডাকেনি! নাফিসার মনটা খারাপ হয়ে গেলো! ভেবেছিলো রাতেই ইমরান তাকে নিতে আসবে। কিন্তু তা আর হলো না!
নাফিসা ব্রাশ করতে করতে তাদের রুমের দিকে এসে দেখলো দরজা ভেতর থেকে বন্ধ! নাফিসা হাতমুখ ধুয়ে নিলে ইমরানের দেখা পেল। ইমরান বাথরুমের দিকেই আসছে। নামাজ পড়ে আবার ঘুমিয়েছিলো মনে হয়। ইমরান যেমন গাল ফুলানো মুডে আছে নাফিসাও ঠিক তেমনই ভাব প্রকাশ করলো তার সামনে। সে রুমে এসে সময় নিয়ে ধীরে ধীরে মুখ মুছতে লাগলো। ইমরান হটাৎ করেই তার হাত থেকে তোয়ালে টেনে নিয়ে নিজের মুখ মুছতে লাগলো! নাফিসা তার এমন কান্ডে হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। ইমরান ঝটপট মুখ মুছে নাফিসার মুখের উপর ছুড়ে মারলো তোয়ালটা! নাফিসার খুব রাগ হলো, সে-ও তার দিকে ছুড়ে মারতে চেয়েছিলো কিন্তু মারলো না। নাফিসা বড়ঘরে এসে দেখে দুই শ্বাশুড়ি রান্না প্রায় শেষ দিকে নিয়ে এসেছে আর জেরিন হাত-পা গুটিয়ে মন খারাপ করে বসে আছে সোফায়। কি করবে ভেবে না পেয়ে থালাবাটি এনে টেবিলে রাখলো। পরক্ষণে ইমরানের জন্য নেওয়া খাবারের কথা মনে হতেই আবার রুমের দিকে এলো। ইমরান শার্ট-প্যান্ট পরে দরজা লাগিয়ে কোথাও যাচ্ছে! নাফিসা বারান্দায় এসে জিজ্ঞেস করলো,
– এতো সকালে কোথায় যাচ্ছো?
ইমরান তার কথার জবাব না দিয়ে তাকে উপেক্ষা করে চলে গেলো! নাফিসা রুমে এসে খাবারের প্লেট নিয়ে আবার বড় ঘরে চলে এলো। আরমানের রুমে এখন জিহানের কথা শোনা যাচ্ছে সাথে গাড়িতে বাজছে গান। কিন্তু দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। নাফিসা কিচেনে চলে এলে বড়মা বললো,
– ইমরান খায়নি রাতে?
– না।
– তার আবার কি হলো?
– কি জানি! হয়তো মুখের রুচি উড়ে গেছে। ভাবছি ভাতের পরিবর্তে রুচি ঝাল চানাচুর খেতে দিবো আজ থেকে।
– ঝগড়া হয়েছে?
– উহুম। শুধু শুধুই এমন করে কেন বুঝি না আমি! এমনসব পুরুষদের বুঝতে গেলে নারীদেরকে অসাধ্য সাধন করতে হবে।
হুট করেই আবিদা বেগম বললো,
– বুবু, মন চায় আমিই বাড়ি ছাইড়া চইলা যাই। একদম ভাল্লাগে না এতো অশান্তি! একেকজনের মুখ ফোলা, চোখ ফোলা দেখতে দেখতে অধৈর্য হইয়া গেছি! না করছিলাম ফিরাইয়া আনতে। গেছে, গেছেই! এতো আদরামের কি দরকার ছিল! এহন তো আরও অশান্তি হাজির হইলো!
– চুপ কর তুই। আমি আরমানের সাথে কথা বলবো। ইমরানের সাথেও।
নাফিসা আরমানের খাবার টেবিলে দিলো। এদিকে আরমান গোসল করে জিহানকেও গোসল করিয়ে বাবা ছেলে একেবারে তৈরি হয়ে বেরিয়ে এসেছে রুম হতে। জিহান টেবিলের পাশে নাফিসাকে দেখে বললো,
– চাচী…
নাফিসা তার দিকে তাকাতেই জিহান হাত নাড়িয়ে অন্য একটা গাড়ি দেখালো। আরমানের হাতে চিপস আর বিস্কিটের প্যাকেট। নাফিসা প্রতুত্তরে হাসলো। জিহান আরমানের থুতনি ধরে বললো,
– আব্বু?
– হুম?
– আম্মু কই?
– আম্মু নেই।
– এহ! আছে।
আরমান আর কিছু বললো না। নাফিসা আরমানকে উদ্দেশ্য করে বললো,
– ভাইয়া, খাবার দিয়েছি।
আরমান চুপচাপ দরজায় তালা লাগিয়ে কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে গেলো জিহানকে নিয়ে। তাদের কথা শুনে জেরিন বেরিয়ে এসেছিলো। কিন্তু জিহান পিছু ফিরে তাকায়নি বিধায় দেখলো না তার আম্মুকে! নাফিসা দ্রুত কিচেনে এসে বড়মাকে বললো। আর নিশাত দৌড়ে গেইটের কাছে এসে বড়মার কথা বলে ডাকলো। কিন্তু আরমান শুনলো না। দুই মায়েরই ভেতরটা ভারি হয়ে এসেছে ছেলেদের এমন অপ্রত্যাশিত কান্ড দেখে! তারা পুরো পরিবারকেই ইগনোর করছে! এদিকে ইমরানও আর ফিরেনি! নাফিসা ফোন করলো কয়েকবার। কিন্তু ফোন বন্ধ! কোথায় গেলো সে! এতো সকালে তো তার অফিস টাইম ছিলো না! অবশেষে দুপুরের অগ্রভাগে বড়মা নিজ ফোন থেকে আরমানের ফোনে কল করলো। প্রথমবার রিং হয়ে দ্বিতীয়বার রিসিভ হলো। বড়মা গম্ভীরমুখে বললেন,
– কোথায় তুই?
– অফিসে।
– জিহান কোথায়?
– আমার সাথেই।
– খুব বড় কলিজা ওয়ালা ব্যাটা হয়ে গেছিস যে মাকেও ভুলে গেছিস? আর ছেলেকে নিয়ে গেছিস কোন আন্দাজে? এইটুকু বয়সে অফিসের কাজ শিখিয়ে দিবি?
আরমান চুপ করে রইলো। বড়মা আবার বললো,
– নিজে তো খাবি না, বাচ্চাটাকেও না খায়িয়ে মারবি?
– খায়িয়েছি হোটেলে।
– হোটেলে খাওয়াবি কেন? আমরা রান্না করতে পারি না! আর অফিসেই নিয়ে যাবি কেন!
– কি করবো, তোমরা অধৈর্য্য হয়ে গেছো বলেই তো তাকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছো। আর কাউকে এতো ধৈর্য ধরতে হবে না, আমি একাই জিহানের খেয়াল রাখতে পারবো।
– কথা তো ভালোই বলতে শিখেছিস! আমরা অধৈর্য্য হয়ে গেছি? মা ছাড়া যে প্রতিনিয়ত কান্না করে সেটা চোখে পড়ে না তোর?
– জিহান ভালো আছে এখানে।
– জ্ঞান দিতে আসছিস? ভালো মন্দ বুঝি না আমরা? কতোক্ষণ ভালো থাকবে? এখন তো মনে হচ্ছে আমরা পালন করিনি তোদের! তোরাই আমাদের লালন পালন করেছিস ছোট থেকে!
ইমোশনাল কথাগুলো আরমানের ভেতরটায় আঘাত হানছে তাই সে চুপ করেই রইলো। বড়মা গম্ভীর গলায় বললো,
– অফিস টাইম শেষে দুই ভাইকেই বাড়ি দেখতে চাই আমি। কোথাও যাবি তো খুব খারাপ কিছু হবে যার দায়ী তোরা। কি, ফিরবি না?
– হুম।
– ইমরান কোথায়?
– জানি না।
– অফিস যায়নি?
– না।
– বাড়িতেও নেই, অফিসও যায়নি তো গেছে কোথায়!
– কি জানি, আমার সাথে দেখা হয়নি।
বড়মা ফোন রেখে দিলো। আর নাফিসার মনের ভেতর ভয় ঢুকে গেলো! তার সকালের নাস্তাও করা হলো না! ইমরানের অপেক্ষায় বসে আছে সারাদিন। দুপুরেও যেহেতু ইমরান ফিরলো না তখন সবার মাঝেই ভয় জেগেছে। ফোনও বন্ধ, অফিসেও নেই, বিকেলে আরমান বাসায় ফিরে জানতে পারলো ইমরান নিখোঁজ! অত:পর সে খোঁজ করতে লাগলো ইমরানের বন্ধুবান্ধবদের কাছে। আবিদা বেগমের বুকে ব্যাথা করছে! বড়মা ও নিশাত পড়ে আছে তার সেবাযত্নে। জেরিনের যেন সবকাজ করতেই মানা! নাফিসা ঘরবন্দী হয়ে কান্না করছে! সবকিছু যুক্তিযুক্ত মনে হলেও শেষ পর্যায়ে নিজেকেই দোষী করছে সে! নারীদের রাগ কম কিন্তু প্রকাশ পায় বেশি। যার ফলে রাগারাগি করে বেশি আর মানিয়ে নেওয়াও সহজ। আর পুরুষের রাগ বেশি, কিন্তু প্রকাশ পায় কম। সহজে রাগে না তারা আবার একবার রেগে গেলে খুব বড় অঘটন ঘটিয়ে ছাড়ে! যেমনটা ঘটিয়েছিলো আরমান আর এখন ঘটাচ্ছে ইমরান! এক পর্যায়ে আশিককে কল করে ইমরানের খোঁজ পেল! আরমান রেগে তাকে এই মুহুর্তে বাড়ি আসতে বললো। সবচেয়ে বেশি রাগ তো হচ্ছে সে ফোন বন্ধ রেখেছে সেই কারণে!
সন্ধ্যার পর ফিরেছে ইমরান। আরমান প্রথমে বকেছে তাকে তারপর বড়মা দুই ভাইকে অর্থাৎ আরমান ও ইমরান উভয়কেই বকেছে! আরমানের ইস্যু ছিলো সে জেরিনসহ তার পুরো পরিবারকে উপেক্ষা করছে সাথে জিহানেরও ক্ষতি করছে। আর ইমরানের ইস্যু ছিলো সে অযথা এমন কান্ড ঘটিয়েছে। কাউকে না জানিয়ে হুটহাট ঘুরতে চলে যাওয়া৷ যদিও তার উদ্দেশ্য ঘুরতে যাওয়া না, সে নাফিসার সাথে রাগ করেই এমনটা করেছে। কিন্তু নাফিসা ছাড়া সকলের অজানাই সেটা। বড়মা কঠোর হয়ে শেষ বারের মতো সাবধান করে দিলো উভয়কেই। দুজন শুধু চুপচাপ শুনে যাচ্ছিলো। বহুদিন পর আজ এমন শাসাচ্ছেন বড় মা। আগে দুইভাই পড়াশোনায় ফাঁকি দিলে কিংবা ঝগড়া লাগলে এমনভাবে শাসাতেন। আবিদা বেগম ঠাসঠাস পিটুনি লাগাতেন আর বড়মা পিটুনি ছাড়াই শাসাতেন এবং বুঝাতেন। এরপর ছেলেরা বড় হয়ে গেলে তা আর দেখা যায়নি।
ইমরান আশিকের সাথে ঘুরতে বেরিয়েছে এবং আরমান বলার পর বাড়ি আসছে তা জানার পরপরই নিশাত নাফিসাকে ইনফর্ম করে গিয়েছিলো। আর এখন ইমরান ঘরে এলে দেখলো নাফিসা টেবিলে মাথা রেখে জানালার বাইরে অন্ধকারে তাকিয়ে আছে। দরজা লাগানোর শব্দে নাফিসা ঘুরে তাকালো। ইমরানকে দেখে সে ঝটপট উঠে চেয়ারে হোচট খেয়েই তেড়ে এগিয়ে এলো। দু’হাতে শার্টের কলার মুঠোয় ধরে নাফিসা বলতে লাগলো,
– তোর সাহস কি করে হয়ে আমাকে এভাবে শাস্তি দেওয়ার! এতোই ঠেকা পড়েছে, তুই রাগ করবি আমি তোর ধারে ঘুরে ঘুরে রাগ ভাঙাবো? এতোই ঠেকা পড়েছে আমার, যে তুই না খেয়ে থাকবি সেইজন্য আমিও না খেয়ে সারাদিন কাটিয়ে দিবো? এতো কেন আমার ঠেকা, যে তোকে ভাবতে ভাবতে আমি নিঃশেষ হয়ে যাবো! এতো কেদেছি কেন আমি তোর জন্য? আমাকে কাদাতে খুব ভালো লাগে তোর? আগেই তো আমি ভালো ছিলাম। সবসময় হাসিখুশি থাকতাম। এখন কেন আমাকে এতো কান্না করতে হয়!
ইমরান নিশ্চুপ তাকিয়ে আছে তার চোখেমুখে। চেহারায় স্পষ্ট ভেসে আছে অনাহারের ছাপ! স্পষ্ট ভেসে আছে সারাদিন কান্না করার ছাপ! নাফিসা কলার ছেড়ে তাকে ঝাপটে ধরে বুকে মুখ লুকিয়ে কান্না করতে লাগলো। তার যেন কাদতেও কষ্ট হচ্ছে! কথাও বলতে পারছে না ঠিকমতো! তবুও সে কান্নার সাথে বলছে, “সরি বলেছি না আমি? আর কখনো কিছু করবো না তোমার অনুমতি ছাড়া। সত্যি বলছি। বিশ্বাস করো একবার।”
এটুকু কথা বলতেই নাফিসা হাপিয়ে উঠেছে। অতি ক্ষুধার কারণে পেট থেকে যেন কথাটাও ঠিকমতো বের হতে চাইছে না। শুকনো গলায় কথা আটকে যাচ্ছে বারবার! ইমরান তাকে দুহাতে শক্ত করে বেধে চুপ করতে বললো। তবু্ও নাফিসা কিছু বলতে চাইছে। ইমরান তাকে ছাড়াতে চেয়ে ব্যর্থ! ইমরানের মতে সে হচ্ছে পঁচা মিষ্টি কুমড়া! যা বাইরে থেকে দেখতে ফিটফাট, অথচ স্পর্শ করলেই খোলস ভেঙে গলে পড়ে! পঁচা মিষ্টি কুমড়ার মতো সে-ও এতোক্ষণ যাবত স্ট্রং থেকে এখন ইমরানের কাছে এসে ভার ছেড়ে ঢলে পড়েছে। বরাবরই এমনটাই করে। ইমরান জানে একে আর কথা শুনানো যাবে না এখন। অত:পর পিছু ঠেলতে ঠেলতে আবার টেবিলের কাছে এনে তাকেসহ খাটে বসে পড়লো ইমরান। গ্লাসের অর্ধেক পর্যন্ত পানি নিয়ে সে মুখের সামনে ধরে পান করতে ইশারা করলো। অনিচ্ছা সত্যেও নাফিসা এক ঢোক গিলে আবার ইমরানের উপর হেলান দিয়ে বললো,
– তুমি বাসা থেকে এভাবে বেরিয়ে গেলে কেন? আমি কি রাস্তায় রাস্তায় খুঁজে পেতাম তোমাকে? আমাকে বলেছো রাগ করে যেন কখনো বাড়ি না ছাড়ি, আমি তো রেখেছি তোমার কথা। তাহলে তুমি রাগ করে আমাকে এভাবে শাস্তি দিলে কেন!
– চুপ করো।
– আমি তো তোমার অবাধ্য হতে চাইনি! তুমি কোনো কথাই শুনছিলে না। তাই বাধ্য হয়েছি সেটাও লুকিয়ে রাখতে। নতুবা তোমার সাথে পরামর্শ করে আমি সব কাজ করতাম। কেবল জিহানের কথা ভেবে আমি ভাবির পক্ষ নিয়েছিলাম৷ তাছাড়া ভাবি প্রেগন্যান্ট। সেটাও জানে না কেউ! এদিকে ভাইয়া না জেনে ডিভোর্স দিয়ে দিচ্ছে আর সেদিকে ডিভোর্স পেপার পাওয়ার পর ভাবির অন্যত্র বিয়ের ব্যবস্থা করছে মামামামী। কতগুলো জীবন নষ্ট হয়ে যাওয়ার পথে ছিলো যা দেখতে পারছিলাম না আমি। তাই অবাধ্য হয়েছি তোমার।
– চুপ করতে বলেছি না!
নাফিসা সোজা হয়ে আবার তার কলার মুঠোয় ধরে বললো,
– এখন এতোটা ইজি তুমি, তো সারাদিন সবাইকে এমন টেনশনে রাখলে কেন? কতগুলো প্রাণকে ভয় দেখিয়েছো? একবার ভেবেছো আমাদের কথা? এখন আবার আমাকে চুপ করতে বলা হচ্ছে? করবো না আমি চুপ। আমাকে শাস্তি দিয়েছো, এখন তোমাকেও শাস্তি পেতে হবে।
ইমরান নিশ্চুপ থেকে তাকে শান্ত করতে ঠোঁট ছুয়ে দিতেই নাফিসা তার ঘাড়ে কামড় বসিয়ে দিলো! ইমরান বললো,
– ওফ্ফ! লাগছে আমার! সারাদিন না খেয়ে কথা বলার শক্তি নেই, কামড় দেওয়ার শক্তি আসে কোত্থেকে? এই, ব্যাথা লাগছে তো!
নাফিসা ছেড়ে দিয়ে তার গলা জড়িয়ে পড়ে রইলো! হাত বাড়িয়ে নাগাল না পাওয়ায় ইমরান হাতে বোতল নিয়ে ফ্যানের সুইচটা অন করলো। অত:পর বললো,
– আমি শুধু কাঁদিয়েই যাই তোমায়, তাই না?
– গত উনিশ-বিশ বছরেও আমি এতোটা কাঁদিনি যতটা বিয়ের পর কাঁদতে হয়েছে!
– নিষেধ করলেও সেই কাজ কেন করো? আমাকে না রাগালে চলে না তোমার? কথা শুনলে আর কখনোই কাঁদতে দিবো না মাই হার্টবিটকে।
– শুনবো।
আরও কিছুক্ষণ নিশ্চুপ বসে থেকে তারপর সে ফ্রেশ হতে গেলো। একেবারে গোসল সেড়ে এসেছে। নাফিসাও হাতমুখ ধুয়ে এলো।