তারাহুরো করে লিফ্ট থেকে বেরিয়ে রোজ যেই না মিটিংরুমে ঢুকবে অমনি একটা ফাইল ঝড়ের গতিতে এসে লাগলো ওর মাথায়।ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেলো রোজ।ব্যাথার চোটে চিৎকার করে বসে পড়লো মাটিতে।
“আম্মুউউউউউউউউউ”
রোজের চিৎকারে সবাই এসে হাজির হলো মিটিং রুমের সামনে।তখনই রুম থেকে ফুল অ্যাটিটিউডের সাথে বের হলো “রিক্ত রায়হান খান”
এসেই কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
“হোয়াট দ্যা হেল,এতো চিৎকার কিসের এখানে?”
রিক্তর কথায় সবাই মাথা নিচু করে নিলো ভয়ে।তখনই রিক্তর চোখ যায় রোজের দিকে।রিক্ত বিরক্তের সহিত রোজকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“এই মেয়ে এভাবে বসে আছো কেন ফ্লোরে?এইটা অফিস,তেমার বাসা নয় যে যা খুশি তাই করবে!”
রিক্তর কথায় রোজ উঠে দাড়িয়ে রাগী সুরে বললো,
“এই যে মিস্টার,এটা যে বাসা নয় সেইটা আমি ভালো করেই জানি।কিন্তু তা আপনি ভুলে গেছেন”
“কি বললে তুমি?”
“কি বললাম তা শুনতে পাননি?কানে শোনেন না নাকি”
রোজের কথায় রিক্ত ওর হাতে থাকা আইফোন টা ছুড়ে মাটিতে ফেলে দিয়ে রোজের দিকে তাকিয়ে বললো,
“ডোন্ট ক্রস ইউর লিমিট স্টুপিড”
“আরে রাখুন আপনার বকবক।আপনি আমার কপালের বারোটা বাজিয়ে আমার উপরই চিৎকার করছেন কোন সাহসে?”
রোজের কথায় রিক্ত ওর কপালের দিকে তাকিয়ে দেখে রোজের কপাল ফুলে একদম কালো দাগ হয়ে গেছে।বেচারির মুখটা লাল হয়ে গেছে,হয়ত ব্যাথা করছে খুব।চোখে পানি চিকচিক করছে কিন্তু রোজ পানি ফেলছে না।জোর করে আটকে রেখেছে এমন মনে হচ্ছে।
তাতে রিক্ত রায়হান খানের কিছুই না।তাই রিক্ত রোজকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“তোমার কপাল কেটেছে,তো নিজে সারিয়ে নাও।এখানে চিৎকার করছো কেন?”
“কারণ আমার এই অবস্থা আপনার জন্যই হয়েছে”
“মানে?”
“মানে আপনি ফাইলটা এতো জোরে ছুড়েছেন যে সেটা আমার কপালে এসে লেগেছে”
“তুমি কেয়ারলেস,তাই তোমার লেগেছে”
“দোষ আপনার।সেটা শিকার করার সৎ সাহস ও দেখছি আপনার নেই।ভীতু কোথাকার”
রোজের কথা শুনে রিক্ত ঠাস করে একটা চর বসিয়ে দিলো ওর গালে।চরটা এতো জোরে মেরেছে যে রোজ তাল সামলাতে না পেরে পড়ে যেতে নেয়।ঠিক তখনই মিস্টার রাশেদ রায়হান খান সেখানে এসে রোজকে ধরে ফেলেন।
“রাশেদ রায়হান খান” ইনিই হলেন রিক্তর বাবা এবং সিআইডি টিমের এসইপি।
রোজ ব্যাথার চোটে কথা বলতে পারছেনা।আগের সেই কপালের আঘাত তার উপর চরের কারণে ওর গালে পাঁচ আঙ্গুলের ছাপ বসে গেছে।ফুলেও গেছে অনেকটা।
এসবের মাঝেই রোজ জ্ঞান হারালো।সবাই তাড়াতাড়ি করে এসে ওকে নিয়ে গেলো পাশের হসপিটালে।
রাশেদ রায়হান খান রিক্তর কাছে এসেই রাগী সুরে বললেন,
“রিক্ত,তুমি বারবার ভুলে যাও যে এইটা অফিস।তুমি আমার ছেলে বলে কখনোই ছাড় পাবেনা।অনেক সহ্য করেছি তোমার এই ঝামেলাগুলো।সামান্য কিছু হলেই হিতাহিত জ্ঞান ভুলে তুমি হয়ে উঠো হিংস্র।এভাবে আর কতদিন চলবে বলো?”
মিস্টার খানের কথায় রিক্ত চুপ করে রইলো।বাবাকে ওও খুব শ্রদ্ধা করে।তাই ওনার কথায় মাথা নিচু করে নিলো।বাবার প্রত্যেকটা কথা-ই সত্য।আসলে ওর রাগটা একটু না অনেকটায় বেশি।তাই রিক্ত ওর রাগ কন্ট্রোল করতে পারেনা।আর আজকে ওর মাথা আরো গরম হয়ে গিয়েছিল।কারণ,আজ ওদের হাতে একটা স্পেশাল কেস এসেছিল।কিন্তু সেই কেসের পেপারগুলো সে না পাওয়ায় ওর হাতে থাকা ফাইলটা রাগের বসে ছুড়ে মারে বাইরে।আর তখনই রোজের আগমন ঘটে।বাকি ঘটনা তো সবারই জানা।
“স্যরি বাবা”
“আমাকে স্যরি বলে কি হবে?যে মেয়েটার এমন অবস্থা করেছো তাকে গিয়ে স্যরি বলো।”
“আমি কোনো বাইরের কাউকে স্যরি বলতে পারবো না”
“এতো ইগো দেখিয়ো না।আর কি বলো তো,এই ইগোর জন্যই তুমি রাইতাকে হারিয়েছো”
বাবার কথা শুনে রিক্তর চোখ জোড়া লাল হয়ে উঠলো।চোখে পানি ছলছল করছে।কঠোর কন্ঠে জবাব দিলো,
“ঠিক আছে,আমি স্যরি বলবো ঐ মেয়েটাকে”
এই বলেই গটগটিয়ে চলে গেলো রিক্ত।আর মিস্টার খান এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।কি আর করবেন উনি।ছেলের এই রাগ আর ইগোর কারণেই উনারা অনেক কিছু হারিয়েছেন।আজ তার জন্য প্রতিনিয়ত চোখের জল ফেলেন উনার পরিবার।
আজো চোখের সামনে পুরোনো স্মৃতিগুলো ভেসে বেড়ায়।কত হাসি-খুশি পরিবার ছিলো ওনাদের।একটা যৌথ পরিবার হওয়া সত্বেও তাদের মধ্য কোনো ঝগড়া বিবাদ ছিলোনা।শুধু ছিলো একরাশ ভালেবাসা,শ্রদ্ধা আর হৈ-হুল্লোড়।
অথচ সময়ের ব্যবধানে আজ সবই স্মৃতি হয়ে রয়ে গেছে স্মৃতির পাতায়।স্মৃতিগুলো তাড়া করে বেড়ায় সবাইকে।আজ এই সুখময় স্মৃতিগুলোয় দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে দিয়েছে খান পরিবারকে।
~হসপিটালে~
রোজ একটা বেডে শুয়ে আছে।হাতে ক্যানোলা লাগানো।স্যালাইন দেওয়া হয়েছে।কপালের দিকটা ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে ডক্টর।
চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকাকালীন সময়ে রোজের মাথায় কেউ হাত বুলিয়ে দিলো।রোজ চোখ খুলে দেখলো ওর সমবয়সী একটা মেয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
“কে তুমি?”
মেয়েটা মিষ্টি হেসে বললো,
“আমি জেরিন তাসনিম প্রভা।সিআইডি টিমের জুনিয়র অফিসার পদে কর্মরত আছি।”
“ওহ আচ্ছা”
“হুম”
এরপর কিছুক্ষণ নিরবতা চললো।এর মাঝেই হাজির হলো মেরিন,রাইসা,রুমকি,শুভ,সাইফ,সাহাফ,মিরা,রাকিব আর শান্ত।
রোজ এতোজনকে দেখে অবাক চোখে জেরিনের দিকে তাকালো।যেন চোখ দিয়েই বলছে,
“কারা এরা”
জেরিন রোজের চোখের ভাষা বুঝতে পেরে বললো,
“আমি সবার সাথে তোমার পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি।”
এরপর সবাই রোজের বেডের কাছে আসলো।তারপর একে একে নিজেদের পরিচয় দিতে লাগলো।
“আমি শোয়েব শান্ত।সিনিয়র অফিসার অফ সিআইডি টিম”
রোজ উঠে বসে বললো,
“আস্সালামু আলাইকুম স্যার”
“আরে আমাকে স্যার বললেও সেইটা শুধু অফিসের ভিতরে বলবে।এছাড়া আমাকে স্যার নয় বরং ভাইয়া বলে ডাকবে”
“আর তুমি উঠছো কেন?তুমি এখনো বেশ দুর্বল”
এই বলেই মিরা রোজের কাছে এসে বসলো,
“না না আপু আমি ঠিক আছি”
“না তুমি একদম ঠিক নেই।আর আমাকে আপু বললে না?তাহলে তো এখন আপুর কথা শুনতে হবে।নাও শুয়ে পড়ো তো।”
এই বলেই জোর করে রোজকে বেড এ শুইয়ে দিলো মিরা।
“বাই দ্যা ওয়ে,আমিও শান্ত,সাহাফ আর রুমকির সাথে সিনিয়র অফিসার পদে আছি।আমার নাম শারিকা নুর মিরা।”
“আমি মেরিন আফরিন।আমি আর জেরিন একই পদে আছি।”
রোজ মেরিনকে হাই বললো।
“আমি আল হাসনাত শুভ।আমি সিনিয়র অফিসার পদে আছি।”
রোজ শুভকে দেখে বললো,
“আস্সালামু আলাইকুম”
“ওয়ালাইকুমুস সালাম”
“আমার নাম রাইসা তাসনিম।আমি জুনিয়র অফিসার অফ সিআইডি টিম”
“আমি সাইফ রায়হান খান।জুনিয়র অফিসার অফ সিআইডি টিম”
এর মধ্যেই রুমকি একটা টুল টেনে এনে বসলো রোজের কাছে।
“তুমি কিন্তু একদম দুর্বল।খাওয়া দাওয়া ঠিক মতো করোনা তুমি?”
রুমকির কথায় রোজ মাথা নিচু করে নিলো।
“কি হলো?কিছু বলো?”
“আসলে আমার খাইতে ইচ্ছে করেনা”
সাইফ এসে বললো,
“এইটা কেমন কথা?তুমি এখন সিআইডি টিমের মেম্বার।তোমাকে তো এখন স্ট্রং থাকতে হবে তাইনা?”
রুমকি রোজের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
“আচ্ছা তেমার মা-বাবা কোথায়?তুমি কি এখানে হোস্টেলে থাকো?”
“না আপু।আমি হোমে থাকি”
রোজের কথায় সবাই অবাক হয়ে বললো,
“হোমে মানে?”
রাকিব বললো,
“তাহলে তেমার মা-বাবা কোথায়?”
“আমার মা-বাবা নেই।আমি এতিম”
রিক্ত রোজকে দেখার জন্য দরজার কাছে আসতেই এমন একটা কথা শুনে থেমে গেলো।
সাইফ অবাক হয়ে বললো,
“তোমার মা-বাবা নেই?”
“না”
কথাটা বলেই রোজের চোখ থেকে দু ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পরলো।
রোজের চোখে পানি দেখে রিক্তর বুকটা কেমন জানি ধক করে উঠলো।রিক্ত আর কোনো কিছু না ভেবেই রোজের সামনে গিয়ে দাড়ালো।রিক্তকে দেখে রোজ খুব রেগে গেলেও সেটা বাইরে প্রকাশ করলো না।চুপ করে রইলো।
নিরবতা ভেঙ্গে রিক্ত রোজকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“স্যরি”
মেরিন রোজের জন্য জুস ঢালছিলো গ্লাসে।রিক্তর কথায় মেরিনের হাত থেকে গ্লাসটা অটোমেটিক পড়ে গিয়ে কয়েক খন্ড হয়ে গেলো।
জেরিন অবাক হয়ে চেয়ে আছে রিক্তর দিকে।
রুমকি বসা থেকে উঠে দাড়ালো।
বাকি সবাই রোবটের মতো দাড়িয়ে আছে।
রিক্ত সবাইকে উপেক্ষা করে রোজের দিকে একটা ফুলের বুকে এগিয়ে দিলো।আর বললো,
“গেট ওয়েল সুন”
এই বলেই আর কোনো দিকে না তাকিয়ে ঠিক যেভাবে এসেছিল সেভাবেই এ্যাটিটিউডের সাথে বেরিয়ে গেল রিক্ত।
চলবে???
তোকে_চাই
পার্ট_১
#লেখনীতে_সুহাসিনী_চৌধুরী(ছদ্মনামের লেখিকা)
ভুল-ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।আমি লেখা-লেখির জগতে নতুন অতিথি।তাই গল্পটা সম্পর্কে আপনাদের সবার মতামত আশা করছি।এবং আপনারা কি রকম গল্প পড়তে পছন্দ করেন সেটাও জানাবেন আমাকে।
ধন্যবাদ।