তোমরা কুঞ্জ সাজাও গো,পর্বঃ ০২

0
410

তোমরা কুঞ্জ সাজাও গো,পর্বঃ ০২
নূর নাহার লিজা

বাদল অনেকক্ষণ ধরে মেয়েটার কার্যক্রম দেখছে। সামনে তিনটা বই খোলা- একবার এই বই থেকে লিখছে, একবার ওই বই থেকে লিখছে। প্রতিদিন রাত ৮টা থেকে ৯টা পর্যন্ত বাদল ছাদে সময় কাটায়। মেয়েটাও এই সময়ে পড়াশুনা করে। দেখতে ভালই লাগে বাদলের । জোরে জোরে মুখস্ত করে, তিন-চারটা বই ঘেঁটে Assignment করে।
“কি দেখছ এত মনোযোগ দিয়ে?” রুনি পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে।
“ওহ তুই। ভই পাইয়ে দিয়েছিস। এত নিঃশব্দে কেউ হাঁটে? বিড়াল নাকি তুই?”
“তুমিই বা শকুনের মত চোখ করে সামনে তাকিয়ে আছ কেন?”
“শকুনের মত মানে? আমি কি ছাদে উঠে চোখ বন্ধ করে রাখব নাকি?” এই বলে একটা সিগারেট ধরাল বাদল।
“মেয়েটা কে রে? পাড়ায় নতুন এসেছে মনে হচ্ছে।”
“হু, ইকবাল চাচার বোনের মেয়ে। রাজশাহী বাড়ি। বুয়েটে ভর্তি হয়েছে এবার। Brilliant আর অহংকারী। সেদিন ইকবাল চাচার বাসায় দেখে কথা বলতে গেলাম, পাত্তাই দিল না। ফালতু কোথাকার।”
বাদল মনে মনে হাসছে। মেয়েটা হয়ত ভালই আছে, বাদল তাকিয়ে ছিল বলেই হয়তো রুনির খারাপ লেগেছে।
“তুমি মিলিকে মেরেছ কেন?”
“ও, বিচার দেয়া হয়ে গেছে?”
“ও আমাকে বিচার দেয়নি, আমি জিজ্ঞেস করেছি, ও বলেছে।”
“তুই জানিস আমি ওকে প্রতিটা অঙ্ক ধরে ধরে করিয়েছি। তারপর ও ছোট ছোট ভুল করেছে।”
“তাই বলে তুমি ওকে থাপ্পড় মারবে? বাদলদা ও বড় হয়েছে। তুমি ওর গায়ে এভাবে হাত তুলতে পার না।”
“তুই কি ছাদে এসেছিস আমাকে উপদেশ দেবার জন্য?”
রুনির ভয় লাগছে। প্রতিদিন এই সময়ে রুনি ছাদে আসে বাদলের সাথে সময় কাটানোর জন্য, কিন্তু আজ একটা বিশেষ কাজে এসেছে।
রুনি বাদলের পাশে বসতে বসতে বলল “না, একটা বিশেষ কাজে এসেছি।” রুনি আসলে বাদলকে গানটা শোনাতে এসেছে- তোমার খোলা হাওয়া।
“বিশেষ কাজ পরে হবে। আগে বল, কাল তোর ইউনিভার্সিটিতে কোন ইম্পরট্যান্ট ক্লাস আছে?”
“ না, কেন?”
“তুই কাল আমার সাথে নারায়ণগঞ্জ যাবি। সকাল ৯টায় বের হব, ১ ঘণ্টা লাগবে যেতে। সব দেখে দুপুর নাগাদ ব্যাক করব।ঠিক আছে?”
রুনি হাঁ সুচক মাথা নারল।
“এখন বল কি কাজ?”
রুনি বলতে যাবে এমন সময় বাদলের পাশে রাখা ফুলের দিকে নজর পড়লো।
“এখানে ফুল কেন?তুমি আবার আমার গাছের ফুল ছিঁড়েছ? বাদলদা তোমায় কতবার মানা করলাম যে আমার গাছের ফুল ছিঁড়বেনা।”
“মিলি তোকে বিচার দিল, এটা বলল না যে কাল মায়ের জন্মদিন।”
“ওহ, কাল তো ২১শে এপ্রিল। খালামনির জন্মদিন। একদম ভুলে গেছি।”
“নিজের মা এর হলে মনে রাখতি, আমার মা তো তাই ভুলে গেছিস। যাই হোক, রাত ১২ টার সময় বাসায় চলে আসিস। মার জন্য সারপ্রাইজ আছে।”
এমন সময় মিলি ছাদে ছুটে আসল “রুনি আপা, তোমার বড় খালা এসেছেন। খুব কান্নাকাটি করছেন। আন্টি তোমায় বাসায় যেতে বলেছেন।”
বাদল গুনগুন করে উঠল “তোমরা কুঞ্জ সাজাও গো, আজ আমার প্রাননাথ আসিতে পারে।”
রুনির বড় খালা কিছুদিন ধরে নিয়মিত রুনিদের বাসায় আসছেন। তার আমেরিকান প্রবাসী ছেলের সাথে রুনির বিয়ে দেয়ার জন্য। কথায় কথায় রুনি বাদলকে একদিন একথা বলে ফেলেছিল। সেই থেকে বাদল ওকে খেপিয়ে যাচ্ছে।
রুনি বাদলের দিকে একবার ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বাসার দিকে চলে গেল।
*****************
বারটা বাজতে বেশী সময় নেই। রুনির শাড়ী পরতে গেলেই এই সমস্যাটা হয়। শাড়ী খুঁজে পেলে চুড়ি খুঁজে পায়না, চুড়ি পাওয়া গেলে দুল পায়না। সাজার পর মনে হয় শাড়ীটা মানাচ্ছে না।সবকিছু খুঁজে পেয়ে শাড়ী পরতেই অনেকটা সময় কেটে গেছে।
বাদলের মা নিলুফা জামান সরকারী স্কুলের টিচার। সারাদিন স্কুল আর বাসার কাজে ব্যস্ত থাকেন। রাত ১০টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েন তিনি।দরজায় টোকা দিল রুনি।মিলি দরজা খুলল।
“ওয়াও রুনি আপা তোমাকে দারুণ দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে আকাশ থেকে নীল পরী নেমে এসেছে।”
বাদলের সামনে প্রশংসা শুনে রুনি লজ্জা পেয়ে গেল। মিলির প্রতি কপট রাগ দেখাল “চুপ কর। ক্যামেরা এনেছি। সাথে নতুন ফিল্ম।অনেক ছবি তুলব আজকে।”
“কিন্তু আমি তো একদমই সাজলাম না।আমার ছবি তো পচা আসবে”
“এই খবরদার। তুই একদম সাজবি না।তুই সাজলে তোর পাশে আমাকে খারাপ দেখাবে।”
“শেষ হয়েছে নাটক? মিলি তুই যা তো রান্নাঘর থেকে একটা ম্যাচ নিয়ে আয়।কেকের চারপাশে মোম জ্বালাতে হবে”
“ম্যাচ তো তোমার কাছেই আছে।”
বাদল কড়া চখে তাকালে মিলি চলে গেল।
“শাড়ি পরেছিস কেন? Upcoming Mother-in-law কে Impress করানোর জন্য?”
রুনি মুখ শক্ত করে জবাব দিল “রাকিব ভাই ওর এক বিদেশী বান্ধবীকে বিয়ে করেছে। বড় খালা অনেক কান্নাকাটি করেছেন।”
“ওহ তাই বল। এজন্যই সর্বাঙ্গে নীল বর্ণ ধারণ করেছ?”
মিলি ম্যাচ নিয়ে আসতেই বাদল উঠে গেল মোম জ্বালাতে। রুনির সারা শরীর কাঁপিয়ে কান্না আসছে। রুনি ঠিক করেছে আগামিকাল বাদলের সাথে নারায়ণগঞ্জ যাবে না। ডাইনিং টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়াল সে। কেক, চকলেট, ফুল- অনেক কিছুর আয়োজন করেছে বাদল।
বাদল মোম জ্বালিয়ে নিলুফাকে ডাকতে গেল।নিলুফা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। মার মুখ দেখে বাদলের মনটা কেমন ভিজে উঠল। অনেক ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছে। মিলির বয়স তখন মাত্র ছয় মাস। নিলুফাকে অনেক কষ্ট করে দুই ছেলেমেয়েকে মানুষ করতে হয়েছে। আর যাই হোক এই ঢাকা শহরে একজন মায়ের একা থাকা যে সহজ ব্যাপার নয় তা অনেকদিন আগেই বুঝে গিয়েছিল বাদল।
বাদল লাইট জ্বালাল। আলোতে ঘুম ভেঙ্গে গেল নিলুফার। বাদলকে সামনে দেখে জিজ্ঞেস করলেন “কিরে কি হয়েছে?”
বাদল কাছে গিয়ে বলল “তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করল মা, তাই দেখতে এলাম।”
“মানে কি?মিলি কোথায়? তোরা এখনও ঘুমাসনি?”
“সব কিছু ঠিক আছে। তুমি একটু ওঠত মা।”
“কেন?”
“আহা ওঠো না মা।”
নিলুফা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। বাদল মাকে জড়িয়ে ধরল। ছেলের কাজকর্ম দেখে নিলুফা অবাক হয়ে যাচ্ছেন ।
“কি হয়েছে বল?”
“কিছু হয়নি। মা তোমাকে একটু কষ্ট দিব। চোখটা একটু বন্ধ কর।”
“কেন?”
“আহা একটু চোখ বন্ধ করই না” এই বলে বাদল নিজেই মা এর চোখ চেপে নিলুফা কে ডাইনিং টেবিলের কাছে নিয়ে গিয়ে চোখ খুলল। সাথে সাথে সবাই মিলে বলে উঠল “Happy Birthday to you”.
নিলুফা সত্যি অবাক। এমন ভাবে তার জন্মদিনের আয়োজন করা হবে তিনি চিন্তাই করতে পারেননি।
খুশিটাকে আড়াল করতে চাইলেন “তোরা এসব কি করেছিস? এই বুড়ো বয়সে জন্মদিন পালন।”
“অসম্ভব। আমরা তোমাকে কখনও বুড়ো হতেই দিব না।” বাদলের উত্তর।
“ওমা রুনি , কি সুন্দর দেখাচ্ছে তোকে শাড়িতে। তোরা এই যুগের মেয়েরা শাড়ী পরতেই চাস না। আমরা তো স্কুল- কলেজে শাড়ী পরে যেতাম।”
“স্কুল- কলেজে তো আর শাশুড়িমারা আসেন না।” বাদলের উত্তর
“মানে কি?”
“কিছু না খালামনি। তুমি তো জানই বাদলদা বড্ড বাজে কথা বলে।” এই বলে রুনি নিলুফাকে জড়িয়ে ধরল। “শুভ জন্মদিন খালামনি”। নিলুফার মনে হল রুনি একটু শক্ত করেই নিলুফাকে জড়িয়ে ধরল। বাদলটা মেয়েটার মন খারাপ করে দিল।
কেক কাটা হল, অনেক মজা হল। মিলি বলল “জান মা রুনি আপা নতুন একটা গান শিখেছে। আপা গানটা গাওনা।”
“ কি গান? গা না। অনেক দিন তোর গান শুনিনা।”
মিলি গান শুরু করতে যাবে এমন সময় কারেন্ট চলে গেল। “এই যা। এত রাতে কারেন্ট চলে গেল।” নিলুফা বলল।
“ মা চলনা ছাদে যাই। ঐখানে রুনি আপার গান শুনব।”
“ না না এত রাতে ছাদে যেতে হবে না। বারান্দায় চল। ঐখানে গান শোনা যাবে।”
সবাই বারান্দায় গেল।রুনি গান ধরল
“মাঝির লাগি আছি জাগি সকল রাত্রিবেলা,
ঢেউগুলো যে আমায় নিয়ে করে কেবল খেলা,
ঝড়কে আমি করব মিতে, ডরব না তার ভ্রূকুটিতে,
দাও ছেড়ে দাও ওগো আমি তুফান পেলে বাঁচি আমি ডুবতে রাজি আছি।”
****************
পরদিন সকালবেলা বাদল অনেকক্ষণ গলির মোড়ে দাঁড়িয়েছিল রুনির জন্য। রুনি আসেনি।দুইবার ফোন দিয়েছে রুনিদের ল্যান্ডলাইনে। দুইবারই ময়নার মা ফোন ধরেছে।কয়েকবার কে কে জিজ্ঞেস করার পরও ঐ পাশ থেকে কোন জবাব পায়নি। আবার ফোন আসতে পারে ভেবে রুনি ফোনটা তুলে রাখল। কিছুক্ষণ পর বাদলকে বাসার গেট দিয়ে ঢুকতে দেখে।ইব্রাহিম বাদলকে কি যেন বলছে। বাদল একবার দোতলার দিকে তাকাল।রুনি সরে গেল। বাদলের মুখোমুখি হতে চাচ্ছেনা সে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here