তোমরা কুঞ্জ সাজাও গো,পর্বঃ ৫

0
408

তোমরা কুঞ্জ সাজাও গো,পর্বঃ ৫
নূর নাহার

রাত এগারোটা বাজে।মিলি ঘুমিয়ে পড়েছে। নিলুফা ডাইনিং টেবিলে পরীক্ষার খাতা নিয়ে বসেছেন। বাদল পাশে গিয়ে বসলো।
“এত রাতে খাতা নিয়ে বসলে যে?”
“খাতাগুলো কালকে জমা দিতে হবে। কাজের চাপে দেখাই হয়নি।”
“তোমার মনে আছে মা তুমি খাতা দেখে আমাকে আর রুনিকে দিতে নম্বর যোগ করে দেয়ার জন্য। ৫টা খাতা দেখে ১ টা করে চকলেট।”
“মনে থাকবে না আবার। অর্ধেকের বেশি চকলেট তো তুই সাবার করতি। মেয়েটা আর কতটুকুই বা পেত?” বাদল নিরুত্তর রইল।
রুনি অনেক নরম স্বভাবের মেয়ে ছিল, হয়তো এখনও আছে। সেটাই হয়তো সুবিধা হয়েছিল বাদলের জন্য। সেদিনের কিশোর বাদলের অনেক ছোট ছোট প্রয়োজন মিটিয়েছিল রুনি। মার্বেল, ঘুড়ি, ক্রিকেট বল কেনা, লাইব্রেরি থেকে বই ভাড়া করা আরও অনেক কাজে টাকার প্রয়োজন হত বাদলের। টানাটানির সংসারে নিলুফা বেশি টাকা দিতে পারতেন না বাদলকে। তখন রুনিই ছিল ভরসা। রুনির ঈদের সেলামির অনেক টাকাই চলে যেত বাদলের শখ পুরনের পেছনে। তারপরও মাঝে মাঝে টাকা কম পড়ে যেত। তখন বাবার পকেট থেকে পিক-পকেটও করতে হয়েছিল অনেকবার।বাদল ছাদে বসে বই পড়তে পছন্দ করে বলে রুনি ওর বাবাকে ধরে ছাদে একটা বসার জায়গা বাধিয়ে নিয়েছিল সিমেন্ট দিয়ে।কত অলস দুপুর একসাথে ছাদে কেটেছে বাদল আর রুনির। বাদল বই পড়ত আর রুনি টেপ রেকর্ডারে গান শুনত। রুনি একটা নির্ভরতার জায়গা ছিল বাদলের কাছে। আজ যখন রুনির সমস্ত ঋণ পরিশোধের সময় এল তখন বাদল মুখ ফিরিয়ে নিবে?
নিলুফা বলতে থাকলেন “সময় কত তাড়াতাড়ি চলে যায় তাইনা। সেই ছোট্ট রুনি বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি যাবে, ওর নিজের সংসার হবে। তোর মনে আছে ছুটির দিনগুলোতে ও সকালবেলা এসে বসে থাকত মিলিকে গোছল করানোর জন্য। সে নিজে একটা বাচ্চা, ও কিনা করাবে আরেকটা বাচ্চাকে গোছল। শুধু গোছল করান না, মিলিকে খাওয়ানো,ঘুম পাড়ান সবকিছু সে নিজের হাতে করবে। আর এখন তো বিয়ে করে বিদেশ বিভুইয়ে চলে যাবে। বাচ্চা- কাচ্চা হলে এখন তো ওকে একাই সবকিছু করতে হবে, ঐখানে তো সাহায্য করার কেউ নেই।”
“তোমার মনে আছে মা আমরা একবার কটকটি খাবার জন্য বড়মামার বিদেশ থেকে পাঠানো পারফিউমের বোতলটা স্প্রে করে পুরো খালি করে ফেলেছিলাম।”
“মনে থাকবে না আবার? কম দস্যিপনা করেছিস তোরা? তার জন্য অবশ্য মার ও খেয়েছিস প্রচুর।”
প্রতিদিন বিকেলবেলা ছাদে ঘুড়ি ওড়ান,লোডশেডিং হলে ছাদে গিয়ে রুনির গান শোনা, নতুন ছবি বের হলে ভিসিআরে দেখা, একুশে ফেব্রুয়ারী শহীদ মিনার বানানো, ডিসেম্বরে পরীক্ষা শেষে চড়ুইভাতি করা, ঝড়ের সময় শিল কুড়ানো আরও কত কি। অনেক সুন্দর ছিল সময়গুলো। রুনির কি সব মনে থাকবে?
কিছুক্ষণ নীরব থেকে বাদল বলল “মা চলনা আমরা এই বাসাটা পালটে ফেলি।”
নিলুফা অবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “হঠাৎ বাসা পালটাতে চাচ্ছিস যে?
“অনেকদিন তো হল মা। আর কতদিন এক বাসায় থাকবে। আর মিলিও তো বড় হয়েছে। ওর একটা নিজস্ব রুম দরকার।”
“তুই রুনিকে অনেক ভালবাসিস তাই না?” ছেলের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন নিলুফা।
বাদল অবাক চোখে মা এর দিকে তাকাল।“কি ভেবেছিলি?আমি কিছু বুঝতে পারব না?”
সবার কাছে মিথ্যে বলতে পারে বাদল ,হয়তো আজ মায়ের সামনে ও বলত। কিন্তু মিথ্যেটা কেন জানি গলা দিয়ে বের হচ্ছে না।
“ওকে বলেছিস কখনও?”
একটু চুপ থেকে বাদল বলল, “বাড়িওলার মেয়েকে দূর থেকে পছন্দ করা যায় মা, তাকে ভালবাসা যায় না।”
একটু চুপ থেকে নিলুফা জবাব দিলেন, “রুনি চলে যাবে। ভাইজান তো রাবেয়াকে সময়ই দিতে পারে না। এই অবস্থায় আমরাও যদি চলে যাই ও তো প্রচণ্ড একলা হয়ে পড়বে। তবে হাঁ তুই যদি বিয়ে করতে চাস তাহলে আলাদা কথা। নতুন বউ নিয়ে তো আর এই ছোট বাসায় থাকা যায় না”। বাদল দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মা নিজেকে একটা বৃত্তের মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলেছেন। রুনি ও বাদলকে ঘিরে একটা বৃত্ত তৈরি করেছে। রুনিকে কেন্দ্র করে বাদলের ও কি একটা বৃত্ত ছিল না? পৃথিবীতে সবারই বোধ হয় একটা বৃত্ত থাকে। শুধু সাধুপুরুষদের কোন বৃত্ত থাকে না।
বাদল উঠল। বারান্দায় গিয়ে সিগারেট ধরাল। বাঁশিটা বেজে উঠল। প্রতিদিন রাত সাড়ে দশটা- এগারোটার দিকে কে জানি বাঁশিটা বাজায়। বেশ ভাল বাজায়। মিলি সন্ধ্যের দিকে একটা কবিতা পড়ছিল, “সতত হে নদ তুমি পড় মোর মনে, সতত তোমার কথা ভাবি এই বিরলে”। সন্ধ্যে থেকে লাইনটা মাথার মধ্যে ঘুরছে। রুনি কি বাদলের জীবনে কোন নদী হয়ে থাকবে? না, রুনিকে আকাশের মত হতে হবে। কোথায় কখন কবে কোন তারা ঝরে গেছে আকাশ কি মনে রাখে? রুনির জীবন থেকে বাদল নামের তারাদের ঝরে পড়তে হবে।
রুনির ধারণা ছিল বাদল আসবে না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে রুনি নিজে একটা রিক্সা নিয়ে কোথাও ঘুরতে যাবে। রুনি প্রায়ই এই কাজটা করে। রিক্সা নিয়ে একা একা ঘুরতে বের হয়। মার্কেটে যায় নয়ত পার্কে যায়। মার্কেটে গিয়ে খুব ভাব নিয়ে জামা কাপড় দেখবে (ব্যাগে সম্বল মাত্র ১০০ টাকা)। দোকানদার দশ বারটা জামা বের করে দেখাবে, তারপর কাপড় নেড়ে চেড়ে রুনি এমন ভাব করে সেই দোকান থেকে বের হবে যে মনে হবে এগুলোর চেয়ে নিম্নমানের জামা-কাপড় আর হয়না।দোকানদার ও তার দোকানের জামার মান নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে।পার্কে গেলেও খুব মজা লাগে রুনির। পিচ্চি-পিচ্চি ছেলে- মেয়েগুলো ক্লাস ফাঁকি দিয়ে প্রেম করতে আসে।মাঝে মাঝে আপত্তিকর কাজও করে। রুনির খুব ইচ্ছে একদিন কোন একটা জুটিকে এরকম আপত্তিকর অবস্থায় ধরে বলবে, “এই তোমরা এসব কি করছ?আর এই ছেলে কালকে একজনের সাথে ছিলে, আজকে আরেকজনের সাথে, একদিনে প্রেম বদলে গেল?”
রুনিকে সম্পূর্ণ অবাক করে দিয়ে বাদল ঠিক সময়ে চলে আসে। বাদলকে রিক্সা করে আসতে দেখে রুনি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। রুনির চোখে পানি চলে এসেছে। বাদলকে চোখের পানি দেখাতে চায়না।
রুনির মনে পড়ে যায় বাদলের সাথে প্রথম বাইরে যাওয়ার কথা। এস এস সি পরীক্ষার কয়েক মাস আগের কথা। এর আগে স্কুল বা কোচিং থেকে বাদলদার সাথে একসাথে ফিরেছে। কিন্তু এবার যে পুরো একটা সিনেমা দেখা। কয়েকদিন আগে বাদলদা বলল “হলে একটা নতুন ছবি এসেছে- শঙ্খনীল কারাগার। দেখবি?” তারপর কয়েকদিন পর বাদলের সাথে মধুমিতা সিনেমা হলে গিয়ে রুনি সিনেমা দেখে এল। সেই থেকে শুরু হল দুজনের একসাথে বাইরে ঘুরতে যাওয়া। এক এক করে অনেক জায়গা ঘুরে দেখিয়েছে বাদল রুনিকে। বাদল সবসময় একটা কথা বলে, “বাইরে থেকে কোন পর্যটক এসে যদি পুরান ঢাকা, ইউনিভার্সিটি, ধানমণ্ডি- এই জায়গাগুলো ঘুরে দেখে তাহলে তার ৭০% ঢাকা দেখা হয়ে যাবে। এই জায়গাগুলোর সাথে ঢাকার ইতিহাস জড়িয়ে আছে ওতপ্রোতভাবে”। বাদলের সাথে ঢাকার প্রতিটা অলিগলিতে ঘুরেছে রুনি। প্রতিটা জায়গাকে অসম্ভব মনে পড়বে রুনির। মনে পড়বে নিউমার্কেটের ফুচকা, সেন্ট্রাল লাব্রেরির সামনে পাতার বিরিয়ানি(এই বিরিয়ানিটা এখন আর পাওয়া যায় না), দাস এর কফি, ক্লাস থেকে বের হয়ে ভেলপুরি আরও অনেক কিছুর কথা। কত সময় কেটেছে চারুকলার সেই দোতলা ছাদটার উপর, কার্জন হলের পুকুরের পাশে, ধানমণ্ডি লেকে, রমনা পার্কে। দিনগুলোকে মনের খাঁচায় বন্দী করে রাখবে রুনি। কখনও পুরনো হতে দিবে না। সন্তর্পণে চোখের জল মুছে রিক্সায় উঠলো রুনি।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here