তোমরা কুঞ্জ সাজাও গো,পর্ব: ৯
নূর নাহার
বাদলের সান্ত্বনায় কাজ হয়নি। রুনি অনবরত কেঁদেই চলেছে, সকাল থেকে। দুপুর সাড়ে ৩টা বাজে। রুনিকে এখনি বিউটি পার্লারে যেতে হবে। নিলুফা বারবার তাগাদা দিয়ে যাচ্ছেন, “এই রুনি, ওঠ মা। দেরী হয়ে যাচ্ছে। রাবু জানতে পারলে অনেক রাগ করবে।” রুনি কিছু বলতে পারছে না, শুধু কেঁদেই যাচ্ছে। সপ্না দূর থেকে সব দেখছে। রাবেয়া ডাক দিল, “সপ্না”। “জি ম্যাডাম” সপ্না দৌড়ে আসল।
“কি হয়েছে ঐখানে?” সপ্না ইতস্তত করতে লাগলো।
“কি হচ্ছে জবাব দিচ্ছ না কেন?”
“ম্যাডাম রুনি আপা খুব কান্নাকাটি করছে।”
“ও এখনও পার্লারে যায়নি? হুইলচেয়ার আন। আমাকে ঐ ঘরে নিয়ে চল। কি হল? দাঁড়িয়ে আছ কেন? বললাম না হুইলচেয়ার আনতে।” সপ্না ভয় পেয়ে দ্রুত হুইলচেয়ার এনে রাবেয়াকে বসাল। রুনির ঘরে নিয়ে গেল। “কি হচ্ছে এখানে?”
যা ভয় পেয়েছিল তাই ঘটলো।নিলুফা জবাব দিল, “তেমন কিছু না।তুমি চিন্তা কর না। ভয় পেয়ে গেছে তো। এখুনি ঠিক হয়ে যাবে।”
“ভয় পাওয়ার মত তো এখানে কিছু ঘটেনি। রুনি আমার দিকে তাকা।” রুনি ভয়ে ভয়ে মায়ের দিকে ফিরল।নিচের দিকে তাকিয়ে থাকল।
“কি হয়েছে? তোর সমস্যা কি?এত কান্নাকাটির কি আছে? তোকে তো আমরা হাত-পা বেঁধে পানিতে ফেলে দিচ্ছি না।” রুনি নিরুত্তর। “ তুই যে গাধাটার জন্য এত কাঁদছিস, ঐ গাধাটা জানে?”
“বাদলদার কোন দোষ নেই মা।”
“আমি বাদলের নাম কখন বললাম?” ঘরের মধ্যে বাজ পড়লেও হয়ত এতটা চমকাত না কেউ।
“রাবেয়া তুমি ঘরে যাও। আমি রুনিকে বুঝিয়ে পার্লারে পাঠাচ্ছি।”
“কি বোঝাবে তুমি রুনিকে বুবু? তার আগে তুমি আমায় বোঝাও তুমি ওদের সম্পর্কে জানতে?”
নিলুফা নিরুত্তর রইল। “বোলো বুবু। আজকে আর চুপ করে থাকার কোন সুযোগ নেই।”
“দেখ ওরা ছোটবেলা থেকে একসাথে বড় হয়েছে, হয়ত একজনের আরেকজনকে ভাল লেগেছে। এইটুকুই। এর চেয়ে আর বেশি কিছু না।”
“কত সহজে তুমি বলে দিলে ভাল লেগেছে। বুবু শুধু ভাল লাগলে কোন ছেলে কোন মেয়ের জন্য ১০০ গোলাপও আনে না আর কোন মেয়ে কোন ছেলের জন্য এভাবে কেঁদে ভাসায় না। ওদের মধ্যে ভাললাগা ছিল না বুবু, ভালবাসা ছিল। এটা তোমরা সবাই যেমন জান আমিও জানি।”
“তুমি কিছু জাননা রাবেয়া। ওরা দুজনের কেউ কাউকে নিজেদের ভাললাগার কথাটুকু পর্যন্ত বলেনি।”
“সব কথা বলতে হয়না বুবু। কিছু জিনিষ বুঝে নিতে হয়।আর ভালবাসার ব্যাপার স্যপার ওরা অনেকদিন আগেই বুঝেছিল। ওদের উপর আমার কোন রাগ বা ক্ষোভ নেই বুবু। ওরা আমার কাছে দুরের ছিল, এখনও আছে কিন্তু তুমি তো দুরের ছিলে না, তুমি কেন আমাকে ওদের কথা বললে না? তুমি কেন একবার ও আমার কাছে রুনিকে চাইতে পারলে না? একবার ও বলতে পারলে না রাবু তোমার মেয়েটাকে আমাকে দাও।আমি ওকে আমার ছেলের বউ করে নিতে চাই। কেন বলতে পারলে না বুবু, বল কেন পারলে না?” নিলুফা অবাক হয়ে রাবেয়ার দিকে তাকিয়ে রইলে।
রাবেয়া বলতে লাগলেন, “জানি এটাই তো বলবে, তোমরা বাড়িওয়ালা আমরা ভাড়াটিয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। ভাড়াটিয়া হিসেবে তোমার দায়িত্ব কি ছিল বুবু? এক্সিডেন্টের পর যখন বারবার রুনিকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিচ্ছিলাম নিজের ঘর থেকে তুমি সেদিন রুনিকে কাছে টেনেছিলে,ওর মায়ের দায়িত্ব পূরণ করেছিলে। ওর মেয়ের হওয়ার দিনে ও আমার কাছে আসেনি, তোমার কাছে গিয়েছিল।বৃত্তি পরীক্ষার আগের দিন ও যখন প্রচণ্ড ১০৩ ডিগ্রি জ্বরে কাতরাচ্ছিল সারারাত ওর পাশে বসেছিলে তুমি সেদিন। ওর মেট্রিক পরীক্ষার দিন ও যখন পরীক্ষার হলে যেতে ভয় পাচ্ছিল তুমি ওকে সাহস দিয়েছিলে, ওকে পরীক্ষার হলে নিয়ে গিয়েছিলে নিজের ডিউটিতে না গিয়ে।এগুলোর মধ্যে কোন দায়িত্বটা ভাড়াটের বলতে পারো বুবু? আজকে আমার মেয়ের যখন তোমার ছেলেকে প্রয়োজন, তোমার পরিবারকে প্রয়োজন তখন তোমার মনে পড়লো আমরা বাড়ীওালা-ভাড়াটে। আমার পা খোঁড়া, আমার বিবেক খোঁড়া না বুবু। আমার মেয়ের বাকিটা জীবন কাটানোর জন্য অন্য কোন মা, অন্য কোন পরিবারের প্রয়োজন নেই। আর তোমার ছেলে একটা গাধা। গাধা নিজের বিয়ের আয়োজন নিজে করে, আবার ১০০ গোলাপ নিয়ে আসছে। আমার মেয়ের বিয়ে আমি আমার ঘর সাজাব, পাড়া- প্রতিবেশীর ঘর আমি সাজাবো নাকি?”
রুনি দৌড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরল, “আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না মা।”
“সেজন্যই তো তোকে উপরতলায় পাঠাতে চাই।বেশি দূরে না।অবশ্য সবকিছু বুবুর ইচ্ছের উপর নির্ভর করছে। সরি বুবু, অনেক কিছু বলে ফেললাম। তোমাকে না বলেই তোমার ছেলের বিয়ের আয়োজন করে ফেললাম। তোমার উপর জোর করছি না বুবু, তুমি চাইলে এই বিয়েটা নাকচ করে দিতে পারো। তোমার বা তোমার পরিবারের প্রতি আমাদের মা- মেয়ের শ্রদ্ধা- ভালবাসার এতটুকু কমতি হবেনা। যাই হোক না কেন এই উপলক্ষে আমরা মা- মেয়ে তো কাছাকাছি আসতে পেরেছি।এই বা কম কিসের?”
“বিয়ের আয়োজন করে ঠিকই তো করেছ। জিজ্ঞেস করলে আমি হয়তো দ্বিধায় থাকতাম।আসলে নিজেকে খুব ছোট মনে করেছিলাম তো তাই হয়তো সাহস করতে পারিনি। হয়তো দেরী হয়ে গেছে তারপর ও জিজ্ঞেস করছি তোমার মেয়েটাকে আমায় দিবে রাবু? তবে সবার চোখে ও হয়তো আমার পুত্রবধু হয়ে যাবে, কিন্তু আমি জানি ও আমার মেয়ে হয়ে যাবে। কিরে যাবি তো আমার বাসায়?” নিলুফা বলল।
রুনি নিলুফাকে জড়িয়ে ধরল। রাবেয়া তাগাদা দিলেন, “যা এখন পার্লারে যা। তোর বাবা সেই কখন গাড়ি পাঠিয়েছে।মিলিকেও নিয়ে যা। ভাইয়ের বিয়েতে ওর ও সাজতে ইচ্ছে করতে পারে।”রুনি চলে গেল।
“এই খামটা নাও। তোমার ছেলের চাকরী হয়েছে বুবু। পরশু Appointment Letter এসেছে। তোমাদের সারপ্রাইজ দিব বলে দেইনি।”
“কি হচ্ছে এসব আজকে? দেখি দেখি।” নিলুফার চেহারা খুশিতে ঝলমল করে উঠল। “রাবু আমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আমার খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করছে।”
“আমার সামনে নাচ। ছেলে-মেয়ের সামনে নাচার দরকার নেই।”
“রাবু, ভাইজান জানে সবকিছু?”
“ওর সাহায্য না পেলে এত কিছু প্ল্যান করতে পারতাম? বাদল কোথায় গো? নিশ্চয়ই পার্কে পার্কে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বেকার জীবনের আর কি কাজ?”
“ঘুরুক। ওর একটু শাস্তির দরকার আছে।গাধা কোথাকার।”
দুজনে হেসে উঠল। “বুবু সপ্নাকে বলতো আমার জিনিষপত্রগুলো রুনির বাবার ঘরে শিফট করতে। আজ থেকে আমরা এক ঘরেই থাকব। আলাদা থাকতে আর ভাল লাগে না।”
“বলছি। তুমি রুমে যাবে না?”
“একটু জানালার কাছে নিয়ে যাও না। আকাশটা কি মেঘলা হয়ে আছে। মনে হচ্ছে খুব জোরে ঢালবে আজ। জান রুনি যেদিন জন্মেছিল সেদিন ও অনেক বৃষ্টি হয়েছিল। আজ ওর বিয়ের দিনেও ঝুম বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে।” নিলুফা রাবেয়াকে জানালার কাছে নিয়ে এলেন। “রাবু যে ছেলেটার ছবি দেখালে সে কে?” “থাক না একটু রহস্য বুবু।” রাবেয়া মুগ্ধ দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।
বাদল পার্কের বেঞ্চে ঘুমিয়েছিল। হঠাৎ ঝুম বৃষ্টি শুরু হলে ঘুম ভেঙ্গে গেল। চমকে গেলেও ভালই লাগছে বৃষ্টিতে ভিজতে। চা খেতে ইচ্ছে করছে। চা খাওয়ার পর পকেটে হাত দিয়ে দেখল মানিব্যাগ নেই। পিক পকেট হয়ে গেছে। চায়ের দোকানদার এমন ভাবে তাকিয়ে ছিল মনে হয় বাদল নিজে চোরকে দিয়ে চুরি করিয়েছে। বাদলের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। ব্যাগে ১০০০ টাকা ছিল। এই মাসের সম্বল। অনেকক্ষণ ধরে পার্কের গেটে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু কোন রিক্সা খুঁজে পেল না। আজ তো হরতাল না। রিক্সাগুলো সব গেল কই? হাঁটতে হাঁটতে মৎস্য ভবন থেকে কাকরাইল মোড়ে আসল। একটা রিক্সা আসছে।
“এই রিক্সা যাবে?”
“কই যাইবেন?”
“খিলগাঁও তালতলা।”
“৫০টাকা ভাড়া।” ২৫ টাকার ভাড়া ৫০ টাকা চাচ্ছে। অবশ্য এখন বাদলের কাছে ৫০ টাকা যা, ১০০ টাকাও তা। কথা না বাড়িয়ে রিক্সায় উঠে পড়ল। আর বেশি দেরী করলে শান্তিনগরে পানি জমে যাবে, যাওয়া সমস্যা হয়ে যাবে।
বাসার কাছের দোকান থেকে রিক্সাভাড়া দিল। গেটের ভিতর ঢুকার পর মনে পড়ল আজ রুনির বিয়ে। আরও পরে আসলে হত। হঠাৎ ইব্রাহিমের সাথে দেখা, “ভাইজান আসছেন। আপনেরে সবাই খুঁজতেছে।”
“কেন?”
“ভিতরে যান। গেলেই টের পাইবেন।”
বাদল ভয়ে ভয়ে উপরে উঠল। দোতলার দরজার কাছে এসে মিলির সাথে দেখা। “মা ভাইয়া এসেছে। আমি কিন্তু রুনি আপাকে বলে দিয়েছি আমি আপাকে ভাবী ডাকতে পারব না। আমি আপাই ডাকব।”
বাদল কিছু বুজতে পারছে না। পেছন থেকে রাবেয়া বলল, “বুবু তোমার ছেলে এসেছে। বিয়ের আগে ওকে হলুদ দিবে না একটু?”
নিলুফা ভিতর থেকে বের হয়ে এসে বললেন, “হলুদ দিতে হবে না, ওর হলুদ দেয়া হয়ে গেছে।” সকালবেলায় বাদলের শার্টের হলুদ দাগ চোখ এড়ায়নি নিলুফার।“কই ছিলি সারাদিন?”
“মা, আমি কিছু বুঝতে পারছি না। মেহমানরা কোথায়? আর রুনি কই?”
“মেয়েটা অনেকক্ষণ ধরে তোর জন্য অপেক্ষা করে আছে। চল উপরে।” নিলুফা ছেলেকে উপরে নিয়ে গেলেন।
(চলবে)