তোমরা কুঞ্জ সাজাও গো,শেষ পর্ব
নূর নাহার
বাদল অনেকক্ষণ ধরে উসখুস করছে। বৃষ্টির পর চারপাশটায় একটা শান্ত পরিবেশ বিরাজ করছে।প্রতিদিনের মত নিয়ম করে বাদল–রুনি ছাদে উঠেছে।রুনি একটু দূরত্ব রেখেই বসেছে। কাছে বসতে লজ্জা করছে।
“তুমি এত উসখুস করছ কেন?”
“সিগারেট নেই তাই।”
“তোমার পাশের টবের উপর একটা পলিথিনের ব্যাগ আছে। ঐটার ভেতর দেখ।”
বাদল প্যাকেটের ভেতর থেকে সিগারেট বের করে ধরাল। সিগারেটের ধোঁয়া বের করতে করতে বলল, “তোর মা তো বিশাল অভিনেত্রী রে। সুবর্ণা মুস্তফা ফেল।”
“অভিনয় করেছে বলেই আমাকে পেয়েছ, বুঝলে।”
“বিয়ে করে মায়ের চামচা হয়ে গেছিস মনে হচ্ছে। যাই হোক, কাল সকালবেলা রেডি থাকবি।এ বাড়ি থেকে আমরা চলে যাব। মহিলাকে একদম বিশ্বাস নেই। হয়তো সকালবেলা দেখব ডিভোর্স লইয়ার নিয়ে এনে বলবেন, আমার না ভুল হয়ে গেছে আমার মেয়েকে তোমার হাতে তুলে দিয়ে। তোমাদের এখনি ডিভোর্স করানো উচিত। একবার যখন পেয়েছি আর হারাতে দিব না তোমায় রুনিরানি।”
“মোটেও এমন কিছু হবে না। মা তোমায় অনেক পছন্দ করে।”
“তাই বুঝি?মায়ের পছন্দ পরে শুনব। আগে মেয়ের পছন্দ শুনি। একটা মানুষ এত কাঁদতে পারে?I can’t believe that. এমন জানলে তো তোকে শীতলক্ষ্যার পাড়ে না, পদ্মার পাড়ে নিয়ে যেতাম।”
“বাজে কথা বলবা না, তুমিই তো আমায় কাঁদিয়েছ।”
“তাই বুঝি? তবে কাঁদিয়ে একদিকে ভালই হয়েছে।চোখ- মুখ ফুলে আছে।অনেক সুন্দর লাগছে তোকে দেখতে।এই লাল জামদানী শাড়িটায় তোকে বেশ মানিয়েছে। দেখ তোর বাগানের ফুলের মধ্যে তোকেও একটা ফুলের মত মনে হচ্ছে।” রুনি লজ্জা পেয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল।
“তা আমি কি আমার ফুলকে Request করতে পারি আমার পাশে এসে বসার জন্য। এত দূরত্বে থেকে বিরহে কাতর হওয়া যায় কিন্তু ভালবাসা যায়না।” রুনি লজ্জায় উঠে যেতে পারছে না।“কিরে আসবি না কাছে?”
অবশেষে রুনি উঠে গেল।একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে বসতে গেল।“পাশে বসতে বলেছি। কোলের উপর বসতে বলিনি।”রুনি সরে যেতে গেল। বাদল হাত ধরে বাধা দিল যেতে। তারপর পকেট থেকে চুড়ি বের করে পড়িয়ে দিল রুনির হাতে।“মা দিয়েছে। মা নিজেই পরাতে চেয়েছেন, আমি বললাম আমাকে দাও। আমার বউ আমার জন্য কান্নাকাটি করে নদনদীর পানি ২ সেন্টিমিটার বাড়িয়ে দিয়েছে, আমিই পরাই।”
রুনি বাদলকে জড়িয়ে ধরল।“তুই আমায় ঋণী করে দিলিরে।”
“বাদলদা আজ আমার অন্য কোথাও বিয়ে হয়ে গেলে তুমি কি করতে?”
“সোজা তোর শ্বশুরবাড়ির সামনে গিয়ে মরে পরে থাকতাম। দেবদাসের মত।”
“যাও। শুধু বাজে কথা বল।”
বাদল রুনিকে নিজের সাথে শক্ত করে ধরে বলল, “নারে, হয়তো তাই করতাম। তোর মনে আছে সেকেন্ড ইয়ারে থাকতে আমার একবার প্রচণ্ড জ্বর হল। আমি চোখ খুলতে পারছিলাম না। তুই কাঁদতে কাঁদতে মাকে বললি, খালামনি বাদলদা কি মরে যাবে?সেদিন টের পেয়েছিলাম তুই আমাকে কি প্রচণ্ডভাবে ভালবাসিস। সেদিন আল্লাহপাককে বলেছিলাম আল্লাহপাক আমি আজকে মরব কিনা জানিনা, যেদিন মারা যাব সেদিন যেন এই মেয়েটার চোখে চোখ রেখে যাতে মারা যেতে পারি।”
“এতদিন এসব বলনি কেনও?”
“মাথা খারাপ? না বলেই যে ভালবাসার নদী পেয়েছি। বললে তো সমুদ্রে ডুবে মরতে হত। কিন্তু এখন তো আমাদের ডুবে মরলে চলবে না।আমার একার রোজগারে তো ভালভাবে থাকা যাবে না। তোকে পড়াশুনা শেষ করতে হবে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। সংসারে সাহায্য করতে হবে। তোমার বাবার মত তো আমার গাড়ি –বাড়ি- প্রতিপত্তি নেই, আমার সাথে থাকতে গেলে একটু কষ্ট করতেই হবে।”
“তুমি পাশে থাকলে আমি সব কষ্ট করতে রাজি আছি। তবে আমার কাছে কিন্তু অন্যরকম মনে হচ্ছে। আমার মনে হয় তুমি গ্রামে চলে যেতে।” বাদল অবাক হয়ে গেল। রুনি কি করে বুজতে পারল? বাদল ঠিক করেছিল গ্রামের বাড়িতে গিয়ে কিছু একটা করে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিবে। রুনি ছাড়া এই শহরটা বাদলের কাছে অর্থহীন।“তুই কি অন্তর্যামী?”
“না, আমি তোমার অর্ধাঙ্গিনী”।বাদলদা।”
“হুম। তুই কি সারাজীবন আমাকে বাদলদা ডাকবি নাকি?”
রুনি মাথা নেড়ে বলল, “না, কিন্তু একটু সময় তো লাগবে”
“ওকে।Take your time”
“আমাদের মনে হয় এই বাসাটা ছেড়ে দিতে হবে।”
“কেন?”
“আমার দাদাভাইয়ের খুব শখ ছিল গ্রামের বাড়িতে একটা হাসপাতাল করার।বাবা-মা ঠিক করেছে হাসপাতালের কাজ শুরু করবে। কিন্তু তার জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন। তাই মা এই বাড়িটা ডেভেলাপারদের দিয়ে দিয়েছে। ওরা এখানে বড় বিল্ডিং করবে। আমাদের চারটা ফ্ল্যাট দিবে। মা বলেছে ২টা আমাদের জন্য রেখে বাকিগুলো বিক্রি করে দিবে।”
“অসম্ভব এই বাড়ি ভাঙ্গা যাবে না।এই বাড়ির ছাদ কোন ক্রমেই নষ্ট করা যাবে না। তোর বাবাকে বল অন্য কোন ভাবে টাকার যোগাড় করতে। বাড়ি ভাঙ্গা যাবে না।”
“নতুন হাসপাতালের জন্য ও না?”
“এই প্রথম আমি কোন Wife কে দেখলাম তার Husband কে বিয়ের রাতে Emotional Blackmail করতে। ঠিক আছে নতুন কোন ছাদে আমরা আমাদের গল্প লিখব সেই আশায় রইলাম।”
রুনি বাদলের গালে চুমু দিয়ে গান ধরল, “এই মোম জোছনায় অঙ্গ ভিজিয়ে এসো না গল্প করি।” বাদল অবাক হয়ে গেল। রুনিত এই ধরণের গান করে না। এই গান ও কখন শিখল?
(গল্পের এখানেই শেষ।এই গল্পটার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ৯০এর ঢাকা শহর, তখনকার ঢাকা শহরের জীবনযাত্রার পদ্ধতি তুলে ধরা। গল্পের প্রয়োজনে বাদল-রুনি জুটিকে আনা হয়েছে, ওদের প্রয়োজনে কোন গল্প তৈরি হয়নি। হয়তোবা অন্য কোন ইস্যু নিয়ে অন্য কোন গল্পের প্রয়োজনে ওদেরকে আবার আনা হবে।গল্পের ইস্যুটাই বড়, ওদের প্রেমকাহিনি না। আমার গল্পের পাঠকরা বলতে পারবেন আমি ঐ সময়টাকে কতটা তুলে ধরতে পেরেছি। আমার মনে হয় খুব সামান্য হলেও পেরেছি, যদিও আমার স্মৃতিশক্তি খুবই দুর্বল।স্মৃতিশক্তি দুর্বল হওয়ার জন্য আমার দুঃখ নেই কারন রবিঠাকুরের স্মৃতিশক্তিও দুর্বল ছিল। রেফারেন্স চাইলে দিতে পারি। গল্পটা পড়ে অনেকের মনে হতে পারে ঢাকা একটা বিলাসিতার শহর ছিল।না, তখনকার ঢাকা শহরেও অভাব ছিল, দুঃখ ছিল।এক মুঠো ভাতের জন্য একদল মানুষ অমানুষিক পরিশ্রম করেছে। ফুটপাতের মধ্যে পলিথিন দিয়ে ঘর তৈরি করে থেকেছে। পতিত নারীর বেদনায় সিক্ত হয়েছে রাজপথ। বখাটেদের উৎপাতে উৎকণ্ঠিত থেকেছে বহু পরিবার। তবু কোথাও বেজেছে বাঁশির সুর, কোথাও গড়ে উঠেছিল মায়ার বন্ধন, কোথাও ছিল সব হারিয়ে ভালবাসার স্বপ্ন।গণমাধ্যমগুলো মানুষের জীবনে যোগ করেছিল নতুন মাত্রা। আজকের ঢাকা শহর গড়ে উঠেছে মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর এক রমরমা বাজার হিসেবে। বাজারের লেনদেনে আমরা সরে আসছি আমাদের স্বকীয়তা থেকে।অপরিকল্পিত নগরায়ন এই শহরকে করেছে বিধ্বস্ত। প্রতিদিন জীবনের প্রয়োজনে এই শহরে যোগ হচ্ছে নতুন নতুন মানুষ। এই শহরে আমার জন্ম, আমার বেড়ে ওঠার শহর এই ঢাকা শহর। এই নতুন যোগ হওয়া মানুষগুলো তাই আমার কাছে বাড়ির মেহমানের মতই। কিন্তু সেই মেহমানদের আমরা, আমাদের এই শহর ঠিক মত সমাদর করতে পারছে না। ফলে এই শহরের প্রতি বেড়ে যাচ্ছে তাদের অসন্তুষ্টি। যাকে ভালবাসা যায় তার ব্যর্থতার দায় কিছুটা বহন করা যায়। তাই এই শহরের পক্ষ থেকে বলছি, আমাদের ক্ষমা করবেন। আমরা আপনাদের ভাল রাখতে পারিনি। )।(শেষ)