তোমাকে ঘিরে আমার অনুভূতি?,পর্ব_০৯,১০
Anika Fahmida
পর্ব_০৯
আদ্র অনুর দিকে তাকিয়েই কঠোর গলায় বলল,
–না, তোর কথা আমার মনে পড়বে না।
অনু অবাক হয়ে আদ্রকে বলল,
–তুমি এই কয়েকদিনে কেমন পাল্টে গেছো আদ্র।
আদ্র গম্ভীর স্বরে অনুকে বলল,
–পাল্টানোটাই স্বাভাবিক। আমাকে বিদেশে গিয়ে ঠিকমতো পড়াশোনা করতে হবে। তোর পেছনে সময় নষ্ট করার কোনো ইচ্ছে আমার নেই।
আদ্র অনুর সাথে এভাবে কথা বলছে অনুর যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। অনু অবিশ্বাস্য স্বরে আদ্রকে বলল,
–তুমি আমাকে এই কথাটা বলতে পারলে আদ্র?
আদ্র অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,
–হ্যা পারলাম।
অনু তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে আদ্রকে বলল,
–বাহ্ তাহলে তুমি আমাকে ভালোবাসো এই কথাটাও মিথ্যে ছিল। এখন বুঝতে পারছি।
আদ্র অনুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
–তুই কি আমাকে কখনো ভালোবেসেছিস অনু?
আদ্রের জিজ্ঞেস করা কথায় অনু থমকে গেল। তার মনে এই কথার উত্তর জানা নেই। অনু আদ্রের দিকে তাকাল। আদ্র অনুর মুখের দিকেই অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অনু আর কোনো কথা না বলে একমুহূর্তে সেখানে দাঁড়াল না। দৌড়ে বেরিয়ে গেল আদ্রের রুম থেকে। আদ্র অনুর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর থম মেরে সোফায় বসে পড়ল। আদ্র কপালে ডান হাত রেখে মনে মনে বলল,
–আমি চলে গেলেও তুই আমাকে ভালোবাসি বলবি না অনু। তারমানে তুই আমাকে ভালোবাসিস না। আমিই শুধু তোকে বোকার মতো তোকে ভালোবেসে গেছি। একটা বার যদি বলতি আমাকে তুই ভালোবাসিস তাহলে বিশ্বাস কর আমি কোথাও যেতাম না। কিন্তু এখন আমাকে বিদেশে যাওয়া থেকে কেউ আটকাতে পারবে না। যেখানে তুই আমাকে ভালোবাসিস না সেখানে আমার এই দেশে থাকারও দরকার নেই।
অনু রাস্তায় শুকনো মুখে হাঁটতে লাগল। অনুর নিজেকে কেমন পাগল পাগল মনে হচ্ছে। কেন আদ্রকে ভালোবাসি কিনা কথাটির উত্তর দিতে পারল না তা অনুর জানা নেই। অনুর বুকের মাঝে চিনচিন ব্যথা করছে। এতো কেন কষ্ট পাচ্ছে অনু বুঝতে পারছে না। অনু রাস্তায় হাঁটছে আর ভাবছে,
–আমি কি আদ্রকে ভালোবাসি? নাকি ভালোবাসি না?
আমার মন কেন সঠিক উত্তর দিতে পারছে না? আচ্ছা আদ্র কি আমাকে সত্যি মন থেকে ভালোবাসে?তাহলে বিদেশ চলে যাচ্ছে কেন? এতো রাগী মানুষটা আমাকে ভালোবাসে তো? আমি বুঝতে পারছি না।
একমাস হলো অনুর সাথে আদ্রের কথা হয় না। আদ্র অনুকে ফোন দেয় না। অনু আদ্রকে ফোন দিতে মন চাইলেও সেই মনের ইচ্ছেকে দমন করে চুপ করে বসে আছে। মনের কোথাও যেন অভিমান লুকিয়ে আছে।
আমেনা বেগম অনুর রুমে এসে অনুকে মন খারাপ করে বসে থাকতে দেখল। অনুর পাশে বসে আমেনা বেগম অনুকে জিজ্ঞেস করল,
–অনু কি হয়েছে তোর?
অনু আমেনা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলল,
–কিছু হয় নি আম্মু।
–তাহলে মন খারাপ করে বসে আছিস কেন?
–এমনি। কিছু ভালো লাগছে না।
–আজ দুপুরে আদ্র বিদেশ যাওয়ার জন্য রওনা দিবে। আদ্র লন্ডনে চলে যাবে। পাঁচ বছর আবারও দেশে ফিরবে। তার আগে নয়।
অনু অবাক হয়ে আমেনা বেগমকে বলল,
–কি বলছো আম্মু? তুমি আমাকে এতোদিন বলো নি কেন যে আদ্র ভাইয়া আজ লন্ডন চলে যাবে?
আমেনা বেগম মন খারাপ করে অনুকে বলল,
–আজ সকালেই তো জানতে পারলাম। নাহলে তোকে আরও আগে বলতে পারতাম।
অনু বুক ভরা কষ্ট নিয়েই আমেনা বেগমকে বলল,
–আম্মু ভালোই হয়েছে আদ্র ভাইয়া চলে যাবে। দরকার কি দেশে থাকার? শুধু আমাকে বকা দিত। আদ্র ভাইয়া চলে গেলে কেউ আমাকে বকা দিতে পারবে না।
আমেনা বেগম অনুকে বলল,
–তুই মুখে এই কথা বলছিস ঠিকই কিন্তু তোর চোখে মুখে আমি কষ্টের ছাপ কেন দেখতে পারছি?
অনু নিজের চোখের জল মুছে নিয়ে বলল,
–উফফ আম্মু তুমিও না কি যে বলো! আমি আর কষ্ট? আমাকে অন্তত আদ্র ভাইয়ার জন্য কষ্টে মানায় না।
আমেনা বেগম অনুর মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে রইলেন। অনু আমেনা বেগমের দিকে তাকিয়ে হাসির ভান করে হাসল।
আদ্র ট্রলি ব্যাগে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছাচ্ছে। অনুর কথা ভীষণ মনে পড়ছে। আদ্র মনে মনে বলল,
–আমি ফোন দিলাম না দেখে তাই তুইও ফোন দিলি না অনু? এতো রাগ আমার উপর? আজ আমি লন্ডন চলে যাচ্ছি। আমাকে ছাড়া হয়তো তুই ভালোই থাকবি।
আদ্রের বুকের ভিতর কষ্ট হচ্ছে। আজ আদ্রের কান্না পাচ্ছে কারণ অনুকে ছাড়া একা বিদেশ থাকতে হবে। কান্না করতে চাইলেও আদ্র কান্না আটকে নিচ্ছে। কান্না আসতে দেওয়া যাবে না।
আদ্র সহ আদ্রের পরিবার বেরিয়ে পড়ল এয়ারপোর্ট যাওয়ার উদ্দেশ্যে। ফ্লাইট ২ঃ০০ টায়। এখন বাজে ১ঃ০০। আধ ঘন্টায় আদ্র এয়ারপোর্ট পৌঁছে যায়। অনেকক্ষণ হয়ে গেল আদ্র এয়ারপোর্টের একটা চেহারে বসে মনে মনে বলল,
–কখন আসবি অনু? তোকে কি একটুও চোখের দেখা দেখতে পারব না? আমি যে তোকে একটাবার দেখতে চাই। তাড়াতাড়ি চলে আয়। নাহলে যে তোকে আমি দেখে যেতেও পারবো না।
এয়ারপোর্টে যাওয়ার জন্য অনু সহ অনুর পরিবার রওনা দিচ্ছে। আদ্রের মা রেহেনা পারভিন অনুর মা আমেনা বেগমকে ফোন দিয়ে জানিয়ে দিল যে তারা পৌঁছে গেছে। তাড়াতাড়ি অনুও যেন এয়ারপোর্ট এসে পড়ে। অনু একটা গাড়িতে বসে। কিন্তু রাস্তায় অনেক জ্যাম। অনেক সময় পাড় হওয়ার পর দেড়িতে যখন অনু পৌঁছাল তখন জানতে পারল আদ্র প্লেইনে উঠে গেছে৷ অনুর বুক ফেটে কান্না পাচ্ছে। আদ্র তারমানে চলেই গেল। শেষমেষ কান্না করতে করতেই অনু বলল,
–তুমি চলে গেলে আদ্র। তোমাকে একটাবার দেখতেও পারলাম না। তোমাকে আমি পাঁচটা বছর আর চোখের দেখা দেখতে পারবো না। কেন আদ্র? কেন চলে গেলে?
আদ্র বিদেশ চলে যাওয়ার পর অনু কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছে। মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেছে। সবার সাথে রেগে কথা বলে। অনুর বাবা বুঝতে পারছে না তার মেয়ে এমন কেন হয়ে গেল। কিন্তু অনুর মা আমেনা বেগম ঠিকই বুঝতে পারছে। বিদেশ যাওয়ার পর আদ্র অনুর সাথে কথার বলার জন্য অনুর ফোন নাম্বারে কল দেয়। কিন্তু অনু বিদেশি অচেনা নাম্বার ফোনের স্ক্রিনে দেখতে পেয়ে আদ্র ফোন দিয়েছে বুঝতে পেরে ফোন রিসিভ করল না। বিছানার একপাশে ফোন রেখে দেয়।
প্রতিদিন আদ্র বার বার অনুর ফোন নাম্বারে কল দেয় কিন্তু অনু ফোন না ধরে মোবাইল অফ করে দেয়। রাগে আদ্র নিজের অনেকগুলো মোবাইল আছাড় দিয়ে ভেঙে ফেলেছে। আদ্র রেগে বলতে লাগল,
–তুই এতোটা বদলে গেলি অনু? এতোটা বদলে গেলি? আমি অনবরত ফোন দিচ্ছি তাও ফোন রিসিভ করছিস না। আমার কথা ভুলেই গেলি! আমি যে তোকে ছাড়া কিভাবে আছি তা একমাত্র আমি জানি। তুই জানিস না অনু। একটাবার ফোন ধরলে তোর কি হয়?
এভাবেই দুই বছর চলে গেল। অনু এখন ভার্সিটিতে অনার্স প্রথম বর্ষে পড়ে। ভার্সিটিতে অনু খুব ভালো বান্ধবী বানিয়েছে। তাদের সাথেই মাঝে মাঝে গল্প করে।
একদিন গল্পের মাঝে অনুর বান্ধবী নেহা অনুর হাতে তার বিয়ের কার্ড ধরিয়ে দেয়। অনু খুশি হয়ে বলল,
–তোর বিয়ের কার্ড নেহা? তুই বিয়ে করছিস?
নেহা মুচকি হেসে অনুকে বলল,
–হ্যা, আমার বিয়ে। অবশ্যই তুই আসবি। তুই না এলে আমি কিন্তু বিয়ে করবো না।
অনু হেসে নেহাকে বলল,
–তোর বিয়ে আর আমি আসব না? এটা কি হয়?অবশ্যই আমি আসব।
বিয়ে বাড়িতে অনু লাল রঙের লেহেঙ্গা পড়ে চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনুর মনটা আজ ভীষণ খুশি লাগছে।
নিজের বান্ধবীর বিয়ে বলে কথা! মন তো খুশি লাগবেই।অনু হেঁটে তার বান্ধবীর কাছেই যাচ্ছিল এমন সময় হঠাৎই একটা ছেলে অনুকে ধাক্কা দিয়ে পাশ কাটিয়ে তাড়াতাড়ি চলে যেতে লাগল। অনু নিজেকে সামলে নিল। আরেকটু হলেই অনু নিচে পড়ে গিয়ে ব্যথা পেত।অনু রেগে গিয়ে ছেলেটিকে বলল,
–ইউ ইডিয়ট ধাক্কা দিলেন কেন? দেখে চলতে পারেন না? কানা নাকি?
ছেলেটা অনুুর কথায় দাঁড়িয়ে পড়ল। অনু এখনও ছেলেটার মুখটা দেখে নি। ছেলেটা পেছন ফিরে অনুকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
–আমি আপনাকে ইচ্ছে করে ধাক্কা দেই নি। আপনার সাহস হয় কি করে আমাকে ইডিয়ট, কানা বলার?
অনু ছেলেটার মুখের দিকে তাকাল। ছেলেটা দেখতে সুদর্শন। গায়ে গোল্ডেন কালার পাঞ্জাবী পড়েছে। তখনি একটা মেয়ে দৌড়ে এসে ছেলেটাকে বলল,
–পল্লব ভাইয়া কি হয়েছে?
অনু বুঝতে পারল ছেলেটার নাম পল্লব।মেয়েটার দিকে তাকিয়ে পল্লব বলল,
–আরে বোন কি হয়েছে না বলে এটা বলো কি হয় নি!এই যে সামনে দাঁড়ানো এই মিসকে দেখতে পাচ্ছো? ইনি আমাকে বকা দিয়েছে। আমি ভয় পেয়ে দাঁড়িয়ে আছি।
অনু পল্লবকে কড়া গলায় বলল,
–আপনি আমাকে ধাক্কা দিবেনই বা কেন? চোখে দেখেন না? আপনি কি অন্ধ?
মেয়েটা অনুকে বলল,
–আপু পল্লব ভাইয়া তো বলল তোমাকে ইচ্ছে করে ধাক্কা দেয় নি। ভুলবশত ধাক্কা দিয়েছে। পল্লব ভাইয়াকে আর কিছু বলো না।
অনু রাগে জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে লাগল। পল্লব অনুর দিকে তাকিয়ে বলল,
–রাগ হচ্ছে আমার উপর? আপনার রাগ ঠান্ডা করার জন্য ঠান্ডা পানি এনে দিতে পারি। আপনার নিজের মাথায় ঠান্ডা পানি ঢেলে মাথা ঠান্ডা করবেন।
অনু রাগী স্বরে পল্লবকে বলল,
–আমার মাথায় ঠান্ডা পানি দেওয়ার প্রয়োজনও নেই। নিজের চরকায় তেল দেন।
অনু পল্লবের সামনে থেকে চলে গেল। পল্লব অনুর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,
–মেয়েটা অদ্ভুত কিন্তু ভীষণ রাগী।
স্টেজের পাশের এক কোণায় অনু দাঁড়িয়ে আছে। নেহা ও নেহার সদ্য বিয়ে করা স্বামী স্টেজের সোফায় বসে আছে। সবাই ছবি তুলছে। অনুর এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগছে না। হঠাৎ অনুর পাশে পল্লব এসে দাঁড়াল। অনু পল্লবকে দেখে অবাক হয়ে বলল,
–আপনি এখানে?
পল্লব অনুকে বলল,
–তো কোথায় থাকবো? বিদেশে?
বিদেশে কথাটি শোনার পর অনুর বুকে ব্যথা হতে লাগল। কষ্টে পুরো শরীর ভারি হতে লাগল। অনুর আদ্রের কথা মনে পড়তে লাগল। অনুর চোখের কোণে পানি চলে আসল। পল্লব অনুর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল অনুর চোখের কোণে পানি। পল্লবের না চাইতেও অনুর চোখের পানি দেখে খারাপ লাগল। পল্লব আবারও অনুকে জিজ্ঞেস করল,
–আপনি ঠিক আছেন?
অনু হাসার চেষ্টা করে পল্লবকে বলল,
–হ্যা আমি ঠিক আছি।
পল্লব সন্দেহী গলায় অনুকে বলল,
–মনে তো হচ্ছে না যে আপনি ঠিক আছেন। আমার তো মনে হচ্ছে আপনি কোনো কারণে খুব কষ্টে আছেন। তাই আপনার চোখে জল দেখতে পারছি।
অনু অবাক হয়ে পল্লবের দিকে তাকাল।
চলবে…
তোমাকে ঘিরে আমার অনুভূতি?
পর্ব_১০
Anika Fahmida
অনুকে অবাক হয়ে তাকিয়প থাকতে দেখে পল্লব অনুকে জিজ্ঞেস করল,
–কি হলো কিছু বলছেন না কেন?
অনু গম্ভীর স্বরে বলল,
–কি বলবো?
–এই যে আপনি কোনো বিষয়ে কষ্টে আছেন কিনা?
–আমার কোনো কস্ট নেই।
–রিয়েলি?
–হ্যা।
আদ্র অনুকে জিজ্ঞেস করল,
–আপনার নাম কি?
অনু বিরক্তি স্বরে পল্লবকে বলল,
–আমার নাম অনু।
পল্লব হাসিখুশি ভাবে অনুকে বলল,
— অনু! নাইস নেম।
বেশ অনেক্ষণ নিরবতার পর পল্লব আবারও অনুর দিকে তাকিয়ে বলল,
–আমার নাম জিজ্ঞেস করলেন না?
অনু পল্লবের মুখের দিকে তাকাল। কিন্তু কিছু বলল না। পল্লব হেসে অনুকে বলল,
–আমার নাম পল্লব।
–ওহ। হ্যা একটু আগে আপনার নাম শুনেছিলাম।
–তাই নাকি? কই আমাকে তো বললেন না। শুধু শুধু কষ্ট করে নিজের নামটা বলতে গেলাম।
–তাহলে নাম না বললেই পারতেন।
পল্লব অনুকে আবারও বলল,
–আজকে আমার ছোট বোনের বিয়ে।
অনু অবাক হয়ে পল্লবকে বলল,
–নেহা আপনার আপন বোন?
পল্লব হেসে অনুকে বলল,
–হ্যা নেহা আমার আপন বোন।
পল্লবের কথা শুনে অনু চুপ করে রইল। আর কিছু বলল না। একটি টেবিলে অনেকগুলো জুস আর কোল্ড ড্রিংকস। পল্লব সেখান থেকে অরেঞ্জ জুস হাতে নিয়ে অনুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
–অরেঞ্জ জুসটা খেয়ে দেখুন। আপনার ভালো লাগবে।
অনু মুচকি হাসার চেষ্টা করে বলল,
–না, লাগবে না।
পল্লব বিরক্ত স্বরে অনুকে বলল,
–আপনি মেয়েটা একটু বেশি চুপচাপ। এতো চুপচাপ আর রাগী কেন আপনি? প্রেমে করে ছ্যাকা খেয়েছেন?
অনু পল্লবের কথা শুনে পল্লবের দিকে তাকিয়ে বলল,
–মানে? কি বলছেন আপনি? আমি কোনো প্রেম করে ছ্যাকা খাই নি।
পল্লব মুচকি হেসে অনুকে বলল,
–তাহলে একটু হাসুন। হাসলে আপনাকে দারুন লাগবে।
অনু বিরক্ত হয়ে পল্লবের সামনে থেকে চলে গেল। পল্লব অনুর পেছন পেছন হাঁটতে লাগল। অনু দাঁড়িয়ে গিয়ে রাগী স্বরে পল্লবকে বলল,
–সমস্যা কি আপনার? আমার পেছন পেছন আসছেন কেন? আমার পেছন পেছন আসবেন না।
পল্লব অবাক হয়ে অনুকে বলল,
–আমি কই আপনার পেছন পেছন আসলাম?
–এই যে এখন আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন।
–আমি ঐদিকটায় একটু যাচ্ছিলাম কারণ আমার বন্ধুরা ঐদিকেই দাঁড়িয়ে আছে।
অনু সামনে তাকিয়ে দেখল বেশ কিছু দূরে অনেকগুলো ছেলে আড্ডা দিচ্ছে। অনু ভুল বুঝতে পেরে কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে পল্লবকে শান্ত স্বরে বলল,
–আই এম সরি।
–ইটস ওকে অনু।
অনু তাড়াতাড়ি করে সামনের দিকে হেঁটে চলে গেল। পল্লব মনে মনে বিড়বিড় করে বলল,
–মেয়েটা অদ্ভুত, রাগী সাথে পাগলও।
নেহার বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হলে অনু নিজের বাড়িতে চলে আসে। পল্লবের ব্যাপারে আর কোনো কিছু জানার আগ্রহ নেই তাই অনু জানতেও চাইল না। রাতে অনু বিছানায় শুয়ে আছে। প্রতিটা মুহুর্তে অনু আদ্রকে অনুভব করে কিন্তু কখনও প্রকাশ করে না। রাত হলেই অনুর বুকের ভিতরে চাপা কষ্ট ভর করে। আদ্রের কথা ভীষণ মনে পড়ে। আদ্র আজও অনুর ফোনে কল দেয় কিন্তু অনু ফোন ধরে না। অনু মনে মনে বলল,
–কেন আদ্র তুমি সেদিন আমার জন্য একটুও অপেক্ষা করলে না? যাওয়ার আগে আমাকে দেখার জন্য তোমার মন কি একটুও উতলা হয় নি? আমি সেদিন তোমাকে দেখতে পেলাম না। একটু জড়িয়ে ধরে কাঁদতেও পারলাম না। সেদিন আমার মনের অবস্থা কি হয়েছিল তুমি কি জানো? জানো না। তোমার ফোন আমি ধরবো না। যতদিন পর্যন্ত না তুমি দেশে ফিরছো ঠিক ততদিন পর্যন্ত আমি তোমার ফোন ধরবো না। তুমিও আমার মতো কষ্ট পাও। আমার সাথে কথা বলার জন্য নিশ্চয়ই তুমি ছটফট করছো। সেই ছটফট সেদিন এয়ারপোর্টে আমিও করেছিলাম কিন্তু তুমি চলে গিয়েছিলে। কেন চলে গেলে তুমি লন্ডনে? আমাকে ফেলে রেখে যেতে তোমার বুকটা একটুও কাঁপল না?
অনু চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল ঠিক কিছুক্ষণ পর ফোন বেজে উঠল। অনু চোখ মেলে তাকিয়ে দেখল আদ্র ফোন করেছে তাই অনু রিসিভ করল না। ঐদিকে আদ্র অনবরত ফোন দিতে দিতে একসময় হাল ছেড়ে দিয়ে চেয়ারে বসে পড়ে। আদ্র নিজমনে বলল,
–দুইটা বছর চলে গেল। কিন্তু আমার ফোন তুই রিসিভ করলি না অনু। প্রতিদিন তোকে ফোন দেই তাও তুই ফোন ধরিস না। তাও আশা করে বসে থাকি একদিন হয়তো তুই ফোন ধরবি। কিন্তু তুই ফোন ধরিস না। ঠিক আছে অনু জাস্ট ওয়েট। আমি খুব শীগ্রই ফিরছি তোর কাছে।তোর সাহস হয়তো একটু বেশিই বেড়ে গেছে। আদ্রের ফোন রিসিভ না করার ফল তুই ঠিক টের পাবি। আমি আসছি তোর কাছে।
আদ্র সিগারেট হাতে নিয়ে দেশলাই থেকে আগুন ধরিয়ে সিগারেট খেতে লাগল। ধোঁয়া চারিপাশে ছড়িয়ে গেল। সিগারেটটি পোড়ার সাথে সাথে একটু একটু করে আদ্রের বুকের ভিতরটাও পুড়তে লাগল।
সকাল হলে অনু ভার্সিটিতে চলে যায়। ভার্সিটির গেট দিয়ে ঢুকতে গিয়ে আবারও অনুর কারও সাথে ধাক্কা লাগে। মেজাজ খারাপ হয়ে উপরে তাকিয়ে পল্লবকে দেখে অনু অবাক হয়ে যায়। অনু অবাক হয়ে বলল,
–আপনি এখানে?
পল্লব অবাক হলেও পরমুহূর্তেই হেসে বলল,
–হেই অনু আপনি এখানে?
অনু বিরক্ত স্বরে বিড়বিড় করে বলল,
–আমার কথা আমাকেই ফিরিয়ে বলছে।
পল্লব অনুকে জিজ্ঞেস করল,
–কিছু বললেন অনু?
অনু হাসার চেষ্টা করে বলল,
–না, না কিছু না।
–আপনি কি এই ভার্সিটিতেই পড়েন?
–হ্যা। আপনি এখানে কেন?
–আমিও এই ভার্সিটিতেই পড়ি। আপনি কোন ইয়ার পড়েন?
–অনার্স ফার্স্ট ইয়ার। আপনি?
–আমি মাস্টার্স ফাইনাল ইয়ার। আপনার থেকে অনেক বড় আমি। তাই আমি কি আপনাকে তুমি করে বলতে পারি?যদি আপনি কিছু মনে না করেন!
অনুর মনে মনে বিরক্ত লাগলেও হেসে বলল,
–হ্যা বলতে পারেন। কিছু মনে করব না।
পল্লব তাড়াহুড়ো করে অনুকে বলল,
–আমার একটু কাজ আছে। আমি আসি। ওকে।
–হুম ওকে।
পল্লব তাড়াতাড়ি করে ভার্সিটির ভিতরে চলে গেল। অনু এখনও দাঁড়িয়ে আছে। তারপর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে অনুও ভার্সিটির ভিতর চলে গেল। ক্লাস শেষ করে অনু বাসায় যাচ্ছিল তখন রাস্তায় পল্লব ডেকে উঠল,
–হেই অনু দাঁড়াও।
কন্ঠটা আগেও শুনেছে অনু। তাই পেছন ফিরে পল্লবকে দেখে একটু ঘাবড়ে গল। অনু দাঁড়িয়ে পড়ল। পল্লব অনুকে জিজ্ঞেস করল,
–বাসায় যাচ্ছো নিশ্চয়ই?
অনু গম্ভীর স্বরে বলল,
–হ্যা।
–আমি তোমাকে বাসায় পৌঁছে দেই?
–দরকার নেই।
–কিন্তু কেন? আমি তোমার না শুনবো না। আমি তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে তবেই ছাড়ব।
অনু বিরক্তি স্বরে পল্লবকে বলল,
–আজব তো! আপনি সেই বিয়ের অনুষ্ঠানের দিন থেকেই আমার পিছু লেগেছেন! সমস্যা কি আপনার?
অনুর কথায় পল্লবেরও রাগ হলো। তাই অনুকে বলল,
–আমি তোমাকে মানবতার খাতিরে বাসায় পৌঁছে দিতে চেয়েছিলাম আর তুমি আমাকে অপমান করলে?
অনুও রেগে চিৎকার করে পল্লবকে বলল,
–কে বলেছে আপনাকে মানবতা দেখাতে? আমি বলেছি? ননসেন্স।
অনু ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে গেল। পল্লবের মুখটা গম্ভীর হয়ে আছে। কিন্তু পরমুহূর্তেই পল্লব বাঁকা হাসল।
আরও কয়েকটা দিন পাড় হয়ে গেল। আজ দুপুরে শপিংমলে অনু চুড়ি কিনতে যায়। কোনো চুড়িই অনুর পছন্দ হচ্ছে না। অনুর মনটা খারাপ হয়ে গেল। হঠাৎ চোখের সামনে অনু লাল ও গোল্ডেনের পাথর বসানো একটা জমকালো চুড়ি দেখতে পেল।কেউ অনুর মুখের সামনে চুড়িগুলো ধরে রেখেছে। অনু মুচকি হেসে চুড়িগুলো ধরতে গিয়েও পারল না। চুড়িগুলো অনুর চোখের সামনে থেকে কেউ সরিয়ে নিল। অনু পেছন ফিরে দেখল পল্লব দাঁড়িয়ে আছে। পল্লব মুচকি হেসে সেই চুড়িগুলো হাতে নিয়ে অনুকে বলল,
–কি চুড়িগুলো পছন্দ হয়েছে?
অনু অবাক হয়ে বলল,
–এখানেও আপনি?
পল্লব হেসে অনুকে বলল,
–তুমি যেখানে আমি সেখানে।
অনু পল্লবকে জিজ্ঞেস করল,
–আপনি আমাকে ফলো করছিলেন?
পল্লব কথা এড়িয়ে অনুকে বলল,
–চুড়িগুলো তোমার পছন্দ হয়েছে কিনা এটা বলো?
অনু সাথে সাথেই বলে উঠল,
–হ্যা। চুড়িগুলো আমাকে দিন।
পল্লব দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল,
–কিন্তু আমি চুড়িগুলো তোমাকে দিব না।
অনু বিরক্তিকর দৃষ্টিতে পল্লবের দিকে তাকাল। অনুর মন খারাপ হয়ে গেল। পল্লব অনুর মন খারাপ দেখে শান্ত স্বরে বলল,
–এই চুড়িগুলো তোমাকে দিতে পারি তবে আমার একটা শর্ত আছে।
অনু পল্লবকে সন্দেহী স্বরে জিজ্ঞেস করল,
–কি শর্ত?
–তোমাকে আমার ভালো বন্ধু হতে হবে। কি রাজি?
অনু অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল,
–আমার কোনো বন্ধুুর প্রয়োজন নেই। আমার চুড়িগুলো লাগবে না।
অনু শপিংমল থেকে বেরিয়ে গেল। পল্লব চুড়িগুলো তাড়াতাড়ি করে কিনে নিয়ে এসে অনুর পাশে পাশে হাঁটতে লাগল। অনু আরও তাড়াতাড়ি করে হাঁটতে লাগল। পল্লব এবার দাঁড়িয়ে পড়ল। মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে থেকে পল্লব অনুকে বলল,
–তুমি আমাকে এভাবে ভয় পাচ্ছো! আমি কিন্তু কোনো গুন্ডা নই।
অনু হাঁটতে হাঁটতেও পল্লবের কথায় থেমে গেল। পেছন ফিরে একটু মুচকি হেসে অনু পল্লবকে বলল,
–আমি জানি আপনি গুন্ডা নন।
আজ প্রথম পল্লব অনুর মুখে সুন্দর মুচকি হাসি দেখতে পেল। এর আগে অনু হাসলেও পল্লব বুঝতে পারত অনু মন থেকে হাসছে না।পল্লবের মন খারাপ চলে গিয়ে মুখে হাসি ফুটে উঠল।
চলবে…