তোমাতেই পূর্ণ আমি #পর্ব-১

0
1749

#তোমাতেই পূর্ণ আমি
#পর্ব-১
#লেখিকাঃআসরিফা সুলতানা

বিধবা মেয়েদের আবার সাজসজ্জা লাগে নাকি?–কথাটা কানে ভেসে আসতেই ঠোঁট দুটো প্রসারিত হয়ে এলো আমার।পাশ থেকেই আমার বেস্টু প্রিয়ু তেড়ে গেল মেয়েটার দিকে।প্রিয়ু মেয়েটা আমার বেস্ট ফ্রেন্ড বললে ভুল হবে।ও আমার বোনের মত।কেউ আমাকে খারাপ কটুক্তি করলে একদম সহ্য করতে পারে না মেয়েটা।এখন নিশ্চয়ই আমার জন্য ওই মেয়েটার সাথে লড়াই করবে প্রিয়ু।

আমি শ্রেয়সী।অদ্ভুত না নামটা?আম্মু রেখেছিলেন।সবাই নামটা সঠিকভাবে উচ্চারণ করতে পারত না বলে শ্রেয়া বলেই ডাকত।তখন থেকেই প্রতিটা মানুষ শ্রেয়া বলেই ডাকে।আমি অনার্স প্রথম বর্ষে পড়ি ।১৮ বছরেই বিবাহ নামক বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানেই জীবনে লেগে গিয়েছে বিধবার ট্যাগ। তখন থেকেই নিজেকে বিধবা হিসেবেই চিনি আর সমাজের মানুষ ও।স্বামী মারা যাওয়ার পর শশুর বাড়িতে ঠাই হয় নি আমার।বরের ভাই-ভাবীরা বের করে দিয়েছেন আমাকে।বৃদ্ধা শাশুড়ী পেরে ওঠেন নি তাদের সাথে।স্বামী হারা হয়ে যখন বাবার বাড়ির দরজায় দাড়িয়েছি সৎ মা জায়গা দেয় নি বাড়িতে।কারণ, বিধবা মেয়ে ঘরে রাখলে নাকি ছোট মেয়েকে বিয়ে দিতে পারবেন না।সেখানেও জায়গা হয় নি আমার।কি অদ্ভুত না জীবনটা?বিধবা কি আমি শখ করে হয়েছি?কোনে মেয়ে কি বিধবা হয়ে থাকতে চায়?কেন আমায় বিধবা,অপয়া বলে আখ্যায়িত করা হয়?বিয়ের কয়েক মাসেই স্বামী মারা যাওয়ার পিছনে আমার হাত ছিল?তবুও সমাজের দৃষ্টিতে আমি অপয়া।কিছুক্ষণ আগে প্রিয়ু আমাকে নবীন বরণে শাড়ি পড়ার কথা বলছিল তখনই ফিহা আমাকে সেই কথাটা বলে উঠল।সত্যিই তো বিধবাদের আবার কিসের সাজসজ্জা!!

ঠান্ডা আবহাওয়া। বৃষ্টির শেষ হবার পর শীতল এই আবহাওয়া খুব পছন্দ আমার।কারো সাথে অহেতুক তর্কে জড়াতে ভালো লাগে না ।আমি যা মানুষ তো তাই বলবে।প্রিয়ুর হাতটা টেনে ক্লাসরুম থেকে বের হয়ে এলাম আমি।এই মুহূর্তে ভীষণ ইচ্ছে করছে আমার বৃষ্টিশেষে শীতলতম আবহাওয়া টা উপভোগ করতে।এটাতে তো আর কারো বাঁধা থাকবে না।বাহিরে আসতেই আমার হাত টা ছাড়িয়ে ফুঁসে উঠল প্রিয়ু।মেয়েটা ভীষণ কিউট। একটু গুলুমুলু। গায়ের রং ফর্সা। গাল ফুলিয়ে যখন তাকায় আরো কিউট লাগে মেয়েটা কে।যেই ছেলে এই কিউট মেয়েটার স্বামী হবে নিঃসন্দেহে সে অনেক লাকি হবে।হালকা হেসে প্রিয়ুর গালটা টেনে দিলাম আমি।
—এই লুকে তোকে ভীষণ কিউট লাগছে প্রিয়ু বেবী।

—তুই এমন কেন শ্রেয়া?একটু প্রতিবাদ ও কি তুই করতে পারতি না?সবক্ষেত্রেই তো অনেক প্রতিবাদী হয়ে উঠিস তবে এই ক্ষেত্রে কেন ভেজা বেড়াল হয়ে যাস?(গাল ফুলিয়ে)

—যা সত্য তাই তো বলবে প্রিয়ু।সত্য তো এটাই আমি বিধবা।এতে কাউকে জবাব দেওয়ার কি আছে বল?

—তুই বিধবা।কিন্তু তাই বলে এই না যে জীবনে এগিয়ে যাওয়া যায় না।আর তোর শরীরে কি কোথাও লিখা আছে তুই বিধবা?নেই তো।আর এটাও কোথাও লিখা নেই যে তুই সাজতে পারবি না অথবা জীবনে এগিয়ে যেতে পারবি না।

—বাদ দে প্রিয়ু।এইটা নিয়ে এতো বাড়াবাড়ির প্রয়োজন নেই দোস্ত।

—অবশ্যই আছে।তোর পুরোটা জীবন পড়ে আছে শ্রেয়া।সৎ মায়ের কারণে কম বয়সে বিয়ে নামক বন্ধনে জরিয়েছিস। তোর স্বামী মারা গিয়েছে এতে ও তোর হাত নেই। বরং এমন স্বামী মরে গিয়েছে তাতেই ভালো হয়েছে।

প্রিয়ুর কথায় ধমকে উঠলাম আমি।

—এমনটা বলতে পারিস না তুই প্রিয়ু।ওনি যেমনই ছিলেন আমার স্বামী ছিলেন।

—ঠিক আছে বললাম না।কিন্তু তুই এখন কারো বউ না।আর তোকে কেউ বিধবা,,অপয়া এসব বলার অধিকার ও নেই। তুই শুধু শ্রেয়সী।

প্রিয়ুর কথায় হাসলাম আমি।

–ঠিক আছে। কারোই অধিকার নেই। আর কেউ যদি বলেই তবে আমার প্রিয়ু তো আছেই তাকে শাসানোর জন্য।

আমার কথায় হেসে দিল প্রিয়ু।আমার হাতটা ধরে বলল,,

—জীবনে সবসময় হাসি খুশি থাকবি দোস্ত। তোর হাসি টা ভীষণ সুন্দর। এতো সুন্দর কেন তুই?

–হয়েছে আর মাখন লাগাতে হবে না ম্যাম।সেই সকালে টিউশন করে বেরিয়েছি এখনো পেটে কিছু পড়ে নি।

–ওমা সেকি!!চল ক্যান্টিনে যাই।

—না।তুই তো জানিস ক্যান্টিনে বসে খেতে ভালো লাগে না আমার।

—ঠিক আছে এখানে অপেক্ষা কর।এখুনি আসছি আমি।

–ঠিক আছে।


প্রিয়ু যেতেই এক সাইডে দাঁড়িয়ে পরলাম আমি।বৃষ্টি হবার কারণে কাঁদা জমে আছে।মাথার ঘোমটা আরেকটু টেনে দিলাম।হঠাৎ-ই একটা গাড়ি প্রচন্ড বেগে গেল আর কাঁদা এসে ছিটকে পড়ল শ্রেয়ার গায়ে।সাদা থ্রি পিছ টা কাদায় মাখা মাখা।মেজাজ গরম হয়ে গেল আমার।ক্যাম্পাসে এমনভাবে গাড়ি চালানোর সাহস কার আছে?কতটা বেয়াদব হলে এমন একটা কাজ করতে পারে।গাড়িটার দিকে এগিয়ে গেল শ্রেয়া।

গাড়ি দরজা খুলে বের হয়ে এলো একটা ছেলে।সাদা শার্ট,হালকা চাপ দাঁড়ি,চোখে সানগ্লাস, ফর্সা চেহারার সুদর্শন ছেলেটাকে দেখে এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলাম।চেহারা দেখে মনেই হয় না ছেলেটা এমন বেয়াদব হতে পারে। তার পাশাপাশি গাড়ি থেকে বের হয়ে আসল আরো তিনটা ছেলে ।ছেলেটার দিকে এগিয়ে গেলাম আমি।অবশ্যই তাকে বলা উচিত তার এতো স্পিডে গাড়ি চালানো অন্যের জন্য কতটা ক্ষতিকর।শ্রেয়া কে দেখে হেসে উঠল সাথের ছেলেগুলো।হাসার কারণ হল শ্রেয়ার গায়ে কাঁদার মাখামাখি।

শয়তান পোলাপান আমার গায়ে কাঁদা ছিটকে এখন হাসা হচ্ছে তাই না?ছেলেটার দিকে আঙুল তুলে বলে উঠলাম,,

—এই যে মিস্টার,,গাড়ি ঠিকভাবে চালাতে পারেন না?দেখুন কি অবস্থা করেছেন আমার।ড্রেস টা নষ্ট করে দিয়েছেন।

শ্রেয়ার কথায় ভ্রু কুঁচকে তাকাল ছেলেটা।আঙুল তুলতে দেখে পাশ থেকে ফুহাদ বলে উঠল—এই মেয়ে তোমার সাহস তো কম না।তুর্যর দিকে আঙুল তুলে কথা বল কোন সাহসে?নিশ্চই ফ্রেশার তুমি।তুমি জানো তোমার সিনিয়র হয় আমরা।

প্রিয়ু দৌড়ে এসে আমার হাত চেপে ধরে ইশারা করল কিছু না বলতে।ওকে তোয়াক্কা না করে বললাম,,

–সিনিয়র হয়ে এতো বেয়াদব আপনারা? তবে আমরা জুনিয়র রা কি শিখব?

শ্রেয়ার কথায় রেগে গেল তুর্য।পকেট থেকে কিছু টাকা বের করে ছুরে মারল শ্রেয়ার মুখে।

–ইউউ পুর গার্ল।টাকা গুলো নাও আরেকটা ড্রেস কিনে নিও।অবশ্যই তোমার ড্রেসটার দাম এক হাজারের বেশি হবে না।তার চেয়েও বেশি দিলাম ভালো একটা ড্রেস কিনে নিও।(রাগী কন্ঠে)

তুর্যর কথা শুনে হেসে উঠল সবাই।অপমানে গা রি রি করে উঠল আমার।এমন বেয়াদব মানুষ আমি কখনো দেখি নি।চেহারা সুন্দর হলে কি হবে অথচ তার মনটা কত নিকৃষ্ট!খুব টাকার দাপট তাই না!আশেপাশে তাকিয়ে একটা ইটের টুকরো তুলে নিলাম আমি।তুর্য বন্ধুদের নিয়ে সামনের দিকে চলে যাচ্ছিল তখনি কোনো কিছু ভাঙার শব্দে পিছন ফিরে তাকাল সবাই।চোখ দুটো লাল হয়ে গেল তুর্যর।শ্রেয়া তুর্যর গাড়ির সামনের অংশের কাচ ভেঙে দিয়েছে।ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাড়িয়ে আছে প্রিয়ু।তুর্য চৌধুরীর সাথে পাঙা নিয়েছে তার প্রাণ প্রিয় বান্ধবী।

—ইডিয়ট গার্ল।তোমার সাহস কি করে হল আমার গাড়ি নষ্ট করার?তুমি জানো এটা কত এক্সপেন্সিভ। (রেগে)

টাকাগুলো কুড়িয়ে হাতে নিলাম আমি।ওনার মুখের উপর ছুঁড়ে দিয়ে বললাম,,,

—আপনার টাকাগুলো আপনাকে ভিক্ষা দিয়ে গেলাম। গাড়িটা ঠিক করে নিয়েন।প্লিজ টাকা গুলো কুড়িয়ে নেন তুর্য ভাইয়া।কাজে লাগবে গাড়ি ঠিক করতে।

আমার কথায় মুখটা রাগে রক্তিম বর্ণ ধারণ করল তুর্যর।সিনিয়র হয়েছে বলে কি হয়েছে এমন নিকৃষ্ট আচরণ করবে নাকি।

কথাটা বলে প্রিয়ুর হাত ধরে ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে এলাম আমি।ভাগ্যে যা আছে পরে দেখা যাবে।

অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সবাই।কে এই মেয়ে?সাহস তার অনেক। নিজের সিনিয়র এর সাথে এমন ব্যবহার করতে একটু ও ভয় লাগল না তার।যে সে হলে মানা যেত কিন্তু ভার্সিটির টপ বয়ের সাথে এমন বিহেভ কেউই মেনে নিতে পারছে না।আর তুর্য কেমন সবাই জানে?অতিরিক্ত রাগী ও বদমেজাজী সে।সবচেয়ে বড় কথা এই ক্যাম্পাসের ছাত্রদের লিডার সে।না জানি কত খারাপ দুর্দশা হবে মেয়েটার ভাবতেই সবার শরীর শিউরে ওঠছে।তুর্যর বেস্ট ফ্রেন্ড আয়ুশ কাছে এসে কিছু বলার আগেই হাত দিয়ে বাঁধা দিল তুর্য।বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে গেল ক্যান্টিনের দিকে।তার পিছু পিছু বাকি সবাই চলে গেল।


ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়েই আমার হাত টেনে ধরল প্রিয়ু।চোখে মুখে তার আতঙ্ক।

—এইটা তুই কি করেছিস শ্রেয়া?কি দরকার ছিল এসব করার?তুই জানিস ওনি কে?

—জানার প্রয়োজন নেই আমার।দেখেছিস না কত নিকৃষ্ট আর বেয়াদব ওনি?

–তবুও,,

–তবুও কিছু না প্রিয়ু। টিউশনিতে যেতে হবে আমার।এগুলোই আমার জীবনের শেষ ভরসা যতদিন না জব পাই।তা তুই ভালো করে জানিস।একটু ও লেট করা যাবে না।

কথাটা বলে একটা রিকসা ডেকে উঠে পড়লাম আমি।স্টুডেন্ট এর বাসার সামনে এসেই ভাড়া মিটিয়ে দিলাম আমি।বাসায় প্রবেশ করতেই আন্টি আমায় বসালেন।অনেকক্ষণ বসে রইলাম কিন্তু নিশা আমার স্টুডেন্ট আসার নাম নেই। কিছুক্ষণ পর আন্টি গত মাসের টাকা টা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন নিশা আর পড়বে না শ্রেয়া।আন্টির কথা টা শুনে মনে হল আকাশ টা ভেঙে পড়ল আমার মাথায়।আরেকটা টিউশনি কোথায় খুজব আমি?কিভাবে চলব?বাসা ভাড়া কিভাবে দিব?ভেবেই কান্না পাচ্ছে আমার।বিনয়ের স্বরে বলে উঠলাম,,

–কেন আন্টি?নিশার কোনো প্রবলেম হয়েছে?

আন্টি মাথা টা নিচু করে বললেন,,

–না।নিশা অন্য কারো কাছে পড়বে।আসলে আমার শাশুড়ী তোমায় পছন্দ করেন না। তিনি চান না তুমি এই বাসায় আসো।তার মনে হয় তুমি অপয়া…

আন্টির কথা শেষ করার আগেই বের হয়ে এলাম আমি।রাস্তার ধারে বসে কান্নায় ভেঙে পড়লাম।আর কতো সহ্য করব এমন জীবন!!

দূর থেকে একজন চেয়ে রইল শ্রেয়ার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে। আবার কখনো কখনো ভ্রু কুঁচকাচ্ছে মানুষটা।হয়তো বুঝতে চাইছে শ্রেয়ার কান্নার কারণ…

চলবে,,,

(ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here