তোমাতেই পূর্ণ আমি #পর্ব -১৫,১৬

0
717

#তোমাতেই পূর্ণ আমি
#পর্ব -১৫,১৬
#লেখিকাঃআসরিফা সুলতানা জেবা
১৫

“~তোমার চক্ষুতে ধরা দেওয়ার সময় এখনো হয়নি শুভ্রময়ী কন্যা। জানি আমাকে দেখার আকাঙ্খা তোমার আকাশ সমান কিন্তু এতো জলদি যে আমি বন্দি হতে চাই না তোমার আঁখিদ্বয়ে। আমি তোমার প্রেমে মত্ত হতে চাই ঠিক এমন ভাবেই যেন না ছুঁয়ে ও আগলে রাখতে পারি তোমায় হৃদয়ের গহীনতায়। ছিলে তো আট মাস না দেখে আমায়। তবে এতো বিচলিত হচ্ছো কেন এখন? ঠিক সময়ে আমি ধরা দিব তোমার সামনে। হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে নিব আমার এই শূন্য বুকে। ততক্ষণ পর্যন্ত আমি তোমার মনে চিরকুট লেখক হয়ে বিচরণ করতে চাই প্রতিটি মুহুর্ত জুড়ে।

চিরকুট টা পড়ে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল। যতই দূরত্ব থাকুক অতীতের এই স্মৃতি গুলো ভীষণ প্রিয় আমার। চিরকুট গুলো পড়লে শত কষ্টের মাঝে ও শান্তি খুঁজে পায় আমি। রাতের আঁধারে মোমবাতির হালকা আলোয় চিকুটের লিখাগুলোর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম আমি। আজ কতো বড় মিথ্যা টা বললাম আমি। যার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনেছি তাকেই আজ ফিরিয়ে দিয়েছি কষ্ট দিয়ে।

অতীত~

সাদা শুভ্র ওড়না দিয়ে মাথায় ঘোমটা টেনে বেড়িয়ে পড়লাম কলেজের উদ্দেশ্যে। লজ্জা ঘিরে ধরছে আমায় চারদিক থেকে। নিশ্চয়ই মানুষ টা আজও আসবেন। আড়াল থেকে আমায় দেখে রঙিন এক চিরকুট দারোয়ান চাচার হাতে ধরিয়ে দিয়ে যাবেন। আচ্ছা আজ চিরকুটে কি লিখবেন ওনি? আমায় ঘোমটা তে কেমন লাগছে সেটা জানাবেন? অচেনা সেই মানুষটার জন্য মনের মাঝে তীব্রভাবে বেড়ে উঠা অনুভূতি গুলো কিভাবে লুকিয়ে রাখব আমি? ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগলাম। আড়চোখে চারদিকে তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে ঢুকে পড়লাম কলেজে। ক্লাসে ঢুকতেই প্রিয়ু দুষ্ট হেসে বলে উঠল,,,

—বাহ্! শুভ্রপরী কে তো নজর কাড়া সুন্দরী লাগছে। মন চাইছে একদম লুকিয়ে ফেলি শুভ্রপরী টা কে। শুভ্রপরীর চিরকুট লেখক কি তার শুভ্রপরী কে দেখেছে? যদি দেখে থাকে তাহলে হয়তো বেচারা হার্ট এট্যাক করেছে।তার শুভ্রপরী যে এখন ছেলেদের হৃদপিণ্ডে ছুড়ি বসানোর রূপ ধারণ করেছে।

—হুঁশশ প্রিয়ু। কেউ শুনলে শরমে মাথা কাটা যাবে আমার। এতো সুন্দর লাগছে না আমাকে। নিজেকে তো বিধবা বিধবা লাগছে সাদা রঙে।—রসাত্মক কন্ঠে বললাম।

হাস্যকর মুখটা মলিন হয়ে এল প্রিয়ুর। রাগ দেখিয়ে বলে উঠল,,,

—–এসব কেমন কথা শ্রেয়া? সাদা পড়লেই কি মানুষ কে বিধবা লাগে নাকি? এসব অলক্ষুণে কথা কিভাবে বলিস তুই? তোর মতো একটা বুঝের মেয়ের মুখে এটা খুবই বেমানান। মজার ছলে ও কখনও এমন কিছু বলবি না।

—ওকে প্রিয়ু বেবি। আমি তো মজাই করছিলাম। শুভ্রতাই আমায় এতোই সুন্দর লাগে বল?আমার কাছে নিজেকে আশি বছরের ভুড়ি মনে হচ্ছে।

বলেই হেসে দিলাম আমি। প্রিয়ু ফিক করে হেসে দিল আমার সাথে। স্যার আসতেই ক্লাসে মনোযোগ দিলাম দুজন।কলেজ ছুটি শেষে মনে একরাশ লজ্জা নিয়ে দারোয়ান চাচার সামনে দাড়াতেই তিনি বললেন,,,

—-আজ চিরকুট আহে নাই। সাহেব রে ও দেহি নাই আজ।

চাচার কথা শুনে মনটা হু হু করে কেদে উঠল আমার। তার মানে কি আজ ওনি আসেন নি? নাকি আমায় ঘোমটাতে ভালো লাগছিল না বলে কোনো চিরকুট লিখেন নি? এক ফালি কষ্ট এসে ভর করল আমার ছোট্ট মনে। নীরবতা বজায় রেখে চলে এলাম বাসায়। একটু ও শান্তি লাগছে না কেন আজ চিরকুট দেন নি ওনি? আমার যে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। সারারাত এক হয় নি দুচোখের পাতা। মনের ভিতর সবকিছু কেমন শূন্য শূন্য লাগছে। ফজরের নামাজ পড়ে বের হয়ে এলাম রুম থেকে। তুমুল বেগে বর্ষণ হয়েছে সারা রাত ধরে। বর্ষণ হয়েছে আমার মনের মাঝে ও। হিম বাতাস বয়ে বেড়াচ্ছে চারদিকে। চার রুম বিশিষ্ট ছোট একটা বাড়ি আমাদের। এই ছোট বাড়িটা কেই আম্মু সাজিয়েছিল তার মন মতো। কিন্তু ক্যান্সার নামক ব্যাধি কেঁড়ে নিয়েছিল আমার মায়ের জীবনটা সেই সাথে আমার জীবনের সুখ গুলো। বৃষ্টি হয়েছে বিধায় ফুল গাছ গুলোতে আজ আর পানি দেওয়ার প্রয়োজন নেই। কয়েকটা মাত্র ফুলের চারা। বাগান করতে ভালোবাসলে ও সাধ্য নেই আমার । কিছু টাকা জমিয়ে মায়ের কাছ থেকে লুকিয়ে এই ফুলের চারাগুলো কিনেছি আমি। জানতে পেরেই খুব মেরেছিলেন আমায়। পুরো চারদিন জ্বরে ভুগেছি আমি। কিন্তু এক নলা ভাত মুখে তুলে দেওয়ার মতো কেউই ছিল না। ফুল গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে একটা সুদীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম । মনটা কেমন অশান্ত হয়ে আছে। সারারাত ঘুমায় নি অথচ ঘুমের ছিটেফোঁটা ও নেই দু’চোখে। নিদ্রা যে আজ আমায় কোনোভাবেই ধরা দিবে না তা বুঝে গেছি। আমি যে এক ভয়ংকর রোগে আক্রান্ত হয়েছি। যা আমার মনে বিস্তার করে চলেছে গভীরভাবে। অচেনা লোকটার প্রতি আমি ভয়ংকরভাবে প্রণয়ে আবদ্ধ হয়েছি। ভালোবেসে ফেলেছি তাকে। অথচ আমায় প্রণয়ে ফেলে অবলীলায় গায়েব হয়ে গিয়েছেন তিনি।

তিনদিন ধরে কোনো চিরকুট আসে না আমার নামে। হতাশ হয়েই ফিরতে হয় প্রতিটা দিন। ঘন্টাখানেক দাঁড়িয়ে থেকে ও দেখা পায় না মানুষটার। আর দেখলেও তাকে চিনার উপায় নেই আমার। হঠাৎ করেই হারিয়ে গেলেন মানুষটা। সাথে হারিয়ে গেল তার চিরকুটে নিবদ্ধ ভালোবাসা টা। আচ্ছা ওনি কি আর কখনও আমায় ভালোবাসা নিবেদন করবেন না ওনার চিরকুটের মধুময় বাক্যে? ভেবেই গেইটের কাছে আসতেই এক প্রকার দৌড়ে এসে আমার হাতে একটা চিরকুট ধরিয়ে দিলেন দারোয়ান চাচা। খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়লাম আমি। কোনো দিকে না তাকিয়ে ছুটে এলাম স্কুলের পিছন দিকটায়। দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বুঁজে রইলাম কিছু সময়।

” ভীষণ ব্যস্ত ছিলাম শুভ্রপরী। এতোদিন আসার একটু ও সুযোগ হয় নি। তবে সেদিন তোমার শুভ্রতায় ঘেরা স্নিগ্ধময় চেহারা দেখেছিলাম আমি। পুরো আধাঘন্টা বুকের বা পাশে হাত দিয়ে তোমার পানে চেয়েছিলাম বিভোর হয়ে ।যখন তুমি আঁড়চোখে তাকিয়ে আমাকে খুঁজতে ব্যস্ত ছিলে তখন আমি মগ্ন ছিলাম তোমাতেই। ”

চিরকুটে ঠোঁটের ছোঁয়া দিয়ে ব্যাগে পুরে নিলাম আমি। শূন্য মনটা ভরে উঠল আনন্দতায়। ভালোবাসা এসে প্রবলভাবে কড়া নাড়তে লাগল মনের দুয়ারে।


কেটে গেছে পুরো বারো মাস। কয়জন পারে এ যুগে এসে না দেখেই চিরকুটের আদান-প্রদানে গভীর এক ভালোবাসার স্রোতে ভেসে যেতে! আমি পেরেছি। না দেখে ও এক অচেনা চিরকুট লেখক কে জায়গা দিয়েছি হৃদয়ের গহীনে। আমি জানি ওনি কখনও আমায় ঠকাবেন না। চিরকুটে লিখা তার প্রত্যেক টা বাক্য সত্য এবং তা আমার নামেই উৎসর্গ। এই এক বছরে আমিও অনেক চিরকুট লিখেছি ওনার জন্য। আট মাসের মাথায় দেখার আবদার করেছি চিরকুটের মাধ্যমে কিন্তু ধরা দিতে রাজি নয় সে। বলেছেন ঠিক একসময় এসে দাড়াবেন আমার আঙিনায়। আজ চারপাশ টা নতুন নতুন লাগছে আমার কাছে। শীতল বাতাস এসে বার বার দোলা দিয়ে যাচ্ছে সারা দেহে । মানুষ টা কে এখনো বলা হয় নি আমার মনের কথা। প্রকাশ করা হয় নি জমিয়ে রাখা ভালোবাসা। আজও ব্যাতিক্রম হয়নি নিয়মের। চিরকুট নিয়ে পা বাড়ালাম ক্লাসের দিকে।প্রিয়ু এসে পাশে বসল।

—দোস্ত আজ কিন্তু তোদের চিরকুট প্রেম বার্ষিকী। আজ চিরকুটে কি লিখা আছে আমাকে পড়ে শোনাতেই হবে।নইলে কিন্তু তোর পিছু ছাড়ছি না আমি।হুহ্!!

কি বলে এই মেয়ে! আমি তো লজ্জায় মরে যাবো এই মেয়েকে চিরকুট পড়ে শোনালে।

—তুই নিজে পড়ে নে।—চিরকুট টা ওর হাতে দিয়ে বললাম।

—না না। আমার শরম লাগে।পরের জিনিসে আমি হাত বাড়ায় না বাবু।

—আহারে সাধু মাইয়া একখান।

চিরকুটের ভাজ খুলতেই মনটা একদম জুড়িয়ে গেল আমার।

~ “বারো টা মাস।৩৬৫ দিন। ৩৬৫ দিন ধরে আমার মাঝে বিচরণ করছো তুমি। নিজেকে পাগল পাগল মনে হয় আমার কাছে। তোমায় এক নজর না দেখলে না পারি পড়ায় মন বসাতে না পারি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে। তোমার জন্য দিনকে দিন ব্যাকুল হয়ে উঠছে আমার বেহায়া মনটা। যদি একবার দেখা দেয় তবে নিজেকে ধরে রাখা দায় হয়ে পড়বে আমার কাছে। কিন্তু আমি যে এখন একটু ও ছুঁয়ে দেখতে চায় না তোমাকে। তোমার ফাইনাল এক্সাম শেষ হলেই অবসান ঘটবে আমাদের চিরকুট প্রেমের। শুভ্রতায় মুড়িয়ে নিজের অর্ধাঙ্গিনী বানিয়ে বুকের পাঁজরে বন্দি করব তোমায়। ভালোবাসি শুভ্রপরী!”

ভালোবাসি শব্দটা শুনে দুরু দুরু বুকটা ধুক করে উঠল খুব জোরে। প্রথমবার,,,প্রথমবার পুরো একবছর পর ওনি ভালোবাসি বলেছেন আমায়। মন হচ্ছে এই মুহূর্তেই জ্ঞান হারাব আমি।

ফোনের শব্দে সম্মিত ফিরে এলো আমার। এতো রাতে কার ফোন হতে পারে? ঘড়ির কাটায় ১ টা ছুঁই ছুঁই। স্মৃতির পাতায় এতোই মগ্ন ছিলাম যে সময়ের ও খেয়াল নেই। কল টা ধরার আগেই কেটে গেল। স্ক্রিনে তাকাতেই পরিচিত নাম্বার টা দেখে কলিজা মোচড় দিয়ে উঠল আমার। ওনার নাম্বার আমি জানলে ও ওনি কিভাবে পেলেন আমার নাম্বার? আগে তো মোবাইল ছিল না আমার। ফোনটা শাশুড়ী মা কিনে দিয়েছেন বিয়ের পর। হয়তো প্রিয়ু বা অন্য কারো কাছ থেকে নিয়েছেন। দ্বিতীয় বার কল বাজতেই তাড়াতাড়ি করে রিসিভ করে নিলাম আমি।কানে দিতেই বুকের বা পাশ টা কম্পিত হতে লাগল প্রচন্ড গতিতে। নেশাগ্রস্ত কন্ঠ ওনার।আচ্ছা ওনি কি ড্রিংক করেছেন!

—-শুভ্রপরী,,,,,,,,,,,,

কম্পনরত কন্ঠে জবাব দিলাম,,,

—-জ্বি।

—- আমি তোমায় ভীষণ ভালোবাসি শ্রেয়সী। দেখে যাও না তোমার সকালের কথাগুলো কেমন রক্ত ঝরাচ্ছে আমার বুকে। আমি জানি তুমি আমায় ভালোবাসো। খুব ভালোবাসো। ভালো না বাসলে ও বাসতে হবে। তুমি তো প্রথম থেকেই আমার ছিলে তাই না?এই শুভ্রময়ী কন্যা কথা বলবি না?বল তুই সবসময় আমারই ছিলি তাই না? তাহলে তুই কেন আভাসের হলি? কেন আমার অধিকার তুই অন্য কাউকে দিলি? কিভাবে হতে পারলি তুই এতো বড় বেইমান? তার জন্যই বুঝি এতো কষ্ট করে আগলে রেখেছিলাম তোকে? ধোকা দিলি আমাকে। ভালোই যদি না বাসিস তবে তোর পায়ে কেন আমার দেওয়া পায়েল টা? সময় আমার পক্ষে ছিল না নয়তো তোকে মেরে ফেলতাম তবুও অন্য কারো হতে দিতাম না। এখন তুই শুধু আমার। শুভ্রপরী শুধু তূর্যর। আমি তোকে ছুঁয়ে দেখব,,কিস করব,ভালোবাসবো,,বুকের মাঝে মিশিয়ে রাখব,,,,,,

শেষের বাক্যটা শুনে কান গরম হয়ে এলো আমার। ওনার নেশাগ্রস্ত কন্ঠ নেশা ধরিয়ে দিচ্ছে আমার মাঝে ও। সেই সাথে বুকের মাঝখানটায় এসে বিঁধছে ওনার বলা বেইমান শব্দটা। বেইমানি তো আমি করি নি। উনিই তো আসেন নি সেদিন। কিছু বলতে নিব তার আগেই কেউ বলে উঠল,,,

—হ্যালো জেরি আমি আয়ুশ। তূর্য এই প্রথম ড্রিংকস করেছে তো তাই একটু আবোল তাবোল বকছে। প্লিজ কিছু মনে করবে না তুমি।যেই ছেলেটা নিজের পঁচিশ বছরের জীবনে কখনও মদ ছুঁয়ে ও দেখে নি সে আজ এক ঘন্টা ধরে গিলেই যাচ্ছে। আমি জানিনা কি কারণে তূর্য আজ এমন করছে তবে এতটুকুই বলব আমি তোমায় না পেয়ে নিশ্বাস নিতে পারলে ও তূর্য এক মুহুর্ত ও বাঁচবে না তোমাকে ছাড়া।

আয়ুশ ভাইয়ার কথায় কি জবাব দিব জানা নেই আমার। মৃদু কন্ঠে বললাম,,-

—আপনি প্লিজ ওনার খেয়াল রাখবেন ভাইয়া।

বলেই কল কেটে দিয়ে শুয়ে পড়লাম বালিশে মুখ গুঁজে। আবারো একটা রাত কেটে যাবে নিদ্রাহীন, কান্নায়।
—————————————-

আজ ভার্সিটি যাবো না। সকালের দুটো টিউশনি শেষ করে সোজা বাসায় ফিরব। শুধু আজ না কয়েকদিনই যাবো না ভার্সিটিতে । প্রিয়ুর থেকে নোটস এনে পড়া কমপ্লিট করে ফেলব।যেভাবে হোক নিজেকে তূর্য ভাইয়ার কাছ থেকে দূরে রাখতে হবে। দুটো টিউশনি করে বের হতে হতে প্রায় নয়টা বেজে গেল।যাক সমস্যা নেই।আজ তো সারাদিন আমি একদম ফ্রী। আর সন্ধ্যার দিকে তিতিশা কে পড়াতে যাবো। বাসার কাছে আসতেই আমার চোখ চড়কগাছ। রাতের বেলা মাতলামো করে এই লোক সকাল সকাল আমার বাসার সামনে কি করছেন?আমি ভুল দেখছি নাতো?যার হাত থেকে বাঁচার জন্য ভার্সিটি যাবো না সিদ্ধান্ত নিলাম সেই হাজির আমার সামনে। সাদা টি শার্ট কালো জ্যাকেট পড়ে হিরো সেজে গাড়িতে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছেন তূর্য সাহেব। চাচার ভাষায় যাকে বলে –আহা কি সুন্দর একখান পোলা দেহার লাহান! তাড়াতাড়ি করে পাশের হিজল গাছটার পিছনে নিজেকে আড়াল করে নিলাম আমি। কাল কথাগুলো বলে যেভাবে পালিয়ে গেছি নাগাল পেলে আজ হয়তো কঠোর শাস্তি দিবেন। যা ভয়ংকর মানুষ ওনি। এসব ভাবতে ভাবতে সামনে তাকিয়ে অবাক আমি। কোথায় গেলেন ওনি? আরেকটু এগিয়ে দেখতে যাবো তখনি কেউ আচমকা কোলে তুলে নিল আমাকে। ভয়ে চিতকার দিতে নিলে আমার দিকে ঝুঁকে ঠোঁটে আলতো কামড় বসিয়ে দিলেন তূর্য ভাইয়া। ঠোঁটে হাত দিয়ে হতবাক হয়ে রইলাম আমি। গালে অধরের ছোঁয়া দিয়ে সরে গেলেন তূর্য । চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখলাম কেউ নেই রাস্তায়। কাঁপা কাঁপা হস্তে ওনার জ্যাকেটের অংশ খামচে ধরলাম খুব শক্ত করে। একটু উপরে তুলে নিজের সাথে আমায় মিশিয়ে নিলেন আরো গভীরভাবে।

চলবে,,,,

(ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

#তোমাতেই পূর্ণ আমি
#পর্ব-১৬
#লেখিকাঃআসরিফা সুলতানা জেবা

গাড়িতে বসিয়ে সিট বেল্ট বেঁধে দিল তূর্য ভাইয়া। মুখে তার ভয়ংকর এক মুচকি হাসি যা ঘায়েল করছে আমাকে তীব্র ভাবে। আসক্ত হয়ে পড়ছি আমি দিনকে দিন ওনার প্রতি। আমার এই আসক্তি যে খুবই ক্ষতিকর তূর্যর জন্য। গাড়ি স্টার্ট দিতেই কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে প্রশ্ন করলাম,,,,

—-কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?

—-কাজী অফিসে। —সামনের দিকে তাকিয়ে ভাবলেশহীন ভাবে জবাব দিলেন তূর্য।

ওনার জবাবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লাম আমি। কি বলছেন ওনি?অজানা ভয় এসে হানা দিল মনের মধ্যে। কম্পিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,,,

—কাজী অফিসে কেন যযাবো?

আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে সামনের দিকে মুখ রেখে গম্ভীর স্বরে বললেন,,,,

—কাজী অফিসে মানুষ কেন যায়?অবশ্যই বিয়ে করতে যায় তাই না?সো আমরাও এজন্যই যাচ্ছি শুভ্রপরী। ভাবলাম আর কতো দূরে থাকব তোমার থেকে! কাছে আনার ব্যাবস্থাই করি এবার।

তূর্য ভাইয়ার কথায় চমকে উঠলাম আমি। সারা শরীর জমে গেল আমার। বহু কষ্টে মিন মিনিয়ে বলে উঠলাম,,,

—ববববিয়ে মানে?

মুহুর্তেই গাড়ি জোরে ব্রেক কষল তূর্য ভাইয়া। রাস্তায় কারো উপস্থিতি নেই। দূরে একটা মাঠ দেখা যাচ্ছে। চারদিকে কেমন শুনশান নীরবতা। পাশ দিয়ে এক দুটো গাড়ির আনাগোনা । এতো নীরবতা কেন? তূর্য ভাইয়ার দিকে ফিরতেই দেখলাম ওনি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। ওনার এমন করে তাকানো ভীষণ অস্বস্তিে ফেলছে আমায়।গলা শুকিয়ে গেছে। ঢুক গিলে বললাম,,,

—কককি হয়েছে? এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?

আগের মতো দৃষ্টি বজায় রেখেই আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি যে একটা প্রশ্ন করেছি তাতে কোনো প্রকার রেসপন্স নেই তূর্যর। আমার দিকে ঝুঁকতেই ভয়ে সরে যেতে নিলে কোমড়ে দু হাত রেখে আমাকে নিজের একদম কাছে টেনে নিলেন ওনি। কোমড়ে ওনার শক্ত হাতের স্পর্শ পেতেই শরীর শিউরে উঠছে বার বার। হার্ট বিট বেড়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। আমার দিকে তাকিয়ে আছেন মোহনীয় দৃষ্টিতে। এই মোহতে যে পড়তে চাই না আমি। একটু নড়তেই কোমরে খামচে ধরলেন ওনি। সাথে সাথেই মৃদু আওয়াজে ব্যাথাতুর শব্দ করে উঠলাম আমি।
—আহ্হ্!!!

লাল আভা ছেয়ে আছে ওনার সারা মুখে। আচ্ছা ওনি কি রাগ করেছেন?কই আমি তো রাগার মতো কোনো কথাই বলি নি। চোখ দুটো ও কেমন লাল হয়ে আছে। এটা কি রাগের প্রভাব নাকি অন্য কিছু? বাঁকা হাসল তূর্য। তাচ্ছিল্য কন্ঠে বলে উঠল,,,,

—বিয়ে মানে কি জানো না?লাইক সিরিয়াসলি? বিয়ে নামক বন্ধনে চার টা মাস আবদ্ধ থেকে ও জানো না বিয়ের মানে!

কথাটা হৃদপিণ্ডে এসে বিধল সাথে সাথেই। আসলে ঐটা কি বিয়ে ছিল?বিয়ে এক পবিত্র বন্ধন। বিয়ের পর স্বামী স্ত্রীর সম্মিলিত ভালোবাসায় গড়ে ওঠে সুখের একটা সংসার। ভালোবাসা কি কখনও ছিল আমার সংসারে? সংসার তো কখনও গড়ে ওঠে নি। স্বামীর ভালোবাসা ও জুটে নি। কিন্তু বাসর রাতেই ধর্ষণের শিকার হয়েছি স্বামীর কাছে। বিয়ের পর থেকেই চার টা মাস অত্যাচার,,, মারের শিকার হয়েছি প্রতিটা মুহুর্তে । এক মুঠো ভালোবাসার বদলে পেয়েছি লাথি,উষ্টা। স্বামীর পরকীয়ায় প্রতিবাদ করায় হারাতে হয়েছে নিজের,,,,আর ভাবতে পারছি না আমি। চোখ জুড়ে বেরিয়ে এল জল। তূর্যর বুকে খামচে ধরে মাথা এলিয়ে কাঁদতে লাগলাম শব্দ করে।

শুভ্রপরীর কান্নার শব্দ কর্ণগোচর হতেই বিচলিত হয়ে পড়ল তূর্য। শক্ত করে জরিয়ে ধরল তার অন্তরে বাস করা শুভ্রপরী কে।বড্ড জেদ হচ্ছে নিজের ওপর। কেন অল্পতেই রেগে যায় সে। নিজের আরেকটু কাছে টেনে চুলের উপর দিয়ে ঠোটের স্পর্শ একে দিল অতি যত্ন করে।

ওনার ঠোঁটের ছোঁয়া পেতেই ডুকরে কেঁদে উঠলাম আমি।কান্না করতে করতে বলতে লাগলাম,,,

—আমি বিয়ে করব না চিরকুট লেখক। বিয়ে করব না আমি।প্লিজ আমায় যেতে দিন। বিয়ে করব না আমি।

শ্রেয়ার ছোট বাচ্চাদের মতো কান্নারচোটে বলা কথাগুলো শুনে তূর্যর মলিন মুখে হাসি ফুটে উঠল । গলায় রাগী ভাব এনে বলল,,,

— নাকে মুখে লাগিয়ে প্যান প্যান করে কোনো লাভ নেই শুভ্রপরী। বিয়ে তো তোমায় করতেই হবে জান।

তূর্য ভাইয়ার কথায় স্থির হয়ে গেলাম আমি। এই লোক কেন নিজের ভালো বুঝে না? বিয়ে আমি কখনও করব না। মরে গেলেও না। বুক থেকে মাথা তুলে সিটে হেলান দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে রইলাম আমি। একবার শুধু পালাতে পারলেই হলো। তূর্যর দিকে তাকাতেই ওনি পানির বোতল এগিয়ে দিলেন আমার দিকে। অসহায় চোখে চেয়ে পানির বোতল টা নিলাম । বাঁকা হাসল তূর্য।


গাড়ি এসে কাজী অফিসের দিকে থামতেই বুকটা ধুক করে উঠল আমার। ওনার হওয়ার ইচ্ছে থাকলেও আমি নিজের সার্থের জন্য ওনার জীবন নষ্ট করতে পারি না। পাশের দরজা খুলে কাঁপা কাঁপা পায়ে বেরিয়ে এলাম আমি। উৎকন্ঠিত মন নিয়ে ওনার পিছু পিছু ঢুকলাম কাজী অফিসে। চোখ থেকে এখনও অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। চোখ মুছে সামনে তাকাতেই আয়ুশ ভাইয়া, মিথি আপু, তিহান ভাইয়া,ফুহাদ ভাইয়ার চেহারা ভেসে উঠল। তার মানেই কি সত্যি সত্যিই আজ আমাদের বিয়ে? অজানা ভয়ে থরথর করে কাপতে লাগল আমার পা দুটো। আয়ুশ ভাইয়া এগিয়ে এসে তূর্যকে লক্ষ্য করে বললেন,,,

—তোরা এসে গেছিস?তোদের জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। কাজী সাহেব ও এসে গেছেন।

আমার দিকে তাকিয়ে আবারও বলে উঠলেন,,,

—আর ইউ ওকে জেরি? চোখ মুখ লাল হয়ে আছে কেন? তোমার কি শরীর খারাপ? ( চিন্তিত ভঙিতে)

আমি কিছু বলতে নিব তার আগেই তূর্য বলে উঠলেন,,,

—আরে জেরি আইসক্রিম খাওয়ার জন্য কান্না করছিল সারা রাস্তা। তেমন কিছু না চল ফুহাদ আর মিথির বিয়েটা সেড়ে নেয়। ওদের আর কতো অপেক্ষা করাবো বল!

তূর্য ভাইয়ার কথায় মনে হলো আকাশ ভেঙে পড়ল মাথায়। মিথি আপু আর ফুহাদ ভাইয়ার বিয়ে অথচ আমায় সারা রাস্তা চিন্তায় ফেলে দম বন্ধ করার উপক্রম। এখন খুব বেশি রাগ লাগছে ওনার উপর। আসলেই ওনি বেয়াদব। খুব বেশি বেয়াদব। বেয়াদব তূর্য চৌধুরী। রাগ ও তো দেখাতে পারি না ওনার সাথে। ওনার সামনে দাঁড়ালেই এখন নিজেকে বিড়াল আর ওনাকে বাঘ মনে হয়।জঙ্গলের সবচেয়ে হিংস্র বাঘ। আমায় কেন এখানে আনা হয়েছে বুঝতে পারছি না আমি। আয়ুশ ভাইয়ার সাথে যেতে নিলে আমার হাত টা চেপে ধরলেন তূর্য । তূর্য ভাইয়ার হাতের মুঠোয় থাকা আমার হাতের দিকে তাকিয়ে অমায়িক হাসি হাসলেন আয়ুশ ভাইয়া। হাসি বজায় রেখেই বললেন,,,

—– তূর্যর সাথে এসো।

কথাটা বলেই চলে গেলেন ওনি। কানের কাছে গরম উত্তাপ পেতেই হালকা নড়ে উঠলাম আমি। গরম এই উত্তপ্ত নিঃশ্বাস দহন রুপে বিচরণ হচ্ছে আমার মনে। শ্বাস আটকে আসছে। আবারও সেই চেনা অতি পরিচিত স্লো ভয়েস। আমার কানের কাছে মুখ এনে স্লো ভয়েসে বলে উঠলেন তূর্য ভাইয়া,,,

——– তূর্য চৌধুরী কখনও সাধারণ ভাবে তার শুভ্রপরী কে নিজের করে নিবে না। শুভ্রপরীর সম্মতিতেই নিজের মাঝে আলিঙ্গন করে নিবে তাকে। আমার শুভ্রপরী কখনও জোর করে কেড়ে নেওয়ার জিনিস না। আমার শুভ্রপরী এমন এক মায়াবিনী যাকে নিজের হৃদয়ে আগলে নিতে হবে ভালোবাসার চাঁদরে মুড়িয়ে। তবে সেই মায়াবিনী আমার হবে। দিন শেষে সে আমার বুকেই বাস করবে।


মিথি আপু ও ফুহাদ ভাইয়ার বিয়ে শেষে কাজী অফিস থেকে বেরিয়ে এলাম সবাই। ভয়ে মনে হচ্ছিল আমার শ্বাস আটকে মরে যাবো আমি। এতোক্ষণে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মুচকি হেঁসে মিথি আপু ও ফুহাদ ভাই কে জীবনের নতুন একটা অধ্যায়ের জন্য কংগ্রাচুলেশন জানালাম আমি। মিথি আপু এতিম বলে মেনে নিচ্ছিলেন না ফুহাদ ভাইয়ের পরিবার। তাদের একটাই কথা এতিম মেয়েকে বিয়ে করলে কপাল পুড়বে তাদের ছেলের। এমন কেন আমাদের সমাজ টা? এতিম,,বিধবা মেয়েরা বুঝি তাদের চোখের বিষ! অনেক মানুষ আছেন এতিম বলে একটু দরদ প্রকাশ করলেও নিজের ছেলেকে বিয়ে করাতে গেলেই দুর দুর করেন এতিম মেয়েদের কে। মিথি আপুর মামা উঠে পড়ে লেগেছিলেন বিয়ে দিতে আর ফুহাদ ভাইয়া ও ফ্যামিলি কে রাজি করাতে না পেরে শেষ পর্যন্ত এমন এক পরিস্থিতিতে এসে পৌঁছালেন। আমার খুব খুশি লাগছে এটা ভেবে যে খারাপ সময়ে ফুহাদ ভাইয়া পাশে ছিলেন মিথি আপুর। অথচ আমার বেলায়? ভিতর থেকে হতাশার এক দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে এল বুক চিরে। তূর্য ভাইয়াদের বনানীর ফ্ল্যাটে থাকবেন মিথি আপু ও ফুহাদ ভাইয়া পরিবার মেনে নেওয়া অবদি। একে একে চলে গেলেন সবাই। আমিও গিয়ে বসে পড়লাম তূর্য ভাইয়ার গাড়িতে। জানি তিড়িং বিরিং করে লাভ নেই ওনি ঠিকি ধরে ফেলবেন আমায়।
একটু অবাক হলেও হাসল তূর্য। ড্রাইভ করতে করতে আঁড়চোখে এক নজর তাকালো শ্রেয়ার দিকে।

আইসক্রিম পার্লারে বসে আছি আমি ও তূর্য ভাইয়া। ওনি আমাকে এখানে কেন নিয়ে আসলেন একদমই বুঝতে পারছি না। ওয়েটার ভ্যানিলা ফ্লেভারের আইসক্রিম দিয়ে যেতেই চোখ দুটো ছলছল করে উঠল আমার। ওনি এখনো মনে রেখেছেন চিরকুটের সেই কথা! মাথা তুলে অশ্রুসিক্ত আঁখিতে তাকাতেই ওনি ইশারা করলেন আমায় আইসক্রিম টা খেতে। মাথা দুপাশে নাড়ালাম আমি। অর্থাৎ খাবো না আমি। নিমিষেই ক্ষেপে উঠলেন তূর্য ভাইয়া। চোখ দুটো লাল হয়ে এলো তার। অগ্নি চোখে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,,,,

—কেন খাবি না? মনে নেই একবার ছেলেদের দেখিয়ে আইসক্রিম খেতে গিয়েছিলি তুই। তোর ঐ আশিক কি যেন নাম,, আকাশ। আকাশ জানোয়ার বাচ**** তোর হাতে ধরছিল আইসক্রিম পার্লারে। এই আইসক্রিম খেতেই তো আমার কথার অবাধ্য হয়েছিলি তুই। এখন যদি না খাস তাহলে তোকে এখানেই বরফের মতো জমিয়ে মেরে ফেলব আমি। খা বলছি!!!!!

তূর্যর ধমকে প্রচন্ড বেগে লাফিয়ে উঠল আমার ছোট্ট মনটা। আইসক্রিম হাতে নিয়ে খেতে লাগলাম ঝটপট। ভুলে গেলাম আশেপাশের সবকিছু। এখন আইসক্রিম খাওয়াটাই আমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। চোখে ভেসে উঠল পুরোনো এক স্মৃতি।

অতীত,,,,

ডিসেম্বর মাস। শীতের প্রহর। শীতে কাঁপা কাপি অবস্থা। কিন্তু প্রিয়ুর মাথায় ভুত চেপেছে এই শীতের মাঝে আইসক্রিম খাওয়ার। অনেক বুঝিয়ে ও লাভ হয়নি এই মেয়েকে। তার একটাই কথা আজ ভ্যানিলা আইসক্রিম না খেলে নাকি ও স্বস্তির নিঃশ্বাসই ফেলতে পারবে না। এই মেয়ের কথা শুনে পেট ফেটে হাসি আসছে আমার। বহুত কষ্টে আঁটকে রেখেছি কারণ স্যার অবস্থান করছেন ক্লাসে। ভ্যানিলা আইসক্রিম আমার ও প্রিয়ুর ফেবারিট। ম্যাডাম একা খেতে যেতেও রাজি নয়। কিন্তু আমার যে কলেজ ব্যাতিত কোথাও যাওয়া নিষেধ। চিরকুট লেখক স্পষ্ট অক্ষরে চিরকুটে লিখেছেন আমি যেন কলেজ আসা যাওয়া ছাড়া কোথাও না যায়।এখন এটা আমি প্রিয়ু কে কেমনে বুঝায়? ফিসফিস করে বলতেই মুখ ফুলিয়ে বলে উঠল প্রিয়ু,,,

—এখন বুঝি উনিই তোর সব তাই না? আমি তোর কেউ না? ওনার আগে আমি এসেছি তোর জীবনে?পারলি তুই শ্রেয়া?এভাবে পারলি আমায় পর করে দিতে?ঠিক আছে আমি খাবো না আইসক্রিম। আইসক্রিমের স্বপ্ন দেখতে দেখতে হারিয়ে যাবো অনেক দূরে।

প্রিয়ুর এহেন কথায় উচ্চ শব্দে হেসে উঠলাম আমি। টিচার চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই ভয়ে চুপসে গেলাম সাথে সাথেই। সবাই এমন ভাবে তাকালো যেন আমি কোনো জোকার। লজ্জায় চুপ হয়ে গেলাম একদম। প্রিয়ুর কানের কাছে মুখ নিয়ে নিচুস্বরে বললাম,,,,

—- ঠিক আছে যাবো প্রিয়ু বেবী। রাগ করিস না প্লিজ। শুধু দোয়া করিস এ কথা যেন কোনোভাবেই জানতে না পারেন ওনি।

আইসক্রিম পার্লারের সামনে এসে দাঁড়ালাম দু’জনে। মানুষ হয়তো পাগল ভাববে আমাদের কে যে এই ঠান্ডার মাঝে ও আইসক্রিম খেতে এসেছি। ভিতরে ঢুকতেই খুব অবাক হলাম আমি।পাগল তো শুধু আমরা না এখানে উপস্থিত মানুষগুলো কে ও পাগল মনে হচ্ছে আমার। দুটো আইসক্রিম অর্ডার দিয়ে কর্ণারের দিকে একটা টেবিলে বসে পড়লাম দু’জন। হাসাহাসি করতে লাগলাম পুরোনো কিছু কথা নিয়ে।

—-ওরে আমার পরী যে এইহানে!

বাক্যটা কানে আসতেই ভয়ে রুহু কেঁপে উঠল আমার। মাথা তুলে আকাশ কে দেখতেই প্রিয়ুর হাত টা চেপে ধরলাম শক্ত করে ।প্রিয়ু ও ভয়ার্ত চোখে তাকালো আমার দিকে। আকাশের পিছনে আরো দুটো ছেলে কেমন কামনার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। চারপাশে চোখ বুলাতেই সব দম ফুরিয়ে গেল আমার। কেউ নেই এখানে। একটু আগেও তো চার থেকে পাঁচজন মানুষ ছিল এখানে। কোথায় গেল সবাই!

—-কি টুক্কুর টুক্কুর কইরা কারে চাও পরী? লাভ নাই। পয়সা দিয়া খালি কইরা দিছি একদম জায়গাটা। পাক্কা দেড় বছর পর ফিরছি দেশে। তোমার লাই মনটা খালি ব্যাথা করতো। এখন তোমার ছোঁয়া পাইলেই এই ব্যাথা সাড়ব আমার।

বলেই আমার হাতটা খপ করে ধরে ফেলল আকাশ। জীবনে প্রথম কোনো পুরুষের খারাপ ছোঁয়া পেতেই চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এলো আমার। লালসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আমার আরো কাছে আসল সে। প্রিয়ু আটকাতে নিলে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল তাকে। চিল্লিয়ে উঠলাম আমি। সাথে সাথেই আমার মুখ চেপে ধরল লোকটা। নিজের মুখটা এগিয়ে আনতে লাগল আমার দিকে। চোখ দুটো খিঁচে মুখটা দূরে সরাতেই আমার গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিল প্রচন্ড জোরে। ছিটকে গিয়ে চেয়ারে পড়তেই কোমড়ের ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠলাম আমি। শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে আমার দিকে এগিয়ে আসতে নিলে ঠাস করে মুখ থুবড়ে ফ্লোরে পড়ে গেল আকাশ। কালো পোশাক ধারী দু’টো লোক আকাশ কে লাথি মারতে লাগল একের পর এক।পাশের ছেলে দুটোর অবস্থা ও কাহিল। প্রিয়ু কে জরিয়ে ধরে ক্রমাগত কেঁপে যাচ্ছি।”

” আমার একদমই উচিত হয় নি ওনার কথা অমান্য করা”–কাঁদতে কাঁদতে বললাম।

“সব আমার জন্য হয়েছে শ্রেয়া। “–কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলল প্রিয়ুৃ।

লোক দুটো মাথা নত করে দাড়াল আমার সামনে। বিনয়ী স্বরে বলে উঠল,,,

—আপনি ঠিক আছেন ম্যাম? সরি আমাদের পৌঁছাতে একটু লেট হয়ে গেছে। ক্ষমা করবেন আমাদের। একা আর কোথাও যাবেন না ম্যাম। স্যার খুব রেগে গেছেন আপনার উপর।

ওনাদের কথার আগা মাথা কিছুই বুঝতে পারলাম না আমরা । আমাদের বাসায় পৌঁছে দিল লোক দুটো। বাসায় এসে নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলাম। যদি মা জানতে পারেন তো কেলেঙ্কারি বাঁধিয়ে দিবেন। সারারাত চিন্তা ভাবনা করে আমার মস্তিষ্ক ধারণ করতে পারল নিশ্চয়ই কালো পোশাকধারী লোক গুলো ওনার কথা বলছিলেন। তার মানে ওনি জানতে পেরে গেছেন! এটা মনে আসতেই ঘুম ছুটে গেল দু চোখ থেকে।

———————————————

তাড়াহুড়ো করে কলেজে ঢুকতে গেলে ডেকে উঠলেন চাচা। মানুষ ঠিকি বলে–” যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়”।
ভেবেই রেখেছিলাম আজ কোনো চিরকুটই নিব না। ওনার চিরকুট পড়ার সাহস যে নেই আজ। আমি অন্যায় করেছি বড্ড অন্যায় করেছি ওনার কথার খেলাপ করে। সারা রাস্তা দোয়া করেছি যেন আজ কোনো চিরকুট না আসে। কিন্তু কোনো লাভ হয় নি। চাচার ডাকে ভয়ার্ত মন নিয়ে দাড়িয়ে পড়লাম আমি।

—- চিরকুট না নিয়ে কই যাও? পোলাডা আজ অনেক চেইত্তা আছিল। চোখে মুখে কি রাগ তার! আমি দো বুঝবার পারছি না এতো রাগের কারণডা কিতা! চিরকুট টা আমার হাতে দিয়া কলেজের ভিতরে গিয়া কতক্ষণ কথা কইলো প্রিন্সিপাল স্যারের লগে। প্রিন্সিপাল স্যার দো তারে দেইখা খাতির যত্নে লাইগ্গা গেল। কিছু কথা কইয়া একটু আগেই চইল্লা গেল।

কোনো কথাই ভালো লাগছে না আজ। চাচার হাত থেকে চিরকুট নিয়ে চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতেই চাচা আবারও বলে উঠলেন,,,

—হুনলাম আকাশ পোলাডারে কেডা জানি কালকা মাইরা ফালায়া গেছে পাড়ায়। একটা হাত নাকি ভাইঙ্গা দিসে।এহন নাকি আইসিইউ তে আছে।খুব ভালা হইছে।খারাপ পোলা আছিল।আমার মাইডা রে স্কুলে আইতে যাইতে বিরক্ত করছে কতো।

চাচার কথা শুনে সেখান থেকে চলে এলাম আমি। দুরুদুরু বুক নিয়ে চিরকুট টা মেলে ধরলাম,,,,,

~ শুভ্রপরী বলে হৃদয়ে জায়গা দিয়েছি বলে মাথায় তুলেছি বলে খুব বাড় বেড়েছে তোর তাই না? আমাকে চিনার ক্ষমতা এখনো তোর হয় নি। আজ পর্যন্ত আমার কথা অমান্য করার সাহস ও কারো হয় নি। যে করেছে তার পরিণতি হয়েছে ভয়ংকর। তোকে ভয়ংকর ভালোবাসলে ভয়ংকর শাস্তি ও আমি দিতে পারব। এমনভাবে ছাটাই করব যেনো আমার খেলাপি করতে গেলে তোর রুহু কেঁপে উঠবে তীব্রভাবে।সারারাত এক দন্ড ও ঘুম আসে নি চোখে। ইচ্ছে করেছে মেরে ফেলি তোকে। আইসক্রিম খাওয়ার ইচ্ছা মেটাব আমি। এমনভাবে মেটাব যেন আইসক্রিম দেখলেই ভয়ে কেঁপে উঠবে তোর হৃদয়। মনে রাখিস আমায় ছাড়া তোকে স্পর্শ করার অধিকার কারো নেই। কখনও যদি আমার ব্যাতিত অন্য কারো হওয়ার চিন্তা ও করিস সেদিন তোর জীবনে প্রলয় ডেকে আনব আমি।ভয়ংকর প্রলয়। “”””

চলবে,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here