#তোমাতেই পূর্ণ আমি
#পর্ব -১৯,২০
#লেখিকাঃআসরিফা সুলতানা জেবা
১৯
ঘুমের প্রকোপে চোখ মেলে তাকাতে পারছি না। কোনোমতে বিছানা থেকে উঠে পাশের জানালা টা খুলে দিলাম। রীতি আপু চলে গেছে কাল বিকালেই। মোবাইল হাতে নিতেই দেখলাম দশটা বেজে ১৫ মিনিট। চোখ দুটো বড় বড় হয়ে এলো আমার। আঠারো বছরের জীবনে কখনও এতো বেলা অব্দি ঘুমায় নি আমি। অবশ্যই আজ এতো বেলা পর্যন্ত নিদ্রায় থাকার বিশেষ কারণ আছে। রাত ৩ টা পর্যন্ত হসপিটালে ছিলাম সবার সাথে। ফুহাদ ভাইয়ের অবস্থা ও আগের চেয়ে ভালো এখন। ৩ টার পর তূর্য আমাকে পৌঁছে দেন বাসায়। কিন্তু ওনার বলা একটা কথা কিছুতেই ভুলতে পারছি না আমি। এখনও বুকটা কেঁপে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। বাইক থেকে নেমে গেইটের ভিতরে চলে আসতে নিলে পিছন থেকে ডেকে ওঠেন তূর্য। আমি দাঁড়াতেই আমার কাছে এসে দাড়ান তিনি। ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলোয় ওনার ক্লান্ত মুখ টা দেখে থমকে গেলাম আমি। কারো ক্লান্তি ভরা চেহারা ও কি এতো মুগ্ধময় হতে পারে? গালে তূর্যর হাতের স্পর্শ পেতেই ঘোর থেকে বেরিয়ে এলাম আমি। ওনার দিকে তাকাতেই ক্লান্তিমাখা স্বরে বলে উঠলেন,,
— কখনও আমি হারিয়ে গেলে তুমি কি মিথির মতোই কাঁদবে শুভ্রপরী?
এমন একটা প্রশ্নের উত্তর কি হবে জানা নেই আমার। অজানা ব্যাথা কষ্ট এসে চেপে ধরল আমার মনে। বুকে আচমকাই অনুভব করলাম অসহ্য ব্যাথা। যা সেকেন্ডেই অতিশয় বেড়ে গেল। কোনো প্রকার জবাব না দিয়ে এক দৌড়ে চলে এলাম ওইখান থেকে। রুমে এসে জানালা দিয়ে দেখতেই নজরে পড়ল তূর্য কে। ওনার দৃষ্টি একদম জানালা বরাবর। চোখে চোখ পড়তেই ক্লান্তি ভরা এক হাসি হাসলেন উনি। কানে মোবাইল ধরে আমায় ইশারা করলেন কিছু একটা। প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরক্ষণে ফোনের রিংটোনে বুঝতে পারলাম ইশারার ভাষা। কানে নিতেই তিনি বলে উঠলেন,,,
–সারারাত খাও নি। সেই দুপুরে খেয়েছিলে। ফুহাদের জন্য এতোটাই চিন্তিত ছিলাম যে তোমাকে খাবানোর কথা মাথা থেকেই বেরিয়ে গিয়েছিল। সরি শুভ্রপরী। তোমার ব্যাগটা চেক করে দেখবে। দুটো চিকেন বার্গার আছে একটা প্যাকেটে। খেয়ে নিবে শ্রেয়সী।
স্তম্ভিত হয়ে পড়লাম আমি। কন্ঠে জড়তা নিয়ে বললাম,,
–আপপপনি খাবেন না?
—ক্ষুধা আছে অনেক তবে খাওয়ার ইচ্ছে টা নেই একটুখানি ও।–হালকা হেসে বললেন তূর্য।
—অদ্ভুত কথা বলছেন তো আপনি চিরকুট সাহেব। খেয়ে নিবেন প্লিজ।
–ইচ্ছে নেই বললাম তো শুভ্রপরী।
–ঠিক আছে। খাওয়ার একদম দরকার নেই। আপনি শুধু একটু নিচে অপেক্ষা করুন। আমি এখনই আসছি।
আমার কথা শুনে অবাক হলেন তূর্য। চোখে মুখে অবাকতা বজায় রেখেই বললেন,,,
–এখন নিচে আসার প্রয়োজন নেই শ্রেয়া। অলরেডি অনেক লেইট হয়ে গেছে। এখন খেয়ে ঘুমোও।
—একটু অপেক্ষা করুন চিরকুট লেখক। –করুন স্বরে বললাম।
–ঠিক আছে।
ওনার কাছ থেকে সম্মতি পেতেই এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল আমার মুখে। বার্গার এর প্যাকেট ও এক বোতল পানি হাতে নিয়ে চলে এলাম নিচে। গেইটের কাছে আসতেই দেখলাম ফোনে ব্যাস্ত ওনি। আমি কাছে এসে দাঁড়াতেই ফোনটা পকেটে রেখে হাসি মুখে বলে উঠলেন,,,
–ফুহাদের জ্ঞান ফিরেছে। আমার জলদি যেতে হবে শ্রেয়সী।
ওনার হাসিটা অবলোকন করতেই হৃদয়ে এক প্রশান্তির নির্মল বাতাস বয়ে গেল। আমার হাতে প্যাকেট আর পানির বোতল দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন তিনি। মুখে হাসি ফুটিয়ে আমি বলে উঠলাম,,,
–দুটো বার্গার আমি খেতে পারবো না। প্লিজ আপনি একটা খেয়ে যান। খাবার নষ্ট করা কি ভালো বলেন? প্লিজ,,,
আমার হাত থেকে প্যাকেট ও পানির বোতল টা নিয়ে বাইকের উপর রাখলেন তূর্য। কাছে এগিয়ে কপালে আসা চুল গুলো কানের পিছনে গুঁজে দিয়ে বলে উঠলেন,,,
–যদি মুখে বলতে আপনাকে ছাড়া আমার গলা দিয়ে খাবার নামবে না তবে কি খুব ক্ষতি হতো শুভ্রপরী?
তূর্যর মুখে নিজের মনের কথাটা শুনে চরম মাত্রায় বিস্মিত হলাম আমি। কিভাবে ওনি বুঝে গেলেন আমার মনের কথাটা!মাথা নত করে বললাম,,,
–বার্গার গুলো হয়তো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি খেয়ে নিলে ভালো হয়।
–ওকে।–এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন তূর্য।
ফোনে মেসেজে আসার শব্দে ধ্যান ভাঙল আমার। হাতে নিয়ে দেখলাম ওনি মেসেজ করেছেন।
~ তুমি কি এখনো ঘুমাচ্ছো শুভ্রপরী? যদি ঘুম ভাঙে তো একবার হসপিটালে আসবে প্লিজ? সকাল সকাল তোমার স্নিগ্ধ ভরা মুখটা দেখতে ভীষণ ইচ্ছে করছে। কিন্তু ফুহাদ কে ফেলে যেতেও পারছি না। টিউশন করানোর আর প্রয়োজন নেই তোমার। আসবে কি?
ছোট্ট একটা মেসেজ।কিন্তু বিরাট আবেগময় এক আবদার। যদি পারতাম তবে গত কয়েক মাসের স্মৃতি গুলো মুছে দিতাম আমি আমার জীবন থেকে। পরম যত্নে লেপ্টে থাকতাম এই মানুষটার বুকে। এক বুক হতাশা নিয়ে ফোনটা হাত থেকে রেখে দিলাম আমি। ভালোবাসার অতল সাগরে এতোটাই নিমজ্জিত হচ্ছিলাম যে বাস্তবতা টাই ভুলতে বসেছিলাম। চোখ ছাপিয়ে জল নেমে এলো। সিদ্ধান্ত নিয়েছি এখান থেকে চলে যাবো। তবে হয়তো কিছুটা হলেও দূরত্ব বাড়বে আমার ও তূর্যর মাঝে। তোহাশ ভাইয়ার জব অফার টা একসেপ্ট করে নিব। জব টা তো আর মন্দ না। ওনারা মানুষ ও খুব ভালো। ভার্সিটিতে ও কম যাবো এতে তূর্য ও ভুলে যাবেন আমায় ধীরে ধীরে। ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নিলাম হসপিটালে যাওয়ার লক্ষ্যে। প্রিয়ু কে ও ফোন করে ডেকে নিলাম। তূর্যর জন্য না হোক ফুহাদ ভাইয়া কে অন্তত একবার হলেও দেখতে যাওয়া উচিত আমার।
ফুহাদ ভাইয়া কে দেখে কেবিন থেকে বেরিয়ে চারপাশ খুঁজে তূর্যর দেখা মিলল না। আমাকে মেসেজে আসার আবদার করে নিজেই এখন গায়েব। একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে ওনার মুখোমুখি হতে হবে না। আমিও প্রিয়ু সামনে এগোতেই দেখা মিলল আয়ুশ ভাইয়া ও তূর্যর। আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলেন তূর্য। ওনার এভাবে চোখ ফিরানো টা ভালো ঠেকল না আমার কাছে। মনটা এক নিমিষেই খারাপ হয়ে গেল। হঠাৎ অনুভব করলাম মাথা থেকে আমার ওড়না টা সরে গেছে। ওহ্ তার জন্য ওনার এমন রিয়েক্ট! তাড়াতাড়ি ওড়না টেনে মাথায় দিতেই তূর্য বলে উঠলেন,,,
–আমার সাথে একটু আসো শুভ্রপরী।
ইশশ সবার সামনে এভাবে বলতে হয়! ওনার কি একটু ও লজ্জা লাগে না। ইতস্ততা নিয়ে পা বাড়ালাম ওনার পিছু পিছু।
শ্রেয়া ও তূর্য যেতেই জড়োসড়ো হয়ে দাড়িয়ে থাকা প্রিয়ুর দিকে তাকালো আয়ুশ। ঠোঁট দুটো প্রশস্ত করে বলল,,,
–আপনি এখানে দাড়িয়ে কি করবেন ন্যাকা রাণী? আপনি বরং আমার সাথে ক্যান্টিনে চলুন।
আয়ুশের মুখে উচ্চারিত ন্যাকা রাণী শব্দ টা শুনে আরও জড়োসড়ো হয়ে গেল প্রিয়ু। নিজের গালেই এখন জুতা দিয়ে
চাপড়াইতে ইচ্ছে করছে তার কেন যে সেদিন ক্যাম্পাসে এতো ঢং করতে গেল। আয়ুশের পিছু পিছু সে ও ছুটল ক্যান্টিনের উদ্দেশ্যে।
গাড়িতে বসে আমার দিকে মুগ্ধময় নয়নে তাকিয়ে রইল তূর্য। কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে গাড়ির সামনের অংশ থেকে পানির বোতল টা হাতে নিয়ে দুই ঢুক পানি খেলেন । ফের আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,,,
–আমি পাঁচ দিনের জন্য বিজনেসের কাজে বাহিরে যাবো শ্রেয়া। কাজটা খুবই ইম্পরট্যান্ট। তোমাকে চোখের আড়াল করা আমার পক্ষে আর পসিবল না। জরুরি না হলে কখনই যেতাম না। এক সেকেন্ড ও তোমার থেকে দূরে থাকা টা খুব পুড়ায় আমায়। খুব বেশি চিন্তা হয় তোমায় নিয়ে। সারাক্ষণ ভাবি কোথায় লুকিয়ে রাখব তোমাকে। আমি জানি আয়ুশ তোমায় ভালোবাসে। নিজের বেস্ট ফ্রেন্ডের প্রতি ও ভীষণ জেলাস হয় আমি। কিন্তু এতে তো আয়ুশের দোষ নেই। ভালোবাসা তো ইচ্ছে করে হয় না। অজান্তেই অনুভূতি জমা হয় অজান্তেই আবার ভালোবাসায় পরিণত হয়।
কথাগুলো বলে ফোনটা হাতে নিয়ে কাউকে কল করলেন তূর্য। রিসিভ হতেই বললেন,,,
–প্রিয়ু কে নিয়ে চলে আয়। আর হে এসাইনমেন্টের খাতাগুলো ও নিয়ে আসিস।পার্কিং এরিয়া তে অপেক্ষা করছি আমরা।
তূর্যর কথোপকথনে আন্দাজ করতে পারলাম আয়ুশ ভাইয়ার সাথে কথা বলছিলেন। নিজের ভালোবাসার মানুষ কে তারই সবচেয়ে কাছের বন্ধু ভালোবাসে তবুও তাতে বিন্দু পরিমাণ ক্ষোভ নেই তূর্যর। শুনেছি বন্ধু নাকি একসময় শত্রু হয়।পিছনে ছুড়ি মারে। অথচ তাদের বন্ধুত্বটা একদম অন্যরকম।একজন জেনেও মনে কোনো ক্ষোভ নেই আর অন্য জন ভালোবেসে ও বন্ধুর সুখের জন্য করেছেন সেক্রিফাইজ। হে,,এটাই বন্ধুত্ব। আয়ুশ ভাইয়া ও প্রিয়ু চলে এলো মিনিট দুয়েক পর। আয়ুশ ভাইয়ার হাতে কতগুলো খাতা। খাতা গুলো আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন আয়ুশ ভাইয়া। মুচকি হেসে বললেন,,,
–কাল এসাইনমেন্ট জমা দেওয়ার ডেট তো?
—হুম ভাইয়া।
— দুটো এসাইনমেন্ট একদম কমপ্লিট।
নির্বাক হলাম আমি ও প্রিয়ু। আয়ুশ ভাইয়া আমাদের এসাইনমেন্ট করে দিয়েছেন! এসাইনমেন্ট গুলো হাতে নিয়ে ধন্যবাদ জানাতেই আয়ুশ ভাইয়া বললেন,,,
—প্রিয়ুর ধন্যবাদ এক্সসেপ্টেবল বাট তোমার টা না জেরি।
—মানে!!!
—কারণ তোমার মুখে উচ্চারিত ধন্যবাদ টা অন্য কারো প্রাপ্য। তোমার এসাইনমেন্ট টা আমি করি নি। করেছে তোমার চিরকুট লেখক।
আয়ুশ ভাইয়ার কথা শুনে থমকালাম আমি। সারারাত তো হসপিটালে ছিল মানুষ টা। তবে কি হসপিটালে বসেই করল? এই এসাইনমেন্ট করতে পাক্কা দু ঘন্টা লাগত। তবে কি ওনি সারারাত ঘুমান নি?তার জন্যই চোখ দুটো এতো লাল!! কিছু না বলে গাড়িতে গিয়ে বসলাম আমি। প্রিয়ু ও বসল আমার পাশে। আজ নিজের উপর খুব ঘৃণা হচ্ছে আমার। কেন সেদিন নিজের বিশ্বাস টা ধরে রাখতে পারলাম না আমি? শুধু ভালোবাসি বললেই কি হয়? একটা মেসেজ কখনও কি কারো প্রতি বিশ্বাস নষ্ট করে দিতে পারে?আজ মনে হচ্ছে আমার ভালোবাসা ব্যার্থ। আমি বিধবা জেনেও আমার প্রতি ওনার ভালোবাসা একটু ও কমে নি বরং বেড়েছে শতগুণ। তূর্যর যোগ্য আমি কোনো সময়ই ছিলাম না। ওনার ভালোবাসার যোগ্য ও আমি না। জানালার দিকে ঝুঁকে আমার দিকে তাকাল তূর্য। শান্ত কন্ঠে বলে উঠলেন,,
–নিজের খেয়াল রাখবে শুভ্রপরী। আজ সন্ধ্যার দিকেই চলে যাবো আমি। ফোন দিব রিসিভ করবে প্লিজ। খুব দরকার হলে ফোন দিবে অথবা আয়ুশ কে জানাবে।
চোখ ঝাপসা হয়ে এলো আমার। এতো কেয়ার এতো ভালোবাসার প্রাপ্য আদোও কি আমি? প্রিয়ু কে উদ্দেশ্য করে বললেন,,,
—খেয়াল রাখবেন আমার শুভ্রপরীর শালী সাহেবা। রাখবেন তো?
—জ্বি ভাইয়া। আপনি একদম নিশ্চিন্ত থাকুন। (হেসে)
গাড়ি চলতেই জানালা দিয়ে মুখ বের করে পানিতে টলমল করা চোখ নিয়ে তূর্যর দিকে ফিরে তাকালাম আমি। তূর্য এখনো দাঁড়িয়ে এদিকেই তাকিয়ে আছেন আয়ুশ ভাইয়া ও সাথে দাড়িয়ে। কষ্ট হচ্ছে আমার। ওনার ভালোবাসায় তো বিন্দুমাত্র খাদ নেই তবে আমার ভালোবাসায় কেন রয়ে গেল?এখন চাইলেও কিছু ঠিক হবে না। কিছুই না। সিটে মাথা এলিয়ে নীরবে চোখের জল বিসর্জন দিতে লাগলাম। আমার যে এখন নীরবতা ছাড়া আর কিছুই নেই। অপূর্ণ আমি তূর্য। আপনাকে ছাড়া অপূর্ণ আপনার শুভ্রপরী।
।
।
কাগজে সাইন করে নতুন জবে নিয়োগ দিলাম আমি। দুপুরেই স্টুডেন্টের বাসায় গিয়ে কথা বলে ছেড়ে দিয়েছি টিউশনি গুলো। জবের কথা শুনে অনেক খুশি হলেন তিহুর আম্মু। আমাকে অর্ধেক মাসের বেতন ও দিয়ে দিলেন। সন্ধ্যা হতেই তিতিশাকে পড়াতে এসে আমার সিদ্ধান্ত জানালাম আরিয়ানা আপু কে। খুশিতে চক চক করে উঠল আপুর চোখ গুলো। আরিয়ানা আপু আমায় জরিয়ে ধরে বললেন,,
–ওয়েলকাম আওয়ার হোম শ্রেয়া। আমি খুব খুশি হয়েছি তুমি রাজি হওয়াতে। আমার মন বলছিল তুমি কখনও ফিরিয়ে দিবে না প্রস্তাব টা।
হালকা হাসলাম আমি। তিতিশার দিকে ঝুঁকে ওর থুতনিতে হাত দিয়ে বললাম,,,
–তিতিশা বেবি হ্যাপি হয়েছে তো?
আমাকে ছোট ছোট হাতে আলিঙ্গন করে নিল তিতিশা। আনন্দ,,উচ্ছ্বাসের ছাপ চোখে। মুখে হাসির ঝলক এনে বলল,,,
–আ’ম ভেরি ভেরি হ্যাপি মিস। তুমি খুব ভালো খুব সুন্দর। তুমি তো একটা পরী। শুভ্রপরী।
তিতিশার কথা শুনে চোখ আকৃতি বড় করে তাকালাম আমি। মনের মাঝে জেগে উঠল সন্দেহ। শুভ্রপরী মানে? এই নামে তো তূর্য ছাড়া আমায় কেউই ডাকে না। আমার ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে আরিয়ানা আপু মুখে হাসি টেনে বললেন,,,
–সত্যিই তুমি খুব সুন্দর শ্রেয়া। ও আজ একটা নাটক দেখেছিল তো। ওইখানে নায়িকা সুন্দর দেখে তিতিশা বলে উঠল,,,–আম্মু দেখো না নায়িকা টা কতো সুন্দর। কতো ফর্সা। সাদা পরী তাই না আম্মু?
সাদা পরী তো বেমানান লাগে তাই না শ্রেয়া? তাই ওকে বললাম সুন্দর মানুষ কে শুভ্রপরী ডাকতে হয়। কথাটা বলে হি হি করে হেসে উঠল আরিয়ানা আপু। আমিও আর মাথা না ঘামিয়ে চলে এলাম বাসায় । কিছু জরুরি জিনিস আছে সেগুলো নিয়েই কাল শিফট হবো তিতিশাদের বাড়িতে।
।
।
আজ তিনদিন হয়েছে তিতিশাদের বাসায় এসেছি। তোহাশ ভাইয়া,,,,আরিয়ানা আপু,,তিতিশা ব্যাতিত আর কোনো ফ্যামিলি মেম্বারই দেখি নি আমি। তিতিশার কথিত সেই চাচ্চু কে ও না। আরিয়ানা আপু কে ও জিজ্ঞেস করি নি পরিবারে কে কে আছে! কি দরকার ওনাদের ব্যাক্তিগত জীবন সম্পর্কে আমার জানার। হাজারো ফুলের মাঝে তিতিশাদের বাগানের বেলি ফুল গাছটার নিচে পাতানো দোলনা টায় বসে আছি আমি । তিতিশা খেলতে ব্যাস্ত বাগানে ওর এক স্কুল ফ্রেন্ডের সাথে। একটু আগেই তিতিশার সমবয়সী এই বাচ্চা ছেলেটা কে দিয়ে গেছে তাদের ড্রাইভার। প্রায় সময় নাকি খেলতে আসে আরিয়ানা আপুর কাছে থেকে জানতে পারলাম। ওদের দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে রইলাম আমি। কিছু একটার শব্দে কেঁপে উঠল আমার হৃদপিণ্ড। পাশ থেকে ফোনটা নিতেই স্ক্রিনে ভেসে উঠল ” চিরকুট লেখক “। কেটে যেতেই সাইলেন্ট করে রেখে দিলাম আমি। এই তিনদিনে হাজার বার ফোন করেছেন ওনি। কিন্তু আমি চাই না আর চাই না ওনি পড়ে থাকুক আমার মোহে। সুন্দর হোক ওনার জীবনটা এটাই আমার প্রত্যাশা।
চলবে,,,,,
(ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)
#তোমাতেই পূর্ণ আমি
#পর্ব -২০
#লেখিকাঃআসরিফা সুলতানা জেবা
মাঝ রাতে মাথায় কারো স্পর্শ পেয়ে ঘুম হালকা হয়ে এল আমার। মিটমিট করে খুব কষ্টে চোখ দুটো খুলে উঠে বসলাম আমি। মোবাইলের ফ্লাশ জ্বালিয়ে চারদিকে চোখ বুলাতেই কিছুই দেখতে না পেয়ে শুয়ে পড়লাম। এটা হয়তো আমার ভ্রম ছিল। কই এ বাড়িতে এসেছি তিনদিন কেটেছে একবার ও তো এমন লাগে নি। হতেও পারে জায়গা বদল করেছি বলে এটা আমার মনের ভীতি। এমনিতেই ঘুম আসে না একদমই। মনের মধ্যে কষ্ট নিয়ে বেঁচে থাকা দায় হয়ে পড়ছে আমার। মনের সাথে পেরে উঠতে পারছি না। তূর্যর প্রতি আসক্তি ভালোই গ্রাস করেছে আমায়। যতই তূর্যর কাছে যেতে চাইছি ততই যেন কঠিন অতীত দেয়াল হয়ে দাড়াচ্ছে আমাদের মাঝে।
সকাল ৭ টায় ঘুম ভাঙল আমার। ফজরের নামাজ পড়ে শুতেই চোখ লেগে গেল। ফ্রেশ হয়ে বাহিরে আসতেই দেখা মিলল তোহাশ ভাইয়ার। মুচকি হেসে বলে উঠলাম,,,
—গুড মর্নিং ভাইয়া।
—গুড মর্নিং শ্রেয়া।
—আপু কোথায়?
–তোমার আপু হয়তো কিচেনে।
–আচ্ছা।
কিচেনে গিয়ে আরিয়ানা আপুর পাশে দাঁড়াতেই মুচকি হাসলেন আপু। আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,,,
— শ্রেয়া তিতিশা কে উঠিয়ে রেডি করে দাও। ওর স্কুলের সময় হয়ে যাচ্ছে।
–জ্বি আপু।
আমি পা বাড়াতেই আপু আবারও ডেকে উঠল। ফিরতেই নির্বিকার কন্ঠে বলল,,,
–তিতিশা ওর চাচ্চুর সাথে ঘুমিয়েছে। উপরের ডান পাশের রুমটা ওর চাচ্চুর। দেয়ালে দেখবে বড় অক্ষরে লিখা–“অনুমতি ব্যাতীত প্রবেশ নিষেধ ”
আপুর কথায় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি। একটা ছেলের রুমে যেতে হবে! আবার পেট ফেটে হাসি ও আসছে আপুর মুখে উচ্চারিত শেষ বাক্যটা শুনে। কোনোভাবেই হাসি আঁটকে রাখতে পারলাম না। হেসে দিলাম ফিক করে। আমার সাথে তাল মিলিয়ে হেসে দিল আপু ও।হাসতে হাসতে বলে উঠলেন,,,
–আমার দেবর টা অত্যন্ত রাগী একজন মানুষ। এ বাড়ির মেম্বার ছাড়া কেউই ওর রুমে প্রবেশ করতে পারে না। ভয়ে ও কেউ রুমে প্রবেশ করবে না। মনে হবে কোনো ভুতের আস্তানা।
—তাহলে আমারও তো প্রবেশ নিষিদ্ধ আপু।
—- ওর ঘুম নয়টার আগে ভাঙে না। তাই কোনো ভয় নেই। চুপ করে ঢুকে তিতিশা কে কোলে তুলে নিয়ে আসবে। দেখবে দেবর সাহেব একদমই টের পাবে না।
আপুর কথায় সম্মতি জানিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলাম আমি। কোথায় থেকে চলে এল এই দেবর টেবর? কই এতোদিন তো দেখি নি! তিতিশা কে ঐখানেই ঘুমোতে হলো? এমনিতেই মনে দহন হচ্ছে প্রতিনিয়ত তার উপর আরেক উটকো ঝামেলা। দুরুদুরু বুক নিয়ে রুমের সামনে এসে দাঁড়ালাম আমি। আপুর কথা একদম সত্য। বড় করে লিখা দেয়ালে খোদাই করে। এমন করে লিখার কি আছে? রুম কি কেউ চুরি করে নিয়ে যাবে? এখন আর হাসি পেল না আমার। বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেল অনেক। দরজাটা হালকা করে চাপিয়ে রাখা। ধীরে ধীরে খুব সাবধানে রুমে প্রবেশ করলাম আমি। পুরো রুমটা অন্ধকার। সত্যিই আমার কাছে ও ভুতের আস্তানা মনে হচ্ছে। যে এই রুমে থাকে সেই ব্যাক্তি ও নিশ্চয়ই ভুতের চেয়ে কম হবে না। কম্পিত হৃদয় আর ভয় দু’টো নিয়ে বিছানার কাছে আসতেই নজরে পড়ল কালো টি শার্ট,, শর্ট প্যান্ট পরিধান করে উপুড় হয়ে ঘুমাচ্ছে কেউ। সেদিকে খেয়াল না করে বিছানায় ভালো করে তাকাতেই দেখলাম তিতিশার কোনো চিহ্নই নাই। তিতিশা কি উঠে চলে গেল? এই মেয়ের আবার ভালো একটা গুণ আছে তা হলো অতিরিক্ত ডাকা ডাকি করে উঠাইতে হয় না। মাঝে মাঝে নিজেই জেগে যায় নিজেই ফ্রেশ হয়ে লক্ষী মেয়ের মতো বসে থাকে। যাক বেঁচে গেলাম!
।
।
হঠাৎ বাহির থেকে ভেদ করে আসা সূর্যের আলোয় দেয়ালে একটা ছবি দেখতেই ভ্রু কুঁচকে এল আমার। ভালো করে দেখতে না পেরে আরেকটু কাছে গিয়ে দেখার জন্য উদ্ধত হতেই ফ্লোরে গোল কিছুর সাথে পা পেঁচিয়ে বিছানায় উপুর হয়ে শুয়ে থাকা মানুষটার পিঠের ওপর গিয়ে পড়লাম আমি। আমার ঠোঁট দুটো গিয়ে লাগল ছেলেটার পিঠে। প্রচন্ড ব্যাথা পেলাম পেটে। কিন্তু ব্যাথার চেয়ে ও বেশি ভয় ও লজ্জা আমায় আঁকড়ে ধরেছে ভীষণভাবে। উঠার চেষ্টা করেও ব্যার্থ আমি। আচমকা কেউ টেনে উল্টো ঘুরিয়ে শুয়ে আমার উপর নিজের ভর ছেড়ে দিল অনাসয়ে। কলিজা মোচড় দিয়ে উঠল আমার সাথে সাথেই। চোখ বন্ধ রেখেই জোরে চিল্লান দিতে গেলে লোকটা আমার মুখ চেপে ধরল শক্ত করে। রাগান্বিত স্বরে বলে উঠল,,,
— এতোদিন আমায় কষ্ট দিয়ে শান্তি হয় নি তোর এখন আবার লোক জড়ো করে সিনেমা দেখাতে চাচ্ছিস?
চেনা কন্ঠস্বর কানে আসতেই পিলে চমকে উঠল আমার। ভয়ার্ত মন নিয়ে পিট পিট করে চোখ মেলতেই মাথায় ব্রজপাত পড়ল। শ্বাস আটকে যাওয়ার উপক্রম। তূর্য আমার দিকে অগ্নি চোখে তাকিয়ে। এতো শক্ত করে মুখ চেপে ধরেছে যে ব্যাথায় টনটন করছে গাল দুটো। যার জন্য পালিয়ে বেড়ানো সেই ব্যাক্তির বাসায়ই এসে পড়লাম আমি। বাসায় এসেছি তো এসেছি শেষ পর্যন্ত ওনার বেডরুমে ওনার বাহুডোরে!!! জমে গেলাম আমি। এক নিমিষেই ক্লিয়ার হয়ে গেল সবকিছু। তার মানে তিতিশার চাচ্চু তূর্য চৌধুরী। আর সেদিন তিতিশার আমায় শুভ্রপরী বলে ডাকা টা মিথ্যে ছিল না। তূর্য তো এখন কোনোভাবেই ছাড় দিবেন না আমাকে। অজানা ভয়ে শরীরের পশম দাঁড়িয়ে গেল আমার। মাথা দু পাশে নাড়াতেই মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিলেন তূর্য। আমি কিছু বলার আগেই গলায় মুখ ডুবিয়ে দিলেন। আকস্মিক হামলায় অবরুদ্ধ হয়ে গেলাম আমি। গলায় তূর্যর উষ্ম ঠোঁটের স্পর্শ পেয়ে বিছানার চাদর টা খামচে ধরলাম শক্ত করে। চিতকার করে তূর্য কে কিছু বলতে চাইছি কিন্তু আশ্চর্য মুখ দিয়ে কোনো কথায় বের হচ্ছে না আমার। কিছু সেকেন্ড অতিবাহিত হওয়ার পর গলায় কামড় অনুভব করতেই ব্যাথাতুর শব্দ করে উঠলাম। প্রচন্ড লেগেছে। মনে হলো যেন কোনো হিংস্র পশু আমার মাংস কামড় দিয়ে খেয়ে ফেলেছে । গলায় কামড় বসিয়ে চোখের পলকেই সরে গেলেন তূর্য। কামড়ের স্থানে হাত চেপে ধরে বসে পড়লাম। বিছানা থেকে উঠতে উঠতে তূর্য গম্ভীর কন্ঠে বলতে লাগলেন,,,
–এখুনি রুম থেকে বেরিয়ে যাবি। নয়তো এর চেয়ে খারাপ কিছু করে বসব আমি। তিনদিন অসহ্য যন্ত্রণা দিয়েছিস আমায়। ভেবেছিস আমার থেকে দূরে চলে যাবি! কিন্তু তুই হয়তো জানিস না তূর্য চৌধুরী কোনো কাঁচা খেলোয়াড় না। কিভাবে নিজের প্রিয় কিছু নিজের করে রাখতে হয় তা তূর্য চৌধুরী খুব ভালো করে জানে।
তূর্যর কথাগুলো শুনে এক মিনিট ও সেখানে দাঁড়ালাম না। বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই হেঁচকা টানে তূর্যর বুকে মুখ থুবড়ে পড়লাম আমি। দেয়ালের সাথে শক্ত করে চেপে ধরে নিজের সাথে একদম মিশিয়ে দাঁড় করালেন আমাকে। আমতা আমতা করে বললাম,,,
–কককি করছেন?
— কিছু না। জাস্ট আমাকে দেওয়া কষ্টের শাস্তি দেওয়া এখনো বাকি। একটু একটু করে পুষিয়ে নিব। এখন বরং আরেকটু পানিশমেন্ট দেয়া যাক,,,
কথাটা বলেই আমার ঠোঁট আঁকড়ে ধরলেন তূর্য। বড় বড় নয়নে তাকিয়ে ওনার বুকে খামচে ধরলাম আমি। আগের চেয়েও ডিপলি স্পর্শ দিতে লাগলেন আমার ওষ্ঠদ্বয়ে। প্রায় মিনিট পাঁচেক পর ছেড়ে দিয়ে আমার দিকে চোখ কটমট করে তাকালেন তূর্য। গায়ের টি শার্ট টা খুলে বুকের কাছের খামচে ধরা অংশ টা দেখিয়ে বললেন,,,
–কি করেছিস এটা? নখ বিঁধে গেছে। তোর নখ যদি আর বড় দেখেছি তাহলে আঙুল কেটে ফেলে দিব আমি।
ঢুক গিললাম আমি। নখ তো বেশি বড় না। বলতে গেলে দেখা যাবে তর্ক করি বলে আবারও শাস্তি দিবে। তার চেয়ে ভালো হবে কেটে পড়ি।
–শুন যাওয়ার আগে রুম টা একদম পরিষ্কার করে দিয়ে যাবি।
কথাটা বলেই ওয়াশরুমে চলে গেলেন তূর্য। আমিও চট করে পুরো রুম গুছিয়ে নিলাম। নিচে একটা ফুটবল পড়ে ছিল। সব এই শয়তান ফুটবলের দোষ। এটা কে বারান্দা দিয়ে নিচে ফেলে দিলাম আমি। এলোমেলো পায়ে সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ে চলে এলাম রুমে। দৌড়ে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই মাথা ঘুরে গেল আমার। ধপ করে বসে পড়লাম চেয়ারে। একি হাল করেছেন ওনি? রক্ত জমাট বেঁধে গেছে গলার কাছের অংশে। ছলছল চোখ নিয়ে আয়নার দিকেই তাকিয়ে রইলাম আমি। এখান থেকে চলে যাওয়ার কোনো উপায় ও আমার নাই। কাগজে স্বাক্ষর করে দু’ বছরের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছি আমি। দরজায় কারো নক করা শব্দে গলায় ওড়না টা পেচিয়ে নিলাম। দরজা মেলতেই একজন সার্ভেন্ট আমার দিকে অয়েন্টমেন্ট এগিয়ে দিয়ে বলল,,,
—ম্যাম!!স্যার পাঠিয়েছেন এটা আপনার জন্য।
নিজে ক্ষত করে আবার নিজেই ক্ষত শুকানোর ধান্দা! আহারে বেয়াদব তূর্য চৌধুরীর অন্যরকম ভালোবাসা। কিছু না বলে মেয়েটার হাত থেকে অয়েন্টমেন্ট টা নিয়ে নিলাম আমি। আয়নার সামনে দাড়িয়ে গলায় লাগাতেই ছ্যাঁত করে জ্বলে উঠল ক্ষত অংশটা। চোখ থেকে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ল। এতো পাষাণ কেন ওনি! ওড়নাটা ভালোভাবে পেচিয়ে নিয়ে ড্রইং রুমে আসলাম। তিতিশা নাস্তার সময় আমায় না দেখলে হুলস্থুল বাঁধিয়ে দিবে। ড্রইং রুমে কোথাও তূর্য কে না দেখে স্বস্তির এক নিশ্বাস ফেলে তিতিশার পাশে গিয়ে বসলাম আমি। তোহাশ ভাইয়া,,আরিয়ানা আপু ও এসে বসল। তিতিশা কে নাস্তা প্লেটে দিয়ে আমি নিজের জন্য নিতেই কোথা থেকে তূর্য এসে আমার প্লেট টা কেড়ে নিয়ে বসে পড়লেন চেয়ারে। অবাক ভঙ্গিতে চেয়ে রইলাম আমি। ওনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,,,
— তোমার কি এতোটুকুও জ্ঞান নেই যে নিজের বর কে ডাকতে হবে নাস্তার জন্য? তা না করে নিজে নাস্তা খেতে বসে গেছে। ভাবী তুমি কি ওকে এ কদিনে কিছুই শিখাও নাই? প্লেন টা কিন্তু আমার ছিল ওকে এ বাসায় আনার। তার আগেই তোমরা কাজ সেড়ে ফেললে কিন্তু তা বলে তো এই নয় যে দেবর কে না খাইয়ে মেরে জা কে পেট ভরে খাওয়াবে।
ডাইনিং টেবিলে উপস্থিত থাকা সবার দিকে তাকাতেই দেখলাম তোহাশ ভাইয়া,,,আরিয়ানা আপু মিটমিট করে হাসছে আর খাবার খাচ্ছে। লজ্জায় মাথা কাটা যাওয়ার মতো অবস্থা আমার। সবাই সবকিছু জেনে প্ল্যান করে এ বাড়িতে আনল আমাকে। চেয়ার থেকে উঠে চলে যেতে নিলে আমার হাত টা টেনে ধরে আবারও নিজের পাশের চেয়ার টা তে বসিয়ে দিলেন তূর্য। পা দিয়ে চেয়ার টা টেনে একদম নিজের মুখোমুখি এনে বসালো আমাকে । মুচকি হেসে খাবার নিয়ে আমার মুখের সামনে ধরতেই তিতিশা হাত তালি দিয়ে বলে উঠল,,,
–ওয়াও চাচ্চু। তুমি একদম হিরো। মিস হা করো। চাচ্চুর হাত ব্যাথা করবে তো।
এতটুকু বাচ্চার মুখে এমন কথা শুনে বিষম খেলাম আমি। তিতিশা ও সব জেনে কেমন বোকা বানালো আমাকে!!! ভাইয়া আপুর সামনে কিভাবে খায় ওনার হাতে সেটা ভেবে উঠতে যাবো ওনি চোখ রাঙিয়ে তাকালেন আমার দিকে। উঠতে গিয়েও আর ওঠা হলো না আমার। মুচকি হেসে ভাইয়া ভাবী বলে ডেকে উঠলেন তূর্য । তোহাশ ভাইয়া সাড়া দিতেই তূর্য বলে উঠলেন,,,
–তোমাদের সামনে আমার হবু বউ কে খাইয়ে দিলে তোমাদের কোনো প্রবলেম নেই তো?
–একদমই না। তবে আমার বোনকে বেশি উতক্ত করবি না।– হেসে বললেন তোহাশ ভাইয়া।
তূর্য খাবার মুখের সামনে ধরতেই মাথা নিচু করে খেয়ে নিলাম আমি। এ কেমন জালে ফেঁসে গেলাম! হৃদয়ে জমায়িত ভালোবাসা গুলো ও কেমন আমার মস্তিষ্কের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে। মনের সাথে আর পেরে উঠছে না মস্তিষ্ক। মাথা নত রেখেই পুরো খাবার শেষ করলাম। চুপ করে তিতিশা কে রেডি করিয়ে দিয়ে বাহিরে এনে গাড়িতে তুলে দিলাম। আরিয়ানা আপু বা অন্য কারো সাথে কোনো কথাই বললাম না। রেডি হয়ে ভার্সিটির জন্য বের হতেই বাইক নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালেন তূর্য। কি আর করার,,,বাধ্য মেয়ের মতো উঠে পড়লাম বাইকে। ভার্সিটির গেইট দিয়ে ঢুকতেই দেখলাম ফিহা ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। তূর্য আমার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বলে উঠলেন,,,
–আজ তো মাত্র দু’টো ক্লাস। ক্লাস শেষে একা যাবে না তুমি। আমার সাথেই যাবে। ওকে?
সম্মতি জানিয়ে ক্লাসে আসতেই প্রিয়ু ঝেকে ধরল আমাকে। এতোদিন কেন ওর ফোন ধরি নি! কেন ভার্সিটি তে আসি নি! একের পর এক প্রশ্ন। থেমে নেই মেয়েটা। প্রিয়ু কে সব খুলে বলতেই মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল বেঞ্চে। ভাবলাম হয়তো আমার বিরহের কথা শুনে কষ্ট পাচ্ছে মেয়েটা কিন্তু পরক্ষণেই আমাকে ভুল প্রমাণিত করে উল্লাসের সাথে বলে উঠল,,,,
–বাহ্!!! জিজু তো সেই মাপের প্লেয়ার। কি ডোজ টাই না দিল তোকে? আ’ম ইমপ্রেসড! তা বিয়ে কবে খাচ্ছি বল?
প্রিয়ুর এমন রসাত্মক স্বর শুনে মেজাজ গরম হয়ে এলো আমার। তীক্ষ্ণ নজর নিবন্ধ করে বললাম,,,
–তোর কাছে এটা মজা লাগছে প্রিয়ু? তুই কি চাস ওনি একটা বিধবা মেয়েকে বিয়ে করে মানুষের খোঁটা শুনুক? আমি জানি ওনি মরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ও আমাকে নিয়ে বিন্দুমাত্র আফসোস করবে না কিন্তু এই সমাজ? এই সমাজের মানুষের কটুবাক্য ওনার রাতের ঘুম কেঁড়ে নিবে ঠিক আমার মতোই!
–তুই কেন এমনটা ভাবছিস শ্রেয়া? তূর্য ভাইয়া তোকে পাগলের মতো ভালোবাসে। সব বিপদে তোর ঢাল হয়ে দাঁড়ায়। কারো সাহস নেই ওনাকে বা তোকে কটুকথা বলার। তূর্য ভাইয়া কে ভয় পায় না খুব কম মানুষই আছে। আর আসল কথা কি জানিস তুই ভীতু। এই তোর প্রতিবাদী রূপ? এই তোর বেঁচে থাকার লড়াই? সিচুয়েশন ফেইস করার বদলে কেন পালিয়ে বেড়াচ্ছিস? তুই ভাবছিস তূর্য ভাইয়ার থেকে পালিয়ে বেড়ালে ওনি সুখী হবে? কিন্তু আমার কি মনে হয় জানিস? তুই হারিয়ে গেলে তূর্য ভাইয়া ধ্বংস হয়ে যাবে। একটা সুখী জীবন পাওয়ার অধিকার তোরও আছে। প্লিজ তূর্য ভাইয়া কে আর কষ্ট দিস না। নিজেও ধুঁকে ধুঁকে মরিস না। প্রতিবাদ করতে শিখ শ্রেয়া। না চাইতে ও পাওয়া অতিরিক্ত প্রণয় নিজের পায়ে ঠেলে দিস না।
প্রিয়ুর কথাগুলো মস্তিষ্কে বিচরণ করতে লাগল। সত্যিই কি আমি ভুল করছি? বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে লড়াই করে কি এক নতুন জীবন শুরু করা উচিত? হুম আমি ভাববো নিজের জন্য নিজের ভালোবাসার মানুষটার জন্য।
ক্লাস শেষে পার্কিং এরিয়া তে এসে তূর্যর অপেক্ষায় দাড়িয়ে রইলাম আমি। মনে মনে অংক কষেছি অনেক। সিদ্ধান্ত নিয়েছি পালিয়ে বেড়াব না আর। গত পাঁচ মাসের সব কথা খুলে বলব তূর্য কে। সব বলেই তূর্যর মতামতেই ওনার সাথে এক নতুন জীবনে পদার্পণ করব। ঘাড়ে কারো গরম নিশ্বাসের উত্তাপ এসে আঁচড়ে পড়তেই হৃদয়টা কেঁপে উঠল দ্রুত গতিতে। কানের অতি নিকটে তূর্যর স্লো ভয়েসের আভাস পেতেই চোখ বুঝে এল আবেশে।
–কখন আসলে?
–এইতো আপনি আসার ঠিক ৬০ সেকেন্ড আগেই।
— ৬০ সেকেন্ড অপেক্ষা করানোর জন্য সরি শ্রেয়সী । ক্লাস শেষে স্যারের সাথে জরুরি কাজে অফিসে গিয়েছিলাম।
কি অদ্ভুত!! ওনার মুখের কথাগুলো হৃদস্পন্দন কেমন বাড়িয়ে দেয়। নিজের নামটা কে ও ওনার মুখে বেশ ভালো লাগছে আমার কাছে। মন বলছে এতো সুন্দর নাম কারো হয়!! এতো সুন্দর নাম কারো হয় কিনা জানিনা! তবে তূর্যর মোহনীয় কন্ঠে নামটা খুবই সুন্দর,,,অন্যরকম! দৃঢ় স্বরে বললাম,,,
–ইট’স ওকে।
–চলো তাহলে,,
—হুম।
বাইকে উঠে মাথা এলিয়ে দিলাম তূর্যর পিঠে। হালকা হাসলেন তূর্য। যাকে এক কথায় বলা যায় তৃপ্তিদায়ক হাসি।
চলবে,,,,
(ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)