তোমাতেই পূর্ণ আমি #পর্ব -২১,২২

0
706

#তোমাতেই পূর্ণ আমি
#পর্ব -২১,২২
#লেখিকাঃআসরিফা সুলতানা জেবা
২১

তূর্যর সাথে বাসায় ঢুকতেই চোখে পড়ল ওয়েস্টার্ন ড্রেস পড়া অসম্ভব সুন্দর এক রমণী কে। চেহারার মিল প্রায় আরিয়ানা আপুর সাথে। তিতিশা কে আদর করতে ব্যাস্ত মেয়েটা। তিতিশা খালা মণি বলে খিলখিল করে হেসে উঠছে। আরিয়ানা আপু ও পাশে বসা । আমার হাত টা ধরে নিজের রুমের দিকে নিয়ে যেতে লাগলেন তূর্য। তাজ্জব বনে গেলাম আমি। ব্যাপার কি! এতোক্ষণ তো হাত ধরেন নি। তাহলে হঠাৎ এমন কি হলো হাত ধরে একদম নিজের রুমের দিকে অগ্রসর হলেন ওনি । চেহারা তে ও কেমন লাল আভা ছেয়ে গেছে মুহূর্তেই। আমাকে নিয়ে আরেকটু এগিয়ে যেতেই আচমকা মেয়েটা এসে তূর্য কে জড়িয়ে ধরল সবার সামনে। বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে রইলাম আমি। মনের কষ্ট গুলো ও দলা পাকিয়ে উঠল। পাশাপাশি দাউদাউ করে জ্বলে উঠল অনল। ইচ্ছে করছে মেয়েটা কে কষিয়ে থাপ্পড় মারি এখনই। চোখ থেকে পানি ঝরে পড়তে লাগল টপটপ করে। হাতটা এখনও তূর্য ধরে রেখেছে বরং আগের চেয়েও অনেক শক্ত করে ধরেছে। অন্য হাতে চোখের পানি গুলো মুছে নিলাম সবার অগোচরে। আরিয়ানা আপুর দিকে নজর যেতেই দেখলাম আপুর চোখে মুখে আতঙ্ক স্পষ্ট। আপু এতো আতঙ্কিত হচ্ছেন কেন! চোখ সরিয়ে তূর্যর চেহারায় দৃষ্টি দিতেই হুঁশ উড়ে গেল আমার। এতো রাগ,,এতো রাগী চেহারায় আমি কখনও দেখি নি ওনাকে। মনে হচ্ছে যেন এক নিমিষেই রাগের হুতাশনে জ্বালিয়ে ছাড়খার করে দিবে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকা সুন্দর এই মেয়েটা কে। ভয়ে তূর্যর হাতে আলতো টান দিতেই মেয়েটা কে গায়ের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ছুঁড়ে ফেললেন ওনি। আঁতকে উঠলাম উপস্থিত থাকা সবাই। আমার হাত টা ছাড়িয়ে তীব্র রাগ নিয়ে ফ্লোরে পড়ে থাকা মেয়েটার দিকে আঙুল তুলে বললেন,,,,

— লাস্ট টাইমের থাপ্পড়ের কথা ভুলে গেছিস তাই না? এখনো তোর লাজ লজ্জা হয় নি। দেখলেই গায়ে পড়ে যাস। শুধু মাত্র ভাবীর বোন বলে আমার হাত থেকে বেঁচে যাস নয়তো তোর মতো বেহায়া,অসভ্য মেয়ে কে কীভাবে শায়েস্তা করতে হয় তা আমি ভালো করেই জানি। এটা তোর জন্য লাস্ট ওয়ার্নিং মনে রাখিস।

কথাটা বলেই আমার হাতটা টেনে নিয়ে যেতে লাগলেন তূর্য। আপুর বোন অথচ কতো পার্থক্য! আপু কতো ভালো আর এই মেয়ের ছেলে দেখলেই গায়ে পড়া স্বভাব। আরিয়ানা আপুর জন্য কষ্ট হচ্ছে আমার। মেয়েটা ও ব্যাথা পেয়েছে খুব ভালো মুখটা দেখেই বুঝা যাচ্ছে। ছোট্ট তিতিশা ফুফিয়ে কেঁদে উঠতেই আপু কোলে তুলে মেয়েটার দিকে এগিয়ে এল। এই মেয়েই তবে তিতিশার সেই আন্টি যে ওনাকে প্রেম নিবেদন করেছেন ।


রুমে এনে আমাকে খাটে বসিয়ে টেবিলের উপর থাকা ল্যাপটপ ফ্লোরে ছুড়ে মারল তূর্য। ভয়ে চুপসে গেলাম আমি।ওনার এরকম রূপ দেখে ভয় যেন আমার শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে। গুটিশুটি হয়ে বসে রইলাম খাটের এক কোণায়। মাথার চুল টেনে তূর্য ও বসে পড়ল খাটে। পা টিপে টিপে ভীরু পায়ে পানির গ্লাস নিয়ে ধরলাম আমি তূর্যর সামনে। মাথা নত তূর্য মাথা তুলে রক্তিম চোখে আমার দিকে তাকালেন। ভয়ে একটু পিছিয়ে যেতেই আমার হাত থেকে গ্লাস নিয়ে নিলেন উনি। পানি খেয়ে গ্লাসটা পাশের টেবিলে রাখলেন। হাফ ছেড়ে বেঁচেছি। আমি তো ভেবেছিলাম উনি পানির গ্লাস টা ছুঁড়ে মারবেন আমার দিকে। আমায় অবাক করে দিয়ে উনি মুচকি হাসলেন। দু হাত টেনে নিজের কোলে এনে বসালেন আমাকে। লজ্জায় কুঁকড়ে গেলাম আমি। হৃদয়ে মনে হলো প্রবল ঝড় উঠেছে। ঘাড়ে থুতনি ঠেকিয়ে বলে উঠলেন তূর্য,,,

— মেয়েটা ভাবীর বোন। নাম অহমিকা। স্বভাব কেমন তা তো দেখলেই। ভাবী ও ওই বেহায়া মেয়ের মাঝে আকাশ পাতাল পার্থক্য। ভাবীর বিয়ের পর থেকেই মেয়েটা অনেক ভাবে আমাকে নিজের প্রতি আকর্ষিত করার চেষ্টা করেছে। লাস্ট ইয়ার তিতিশার বার্থডে তে থাপ্পড় পর্যন্ত মেরেছি সবার সামনে। আমার মন কি আর অন্য কারো জন্য সাড়া দেয় বলো? মন তো কেঁড়ে নিয়েছে এক অনন্যা অনেক আগেই। আশা করি ভুল বুঝবে না। কখনও যদি ভুল বুঝো অথবা অবিশ্বাস করো তাহলে এর পরিণতি একটু ও ভালো হবে না শ্রেয়া।

অজানা ভয়ে মন কেঁপে উঠল সাথে সাথে। অস্ফুটস্বরে জবাব দিলাম,,

–হহহুম,,

আমাকে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন তূর্য। কপালে ভালোবাসার পরশ একে দিয়ে বললেন,,,

–যাও ফ্রেশ হয়ে নাও।

মাথা নেড়ে রুম থেকে বেরিয়ে নিজের রুমে যেতে নিলে চোখে পড়ে অহমিকা আপু কে। কোমড়ে মনে হয় খুব ব্যাথা পেয়েছেন। আরিয়ানা আপু আইস ব্যাগ চেপে ধরে রেখেছেন হাতে। অহমিকা আপুর ভাব ভঙি দেখে মনে হচ্ছে যেন কোনো জলন্ত লাভা ফাটছে। কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই তীক্ষ্ণ চক্ষু নিয়ে আমার দিকে তাকালেন অহমিকা আপু। আরিয়ানা আপু মুচকি হেসে বললেন,,,

–শ্রেয়া তিতিশাকে নিয়ে যাও। দেখো না খুব কাঁদছে। আর হে তূর্য কে ভুল বুঝো না প্লিজ।

আরিয়ানা আপুর কথায় চমকে উঠলাম আমি। যেই ছেলেটা তার বোনকে ব্যাথা দিয়েছে সেই ছেলেরই পক্ষ নিচ্ছেন উনি। দু বোন কিন্তু স্বভাব আচরণে কতো ভিন্নতা। আপুর দিকে তাকিয়ে বললাম,,,

–আপু তেল গরম করে মালিশ করে দিন দেখবেন ব্যাথা কমে গেছে।

কথা শেষ করতে না করতেই চিল্লিয়ে উঠলেন অহমিকা আপু। এতো জোরে গর্জে উঠেছেন যে ছোট্ট তিতিশা ভয়ে আমার কোমর জরিয়ে ধরল শক্ত করে। তিতিশার মাথায় হাত বুলিয়ে অহমিকা আপুর দিকে তাকাতেই তিনি তীব্র রাগ নিয়ে বলে উঠলেন,,,

–ইডিয়ট,,, ফালতু মেয়ে তোমাকে কেউ নাক গলাতে বলেছে? আপু কাজের লোক রাখো অথচ দেখো কি পন্ডিতি করতে এসেছে। এসব মেয়েরা যেখানেই যায় মানুষ কে ফাঁদে ফেলে সবকিছু লুটপাট করে নিতে চায়। এই মেয়েকে তিতিশার জন্য রাখার দরকার নেই। ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দাও।

অহমিকা আপুর কথায় মনে হলো কেউ আমার হৃদয়পটে ছুড়ি বসিয়েছে। কান্না আঁটকে রাখতে চেয়েও পারলাম না। অশ্রুগুলো বেয়ে পড়তে লাগল অঝোর ধারায়।

-ঘাড় ধাক্কা দিয়ে শ্রেয়া কে না তোকে বের করা উচিত। কোমর ভেঙে ও শিক্ষা হয় নি তোর।

কঠিন এ বাক্য শুনেই উপরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম তূর্য দাঁড়িয়ে আছে চোয়াল শক্ত করে।তূর্যর কথায় ভিজে বিড়াল হয়ে গেল অহমিকা। দাঁতে দাঁত চেপে আবারও বলে উঠল তূর্য,,,

—- শ্রেয়া আমার হবু বউ কোনো কাজের মেয়ে না। এ বাড়িতে তোর চেয়ে ও বেশি অধিকার শ্রেয়ার। ফারদার যদি ওকে কোনো প্রকার উল্টো পাল্টা কথা বলেছিস তো তোর বেঁচে থাকাও কষ্টসাধ্য হবে।

কথাটা বলে চলে গেলেন তূর্য। আমিও আর না দাড়িয়ে তিতিশা কে নিয়ে চলে এলাম সেখান থেকে।চোখের জল মুছে পা বাড়ালাম ওয়াশরুমে। মনে মনে ভেবে নিলাম কারো কথায় বা কারো কটুক্তিতে কান দিব না আমি। সত্য একটাই পৃথিবীতে সব মানুষ আমায় তাচ্ছিল্য করলেও তূর্যর কাছে আমি উনার “শুভ্রপরী”। সব অপূর্ণতা আমায় ঘিরে ধরলেও একমাত্র তূর্যর ভালোবাসায় পূর্ণ আমি।

————————————————-

রাত এগারোটা ,,,,

তিতিশার সাথে বসে বসে কার্টুন দেখছি আমি। খারাপ না ভালোই লাগছে। মনে হচ্ছে যেন ফিরে গেছি ছোট বেলায়। আমার কখনও ছোট বেলায় কার্টুন দেখার সুযোগ হয় নি। মা কখনোই টিভি দেখতে দিতেন না। আমি যদি টিভি দেখায় ব্যাস্ত থাকতাম তবে ঘরের কাজগুলো কে করত!!! তিতিশার দিকে তাকিয়ে বুকটা হা হা কার করে উঠল আমার। কি সুন্দর লাগে ছোট বাচ্চাদের! তিতিশার দিকে যতবার তাকাই মন টা জুড়িয়ে যায় আমার। ইচ্ছে করে ফিরে যায় ছোট বেলার সেই জীবনে। তিতিশার মতোই উপভোগ করি নিজের লাইফটা কে। আসলে সময় থাকতে কখনোই আমরা সময়ের মূল্য দিতে জানি না। পরবর্তীতে হায় হুতাশ ছাড়া আর কিছুই থাকে না।না আর ভাবতে পারছি না। আঠারো বছরের জীবনে কঠিন কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছি আমি। জীবনে একবার হারিয়েছি ভালোবাসা। অতীতের সেই বিষাক্ত স্মৃতি গুলো ভেবে আর কষ্ট পেতে চাই না। বর্তমান টা খুশিতে ভরিয়ে তোলাটাই মুখ্য। একজন সার্ভেন্ট এসে আমার পাশে দাড়িয়ে বললেন,,,

–ম্যাম,,তূর্য স্যার আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন ছাদে।

তূর্য ডেকেছে এতো রাতে? কিন্তু কেন? না গিয়ে তো উপায় নেই।পরে দেখা যাবে উনার রাগের দাপটে আমার অবস্থা মর্মান্তিক।

–তিতিশা কে ঘুম পাড়িয়ে দিবেন।

কথাটা বলেই মাথায় ওড়না জরিয়ে চলতে লাগলাম আমি ছাদের দিকে। ছাদের দরজায় এসে দাঁড়াতেই চাঁদের দিকে তাকিয়ে চোখ জুড়িয়ে গেল আমার। চাঁদের আলোয় কি সুন্দর দেখা যাচ্ছে সবকিছু। অর্ধপূর্ণ চাঁদ টা আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে পুরো ছাদে। ছাঁদের কার্নিশ ঘেঁষে পিছন ফিরে আকাশ পানে তাকিয়ে আছে তূর্য। ধীর পায়ে উনার পিছনে গিয়ে দাড়ালাম আমি। পিছন দিকে না মুড়েই বলে উঠলেন,,,

–আজ কি আমার সাথে জোস্না বিলাস করবে শুভ্রপরী? আজ নিজের মন মতো সাজাবো আমি তোমায়। অপরূপ সৌন্দর্যের অধিকারী চাঁদ ও জ্বলবে তোমায় দেখে।

ওনার এই কথাগুলোই যথেষ্ট হৃদয়ে তোলপাড় তোলার জন্য। দৃঢ় কন্ঠে বললাম,,,,

–হুম।

আমাকে পিছন থেকে টেনে সামনে নিলেন তূর্য। মাথার ঘোমটা টা সরিয়ে দিতেই চমকে উঠলাম আমি। জড়তা নিয়ে বলে উঠলাম,,,

–ককককি করছেন?

—হুঁশশ!

হঠাৎ অনুভব করলাম আমার চুলের ভাঁজে কিছু পড়িয়ে দিলেন ওনি। কপালে এসে জিনিসটা ঠেকতেই অজান্তেই হাত চলে গেল কপালে। স্পর্শ করতেই বুঝতে পারলাম টিকলি পড়িয়ে দিয়েছেন। ফুলের টিকলি। কিছু একটা মনে পড়তেই হৃদয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। কানে ও ফুলের দুল পড়িয়ে দিলেন তূর্য। ফুলের সুভাষ নাসারন্ধ্রে পৌঁছাতেই মস্তিষ্ক ধারণ করে নিল এটা বকুল ফুল। বকুল ফুলের মালা। হাতে ও গলায় ও পড়িয়ে দিলেন তূর্য। পড়ানো শেষে আমায় ঘুরিয়ে দাঁড় করালেন ওনার সম্মুখে। ভীষণ অস্বস্তি ও লজ্জায় মাথা নত করে রইলাম আমি। থুতুনি ধরে মুখটা উপরে তুললেন তিনি। তাকাতেই লজ্জায় স্তম্ভিত হয়ে পড়লাম। উনার চোখে মুগ্ধতায় ভরপুর। অন্যরকম নেশার সমাহার। নেশাতুর কন্ঠে বলে উঠলেন ওনি,,,,

–মাশাল্লাহ! বলেছিলাম না একদিন সাজাবো তোমায় বকুল ফুলের মালায়! আমার কল্পনার চেয়ে ও বেশি অপ্সরী লাগছে তোমায়।

সম্মোহন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে কোমরে দু হাত রেখে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলেন আমাকে। দু চোখে চুমু একে দিলেন যত্নসহকারে। দু গালে অধরের ছোঁয়া পেতেই লজ্জা আমায় ঘিরে ধরল ভীষণভাবে। দু হাতে গলা জড়িয়ে ওনাকে ঝাপটে ধরলাম শক্ত করে। ওনার বুকে ঠোটের ছোঁয়া দিতেই কোমর আঁকড়ে ধরে শূন্যে তুলে ধরলেন আমাকে। আতংকিত হতেই উনি মুচকি হেসে বলে উঠলেন,,,

–ভয় নেই জান আমি আছি তো।

ঠোঁট দুটো প্রশস্ত করে ফিল করতে লাগলাম মুহূর্ত টা। নির্মল বাতাস এসে ছুয়ে যাচ্ছে আমাদের শরীরে। শিউরে উঠছি বার বার। অদ্ভুত ভালে লাগা ছেয়ে গেল মন জুড়ে। আমায় শূন্যতে রেখেই উচ্চস্বরে বলে উঠলেন তূর্য,,,,

–বিয়ে করবে আমায় শুভ্রপরী?????????হবে কি বন্দী আমার হৃদ মাঝারে? আমার শূন্য বুকে পূর্ণতা নিয়ে আসবে কি তুমি? শূন্য আমি। অপূর্ণ আমি তোমায় ছাড়া। #তোমাতেই পূর্ণ আমি হতে চাই শুভ্রময়ী কন্যা। তোমাতেই পূর্ণ আমি সর্বদা।

খুশিতে টগবগ হয়ে উঠল আমার ক্লান্ত অবিশ্রান্ত মনটা। চোখে এসে ভিড় জমালো হাজারো অশ্রুকণা। ভালোবাসার মানুষ কে চিরতরে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা সবারই থাকে। পেয়ে ও হারিয়েছি আমি। আর হারাতে চাই না কিছু। ডুকরে কেঁদে উঠলাম আমি। কান্না মিশ্রিত স্বরেই বললাম,,,

— আপনার শূন্য বুকে পূর্ণতা হয়ে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকতে চাই আমি । হতে চাই আপনার অর্ধাঙ্গিনী। আমার এই অপূর্ণ জীবনটা কে পূর্ণতায় ভরিয়ে তুলতে চাই আপনার সাথেই।

অশ্রু কণা গড়িয়ে পড়ল তূর্যর কপাল বরাবর। শূন্য থেকে নামিয়ে নিজের বুকে প্রচন্ড জোরে আমায় আঁকড়ে ধরলেন তূর্য। কেঁদে দিয়েছেন তিনি ও।

–ভালোবাসি শুভ্রপরী। প্রমিজ করো আর কখনও হারিয়ে যাবে না আমায় ছেড়ে।আমায় দমবন্ধকর পরিস্থিতিতে ফেলে আর কখনও উদাসিনী হবে না তুমি।

— কখনও না। আপনার হাতটা ধরেই পার হবে আমার বাকি জীবনটা।

চলবে,,,,

(ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

#তোমাতেই পূর্ণ আমি
#পর্ব -২২
#লেখিকাঃআসরিফা সুলতানা জেবা

ছাদে পাতানো বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে চাঁদ দেখতে ব্যস্ত আমি ও তূর্য। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে চাঁদের সৌন্দর্য বিলাসে মগ্ন চিরকুট লেখক। ওনার দিকে এক পলক তাকিয়ে আমি বলে উঠলাম,,,

–আমি কিছু বলতে চাই তূর্য।

মুখে মুচকি হাসি নিয়ে হাতে মাথা ঠেকিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন তূর্য। চোখে তার স্পষ্ট আমি কি বলতে চাই সেটা শুনতে চায় সে। মনে একটু সাহস জুগিয়ে বললাম,,,

–আমি যা বলব তাতে হয়তো আপনি রেগে যাবেন। তবে আমি চাই অতীতের কিছু বিষাদের স্মৃতি আপনাকে জানিয়েই আপনার সাথে নতুন পথে হাঁটতে ।

চাঁদের আলোয় দিব্যি দেখতে পাচ্ছি তূর্যর মুখে রাগ স্পষ্ট । নিচে রাখা তূর্যর হাতটা কাঁপা কাঁপা হাতে স্পর্শ করলাম আমি। নিমিষেই তূর্যর কঠিন চাহনি মোহনীয় দৃষ্টিতে পরিণত হল ।আমার হাত টা নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নিলেন শক্ত করে। আজ বলতে চায় আমি তূর্য কে আমার জীবনের কষ্ট গুলো। এক চাপা কষ্ট চাপা আর্তনাদ থেকে মুক্তি পেতে চাই আমি। যা কেউ জানে না তা জানার অধিকার আছে তূর্যর। জল গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে। তূর্যর দিকে তাকিয়ে করুন স্বরে বলতে শুরু করলাম,,,,

–বিয়ের প্রথম রাতেই আমি আপনার খালাতো ভাই আভাসের হাতে ধর্ষণ হয়েছি। আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমার সাথে জোর করে সম্পর্ক স্থাপন করা তো ধর্ষনই তাই না?

সাথে সাথেই উঠে বসলেন তূর্য। আমায় টেনে মিশিয়ে নিলেন নিজের বুকে। ওনার মুখের দিকে না তাকিয়েই বুঝতে পারছি কথাটা বড্ড গেঁথেছে ওনার বুকে। হয়তো রক্তক্ষরণ ও হচ্ছে হৃদপিন্ডে। এটাই স্বাভাবিক। যেই মেয়েটা কে নিজের চোখে চোখে রেখেছে, পাগলের মতো ভালোবেসেছে সেই মেয়েটা কে অন্য কেউ কলঙ্কিত করেছে সেটা মেনে নেওয়া হয়তো খুবই কঠিন। বুকে মাথা রেখেই আমি আবার বলতে লাগলাম,,,

—– যেমনই হোক নিজেকে মানিয়ে সংসার করতে চেয়েছি আভাসের সাথে। ওনার মনে আমার জন্য হিংসা ব্যতীত কিছুই ছিল না। রাত দুপুরে মদ খেয়ে বাড়ি ফিরা ছিল ওনার অভ্যেস। বিয়ের পর জানতে পারি সিমথী আপুর সাথে ওনার প্রেমের সম্পর্ক ছিল বহু আগে থেকেই। কিন্তু মা সেটা মেনে নেন নি।কারণ সিমথী আপুর আরো অনেক ছেলেদের সাথে অবৈধ সম্পর্ক ছিল যা কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে রাজি ছিলেন না আভাস। বহু কষ্টে তাকে জোর করে মানানো হয় বিয়ের জন্য। বিয়ে তো ওনি করেন কিন্তু সিমথী আপুর সাথে রাত দিন ঘুরাঘুরি আরো বেড়ে যায়। মনের মাঝে ক্ষোভ নিয়ে নিজের দেহ চাহিদা মিটাতেন ওনি। প্রতিবাদ করতে গেলেই মারধর করতেন আমায়। জানেন,,তখন খুব মনে পড়তো আপনার কথা। মনে হতো আপনি আসবেন আমায় প্রটেক্ট করবেন। কতো যে নিদ্রাবিহীন রাত কাটিয়েছি আপনার স্মরণে তা হিসাব ছাড়া। সারাক্ষণ অপেক্ষা করতাম আপনার চিরকুটের। আশায় থাকতাম শুধু একবার, একবার হলেও যেন আমার নামে কোনো চিরকুট আসে। রাতের আঁধারে লুকিয়ে পড়তাম আপনার ভালোবাসার মাদকতায় ভরপুর পুরোনো চিরকুট গুলো। তিন মাসের মাথায় আমি শত কষ্টের মাঝে ও খুশির ঝলক খুঁজে পেয়েছিলাম। প্রত্যেকটা মেয়েই খুশিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়ে যখন সে জানতে পারে তার গর্ভে বেড়ে উঠছে ছোট্ট একটা প্রাণ। জানেন তূর্য সেদিন প্রেগন্যান্সি কিটে যখন পজিটিভ আসে তখন খুশিতে ওয়াশরুমের দেয়ালে হেলান দিয়ে কেঁদেছিলাম দু ঘন্টা ধরে। ভুলে গেছিলাম সবকিছু। আভাস কে আমি ভালো না বাসলেও আমার গর্ভের সন্তান তো তার। সম্পর্ক যেমনই হোক বাচ্চাটার জন্য আরেকবার সুন্দর একটা জীবন গড়ার প্রত্যাশা ছিল আমার। ভেবেছি আভাস হয়তো জানতে পারলে সব খারাপ পথ ছেড়ে ভালো হয়ে যাবে। শুনেছি সন্তানের জন্য বাজে নেশাখোর ছেলেটাও আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করে। কাউকে না জানিয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম প্রথমে আভাস কেই জানাব। বন্ধুদের সাথে দশ দিনের ট্যুরে চলে যায় আভাস। আসলে তা তো মিথ্যা ছিল। সত্য তো এটা ছিল সিমথী আপু কে নিয়ে দশ দিনের জন্য বান্দরবান ঘুরতে যান ওনি। দশদিন পর যখন ওনি ব্যাক করেন হাসি মুখে ওনাকে সবটা বলতেই কোনো রিয়েক্ট না করে রুম থেকে বেরিয়ে যান । ভাবলাম হয়তো খুব বেশি খুশি হয়েছেন তাই প্রকাশ করতে পারছেন না ঠিক ভাবে। পাঁচ দিন পর আনুমানিক রাত ১ টা বাজে। বিছানায় আভাস কে না পেয়ে চমকে উঠলাম আমি। সিমথী আপুর রুমের সামনে এসে দাঁড়াতেই নিজের সন্তানের জন্য কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছিল আমার। নিজের চোখের সামনে আভাস ও সিমথী কে কিস করতে দেখে মাথায় চড়চড় করে রক্ত উঠে গেল। ওনার থেকে টেনে এনে সিমথী আপু কে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলাম। কষিয়ে থাপ্পড় মারলাম ওনার গালে। কেন জানিনা সেই রাতে আমার সাহস টা বেড়ে গিয়েছিল অনেক। সন্তানের জন্য একবার লড়াই করার ইচ্ছে জাগল আমার মাঝে। চোখে জল গলায় কঠোর ভাব এনে আভাস কে বলে উঠলাম,,,

–এতো নিচ আপনি? সন্তানের জন্য মায়া লাগল না? আমি তো ভেবেছিলাম আপনি খুশি হয়েছেন! ভুল পথ ছেড়ে দিবেন। এতো নিকৃষ্ট মানুষ আমি কখনও দেখি নি। নিজের বউ নিজের অংশ কে ঠকিয়ে পরনারী তে লিপ্ত আপনি! জানোয়ার তো আপনি শুরু থেকেই ছিলেন আজ তা আরো ভালো ভাবে প্রমাণিত করলেন। আমার সন্তানের বাবা হওয়ার যোগ্যতা ও আপনার নেই। এমন জানোয়ার কোনোদিন ভালো হতেই পারে না।

কথাগুলো বলেই থু থু ছুঁড়ে মারলাম ওনার মুখে। আচমকা পিছন থেকে হ্যাঁচকা টানে খাটের উপর ছিটকে পড়লাম আমি। পেট গিয়ে ঠেকল খাটের একদম কোণায়। তখন মনে হচ্ছিল আমার দম কেউ আঁটকে দিয়েছিল খানিক সময়ের জন্য। ব্যাথায় চিতকার করে উঠলাম খুব জোরে। আমি অনুভব করেতে পারছিলাম তূর্য আবার,,আবারও কেঁড়ে নেওয়া হয়েছে আমার সুখের আরেকটা কারণ । মা এসে আমাকে দেখতেই মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন আমার পাশে। আভাস এগিয়ে আসতেই পর পর দুটো থাপ্পড় মেরে ক্ষান্ত হন মা। ড্রাইভারের সাহায্যে আমায় হসপিটাল নিয়ে গেলেন।


লাভ হয় নি তূর্য। ওরা খুন করেছে আমার,,,সসস। বাবা হয়ে পরনারীর জন্য,,,। একটু ও কষ্ট ছিল না ওনার চোখে। আর বলতে পারছি না আমি। তূর্যর বুকের খোলা অংশে আঁকড়ে ধরে কেঁদে উঠলাম চিতকার করে। এতো দিনের জমানো এই কষ্ট টা বলার মতো মানুষ আমি পাই নি। আজ পেয়েছি সঠিক একজন মানুষ। যার ভালবাসায় নেই কোনো সার্থ যার কাছে অনাসয়ে মেলে ধরতে পারি আমি নিজেকে। যাকে বলা যায় সবকিছু নির্দ্বিধায় । যার বুকে মাথা রেখে অশ্রু বিসর্জন দেওয়া যায় আমার জীবনে সেই মানুষ টা তূর্য। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেছে। তূর্যর কোনো নড়চড় নেই । তিনি যেন জমে গেছেন একদম । আমায় জড়িয়ে রেখেছেন শক্ত করে। চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে আসছে সবকিছু। প্রচুর পরিমাণে রাগ জমল আমার মনে। মাথা উঠিয়ে তূর্যর কলার চেপে ধরলাম খুব জোরে। তূর্যর কোনো হেলদোল নেই। কলার টেনে চিল্লিয়ে বলে উঠলাম,,,

—কথা বলছেন না কেন আপনি?????আমার কথা শুনেছেন আপনি?কেন এমন করলেন তূর্য? কেন আসেন নি আপনি? চাচার মোবাইল দিয়ে আমি সেদিন অসংখ্য বার কল দিয়েছি আপনার চিরকুটে লিখে দেওয়া সেই নাম্বারে। কলেজ গেটে বসে কেঁদেছি আমি। এই আপনার ভালোবাসা? এই আপনার আগলে রাখা? খুব তো বড় বড় কথা বলতেন হৃদয় কুঠিরে লুকিয়ে রাখবেন! পেরেছেন?বরং মাঝ পথে একা ফেলে চলে গিয়েছেন। আপনি আসলে তো এমনটা হত না তূর্য। আমাদের তো সুখের একটা সংসার হত তাই না!

কাঁদতে কাঁদতে ঢলে পড়লাম ওনার বুকে। অস্ফুট স্বরে বললাম,,,

–কেন সেদিন বলললেছিলেন মেসেজে,,,আপপপনি ভভভালোবাসেন অন্য কাউকে। আআআআমি কিন্তু এটা বিশ্বাস করি নি তূর্য। বিয়ের দিন ও পালিয়ে এসে আমি দাড়িয়ে ছিলাম কলেজ গেটে আপনার অপেক্ষায়। আপনি আসেন নি। জোর করে মেরে আমমমায় মা বববিয়ে দিয়েছেন। আমমি পারি নি তূর্য। আপনাকে চিনতাম না।ঠিকানা ও জানতাম না যে চলে যেতাম আপনার কাছে।

একসময় নীরব হয়ে গেল শ্রেয়সী। শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে চিতকার করে উঠল তূর্য । কান্নায় ভেঙে পড়ল। তার চিতকারে হয়তো রাতের নিশাচর প্রাণী গুলো ও কেঁপে উঠেছে। শুভ্রপরীর এতো আর্তনাদ এতো কষ্ট কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না সে। প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে তার। কেন সময় এমন এক কঠোর খেলা খেলল ওদের সাথে!! কেন সুখের বদলে বিষাদে ভরিয়ে দিল তার বুকে থাকা মেয়েটার জীবন! এমনটা না হলেও কি পারত না? শ্রেয়সীর শেষ পরীক্ষার দিন সে তো যাচ্ছিল তবে কেন নিয়তি এতটা কঠোর হল।

শ্রেয়সী কে কোলে নিয়ে পা বাড়াতেই আরিয়ানা কে ছাঁদের দরজায় দাড়িয়ে থাকতে দেখল। আরিয়ানা আতংকিত হয়ে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল,,,

–শ্রেয়ার কি হয়েছে তূর্য? আর তোর চোখ মুখ এমন দেখাচ্ছে কেন?

তীব্র লাল হয়ে আছে তূর্যর চোখ। ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলে উঠল,,,

–আমার কলিজা ছিঁড়ে নেওয়ার খেলায় যে নেমেছিল তার জীবনে আগুন লাগিয়ে দিব আমি। তার কাছে নিজের বেঁচে থাকাটাই যন্ত্রণাদায়ক মনে হবে।

কথাটা বলে শ্রেয়সী কে রুমে এনে শুয়ে দিল তূর্য। গালে কান্নার ছাপ পড়ে আছে। অসহ্য যন্রণা এসে বাসা বাধল বুকে।ফুল গুলো খুলে একটা রুমাল ভিজিয়ে মুখটা মুছে দিল তূর্য। কপালে গালে অজস্র স্পর্শ দিয়ে শ্রেয়সীর হাত টা মুঠোয় নিয়ে বলে উঠল,,,

–তোমাকে ছাড়া নিজের ইচ্ছায় একটু ও স্বস্তির নিঃশ্বাস নেই নি আমি শুভ্রপরী। তোমার শরীরে স্পর্শ করার সাধ্য ও ছিল না কারো। কিন্তু,,,। আমি ওই জানোয়ার মেয়ে সিমথী কে কখনও ছাড়ব না।

আর বলতে পারল না তূর্য। হাতে চুমু খেয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এল সে। আরিয়ানা কে রুমের বাহিরে দেখেই বলল,,,ভাবী অহমিকা কোথায়?

আতকে উঠল আরিয়ানা। ভয়ার্ত গলায় বলল,,

–আবার কি হয়েছে তূর্য?

–আপনার বোন কি আমার দুর্বলতার সুযোগ নেই নি ভাবী? যদি নিয়ে থাকে তাহলে তার পরিণাম তো আপনি জানেনই,,,

মুহুর্তেই আরিয়ানা জবাব দিল,,,

–অহমিকা যদি তোকে আর শ্রেয়সী কে আলাদা করার পিছনে জড়িত থাকে তবে ওকে আমি নিজে শাস্তি দিব তূর্য। আমি কখনোই চাই না শ্রেয়সী তোর থেকে দূরে থাকুক। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে তোরা এক হতে পারিস নি। কিন্তু দিন রাত আমি এটাই পার্থনা করি শ্রেয়সী তোর হোক। তোর সাথে সুখে থাকুক।

চলবে,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here