তোমাতেই পূর্ণ আমি #পর্ব -২৩,২৪

0
640

#তোমাতেই পূর্ণ আমি
#পর্ব -২৩,২৪
#লেখিকা -আসরিফা সুলতানা জেবা
২৩

সকালে ঘুম ভাঙল ফোনের ভাইব্রেশনে। ব্যাথায় ও ঘুমের দাপটে চোখ দুটো মেলে তাকানোটা ও নির্মম হয়ে দাড়িয়েছে। ফোন বেজে চলছেই লাগাতার।প্রচুর রাগ হচ্ছে আমার।ইচ্ছে করছে ফোনটা কে ভেঙে চুরমার করে দেই। পাশ থেকে ফোনটা টেনে চোখ বন্ধ রেখেই হ্যালো বলতেই তেতে উঠল প্রিয়ু।

— কটা বাজে জানিস? দশটা বাজে। এতোক্ষণে তোর আমাদের বাড়িতে থাকার কথা। মা ও ভাইয়া বার বার জিজ্ঞেস করছে তুই এখনো কেন আসিস নি! নুসাইবা আপু ও চলে এসেছে সকালেই বেবি নিয়ে আর তুই এখনো পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিস।–ক্রুদ্ধ কন্ঠে কথাগুলো বলল প্রিয়ু।

প্রিয়ুর তেজী স্বর কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই এক লাফে উঠে বসলাম আমি। উড়ন্ত পাখির মতো আমার ঘুমও উড়ে গেল নিমিষেই। আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না যে দশটা বেজে গেছে। প্রিয়ুর কথার কোনো উত্তর না দিয়ে ফোনটা কেটে স্ক্রিনে দৃষ্টি তাক করতেই দেখলাম সত্যি সত্যিই দশটা বাজে। আজকাল কি হল আমার? এতো ঘুম কবে এসে সঙ্গী হল আমার? আজ প্রিয়ুদের বাসায় ছোট খাটো অনুষ্ঠান। আত্মীয় -স্বজন,,বন্ধু -বান্ধবদের মিলন মেলা ও বলা যায়। আন্টি সকাল সকাল উপস্থিত হতে বলেছিল আমায়। কিন্তু আমি তো গাধার মতো ঘুমে ব্যস্ত। মানুষ ঠিকই বলে কান্না করলে ঘুম ভালো হয়। তূর্যর বুকে নিস্তেজ হয়ে পড়েছিলাম। ওনিই হয়তো কোলে করে রুমে শুয়ে দিয়ে গেছেন ভাবতেই এক ঝাঁক অনুভূতি জেঁকে বসল আমার মন পাঁজরে। হুড়মুড়িয়ে বিছানা থেকে উঠতে নিয়ে সোফার দিকে দৃষ্টি পড়তেই হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল বহুগুণ। সোফায় বসে আমার দিকে এক নজরে তাকিয়ে আছেন তূর্য। ঠোঁটের কোণায় মৃদু হাসি বহমান। চুল গুলো ভেজা। হয়তো মাত্রই শাওয়ার নিয়ে আমার রুমে এসেছেন। আমার চোখ দুটোতে দৃশ্যমান অমায়িক স্নিগ্ধতায় ভরপুর তূর্যর সুন্দর মুখ টা। কালো শার্ট টা ওনার সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছেন শতগুণ। এতো সুদর্শন ও কোনো যুবক হয়! মন পিঞ্জিরাতেই আবদ্ধ হয়ে রইল প্রশ্নটা। ওনার সম্মুখে দাঁড়িয়ে এই প্রশ্ন করার অসীম সাহসিকতার অধিকারী যে আমি নয়। সম্মোহন থেকে ফিরে আসতেই অভিশঙ্কায় গাল দুটো লাল হয়ে এল আমার। বিছানা থেকে ওড়না নিয়ে গায়ে দিলাম তাড়াতাড়ি করে। এহেন কান্ডে তূর্যর হাসির বেগ বেড়ে গেল। সোফা থেকে উঠে আমার দিকে এগিয়ে আসতেই উঠে গেলাম আমি। পা বাড়াতেই তূর্য নরম স্বরে বলে উঠলেন,,,

–স্টপ দেয়ার শুভ্রপরী।

থেমে গেলাম ওনার মুখে উচ্চারিত বাক্যটা কর্ণধার হতেই। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমার গালে হাত ছোঁয়াতেই শিহরণ জেগে উঠল সারা দেহে। চোখের পলক ফেলতেই ঠোঁটের ছোঁয়া একে দিলেন অবলীলায়। একটু ঝুঁকে কানের পাতায় চুমু আঁকতেই প্রচন্ড জোরে ঝড় শুরু হল আমার ছোট্ট হৃদপিণ্ডে। পিছিয়ে এলাম আমি। ওনার সামনে দাড়িয়ে থাকা আমার পক্ষে কিছুতেই পসিবল না এ মুহুর্তে। তূর্যর আসক্তি আমায় ঘিরে ধরেছে ভয়ানকভাবে। এমন আসক্তিতে আসক্ত হতে চাই আমি বহুবার। চোখে মাদকতা বিরাজমান। নেশাময় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে পা বাড়াতেই দৌড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলাম আমি। চিল্লিয়ে উঠলেন তূর্য। দুষ্ট স্বরে বলে উঠলেন,,,

–কতক্ষণ থাকবে ওয়াশরুমে? তুমি যতক্ষণ না বের হবে আমি কিন্তু এখান থেকে ও এক পা ও নড়ছি না।

ওনার কথা শুনে মাথা ঘুরে গেল আমার। বলে কি এই ছেলে? পাগল হয়ে গেলেন নাকি! আমাকে আজ সারাদিন ওয়াশরুমে রেখে মেরে ফেলার ধান্দা করেছেন নির্লজ্জ, বেয়াদব তুর্য চৌধুরী! বের হলেই আটকা পড়তে হবে ওনার বাহুডোরে আর না বের হলে আঁটকে থাকতে হবে ওয়াশরুমে।অপরদিকে প্রিয়ুদের বাসায় না গেলে প্রিয়ু একটা চুল ও রাখবে না আমার মাথাতে। এ কোন জ্বালায় পড়লাম রে বাবা! যাই হোক আগে ফ্রেশ হয়ে নেই। মুখ ধুয়ে দরজা টা একটুখানি খুলে মাথা বের করতেই রুমের কোথাও তূর্যর হদিশ পেলাম না। আনন্দে টগবগিয়ে উঠল মনটা। পা চেপে চেপে বের হয়ে কাপড় নিয়ে আবার দৌড় লাগলাম ওয়াশরুমে। গোলাপি ও সাদা রঙে মিশেলে একটা লং কুর্তি পড়ে রেডি হয়ে গেলাম ফটাফট। ড্রয়ার থেকে পার্স বের করতে গিয়ে চোখে পড়ল শুভ্র রঙা একখানা চিরকুট। বিস্মিত হলাম আমি। বিস্মিত নয়নে চিরকুট টা হাতে তুলে নিলাম।

❝ আজ আমাদের হলুদ সন্ধ্যা। তোমার কানে কি কেউ পৌঁছে দিয়েছে এই কথাটা? দেয় নি তো তাই না? আমিই জানিয়ে দিলাম গোধূলি বিকেল,,রক্তিম আকাশ কে স্বাক্ষী রেখে দুজন হাঁটতে চলেছি এক নতুন পথে। আজ বাদেই কাল আমার শুভ্র রাঙা পরী আবদ্ধ হতে চলেছে আমার শূন্য বাহুতে। তৈরি তো তুমি শ্রেয়া? তৈরি না হলেও যে হতে হবে তোমায়। আর কতো অপূর্ণ রাখবে আমায়। পূর্ণতা নিয়ে পদক্ষেপ করো আমার জীবনে,, আমার প্রাণস্পন্দন হয়ে।❞

ধপ করে খাটে বসে পড়লাম আমি। এক ফোঁটা জল ঝড়ে গেল টপ করে। হদস্পন্দন যেন থমকে গেল মুহুর্তেই। বিশ্বাস করতে পারছি না আমি। কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না একটা দিন পেরুলেই সারাজীবনের জন্য তূর্যর হয়ে যাব। মন প্রাণ জুড়ে বয়ে যেতে লাগল প্রশান্তির বাতাস। অশ্রুসিক্ত নয়ন কোনোভাবেই বাঁধ মানতে রাজি নয় আজ। কিভাবে বুঝাব? কাকে বুঝাব আমার মনের হাল! খুশিতে মানুষ কেন কাঁদে তা আজ অনুভব করতে পারলাম। নিজের বহু আকাঙ্ক্ষার অজস্র ভালোবাসার জিনিসটা পেয়ে গেলে খুশির বদলে কান্নাটাই সঙ্গী হয়ে উঠে। আমায় এক মুঠো খুশির ঝলক উপহার দিয়ে কোথায় হারালেন তূর্য? চিরকুট টা হাতে নিয়ে দৌড়ে তূর্যর একদম নিকটে এসে দাঁড়ালাম আমি। আমাদের মাঝে একটু ও ফাঁক নেই। নেই কোনো দূরত্ব। দিক বিদিক ভুলে শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে জরিয়ে ধরলাম তূর্য কে। তূর্য ও আমায় শক্ত করে জরিয়ে ধরে কিছু টা উপরে উঠিয়ে নিলেন। প্রচন্ড হাঁপাচ্ছি তূর্যর গলা জরিয়ে ধরে। আরেকটু উপরে তুলে নিয়ে আমার কপালে কপাল ঠেকালেন তূর্য। নাকে হালকা ঘষা দিতেই আমি হাঁপানো কন্ঠে বলে উঠলাম,,,

–চচচচিরকুটের লিখা গুলো সত্য তূর্য?

–মিথ্যা মনে হচ্ছে বুঝি?–মুচকি হেসে বললেন ওনি।

–উঁহু,, স্বপ্ন মনে হচ্ছে তূর্য। এমন এক সুখের স্বপ্ন যা কখনও দেখি নি আমি। আমি জাগতে চাই না তূর্য। এই স্বপ্ন টা কে আকড়ে ধরে রাখতে চাই। আমি আপনার হতে চাই।

কথাটা বলেই কেঁদে দিলাম আমি। আমায় নিচে নামিয়ে দাঁড় করালেন তূর্য। পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখের পানি গুলো মুছে দিয়ে বললেন,,,

–মেকআপ গুলো কান্নায় বিসর্জন দিয়ে দিলে শ্রেয়া? ইশশ কি করলে এটা?

ওনার এমন রসাত্মক কথায় অভিমানী দৃষ্টিতে তাকালাম আমি। হাসলেন ওনি। মুগ্ধ স্বরে বলে উঠলেন,,,

–তুমি তো মেক-আপ করো নি তবে মুখ কেন ফুলিয়েছ অভিমানিনী?

–আমি মুখ ফুলায় নি তূর্য।

কথাটা বলেই চারদিকে নজর দিতেই চমকে উঠলাম আমি।মুখ হা হয়ে গেল আমার। ডান হাত টা আপনা আপনি চলে গেল মুখে। পুরো ড্রইং রুম সাদা, লাল গোলাপ দিয়ে একদম সাজানো। তার মানে সত্যি সত্যিই আজ হলুদ সন্ধ্যা। ড্রইং রুমে কেউ নেই। কেউ থাকলে আজ ইজ্জতের ফালুদা হয়ে যেত শিওর। খুশিতে আত্মহারা হয়ে ভুলেই গেছি কোথায় অবস্থান করছি। আমার ওড়নাটা টেনে নিয়ে ঘোমটা দিয়ে দিলেন তূর্য। কন্ঠে দৃঢ়তা এনে বললেন,,,

–ড্রাইভার নিয়ে যাবে তোমায় প্রিয়ুদের বাসায়। সাবধানে যেও। প্রিয়ুর সাথেই থাকবে। প্রিয়ু ফোন দিয়েছিল আমায়। এখানে কিছু অ্যারেঞ্জমেন্ট শেষ করে দুপুরের দিকে যাবো আমিও আয়ুশ। নিজের খেয়াল রাখবে।

–ওকে।

গাড়িতে এসে বসতেই তূর্য হাত টা ধরলেন আলতো করে। মুচকি হেসে বললেন,,,

–মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট কথা। কারো বাঁকা কথায় কান দিবে না শ্রেয়া। জানোই তো পাছে লোকে কিছু বলে।

তূর্যর কথার পরিপ্রেক্ষিতে হাসলাম আমি। মাথা দুলিয়ে বুঝালাম একদমই কান দিব না কারো কথায়। বরং কানে তুলো গুঁজে রাখব নয়তো জবাব দিব বিনয়ের সাথে।

———————————–

প্রিয়ুদের বাসায় ঢুকতেই চোখ কপালে উঠে গেল আমার। প্রিয়ুর আত্মীয় স্বজন কেউ বাদ আছে কিনা আসার সন্দেহ হচ্ছে। প্রিয়ুর ফুফাতো মামাতো ভাই বোন সব আড্ডায় মত্ত সাথে শিহাব ভাই ও। আমাকে দেখেই দৌড়ে এল প্রিয়ু। প্রিয়ুর হাত ধরে সবার কাছে গিয়ে সালাম দিতেই মুখ তুলে তাকালেন শিহাব ভাইয়া। ওনাকে দেখে কিছুটা চমকালাম। অনেক পরিবর্তন হয়েছে ওনার চেহারায়। পড়ার সুবাদে জাপানে ছিলেন প্রায় চার বছর। প্রিয়ুর ফুফাতো মামাতো ভাই বোন সবাইকেই আমার চেনা। নুসাইবা আপুর বিয়েতেই পরিচয় সবার সাথে। সবাই একসাথে সালামের জবাব দিলেন। শিহাব ভাইয়ার দিকে দৃষ্টি পড়তেই লক্ষ্য করলাম ওনি অপলক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে। ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম আমি।ওনার এই চাহনি অজানা নয় আমার।আমাদের মেয়েদের একটা বিশেষ গুণ হল কেউ আমাদের দিকে কেমন নজরে তাকাই তা দিব্যি বুঝতে পারি। শিহাব ভাইয়ার অবলোকন বুঝেছি চার বছর আগেই। ওনার মনে যে আমায় নিয়ে অনুভূতি জমে আছে তা আমি বুঝতে পারলেও মেনে নেওয়ার উপায় ছিল না। ওনাকে প্রিয়ুর ভাইয়া ছাড়া অন্য কিছু কখনও ভাবতেই পারি নি আমি। শুকিয়ে যাওয়া গলায় জিজ্ঞেস করলাম,,,,

–কেমন আছেন ভাইয়া?

— বেঁচে আছি।–দৃঢ় কন্ঠে বলে উঠলেন শিহাব ভাইয়া।

হেঁসে উঠল সবাই। শিহাব ভাইয়া উঠে আমায় জায়গা করে দিলেন বসার জন্য। মলিন হেসে বসে পড়লাম আমি।


নুসাইবা আপুর সাথে আড্ডা দিলাম এতোক্ষণ। ওনার বেবি টা বেশ কিউট। একদম গুলু মুলু। আন্টি সবার জন্য লেবুর শরবত বানিয়ে নিয়ে যেতে লাগলেন। ওনার হাত থেকে ট্রে টা নিয়ে যেতে লাগলাম প্রিয়ুদের বাড়ির বা দিকটায়। ওইদিকে পুকুর পাড়ে খুব সুন্দর করে ঘাট বানানো। সেখানেই আড্ডা দিতে ব্যস্ত সবাই। প্রিয়ুদের বাড়ির এই পুকুর টা কখনোই ভরাট করে নি প্রিয়ুর বাবা। ঠান্ডা বাতাস শান্তির এক স্থান। কে চাইবে এতো সুন্দর জায়গাটা নষ্ট করতে! আকস্মিক শিহাব ভাইয়া রাস্তা অবরোধ করে দাঁড়ালেন। শিহাব ভাইয়া এসে সামনে দাঁড়াতেই ভয়ে হাত ফসকে ট্রে টা পড়ে যেতে নিলে ধরে নিলেন ওনি। একজন কে ডেকে শরবতের ট্রে তার হাতে ধরিয়ে আমার উদ্দেশ্যে বললেন,,,

–তোমার সাথে আমার কথা আছে শ্রেয়সী।

—কককি কথা ভাইয়া?

–ভয় পাচ্ছো?

–নননা।

—মনে আছে ছোট বেলায় খুব ভয় পেতে আমায়?

–হহহুম।

— ভয়ের জন্যই কখনো আমার চোখের ভাষা পড়তে পারো নি তাই না?–তাচ্ছিল্য স্বরে কথাটা বলে উঠলেন শিহাব ভাইয়া।

অবাক হলাম আমি। ওনার প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতেই আবারও বলে উঠলেন,,,

—- বিয়ে কেন করে নিলে শ্রেয়া? জানো তোমার বিয়ের কথা শুনে কতোটা ক্ষত হয়েছিল আমার হৃদয়ে? তুমি তো আমার মনের কথাই বুঝো নি।

–আআআপনাকে আমি ভাইয়ের নজরেই দেখতাম।

রেগে গেলেন ওনি। তেড়ে এলেন আমার দিকে। ক্ষোভ নিয়ে বললেন,,,

–আমি কখনো তোমাকে ছোট বোনের নজরে দেখি নি। আর হারিয়ে ফেলে ও ফিরে পাওয়া আরেকটা সুযোগ ও হারাতে চাই না আমি। আমি তোমায় বিয়ে করতে চাই শ্রেয়া।

❝বাহ্!!! আজ আমাদের হলুদ সন্ধ্যা অথচ আমার হবু বউকে বিয়ের প্রস্তাব । আমি কিন্তু বউ দিচ্ছি না। বউ আমার প্রাণের চেয়ে প্রিয়। ❞

চক্ষু দুটো স্থির হয়ে গেল আমার। সামনেই সাবলীল ভঙ্গিতে দাড়িয়ে তূর্য। ভয়ে কাঁপতে লাগলাম। শিহাব ভাইয়া কে আবার কিছু করবেন নাতো? কিন্তু আমার ভয় কে উড়িয়ে দিয়ে শিহাব ভাইয়ার সাথে হাত মিলালেন তূর্য। আমাকে এক হাতে নিজের সাথে জরিয়ে নিলেন ওনি। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে ওনার বাহুতে আঁটকে রইলাম আমি। আয়ুশ ভাইয়া ও পাশে এসে দাড়ালেন সাথে প্রিয়ু। রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে শিহাব ভাইয়ার আখিদ্বয়। ভীষণ টেনশন হচ্ছে ওনার জন্য। ওনি যদি তূর্যর ব্যাপারে একটু ও জানতেন তবে চোখ দুটো তোলার ও সাহস পেতেন না। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বললেন তূর্য,,,

— আজ আমাদের জীবনের নতুন একটি ধাপ। কাল থেকে তূর্যর অর্ধাঙ্গিনী রূপে চিনবে সবাই শ্রেয়া কে। রাতে চলে আসবে সবাই বাড়িতে। হুট করেই যেহেতু বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি তাই হুট করে হাজির হয়ে যেও সবাই। আরেকটা কথা দোয়া করো সবাই কেউ যেন আর আমার পিঞ্জিরার পাখিকে কেঁড়ে নেওয়ার সাহস না পায়। তাহলে রক্তাক্ত হতে বেশি সময় লাগবে না তার।

ঠান্ডা কন্ঠে হুমকি! বাহ্!! শিহাব ভাইয়া কিছু না বলে চলে গেলেন সাথে সাথেই। প্রিয়ু এসে ঝাপটে ধরল আমাকে। আয়ুশ ভাইয়া হেসে বললেন,,,

–বলেছিলাম না খুব শীগ্রই পরিবর্তন হতে যাচ্ছে তোমার জীবন। এবার হারিয়ে যেও না। আমার কলিজার বন্ধু টা কে দম বন্ধ পরিস্থিতিতে রেখে নিরুদ্দেশ হয়ে যেও না। কংগ্রাচুলেশনস জেরি।

এক মিনিট ও স্থায়ী হলেন না আয়ুশ ভাইয়া। প্রিয়ু কে সাথে নিয়ে চোখের পলকেই পালিয়ে গেলেন। কিন্তু ওনার চোখের কোণে চিকচিক করা পানি টা আমার নজর এড়ায় নি। ভালোবাসা সার্থপরের রূপ কেন ধারণ করে? কেন যাকে পাব না তাকেই মন দিয়ে বসি আমরা?ভালেবাসা কাউকে কাদায় তো কাউকে সুখের পরশ দেয়। প্রিয়ু ও আয়ুশ ভাইয়া কে ধুকে ধুকে মরতে দিব না আমি। একদিন সুখী হবেন দুজন।শুধু বাকি একটু প্রচেষ্টা যা আমাকেই করতে হবে। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে তূর্যর দিকে তাকালাম আমি। হাতটা ধরে বললাম,,,

—চলুন না বিয়ের শপিং করতে যাই।

চলবে,,,,

#তোমাতেই পূর্ণ আমি
#পর্ব -২৪
#লেখিকা -আসরিফা সুলতানা জেবা

গায়ে হালকা গোলাপি কালারের জামদানী শাড়ি। মাথায় সাদা গোলাপের টিকলি। কানে সাদা গোলাপের দুল। মাথায় গোল্ডেন পাড়ের শুভ্র রঙের ওড়না দিয়ে ঘোমটা দিয়ে রাখা। সবকিছু গোলাপি ও শুভ্রতায় ভরপুর। অদ্ভুত না?কেউ কি কখনও হলুদে এমন সাজ সাজে? সিম্পলের মাঝে এই সাজ টাই নিজেকে নিজের কাছে শুভ্রময়ী এক কন্যা মনে হচ্ছে। অদ্ভুত শিহরণ জাগছে মনে। লাল শাড়ি পরিহিতা প্রিয়ু বসে আছে আমার পাশে। লাল রঙে রাঙানো প্রিয়ু কে অপরূপ সৌন্দর্য ভর করেছে। আচ্ছা আয়ুশ ভাইয়া কি এক নজর ও দেখেছে প্রিয়ু কে? যদি দেখে থাকে তবে কি একটুও অনুভূতি জাগ্রত হয়েছে ওনার হৃদয়ে? হাতে টান পড়তেই আলতো হেসে তিতিশার দিকে দৃষ্টি দিলাম আমি। সাদা লেহেঙ্গায় পিচ্চি তিতিশাকে রাজকন্যা দেখাচ্ছে। রাজকন্যাই তো! এ বাড়ির সকলের চোখের মণি। তূর্যর ছোট্ট মা তিতিশা চৌধুরী। একটু ঝুঁকে কপালে চুমু খেলাম আমি। খুশিতে লাফিয়ে উঠল তিতিশা। আমার গালে চুমু খেয়ে হাসি দিয়ে বলে উঠল,,,

–তোমাকে খুব কিউট লাগছে মিস। চাচ্চু কতো খুশি হবে তোমাকে পেয়ে। আমি না তোমাকে চাচ্চুর মোবাইলে দেখতাম। চাচ্চু কতো লাকী আমার সুন্দর মিস চাচ্চুর বউ হবে।

লাকী তোমার চাচ্চু নাকি এই বিধবা মেয়ে তিতিশা বেবী? তোমার চাচ্চুর তো কপাল পুড়ল। অত্যাধিক হ্যান্ডসাম তূর্য চৌধুরীর কপালে শেষ পর্যন্ত ফালতু একটা বিধবা মেয়ে!

ঘরে ঢুকতে ঢুকতে কথাটা বললেন অহমিকা আপু। কথাটা শুনতেই অসহনীয় যন্ত্রণা হতে লাগল মনে।জল গুলো ও বেরিয়ে আসতে চাইছে চোখ ছাপিয়ে। কাঁদব না আমি কোনোভাবেই কাঁদব না। কারো কথায়,,, কারো কটুক্তিতে ও তূর্য থেকে দূরে থাকব না আমি। বহু কষ্টে আঁটকে রাখলাম দলা পাকিয়ে উঠা চোখের জল গুলো।প্রিয়ু তেড়ে যেতে নিলে ওর হাতটা চেপে ধরলাম আমি। দৃঢ় কন্ঠে বললাম,,,

–আজকে অন্তত না প্রিয়ু। যে যাই বলুক তূর্যই আমার কাছে সবকিছু। যার সাথে আমি বাঁচব তার তো কোনো প্রবলেম নেই তাই না?বরং সে তো আমার ঢাল। আমার তূর্য হলেই চলবে কোনো হিংসা বিদ্বেষ আমি চাই না।

একটু হাসল প্রিয়ু। পাশে বসে এক পাশ দিয়ে আমায় জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। অহমিকা আপু তীক্ষ্ণ ঘৃণিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই আরিয়ানা আপু রুমে প্রবেশ করলেন। একটু রাগ নিয়ে বলে উঠলেন,,,,

–উল্টো পাল্টা কিছু করিস না অহমিকা। তখন তূর্যর হাত থেকে আমিও তোকে বাঁচাতে পারব না।

কথাটা বলতে দেরি কিন্তু অহমিকা আপুর তীব্র রাগ নিয়ে বের হতে একটু ও বিলম্ব করলেন না। তপ্ত একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে আমার দিকে তাকালেন আরিয়ানা আপু। মুখে হাসি নিয়ে বলে উঠলেন,,,

–আমি কখনও এমন ব্রাইড দেখি নি। আজ প্রথম হলুদে কাউকে এমন সাজে দেখলাম। তূর্যর পছন্দ আছে। বাই দ্যা ওয়ে,,,, তূর্য কি দেখেছে তার শুভ্রপরী কে?

রুমে উপস্থিত সবাই একসাথে বলে উঠল,,,,,–এখনও দেখে নি। দেখলে বোধহয় বিয়েটা আজই করে ফেলবে। লজ্জায় নুয়ে গেলাম আমি। তাদের তো আর বলতে পারি না আমার চিরকুট লেখক এতোটাও অধৈর্য্য না। হঠাৎ অনুভব করলাম সবকিছু একদম নিরব। কি হলো?কারো শোরগোল আওয়াজ নেই কেন? মাথা তুলতেই বুকটা ধুক করে উঠল প্রচন্ড জোরে । শীতল স্রোত বয়তে লাগল হৃদয়ে। একদম সাদা পাঞ্জাবি তে আমার সামনে বসে আছে এক অতি সুদর্শন যুবক। মুগ্ধতায় ভরপুর চোখ তার। মুখে ফুটে আছে চমৎকার এক হাসি। নিজেকে ফিকে লাগছে ওনার সৌন্দর্যের কাছে। চোখে মুখে লজ্জা নিয়ে আমি তাকাতেই উনি হাতটা বাড়িয়ে দিলেন আমার দিকে। নিজের ডান হাত টা ওনার হাতে রাখতেই দাঁড়িয়ে পড়লেন উনি। টেনে দাঁড় করালেন আমাকেও। তাল সামলাতে না পেরে বুকে হাত ঠেকাতেই আমাকে উল্টো ঘুরিয়ে কাঁধের দিকে ওড়নাটা সরাতেই আঁতকে উঠলাম আমি। মানুষ টা কে নিজের চেয়ে ও বেশি বিশ্বাস করি আমি কিন্তু লজ্জা যে আমায় ছাড়তে রাজি নয়। হাত মুঠো করে চোখ খিঁচে দাঁড়িয়ে রইলাম। কাঁধে আঁচড়ে পড়ছে গরম নিশ্বাস যা ক্রমশ কাঁপন সৃষ্টি করছে শরীরে। গলায় কিছু একটা পড়াতেই চমকে উঠলাম আমি। তাকিয়ে দেখলাম একটা চেইন । তাতে খুব সুন্দর একটা লকেট। খুব সুন্দর করে মাঝ বরাবর TS অক্ষর। কানের পাতায় ওনার ঠোঁটের স্পর্শ পেতেই আমার পেটে বিচরণ করা হাত দুটোর উপর খামচে ধরলাম খুব জোরে। সাথে সাথেই আরো গভীর ভাবে আলিঙ্গন করে নিলেন আমাকে। ঘোর লাগা কন্ঠে উচ্চারিত করলেন,,,,

—আমার দেওয়া তৃতীয় উপহার শুভ্রপরী। মানুষ বিয়ের রাতে উপহার দেয়। কিন্তু আমি সবসময় ব্যতিক্রম হয়ে থাকতে চাই তোমার স্মৃতির পাতায়।

ওনার কথাগুলো কেমন ঘোরে ডুবিয়ে দিল আমাকেও। আসলেই ওনি ব্যতিক্রম আমার জীবনে যাকে চাইলে ও কখনো ভুলা সম্ভব নয়। আকস্মিক আমাকে কোলে তুলে নিলেন তূর্য। ভয়ের চোটে ওনার গলা জরিয়ে ধরলাম অনেক শক্ত করে। ঠোঁট দুটো কাপছে অনবরত। কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,,,

–কককোলে কেন নিলেন?

–নিচে যেতে হবে না?(মুচকি হেসে)

ওনার মুখে এমন প্রশ্ন শুনে অক্ষিকোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। কি বলছেন ওনি?কোলে তুলে নিয়ে নিচে যাবেন? কি ভাববেন সবাই? আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই তূর্য বেরিয়ে এলেন রুম থেকে। সিঁড়ির কাছে আসতেই একত্রে চিল্লিয়ে উঠল সবাই। অতিরিক্ত লজ্জা- সংকোচ ঘিরে ধরল আমাকে। এক সেকেন্ড ও সময় নিলাম না তূর্যর বুকে মুখ লুকাতে। মুচকি হাসল তূর্য।

—কত কাল মুখ লুকিয়ে রাখবে লজ্জায়?

তূর্যর এমন কথায় ওনার বুকে মুখটা ঘষে আরো ভালোভাবে লুকিয়ে নিলাম।


বাহিরে বাগানের দিকটায় স্টেজ করা হয়েছে। বেশি আত্মীয় স্বজন বলা হয় নি। ছোট খাটো অনুষ্ঠান। কাছের সব বন্ধু-বান্ধবদের বলা হয়েছে। হুট করেই বিয়ের আয়োজন তাই সবাইকে বলার সুযোগ আর হয়ে উঠে নি। আমাকে স্টেজে বসিয়ে দিয়ে গায়েব হয়ে গেলেন মিষ্টার তূর্য সাহেব। হলুদ তিনি আমায় সবার আগেই দিয়েছেন বদ্ধ সেই রুমে লকেট পড়ানোর সময়। খালি পেটে ওনার হাতের বিচরণের উদ্দেশ্য ছিল আমায় হলুদ ছোঁয়ানো। একে একে সবাই হলুদ ছোঁয়ালেন আমায়। ছেলে বলতে তূর্যর কয়েকজন ফ্রেন্ড। আমার কাছের বলতে মিহি, প্রিয়ু ও প্রিয়ুর ফ্যামিলি। মা কে ফোন দিয়েছিলাম কিন্তু নাম্বার বন্ধ। আর সেখানে যেতে ও নিষেধ করে দিয়েছেন মা। বিধবা অপয়া মেয়ের চেহারা দেখতেও রাজি নন তিনি। শিহাব ভাইয়া আসেন নি। প্রিয়ু ও আংকেল আন্টিই এসেছেন। কেন আসেন নি সেটা বুঝতে পারলেও কিছু যে করার নেই আমার। মিথি আপু ও ফুহাদ ভাইয়া আমাকে হলুদ পড়িয়ে নেমে যেতেই আয়ুশ ভাইয়া এসে বসলেন কিছুটা দূরত্ব রেখে। চোখ ছলছল অথচ ঠোঁটের কোণে হাসি। কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেললাম আমি। ধরা গলায় বলে উঠলেন,,,

–আমি তোমায় হলুদ ছোঁয়াব না জেরি। তোমাকে স্পর্শ করার অধিকার আমার নেই। কিন্তু আমি তোমায় একটা জিনিস দিতে চাই। ভার্সিটিতে তোমাকে প্রথম বার দেখার পর যতটা না মুগ্ধ হয়েছিলাম তার চেয়ে ও বেশি মুগ্ধতা ভর করেছিল আমায় রাস্তায় কান্নারত একটা মেয়েকে দেখে।

চোখ ফিরিয়ে আয়ুশ ভাইয়ার দিকে তাকালাম আমি। অবাক হলাম খুব বেশি। আলতো হেসে তিনি আবারও বলতে লাগলেন,,,,

— হুম। রাস্তার সাইডে বসে কাঁদছিলে তুমি। কারো কান্না মিশ্রিত চেহারা যে এতো মায়াবী হয় এটা সেদিন তোমায় না দেখলে কখনও অনুভব করতে পারতাম না আমি। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেও সেদিন মন ভরে নি আমার।ইচ্ছে করেছে তোমায় অশ্রুকণা নিজ হাতে মুছে দেই আমি আর আগলে নিয়ে বলি তুমি কখনও কাঁদবে না জেরি। তোমার এই চেহারা দেখলে যে আমার মতো অন্য ছেলেরা ও ঘায়েল হবে অনায়েসে। মনে আছে একদিন তোমাকে রাতের আঁধারে এগিয়ে দিয়েছিলাম বাসা পর্যন্ত? তখন আমি পুরো ডুবে গিয়েছিলাম তোমার ভালোবাসায়। তখনও আমি জানতাম না তুমিই তূর্যর শুভ্রপরী। তূর্য তোমার কথা বললেও কখনও তোমাকে দেখার সুযোগ হয়ে উঠে নি আমার। নবীন বরণ এর দিন যখন তোমার পায়ে তূর্যর দেওয়া পায়েল টা দেখেছি ক্ষত বিক্ষত হয়ে গিয়েছিল আমার হৃদপিণ্ড। পায়েল টা কিনার সময় আমি সাথে ছিলাম। তূর্যর ব্যবহার, তোমার পায়ে সেই পায়েল সব মিলিয়ে আমার বুঝতে একটু ও কষ্ট হয় নি তুমিই সেই আবেদনময়ী যে তূর্যর হৃদয় স্পর্শ করেছে অনেক আগেই। বাদ দেয় সব কথা তবে আমার একটা রিকুয়েষ্ট আছে জেরি।

আয়ুশ ভাইয়ার কথাগুলো শুনে খুব কষ্ট হচ্ছে আমার। কি রিকুয়েষ্ট করবেন ওনি?

–ভয় পেও না। তোমার কিছু করতে হবে না।আমি একটা রিং কিনেছিলাম তোমার জন্য। আসলে আম্মুর সাথে অলংকার দোকানে গিয়ে রিং টা নজর কেঁড়েছিল আমার। সাথে সাথে মনের চক্ষুতে ভেসে উঠেছিল তোমার ছবি। তুমি রিং টা নিলে আমি অনেক শান্তি পাব জেরি। নিবে তো?

রিং এর বক্সটা ওনি বাড়িয়ে দিলেন আমার দিকে। জড়তা নিয়ে সামনে তাকাতেই দেখলাম তূর্য হাসি মুখে দাড়িয়ে। চোখের ইশারায় বুঝালেন রিং টা নিতে। আয়ুশ ভাইয়ার হাত থেকে রিং টা নিয়ে আঙুলে পড়লাম। চোখে জল মুখে তৃপ্তির হাসি নিয়ে চলে গেলেন আয়ুশ ভাইয়া। আয়ুশ ভাইয়া যেতেই এগিয়ে এলেন তূর্য। কোমরের এক পাশে হাত রেখে টেনে নিলেন একদম নিজের কাছে। বুকে হাত রেখে বিস্মিত চোখে তাকাতেই কপালে ঠোঁটের স্পর্শ দিলেন ওনি। ক্যামেরা বন্দী হল বিস্মিত এই মুহুর্তটা।
————————————————

রাত দুটো বাজে,,,

প্রোগ্রাম শেষ হয়েছে কিছুক্ষণ আগেই। প্রিয়ু আর আরিয়ানা আপুর নাচ দেখে মুগ্ধ আমি। আরিয়ানা আপু একদম পারফেক্ট একটা মেয়ে।এতো ভালে নাচতে পারেন ওনি যে দেখবে সেই মানুষই মুগ্ধ হতে বাধ্য। গরমে ঘেমে একাকার অবস্থা। প্রিয়ু ফ্রেশ না হয়েই ঘুমে মগ্ন। এই মেয়ে এমনই একদম বেপরোয়া। নিজের খেয়াল পর্যন্ত রাখে না। শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে এলাম আমি। বিছানায় এপাশ ওপাশ করেও ঘুম আমার চোখে ধরা দিতে রাজি হল না। কি আর করার? হঠাৎই একটা আইডিয়া আসল মাথায়। তূর্য নিশ্চয় এখনো ঘুমান নি। চট করে উঠে চলে এলাম কিচেনে। দু কাপ চা বানিয়ে রওনা হলাম ওনার রুমের দিকে। দূর থেকেই দেখলাম দরজা হালকা চাপানো। তার মানে ওনি ঘুমোন নি। খুশিতে লাফিয়ে উঠল মনটা। ঘুম যেহেতু আসছে না তার চেয়ে ও ভালো কিছু সময় আড্ডা দেওয়া যাবে ওনার সাথে।
দরজার কাছে এসে থমকে গেলাম আমি। পা দু’টো কাঁপতে লাগল অনবরত। চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠল পুরোনো এক স্মৃতি। আবারও আমার সাথেই,,,,,। না এটা ভুল।চোখের দেখা ভুল হতে পারে। চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল গাল বেয়ে। পুরো পৃথিবী টা ঘুরে গেল আমার। চোখের সামনে তূর্য কে পিছন থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জরিয়ে আছে অহমিকা আপু। আয়নায় দৃশ্যমান তূর্যর অগ্নি আখিঁদ্বয়। ফর্সা চেহারা লাল আকার ধারণ করে আছে। হাত মুঠো করে চোয়াল শক্ত করে দাড়িয়ে আছেন ওনি। আমার হাত থেকে চায়ের কাপগুলো পড়ে প্রচন্ড শব্দ সৃষ্টি করে উঠল। বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে গেলাম আমি। রাগে রি রি করছে আমার সাড়া শরীর। তূর্য কেন চুপ করে আছেন? কান্নার বেগ বেড়ে গেল হুট করে। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে তূর্য কে আটকাতে গেলে ওনি চোখ রাঙিয়ে তাকালেন আমার দিকে । এতো রাগ!!!! ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে এল আমার। ভয়ের কারণ হলো অহমিকা আপুর গলায় ছুড়ি চেপে ধরলেন তূর্য। হুংকার দিয়ে বলে উঠলেন,,,,

— তোকে আজ মেরেই ফেলব। বেহায়া মেয়ে তোর সাহস কি করে হলো আমায় পিছন থেকে জরিয়ে ধরার? এই তোর সতিত্ব আছে নাকি বিসর্জন দিয়ে দিয়েছিস? মেয়েদের অলংকার তার সতীত্ব আর তুই আমার গায়ে ঢলে পড়িস! ভালোবাসিস আমায় তাই না?তাহলে মরে যা। আমি চাই তুই মরে যা। এতটুকু তো করতে পারবি আমায় ভালোবেসে তাই না?

অহমিকা আপু থরথর করে ঘামছেন। ভয়ে ওনার অবস্থা খারাপ। আমি বার বার থামাতে চাইছি তূর্য কে কিন্তু তিনি যেন আরও ভয়ংকর হয়ে উঠছেন। তীব্র রাগ নিয়ে ওনি বললেন,,,

— আমার ভালোবাসা কেঁড়ে নিতে চেয়েছিলি তুই। আমার শ্রেয়শী কে কেঁড়ে নিতে চেয়েছিলি। লোক ঠিক করে মারার প্ল্যান করেছিলি ওকে হলুদের রাতে তাই না?তুই তো জানিস না তূর্য মরে যাবে কিন্তু তার শ্রেয়সীর বিন্দুমাত্র ক্ষতি হতে দিবে না।

চমকে উঠলাম আমি। অহমিকা আপু আমায় আজ মারার প্ল্যান করেছিলেন?তূর্য ছুরিটা আরেকটু চেপে ধরতেই ভয়ে চিল্লিয়ে উঠলাম আমি। আমার চিল্লানোতে আরিয়ানা আপু,,প্রিয়ু সবাই রুমে এসে উপস্থিত হলেন। তূর্যর হাত থেকে ছুরি টা নিয়ে নিলেন তোহাশ ভাইয়া। রক্তিম চক্ষু নিয়ে আমার দিকে তেড়ে আসলেন তূর্য । চোখ বন্ধ করে মনের মাঝে জমায়িত ক্ষোভ নিয়ে বলে উঠলাম,,,

–কেন আপনি এতো রেগে যান তূর্য? মেরে ফেলবেন আপনি? রাগের মাথায় কি করতে যাচ্ছিলেন আপনি এসব?

— ঐ মেয়ের সাহস কি করে হল আমার জীবন থেকে তোমাকে সরানোর চেষ্টা করার?

—আজ আপনি এতো ক্ষেপে গেলেন অথচ সেদিন আপনি কোথায় ছিলেন তূর্য? কোথায় ছিল আপনার ভালোবাসা? কোথায় ছিল আপনার এতো পাগলামি? ছেড়েই তো দিয়েছিলেন মাঝ রাস্তায়। –চিল্লিয়ে বলে উঠলাম আমি।

রাগ আর ভয়ের চোটে কথাগুলো বলে বসলাম আমি। হুঁশ আসতেই বুঝতে পারলাম একদম ঠিক করি নি আমি। কি বললাম এসব? তূর্য আমায় খুব ভালোবাসেন।খুব বেশি। আমি কেন বললাম এসব!!! বুক ফেটে যাচ্ছে আমার। রুমের সবাই একদম নির্জীব হয়ে আছে। তূর্যর দিকে তাকাতেই আঁতকে উঠল আমার মন। রক্তচক্ষু পানিতে টলটল। হাত বাড়িয়ে ওনাকে ছুঁতে যেতেই বাঁধা দিলেন ওনি। পিছিয়ে গেলেন আমার কাছ থেকে কয়েক কদম। কন্ঠে রাগ ও অভিমান নিয়ে বলে উঠলেন,,,,

—ভালোবাসায় বিশ্বাস টাই প্রথম জানিস তো? তোকে ভালোবেসে আমি কষ্ট বাদে আর কিছুই পাই নি। তবুও আমি তোকেই চাই। এতোটাই ভালোবাসি আল্লাহ ব্যতীত কারো সাধ্য নেই তোকে আমার কাছ থেকে কেঁড়ে নেওয়ার। যেই ছেলেটা তোকে ছাড়া স্বস্তির নিঃশ্বাস পর্যন্ত নিতে পারে না তাহলে তোকে কিভাবে ছেড়ে দিতে পারে বল? পৃথিবীতে সব মানুষই এক চিলতে সুখ চায়। আমিও চেয়েছি তোর মাঝে। আমার এক চিলতে সুখ তোর মাঝে নিহির্ত। তাহলে সুখ আঁকড়ে না ধরে আমি কেন দুঃখ নিয়ে বেঁচে থাকতে চাইব বল? তোকে ছাড়া তো বাঁচতে পারব না কিন্তু তোর মুখের কথাগুলো শুনার পর এক বিন্দুও শান্তিতে থাকতে পারব না। বুকের বা পাশ টাই রক্তক্ষরণ হচ্ছে শ্রেয়সী। প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে আমার। আজ হয়তো সত্যি সত্যিই হারিয়ে যাব। ছেড়ে দিয়ে যাব তোকে মাঝ রাস্তায়।

কথাগুলো বলে এক দন্ড ও দাড়ালেন না তূর্য। হন্তদন্ত হয়ে বেড়িয়ে গেলেন রুম থেকে। কান্নায় ভেঙে পড়লাম আমি। ঢলে পড়লাম ফ্লোরে। আরিয়ানা আপু এসে ধরতেই আপুর দিকে অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকালাম।

–ওনি হারিয়ে যাবেন আপু। আমি কেন বললাম এসব? ওও আপু আমার মাথা ঠিক ছিল না। আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম ওনার এতো রাগ দেখে। মনে হয়েছে যদি ওনি অহহহমিকা আআপু কে মেরে ফেলেন! কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছে আমার। মরে যাব আমি ওনাকে ছাড়া। ওনি হারিয়ে যাবেন। কি করব আমি? প্লিজ নিয়ে চলো আমায়।

–তোহাশ গেছে ওর পিছু পিছু। তুই টেনশন করিস না। তূর্য তো সব রাগের মাথায় বলেছে। ওও তোকে খুব ভালোবাসে শ্রেয়া। তোকে ছাড়া এক দন্ড ও বাঁচবে না ও। আগে ও কখনও তোকে ছাড়ে নি তূর্য।

প্রিয়ু ও আপু মিলে ফ্লোর থেকে তুলে খাটে বসালেন আমায়। কিছুই ভালো লাগছে না আমার। কেন যেন মনে হচ্ছে খুব খারাপ কিছু হতে চলেছে। আরিয়ানা আপু আমার পাশে বসে বলে উঠলেন,,,

—তোকে আজ কিছু কথা বলতে চাই আমি। কান্না থামা প্লিজ। তুই কষ্ট পাবি বলে তূর্য কাউকে বলতে নিষেধ করেছিল। কথাটা হাতে গুণা কাছের কয়েকজনই জানে। তূর্য কেন তোর বিয়ে আটকায় নি এতো মাস কোথায় ছিল সব বলব আমি। তার আগে আমায় ক্ষমা করে দিস অহমিকার জন্য। ভেবেছিলাম ভালে হয়ে যাবে। কিন্তু ও যে এমন কিছু করবে কল্পনা ও করতে পারি নি আমি। এতো নিকৃষ্ট আমার বোন ভাবতেই বুকটা ফেটে যাচ্ছে আমার।

–তোমার কোনো দোষ নেই আপু। প্লিজ তুমি ক্ষমা চাইবে না। আমি ভুল করেছি আপু।

দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ছাড়ল আরিয়ানা।

————
পরিবারের প্রত্যেক টা মানুষই জানত তূর্য একটা মেয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। তূর্যর মতো এতো কঠিন আর স্ট্রং পারসোনালিটির মানুষ একটা মেয়ের জন্য দিন রাত পাগলামি করছে, ছুটে যাচ্ছে মেয়েটা কে এক পলক দেখার জন্য তা জেনে বাবা-মা,, আমরা সবাই চরম অবাক হয়েছিলাম। আমরা যখন জানতে পারলাম যেমন তেমন প্রেম নয় চিরকুট প্রেম করছে তূর্য অবাকের শীর্ষ পর্যায়ে চলে গিয়েছিলাম সবাই । বাবা তো সারাক্ষণ বলত কবে দেখাবি আমার ছোট বউ মা কে। তূর্য বাবার খুব আদরের ছিলেন। তিনি যখন জানতে পেরেছেন ওনার গম্ভীর,,,বদমেজাজী ছেলে এক মেয়ের জন্য পাগলপ্রায় পুরো বাড়িতে সব কাজের লোক কে মিষ্টি খাইয়েছেন ওনি। কারণ বাবার ধারণা ছিল তূর্য কখনও কোনো মেয়ের প্রেমেই পড়বে না৷। সারাক্ষণ তোহাশ কে বলত তুই তো লাভ মেরিজ করে নিলি কিন্তু আমার গুণধর, রাগী ছোট ছেলেটা কে যে কোন মেয়ে বিয়ে করবে। বাবা বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন তোর সাথে দেখা করার জন্য। বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু তূর্যর একটাই কথা একদম শেষ পরীক্ষার দিন বাবা কে নিয়েই তবে সামনা সামনি হবে তার ভালোবাসার মানুষের। তূর্যর কথাই অটল রইল। কারণ সে তার প্রেয়সীর পড়ালেখায় বিঘ্ন ঘটাতে রাজি ছিল না। আমরাও অপেক্ষার প্রহর গুণতে লাগলাম পরীক্ষা শেষ হবার। অবশ্য তোর ছবি দেখেছিলাম মোবাইলে। আর তূর্যর রুমের দেয়ালে তো তোর অনেক বড় ছবিই আছে।

আপুর কথায় সাথে সাথে দেওয়ালে তাকিয়ে দেখলাম বিশাল বড় ফ্রেমে বন্দীনি আমি। নুসাইবা আপুর বিয়ের অনুষ্ঠানে লাল ড্রেস পড়ে গিয়েছিলাম আমি। এটা সেইদিনেরই পিক। কিন্তু পিকটা কে তুলল? এসব ভাবতে পারছি না আর। আপু বলেছেন তূর্যর বাবা-মা আছেন তবে তারা কোথায়?

–বাবা-মা কোথায় আপু?

—নেই শ্রেয়া। বাবা নেই। মা আছেন কিন্তু,,,বাদ দেই সেসব কথা। (হতাশ কন্ঠে বললেন আপু)

বাবা মারা গেছেন ভাবতেই মনটা কেঁপে উঠল। আমাকে দেখার এতো আশা ছিল ওনার। দেখেছিলেন আমায়? কি হয়েছিল পাঁচ মাস আগে? সবকিছু এখন এতো এলেমেলো কেন?

–তুই তূর্যর জন্য শেষ পরীক্ষার দিন অপেক্ষা করছিলি তাই না? তূর্য ও সেদিন বাবা কে সাথে নিয়ে ছুটে গিয়েছিল তোর মুখোমুখি হতে। তোকে ও বাবাকে দেওয়া কথা রাখতে।কিন্তু,,,

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here