#তোমাতেই পূর্ণ আমি
#পর্ব -২৫,২৬
#লেখিকাঃআসরিফা সুলতানা জেবা
২৫
❝তিন মাস পনেরো দিন কোমায় ছিল তূর্য❞
জমে বরফ হয়ে গেলাম আমি। হাত পাও কেমন অসার হয়ে পড়েছে। চোখের পানিগুলো ও যেন নিষ্ঠুর হয়ে গেল। একদম কান্না পাচ্ছে না আমার। বরং শ্বাস আঁটকে আসছে। মনে বার বার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে আরিয়ানা আপুর বলা বাক্যটা। অতি শোকে মানুষ পাথর হয়ে যায়। আমার বেলায় ও কি তা ঘটছে! দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে আমার ভিতরটা অথচ চোখে এক ফোঁটা অশ্রুর চিহ্ন ও নেই। তূর্য কোমায় ছিলেন এটা মনে পড়তেই যেন বুক টা হাহাকার করে উঠছে। নীরবতা ছেয়ে গেল চারদিকে। গভীর রাতের আঁধারে যেন আমি আমার জীবনে ধেয়ে আসা অন্ধকার দেখতে পাচ্ছি। না আমার সহ্যশক্তি নেই আর। আমি হাসতে চাই ভালো থাকতে চাই তূর্যর সাথে।
আরিয়ানা আপু দীর্ঘ একটা শ্বাস ছেড়ে আবারও বলতে শুরু করলেন,,,,
~সেদিন যাওয়ার পথে তূর্য ও বাবার খুব ভয়ানক এক্সিডেন্ট হয়। গাড়িটা ব্রেক ফেইল ছিল। এক্সিডেন্টের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে ছিলাম সবাই। হসপিটালেই পৌঁছাতেই জানতে পারলাম বাবা আর নেই। তূর্যর অবস্থা ও ভালো না। বাঁচার চান্স ছিল না। ডক্টর রা জানান বেচে গেলেও তূর্য হয়তো কোমায় চলে যাবে। মাথার আঘাত টা ছিল গভীর। মস্তিষ্কে আঘাত হানে। সত্যিই তাই হল। সেদিন আর তোর কাছে পৌছানো হল না বাবা আর তূর্যর। বাবার আশা টা আশা-ই থেকে গেল চিরতরের জন্য। তূর্যর অবস্থা ও বাবার মৃত্যু আমরা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না।শোকের ছায়া নেমে এল পুরো পরিবারে। এতো কিছুর মাঝে আমরা একদম ভুলে গেলাম তোর কথা। ভাগ্য এতোটাই খারাপ যে তূর্যর মোবাইল টা পর্যন্ত সেদিন বাড়িতে ফেলে গিয়েছিল। তিন মাস পর যখন তূর্য সুস্থ হয় সাথে সাথেই ছুটে গিয়েছে তোর কলেজের ঐ দারোয়ান চাচার কাছে। ওনাকে তো পেলেনই না বরং জানতে পারল ওনি মারা গেছেন। তোদের বাড়ির এড্রেস ও তূর্য জানত। সেখানে গিয়েও তোকে পায় নি। তোরা নাকি বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে চলে গেছিস। পাগল হয়ে গিয়েছিল তূর্য। দিন রাত শুধু তোর খোঁজে বাহিরে বাহিরে থাকত। লোক পর্যন্ত লাগিয়ে রেখেছিল। রাতের আঁধারে কাঁদত ছেলেটা। নিজেকে বন্দী করে রাখত অন্ধকার রুমে। আভাস মরে যাওয়ার ঠিক পনেরো দিন আগে তূর্যর মোবাইলে ফোন এসেছে কে যেন তোকে দেখেছে হসপিটালে একটা ছেলের সাথে। ফোন পাওয়া মাত্রই তূর্য ছুটে গিয়েছিল সেখানে। নিজের খালাতো ভাইয়ের সাথে তোকে দেখতে পেয়ে থমকে গিয়েছিল তূর্য । কোনোভাবেই সে বিশ্বাস করতে পারছিল না তুই আভাসের বউ। আভাসের বিয়েতে আমাদের কারোই যাওয়া হয় নি। আর ওর বিয়েটা ও খালামণি হুট করেই ঠিক করেছিল। তূর্যর রক্ত টগবগিয়ে উঠেছিল তোকে আভাসের বউ হিসেবে দেখে। বাসায় এসে ঘরের সবকিছু ভাঙচুর করছিল। তোহাশ আটকাতেই ওকে জরিয়ে ধরে কেঁদেছিল তূর্য। বড় ভাইয়ের কাছে আবদার করেছিল তোকে এনে দিতে। কিন্তু তা কি আর সম্ভব ছিল?অন্যের বউ হয়ে গিয়েছিলি তুই। অন্য কারো বউ কি আর কেঁড়ে নিয়ে আসা যায়? পারি নি আমরাও পারি নি তূর্যর আবদার টা রাখতে। তারপর থেকে নিজেকে অন্ধকারে রাখতেই ভালোবাসতো তূর্য। তোর ব্যাপারে খোঁজ ও রাখত। যাকে আমরা নিজের চেয়ে ও বেশি ভালোবাসি সেই মানুষ টা যদি অন্য কারো ও হয় তবুও আমরা তাকেই ভালোবেসে যায়। ভালোবাসা কি এতোটাই ঠুনকো হয় যে সময়ের স্রোতে অথবা মানুষ টা অন্য কারো হয়ে গেলেও আমরা ভুলে যাব তাকে? পারে নি তূর্য ও কখনও পারে নি তোকে ভুলতে বরং ওর ভালোবাসায় পাগলামি বেড়ে গিয়েছিল শতগুণ। তোর হাসবেন্ড থাকা সত্ত্বেও ও আড়ালে তোর খেয়াল রাখার তোকে ভালোবাসার দায়িত্ব টা পালন করে যাচ্ছিল ।শুধু নিজেকে হারিয়ে বসেছিল তোকে হারানোর সাথে সাথেই। শান্তি, সুখ কখনও আর ধরা দেয় নি তূর্যর জীবনে। কিন্তু তোর বিরুদ্ধে হাজারো ক্ষোভ জমা হয়েছিল তূর্যর মনে। তাই নিজের ক্ষোভ রাগ দমিয়ে রাখতে না পেরে ভার্সিটিতে খারাপ বিহেভ করেছে। তুই গাড়িতে হাত দিয়েছিলি বলে গাড়ি ভাঙে নি। গাড়ি ভেঙেছে কারণ তার অজান্তেই তার শুভ্রপরীর গায়ে কাঁদা ছিটকে পড়েছে। সব রাগ মিটিয়েছে গাড়িটা ভেঙে। আভাস মারা যাওয়ার দিন ও তূর্য যায় নি। তোকে সামনাসামনি দেখলে নিজের রাগ টা বেড়ে যাবে সবার সামনে কিছু করে বসবে তাই না গিয়ে নিজেকে বন্দী করে রেখেছিল চার দেয়ালের মাঝে।
।
।
আভাস কে তো তূর্যই খুন করতে চেয়েছিল যেদিন জানতে পেরেছে তোকে রেখে পরনারী তে মত্ত সে। তোহাশ আটকে রেখেছিল বহু কষ্টে। কিন্তু দেখ তূর্যর আর খুনই করতে হয় নি তার আগেই আল্লাহ ওকে শাস্তি দিয়েছে।অতিরিক্ত নেশার কারণে হারাতে হয়েছে নিজের জীবন। হার্টে ইনফেকশন হয়ে মারা গেল । আসলে একটা কথা কি জানিস? যে নিজের প্রিয় জিনিস টা হারায় সে বুঝে কেমন কষ্ট হয়,,কেমন যন্ত্রণা হয়। আর কেউ অপ্রত্যাশিত অন্য কারো মূল্যবান জিনিসটা পেয়েও কদর না করে ফেলে রাখে অবহেলায়। আভাস বুঝে নি তোর প্রায়োরিটি। আর তূর্য প্রতিনিয়ত চোখের জল ফেলেছে তোকে হারিয়ে। এখনও বিশ্বাস হয় না শ্রেয়া যেই ছেলে জীবনে অনেক কঠিন পরিস্থিতি ফেইস করে ও এক ফোটা অশ্রু গড়ায় নি চোখ থেকে সেই ছেলেটা একটা মেয়ের জন্য চোখের জল বিসর্জন দিয়েছে। আল্লাহ হয়তো তূর্য কে তোকে পাওয়ার আরেকটা সুযোগ দিয়েছিল। নিজেকে কিছু টা গুছিয়ে নেয় তূর্য। তোকে ভার্সিটি তে প্রিয়ুর বাবা ভর্তি করিয়ে দিয়েছে? না ওনি করান নি বরং ওনাকে দিয়ে কাজ টা করিয়েছে তূর্য। প্রিয়ুর বাবা আমাদের অফিসের ম্যানেজার। তূর্যর কথা মোতাবেক সবকিছু করেন ওনি। চাইলে তোকে জোর করে নিজের কাছে আনতে পারত। কিন্তু তূর্যর ইচ্ছে ছিল ধীরে ধীরে আবারও নিজের শুভ্রপরী কে নিজের করে নিবে। তূর্যর ভালোবাসায় আঙুল তুলে ঠিক করিস নি শ্রেয়া কিন্তু আমি জানি ও কষ্ট পেলেও তোকে ছাড়বে না। ওর অস্তিত্বে মিশে গেছিস তুই।
আপুর কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে রইলাম আমি। নিয়তি কেমন তিক্ত খেলা খেলল আমাদের সাথে! আমাদের দু জনের জীবনে ভয়ংকর প্রলয় ডেকে আনল। অন্ধকারে ডেকে দিল আমাদের জীবন টা। অন্ধকার যেমন আছে তেমন আলো ও তো আছে!! রাতের পর যদি দিন হয় নতুন এক ভোরের সূচনা হয় তাহলে আমারও তূর্যর জীবনে কেন নতুন ভোরের আগমন ঘটবে না? ভাগ্য যখন আমাদের দু’জন কে আবারও কাছাকাছি টেনে এনেছে তাহলে কেন দূরে দূরে অবস্থান করছি আমরা? তূর্যর চেয়ে বেশি কখনও কেউ আমাকে ভালোই বাসতে পারবে না। কখনও না। তূর্যর ভালোবাসা সার্থহীন। আমার ভালোবাসা খুবই নগন্য ওনার ভালোবাসার তুলনায়। নতুন এক ভোর চাই নতুনভাবে নিজেকে পূর্ণ করতে চাই। তূর্য কে চাই। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস অব্দি আপনাকেই চাই তূর্য।
এক মুহূর্ত ও বসলাম না আমি। দৌড়ে চলে এলাম ছাদে। পিছন থেকে নিজের সবটুকু শক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরলাম ওনাকে। পিঠে মাথা হেলিয়ে কান্নামিশ্রিত স্বরে এক নিঃশ্বাসে বলে উঠলাম,,,
–ভালোবাসি তূর্য। খুব ভালোবাসি আপনাকে। আমি জানতাম আপনি এখানেই থাকবেন। দয়া করে হারিয়ে যাবেন না। আমাকে ক্ষমা করে দিন প্লিজ। রাগের বশীভূত হয়ে আমি ভুল বাল বকে ফেলেছি। কিন্তু আপনাকে ভুল বুঝি নি। কখনও ভুল বুঝি নি।
আমার হাত টা টেনে সরিয়ে দিলেন তূর্য। চোখ দুটো টকটকে লাল হয়ে আছে ওনার। আমি অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকাতেই চোখ ফিরিয়ে নিলেন তিনি। নিঃশব্দে বিনা বাক্যে আমার হাত টা টেনে নিয়ে যেতে লাগলেন নিচে। নিচে এসে ড্রইং রুমে এক বৃদ্ধ লোক কে দেখে খুব অবাক হলাম । আরিয়ানা আপু,,,প্রিয়ু,,, আয়ুশ ভাইয়া সবাই একদম চুপচাও বসে আছে। তিতিশা আপুর কোলে বসে বুকে মাথা রেখে ঘুমে মগ্ন। রাত তিনটা বাজে। গভীর রাতে নীরবতার বদলে ড্রইং রুমে মানুষের সমাহার। আমাকে টেনে নিয়ে সোফায় বসালেন তূর্য। নিজেও বসে পড়লেন আমার পাশে। বৃদ্ধ লোকটার দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে বলে উঠলেন,,,
—শুরু করুন কাজী সাহেব।
চমকে উঠলাম আমি। তূর্যর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতেই ওড়না টা ভালো করে মাথায় দিয়ে বলে উঠলেন,,,
—কবুল বলতে দেরি করবে না ওকে?
বিস্মিত হয়ে পড়লাম। কি হচ্ছে এসব? এতো রাতে কাজী? এমনভাবে বিয়ে? আবার বলছে অতি বিলম্বিত না করে কবুল বলে দিতে!!! কাজী সাহেব কবুল বলতে বললে বিস্ময়কর দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকালাম আমি। সবাই যেন তূর্যর পক্ষেই। এতো রাতে এমন করে বিয়ে কেমন জড়তা ঘিরে ধরছে আমায়। তূর্যর তীক্ষ্ণ রাগান্বিত চক্ষু শেষ মেশ কবুল বলতে বাধ্য করল আমায়। তূর্য একটু ও সময় নিলেন না কবুল বলতে। আলহামদুলিল্লাহ বলে প্রিয়ু সবাই কে মিষ্টি মুখ করাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কে বলবে একটু আগে তুফান হয়েছে এ বাড়িতে!! আর অদ্ভুত ভাবে বিয়েতে ও কতটা খুশি সবাই। কাজী সাহেব কে এগিয়ে দিতে গেল আয়ুশ ভাইয়া। তোহাশ ভাইয়া ও চলে গেলেন রুমে। প্রিয়ুর সাথে আমি চলে যেতে নিব তখনি খেয়াল করলাম তূর্য আমার হাত টা ধরে রেখেছে। হেসে দিল প্রিয়ু ও আরিয়ানা আপু।
–ওকে ছেড়ে দে তূর্য। কাল তো বিয়ের অনুষ্ঠান। সাড়ে তিনটা বেজে গেছে এখন না ঘুমোলে অসুস্থ হয়ে পড়বে মেয়েটা।
–শ্রেয়া আমার সাথে আমার রুমে ঘুমাবে ভাবী। বিয়ে করেছি এখন বউ আমার সাথেই থাকবে। বউ ছাড়া এক মুহূর্তও চলবে না আমার।
বিনা লজ্জা সংকোচে তূর্যর বলা কথা শুনে বিষম খেলাম আমি । মারাত্মক লোক তো ওনি। মুখে কি কিছুই আটকায় না? লজ্জা ও কি আমার মতো করে ওনাকে ঘিরে ধরে না? ওনি তো পুরোই লজ্জাহীন যাকে সংক্ষিপ্ত রূপে বলা হয় নির্লজ্জ। মারাত্মক,, ভয়ংকর,, বেয়াদব তূর্য চৌধুরী আমার স্বামী ভাবতেই হৃদয়টা কেঁপে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। আরিয়ানা আপু ও প্রিয়ু হেসে চলে গেল। এই হাসি এনে দিল আমার মনে ভীষণ অস্বস্তি।
।
।
বাধ্য বউয়ের মতো ওনার পিছন পিছন রুমে আসলাম আমি। ওনি দরজা লাগাতেই বুকটা কেঁপে উঠল ভীষণ জোরে। নিজের এক হাত দিয়ে অন্য হাত খামচে ধরলাম আমি। গলা শুকিয়ে কাঠ। লজ্জায় কেমন নুইয়ে নুইয়ে পড়ছি। আমার দিকে সম্মোহিত ভাবে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে তূর্য। পা দু’টো ফ্লোরে আঁকড়ে ধরলাম আমি। একদম কাছে এসে দাঁড়াতেই হার্ট বিট হতে লাগল প্রচন্ড গতিতে । ওনার গরম নিশ্বাস চোখে মুখে আঁচড়ে পড়তেই খিঁচে বন্ধ করে নিলাম চোখ। ওমা একি হলো!!! মুখে গরম নিশ্বাস অনুভব করছি না কেন? অজস্র ভয় ও বুকের ধুকপুকানি নিয়ে চোখ মেলে দেখি তূর্য নেই। কোথায় গেলেন? পিছন ফিরতেই হতবাক আমি। কি সুন্দর করে বিছানায় শুয়ে ঘুমে ডুবে গেছেন নির্লজ্জ তূর্য সাহেব। কিছু সময়ের ব্যবধানেই ঘুমিয়ে গেলেন? বিশ্বাস হচ্ছে না। একটু পরীক্ষা করে দেখা যাক। ওনার একদম নিকটে গিয়ে মুখের সামনে হাত নাড়াতেই হাত টা জোরে চেপে ধরলেন তিনি। চোখ বড় বড় করে তাকাতেই বলে উঠলেন,,,
–বিয়ে করেছি বলে কি সুযোগ লুটে নিবে নাকি শুভ্রপরী? বিয়ে তো করলাম তোমায় নিজের খাঁচায় বন্দী করতে। তাই বলে কি নিজের ইজ্জতের বিসর্জন দিতে হবে এবার ? নো নেভার।
ওনার কথা শুনে মাথা ঘুরে গেল আমার। ছি!! কিসব বলছেন ওনি!!কি লজ্জাজনক কথা বার্তা! হাত টা ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই হাতে টুপ করে একটা চুমু খেয়ে নিলেন। ঝিকে উঠল সারা শরীর।
–আমি ইজ্জতের রফাদফা করব মিথ্যা অপবাদ দিলেন অথচ নিজেই আমার ইজ্জতহরণ করতে উঠে পড়ে লেগেছেন।
কথাটা বলতে দেরি কিন্তু তূর্যর আমাকে নিজের উপর টেনে নিতে একটু ও দেরি করলেন না।
—আমি তোমার ইজ্জতহরণ করব তাই না?( শান্ত কন্ঠে)
—না না আমি তো বলছিলাম তূর্য ভাইয়া আমার ইজ্জত অনেক মূলললল্যবান। ( কাঁপা কাঁপা গলায়)
ভয়াবহভাবে গর্জে উঠলেন তূর্য। চোখ রাঙিয়ে বললেন,,,
–বাসর রাতে আমাকে ভাই ডাকার অপরাধে টানা এক ঘন্টা কান ধরে দাড়িয়ে থাকবি।
এবার বোধহয় বেহুশ হয়েই যাব। সারারাত এক ফোঁটা ও ঘুমায় নি। এখন চোখে ঘুম ভর করেছে কিন্তু তিনি বলছেন কান ধরে দাড়িয়ে থাকতে। তূর্য যা ভয়ংকর। ওনি যা বলেছেন তাই করতে হবে। ওনার উপর থেকে উঠে অসহায় চোখে তাকালাম আমি।
–কোনো লাভ নেই। অসহায় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালে চোখ দুটো খুলে ফেলব এখনই।
হুমকি!!! কত্তো খারাপ আপনি আমায় হুমকি দিচ্ছেন? তূর্যর জান প্রাণ তূর্যর শুভ্রময়ী কে হুমকি দিচ্ছেন! মনের কথা মনে রেখেই কান ধরে দাড়িয়ে পড়লাম আমি। মুখ ফুলিয়ে তূর্যর দিকে তাকাতেই দেখলাম মিট মিট করে হাসতে ব্যস্ত বেয়াদব ছেলে।
~এমনকি কখনো হয় বিয়ের প্রথম রাতেই রোমান্সের বদলে কান ধরে দাড়িয়ে থাকতে হয় বউ?
তূর্যর এমন জ্বালাময়ী হাস্যরসাত্মক প্রশ্নে ঠোঁট ভেঙে কেঁদে দিলাম আমি। ভ্রু কুঁচকে তড়িঘড়ি করে বিচলিত হয়ে কোলে তুলে নিলেন তূর্য। বিছানায় শুয়ে আমাকে নিজের বুকে টেনে নিতেই এক গাল হেসে বলে উঠলাম,,,,
–এমনকি কখনও হয় বাসর রাতে শাস্তির ভয়ে অভিনয় করে বউ?
অগ্নি দৃষ্টি নিবদ্ধ করল আমার দিকে তূর্য। চোখ মেরে ওনার বুকে মুখ লুকাতেই নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিল আমাকে। কানের কাছে দৃঢ় স্বরে বলে উঠলেন,,,
~❝ হাজারো অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে
আমার শুভ্রপরী বন্দী হয়েছে আজ আমার বাহুডোরে। ❞
চলবে,,,,
#তোমাতেই পূর্ণ আমি
#পর্ব -২৬
#লেখিকাঃআসরিফা সুলতানা জেবা
~উঠে পড়ো জান। আজ নতুন সাজে সাজতে হবে তোমায়।
কানের কাছে মুগ্ধতা মেশানো সুরেলা আওয়াজ ভেসে আসতেই পিট পিট করে পলক ঝাঁপটিয়ে চোখ মেলে তাকালাম আমি। নয়ন জোড়ায় ফুটে উঠল তূর্যর স্নিগ্ধ চেহারা। হাটু গেঁড়ে বসে আছেন তিনি আমার একদম কাছাকাছি। এক পাশ হয়ে তূর্যর দিকে ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে মুচকি হাসলাম।
–মিষ্টি হাসি হেসে আমার হৃদয়ে ক্ষত করার ধান্দা বাদ দাও শ্রেয়া। তোমাতে ঘায়েল হয়েছি আমি বহু আগেই। আর কতো ক্ষত করবে হৃদয়ে?
তূর্যর মুচকি হেসে বলা কথাটা শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকালাম আমি। অভিমানী কন্ঠে বলে উঠলাম,,,
–আমি আপনার হৃদয়ে ক্ষত করেছি?আপনি এমনটা বলতে পেরেছেন তূর্য?
–করেছ তো। বহু আগেই ক্ষত করেছ আমার হৃদপিণ্ডে। ক্ষত তো শুকায়নি বরং গভীর হচ্ছে ধীরে ধীরে।
কথাটা বলেই কপালে এক গভীর স্পর্শ দিলেন ওষ্ঠদ্বয়ের। মানুষ টার মুখটা দেখলে মনে হয়ে কোনো দিন কোনো কষ্টই ছিল না আমাদের অতীতে। শত কষ্টে পেয়েও কত মুগ্ধতা ভরপুর তার হাসিতে। আসলেই আপনি স্ট্রং তূর্য। খুব স্ট্রং। আমার ভাবনার মাঝেই আমাকে টেনে তুলল তূর্য। হতভম্ব হয়ে ওনার দিকে তাকাতেই ইশারা করলেন পিছন ঘুরে দাঁড়াতে। বিস্ময়কর দৃষ্টিতে সামনের দিকে ঘুরে দাড়িয়ে পড়লাম। পিছন থেকে চুল গুলো একটু উঁচু করে খোঁপা করে দিলেন তূর্য। ছলছল করে উঠল দু চোখ। ওনার ভালোবাসা কেয়ার গুলো হৃদয় নাড়িয়ে দেয়। মাথায় চুমু খেয়ে মিষ্টি স্বরে বললেন,,,
–চট করে ফ্রেশ হয়ে চট করে নিচে চলে এসো বউ।
“বউ” শব্দ টা শুনে ভেতর জুড়ে শুরু হল ভয়াবহ তোলপাড়। মনে হচ্ছে কোনো স্বপ্নের রাজ্যে বাস করছি। আজ সত্যিই আমি ওনার বউ। শত অপেক্ষা,কষ্টের প্রহর কাটিয়ে শত বাঁধা পেরিয়ে এক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি দু জনে। মুচকি হেসে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালাম আমি। তূর্য নিচে চলে গেলেন।
।
।
ডাইনিং টেবিলে নাস্তা করতে ব্যস্ত সবাই। হঠাৎ নজরে পড়ল খুব সুন্দর একজন মহিলা কে। বাদামি রঙের তাঁতের শাড়িতে অসম্ভব সুন্দর লাগছে ওনাকে। চেহারা ও ভীষণ সুন্দর। কিছুতেই আমার মস্তিষ্ক ধারণ করতে পারছে না ওনার পরিচয়। ডাইনিং টেবিলে বসে আমাদের সাথে নাস্তা করছে নিশ্চয়ই তূর্যদের কাছের কেউ হবে। তূর্যর দিকে তাকিয়ে দেখলাম কেমন চোয়াল শক্ত করে আছে। ব্যাপার কি একটু আগেই তো হাসি খুশি ছিলেন! আধা ঘণ্টার মাঝে কি এমন হল যে এভাবে রুড হয়ে আছেন! আরিয়ানা আপু মহিলা টা কে বেশ বিনয়ের সাথে নাস্তা দিচ্ছেন। আড়চোখে মহিলাটার দিকে তাকালাম। আশ্চর্য ওনি তো আমার দিকেই চেয়ে আছেন। এতো নিরিবিলি কেন?তোহাশ ভাইয়া ও এক নাগাড়ে নিজের নাস্তা করে যাচ্ছেন। সবকিছু কেমন ভুতুড়ে ভুতুড়ে লাগছে। কে বলবে এটা বিয়ে বাড়ি!! আচমকা মহিলা টা আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,,,
–তুমি তূর্যর বউ? শাশুড়ী কে সালাম না করেই খেতে বসে পড়লে?
নিস্তব্ধ হয়ে পড়লাম আমি। উনি তূর্যর মা। আরিয়ানা আপু চোখের ইশারায় হ্যাঁ বুঝাল। দাড়িয়ে পড়লাম আমি। নরম স্বরে বলে উঠলাম,,,
–আসসালামু আলাইকুম মা। ক্ষমা করবেন। আসলে আমি আপনাকে,,,
রাগান্বিত চোখে আমার দিকে তাকালেন তূর্য। ওনার চাহনিতে কথাগুলো গলায় আটকে গেল। নাস্তার প্লেট টা ঠেলে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন ওনি। চোয়াল শক্ত করে রাগী কন্ঠে বলে উঠলেন,,,
–আমার বউ হয়ে তুমি অন্য কারো কাছে মাথা কেন নত করছো শ্রেয়া?
–ওওওনি আপনার মা তূর্য।
ফুঁসে উঠল তূর্য। ওনার দিকে ঘৃণিত নজরে তাকিয়ে স্পষ্ট স্বরে বললেন,,,
–আমার মা নেই শ্রেয়া। আমার আর তোহাশ ভাইয়ার মা মরে গেছে। ফারদার ঐ মহিলা কে আমার মা বলে দাবি করবে না। নিজের শাশুড়ী ও ভাববে না। ওনি আমার বাবার সেকেন্ড ওয়াইফ ছিলেন।
তূর্যর কথায় বিস্ফোরিত নয়নে চেয়ে রইলাম। ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বললাম,,,
—- সম্পর্কে তততো মমমা হয় তূর্য।
এক প্রকার তাচ্ছিল্য করে হাসলেন ওনি। মুখ ফিরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,,,
–সম্পর্কে মা হলে ও ওনি কখনও মা হয়ে উঠতে পারেন নি শ্রেয়া। বাবা ওনাকে আমাদের জন্য বিয়ে করে আনলেও ওনি তো বাবার টাকার জন্য বউ হয়ে এসেছিলেন। আমাদের ছেলে হিসেবে কখনও মানতেই পারেন নি ওনি।
তূর্যর কথা শুনে চুপ হয়ে রইল সবাই। আরিয়ানা আপু একটু ইতস্তত করে বলল,,,
–থাক না তূর্য। আজ তোর বিয়ে এসব কথা বাদ দে।
হাসল তূর্য। কঠিন স্বরে বলল,,,
–বাদ দেওয়ার মতো কিছুই নেই ভাবী। ওনি কেন এসেছেন এখানে? ওনাকে তো বাবা সম্পত্তির ভাগ দিয়েছেন তাই না?তাহলে এখানে কি করছেন ওনি? ওনার কোনো অধিকার নেই এ বাড়িতে আসার।
–তোমার বিয়েতে কি আমি আসতে পারি না তূর্য?
রক্তিম বর্ণ ধারণ করল তূর্যর চোখ দুটো। তীব্র রাগ নিয়ে বলে উঠল,,,
–কেন আবারও আমাদের আলাদা করতে এসেছেন?
চমকে উঠল সবাই। কৌতূহলী দৃষ্টি তাক করল তূর্যর দিকে। মেহরিমা চৌধুরী ও উঠে পড়লেন চেয়ার থেকে।
—তোমাদের আলাদা করতে এসেছি মানে?
–আর কতো নাটক করবেন আপনি? ছোট থেকেই আপনার নাটক সহ্য করে আসছি। ভুলে যাবেন না ভাইয়া সব মুখ বুঝে সহ্য করলেও আমি ছেড়ে দেবার পাত্র নয়। আপনারা সবাই তো জানেন না মাসখানেক আগে আমাকে আর শ্রেয়া কে আলাদা করার পিছনে ওনার হাত ছিল।
সবাই যেন শক খেল। তূর্যর কথার আগা মাথা কিছুই বুঝতে পারছে না কেউ। তোহাশ ভাইয়া নরম কন্ঠে বলে উঠল,,
–বুঝিয়ে বল তূর্য।
— আমার যেদিন এক্সিডেন্ট হয় শ্রেয়া ঐদিন ফোন দিয়েছিল তাই না? দুর্ভাগ্যবশত মোবাইল টা আমি রুমেই ফেলে যায়।আমি কখনও নিজের ফোনে পাসওয়ার্ড ইউজ করি না এটা পরিবারের সবারই জানা। সেদিন চাচার মোবাইলে মেসেজ টা মেহরিমা চৌধুরী দিয়েছিলেন। প্রশ্ন হল আমি কিভাবে জানলাম! আমার রুমে যে গোপন ক্যামেরা আছে সেটা সবারই অজানা। সেদিন রাতে শ্রেয়া যখন বলল মেসেজে আমি বলেছি আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি ইচ্ছে করেছে নিজেকে শেষ করে দেয়। যাকে এতো ভালোবাসি তার মুখে এমন কথা শুনা টা খুবই যন্ত্রণাদায়ক। অবশ্য এতে শ্রেয়ার কোনো দোষ ছিল না। আমাকে ও তাকে আলাদা করার জন্য তো অজানা এক শত্রু উঠে পড়ে লেগেছিল। রাতেই ভিডিও ফুটেজ চেক করতেই সত্য আমার সামনে প্রকাশিত হল। শুধু এতটুকু তেই ক্ষান্ত হন নি তিনি। তার আগে শ্রেয়ার সব ডিটেইলস বের করে আমার খালা মণি কে শ্রেয়া কে আভাসের বউ করার তাগিদ দেন। খালা মণি যাচাই বাছাই করে জানল শ্রেয়া খুব ভালো মেয়ে তাই দ্বিমত করেন নি। অন্যদিকে মেহরিমা চৌধুরী শ্রেয়ার সৎ মা কে মোটা অংকের টাকা দিয়েছেন যেন বিয়েটা হয়। সবকিছু ঠিক আছে নাকি ভুল কিছু বলে ফেলেছি মেহরিমা চৌধুরী????
সবকিছু শুনে ধপ করে পাশের চেয়ারে বসে পড়লাম আমি। আমাদের প্ল্যান করে আলাদা করেছেন ওনি। সবকিছুর পেছনে ওনার হাত!!! আমার দিকে তাকিয়ে মা বলতে শুরু করলেন,,,
—ভুল কি করেছি তূর্য? আমার ভাইয়ের মেয়েকে রেখে একটা রাস্তার মেয়ে কে বিয়ে করতে যাচ্ছিলে তুমি। পাগল হয়ে যাচ্ছিলে ফালতু একটা মেয়ের জন্য। তোমর বাবা কে বুঝিয়ে ও লাভ হয় নি। ওনি তো তুমি বলতেই পাগল ছিল। অহমিকার নখের যোগ্য ও না এই মেয়ে। বেশ করেছি তোমাদের আলাদা করে।
— আরিয়ানা ভাবী ও অহমিকার মাঝে আকাশ পাতাল পার্থক্য। আসলে অহমিকা তো পুরো আপনার স্বভাবই পেয়েছে। যেমন ফুপু তেমন ভাতিজী। ভাগ্য ভালো তোহাশ ভাইয়ার কপালে আরিয়ানা ভাবী জুটেছে। এই কাজটা ভালো করেছেন। কিন্তু আমাকে ও শ্রেয়া কে আলাদা করে একদম ঠিক করেন নি। কি লাভ হল? ঘুরে ফিরে আমার শুভ্র পরী আজ আমার অর্ধাঙ্গিনী। (হেসে)
–একটা বিধবা মেয়ের জন্য আমার সাথে তর্ক করছো তুমি?
–মেয়েটা বিধবা না। শ্রেয়া আমার বউ। সম্পর্কে আপনি আমার বড় বলে এই তিক্ত কথাটা বলে ও এখনো দাড়িয়ে আছেন এখানে। নয়তো আজ আপনাকে আমার হাত থেকে কেউই বাঁচাতে পারত না। আর এক মিনিট ও যদি আপনি এখানে উপস্থিত থাকেন তবে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না। বেরিয়ে যান আমাদের বাড়ি থেকে। আপনার মতো লোভী, সার্থবাদী মহিলার মুখ দেখতে চাই না। আজও আপনি প্রমাণ করে দিলেন পর পরই হয়। পর কখনো আপন হয় না।
তাচ্ছিল্য হেসে চলে গেলেন ওনি। তোহাশ ভাইয়া তূর্যর কাধে হাত রাখতেই হাত টা চেপে ধরল তূর্য। একটু হেসে বলল,,,
–দেখলে তো ভাইয়া কেমন খেল খেলল আমার জীবনটা নিয়ে!!! আর উনাকে মায়ের আসনে বসিয়েছিলাম আমরা।
উপরে গিয়ে রেডি হয়ে নাও শ্রেয়া।
।
।
একজন মা কিভাবে নিজের সার্থের জন্য সন্তানের খুশি কেঁড়ে নিতে পারে? আপন না হোক তবুও তো মা। আমি তূর্যর চোখে দেখেছি কতো টা কষ্ট পেয়েছেন তূর্য। ওনার জায়গায় অন্য কেউ হলে হয়তো এতক্ষণে তূর্যর রাগের শিকার হতো কিন্তু ওনাকে কথাগুলো বলতে গিয়েও তূর্যর ঠোঁট কাপছিল। আমি জানি আপনি অনেক কষ্ট পেয়েছেন তূর্য। কেন এমন হয়? কেন আমরা যাদের আপন ভাবি তারা আমাদের দু চোখের বিষ মনে করেন? টাকা কি সবকিছু? ভালেবাসা,,মায়া-মমতা কি কিছুই না? ভাগ্য খারাপ ওনার। ওনি যদি বুঝতেন আপনার ও তোহাশ ভাইয়ার চোখে ওনার জন্য কতটা সম্মান কতটা ভালোবাসা তবে এতো সার্থপর হতে পারতেন না। বুক চিরে একটা উত্তপ্ত শ্বাস বেড়িয়ে এল।
।
।
শুভ্র লেহেঙ্গা পড়ে তৈরি হয়ে নিলাম আমি। প্রিয়ু,, আরিয়ানা আপুও রেডি। একটু পরেই নিচে নিয়ে যাবে আমাকে। লাল আরেকটা ওড়না এনে মাথায় দিয়ে দিল আরিয়ানা আপু। অবাক হয়ে ওনার দিকে তাকাতেই ঠোঁট দুটো প্রসারিত করে বললেন,,,
–তূর্যর আদেশ।
সাদা ওড়না মাথায় দেওয়া আছে। তার উপর একদম মুখ ঢেকে আবার লাল ওড়না। অদ্ভুত তো!!! বিয়ে তো রাতেই হয়ে গেল তবুও কতো আয়োজন। আমাকে নিয়ে নিচে নেমে আসল প্রিয়ু ও আরিয়ানা আপু। এতো ভারী লেহেঙায় হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। তবুও কিছু করার নেই তূর্য চৌধুরীর ইচ্ছে বলে কথা। লাল ওড়নার উপর দিয়ে ঝাপ্সা ভাবে ভেসে এল তূর্যর হাসোজ্জল চেহারাটা । সাথে সাথেই কয়েকটা হার্ট বিট মিস হয়ে গেল। ওনার হাতটা ধরে এগিয়ে গেলাম স্টেজের দিকে। স্টেজে আমাকে বসিয়ে সবার উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,,,
–আমার বউ কে প্রথমে দেখার অধিকার আমার। তাই আমি প্রথমে দেখব।
ওনার বন্ধুরা সবাই হৈচৈ করে উঠল। ইশশ কি লজ্জাজনক ব্যাপার।এই লোক একদিন মাথা কাটিয়েই ছাড়বে। ধীরে ধীরে ইয়া বড় ঘোমটা টা তুললেন ওনি। এক নজরে তাকিয়ে থেকে অস্ফুটস্বরে বলে উঠলেন,,
–মাশাল্লাহ,,,,,, শুভ্রতায় ঘেরা মায়াবী কন্যা।
হেসে দিলাম আমি।আমার হাতটা আকড়ে ধরলেন খুব শক্ত করে। অপলকভাবে তাকিয়ে রইলেন। পাশ থেকে আয়ুশ ভাইয়া চিল্লিয়ে বললেন,,,
–আজ একটা প্রমিস চাই জেরি।
ভ্রু কুঁচকে তাকালাম আমি। হৃদপিণ্ড চরম লাফাচ্ছে।আয়ুশ ভাইয়া মুচকি হেসে বললেন,,,
–প্রমিস করো তুমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত হারিয়ে যাবে না তূর্যর জীবন থেকে।
সাথে সাথেই তূর্যর হাতটা আঁকড়ে ধরে আওয়াজ করে বললাম,,,
— শত বাধা আসুক তবুও আমি আপনাকে ছেড়ে যাব না তূর্য। আপনার বন্ধুমহলের সামনে প্রমিস করলাম শেষ নিঃশ্বাস অব্দি আমি আপনারই থাকব।
করতালির আওয়াজ এসে কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই লজ্জায় শিউরে উঠলাম আমি। তূর্য এখনও এক ধ্যানে তাকিয়ে।ইশশ কি মারাত্মক চাহনি!!!
।
।
ঘোমটা টেনে বসে আছি বিছানায়। রাত বারোটা বাজে। বাহিরের শোরগোল কানে এসে বাজছে। ফুহাদ ভাইয়া, প্রিয়ু,,মিথি আপু সবাই ঝেকে ধরেছে তূর্য কে বেশ ভালোই বুঝতে পারছি। হঠাৎ তূর্যর কন্ঠ শোনা গেল–আমার বউ,, আমার রুম অথচ তোদের টাকা দিতে হবে। নেভার। ফুহাদ মনে আছে একবার ক্লাবে একটা মেয়ে,,,তূর্য কথাটা শেষ করার আগেই ফুহাদ মিথি কে নিয়ে প্রগাঢ়পাড়। প্রিয়ু ও আরিয়ানা বেক্কল বনে গেল। কি হল! একে অপরের দিকে তাকাতেই তূর্য প্রগাঢ়পাড়।
হুড়মুড়িয়ে ওনাকে ঘরে ঢুকতে দেখে কিছুটা নড়েচড়ে বসলাম আমি। বাহির থেকে আরিয়ানা আপুর চিতকার শুনা যাচ্ছে,,
–ভালে হবে না বলে দিলাম তূর্য। আমাদের বোকা বানালি। এটার শোধ নিয়েই ছাড়ব।
কোনো কিছু না বলে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে গেলেন তূর্য। ওনি আমার সাথে কথা বললেন না কেন? চিন্তা নিয়ে বিছানা থেকে উঠতেই বেরিয়ে এলেন । দ্রুত গতিতে কাছে এসে দাঁড়ালেন। থরথর করে কাঁপতে লাগল সারা শরীর। মুচকি হাসল তূর্য। মধুর স্বরে প্রশ্ন করল,,,
–নার্ভাস?
–উঁহু! আপনি এসে আমার সাথে কথা বললেন না কেন? আপনি কি রেগে আছেন কোনো কারণে? আবার কানে ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখবেন না তো?–ভয়ার্ত কন্ঠে বললাম।
— রাখলে তো মন্দ হয় না! কাল অভিনয় করে বেঁচে গিয়েছ। আমার সাথে অভিনয়ের শাস্তি কি জানো তো?( রাগী কন্ঠে)
ঢোক গিললাম আমি।কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললাম,,,
–আআমমমি তো,,,
–আমি তো কি শুভ্রপরী? আবার অভিনয়!–ভ্রু উঁচু করে।
— না না আমি তো!
–আমি তোমার নানা?কালকে ভাই আর আজকে নানা?(রাগান্বিত স্বরে)
–কি বলছেন তূর্য? আপনি তো আমার স্বামী।
–যাও ফ্রেশ হয়ে নাও।–মুচকি হেসে।
দ্রুত বেগে ওয়াশরুমে ঢুকে দরজায় হেলান দিয়ে দাড়ালাম আমি। শ্বাস প্রশ্বাস আটকে আসছে। এভাবে কেউ ভয় দেখায়? ওনি ইচ্ছে করে এমন করলেন আমার সাথে!!!
।
।
ফ্রেশ হয়ে লাল একটা শাড়ি পড়ে বের হয়ে এলাম। আয়নার সামনে দাড়িয়ে চুল আঁচড়াতেই চোখে পড়ল চিরকুট,,,,
~❝ হৃদয়হরণী,,,আমার হৃদয়স্পর্শী শুনছো তুমি,,,
তোমাতেই পূর্ণ হয়েছি আজ আমি।
বৃষ্টিস্নাত সকালে নয়, রাতের আঁধারে নয়
সারা প্রহর তোমার ভালোবাসায় সিক্ত থাকতে চাই আমি।
আসক্তি হতে চাই তোমার যেন অবলীলায় বলতে পারো
তূর্য নামক আসক্তি গ্রাস করেছে আমায়।❞
ভীষণভাবে কেঁপে উঠল হৃদপিণ্ড। বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেল বহুগুণ। অন্যরকম অনুভূতি ভিড় জমাচ্ছে মন জুড়ে। চিরকুট প্রেমে মত্ত হয়েছি বহু আগেই। আজ যেন নতুন করে মত্ত হচ্ছি চিরকুট লেখকের প্রেমে। সামান্য চিরকুট অথচ তার মধ্যে লিখাগুলোর গভীরতা ব্যাপক। এমন বাক্য যার মনে আওড়াবে সেই ব্যক্তি প্রেমে পড়তে বাধ্য হবে। চিরকুট লেখকের প্রেমে!!! শাড়িটা ঠিক করে পেছনে চোখ উল্টে তাকাতেই চোখে আটকালো তূর্যর মোহময় নয়ন। একটু ও সময় নিলাম না তূর্য কে ঝাপটে ধরতে। হৃদয় নাড়ানো আহ্বানে সাড়া না দিয়ে কি উপায় আছে!!! কোমর আঁকড়ে ধরে মুখোমুখি করে নিলেন তূর্য। সাহস জুগিয়ে ওনার কপালে ঠোঁট ঠেকালাম এই প্রথম। প্রথমবার । হাতের বাঁধন ঢিলে করে দিলেন মুহুর্তেই । পড়তে নিলেই আবারও আঁকড়ে ধরলেন নিজের একদম কাছে। চোখ বন্ধ করে স্লো ভয়েসে এক নিঃশ্বাসে বলে উঠলাম,,
— আপনাতেই মগ্ন হতে চায় আপনার শুভ্রপরী প্রেমময় তূর্য চৌধুরী। ❤️
চলবে,,,,