তোমাতেই পূর্ণ আমি #পর্ব -৭,০৮

0
810

#তোমাতেই পূর্ণ আমি
#পর্ব -৭,০৮
#লেখিকাঃআসরিফা সুলতানা জেবা
০৭

ক্যাম্পাসের পিছনের দিকে পুকুরের পাড়ে বসে আছি আমি আর প্রিয়ু।পুকুরের পাশের এই দিক টা খুব নিরিবিলি থাকে।মাঝে মাঝে এক দু’জন কাপল দেখা যায়।বকুল ফুলের ঘ্রাণে মাতোয়ারা হয়ে আছে চারদিক টা।এক সময় খুব ইচ্ছে ছিল বকুল ফুলের মালা গেঁথে হাতে,,গলায়,,কানে দুল বানিয়ে পড়ব। ইচ্ছে টা আমার ছিল বললে ভুল হবে। সেই আড়ালে থাকা মানুষটার ইচ্ছে ছিল আমায় এই রুপে দেখার। কিন্তু সময়ের সাথে ইচ্ছে গুলো হারিয়ে গেছে আমার জীবন থেকে ঠিক সেই মানুষটার মত। প্রিয়ু একটু পর পর আমার হাত খোচাচ্ছে।ভয়ে আঁতকে আছি এখনও দুজন তূর্য ভাইয়ার ঐ রাগী রূপ টা দেখে। আমাদের এই দশা না জানি নিশি আপুর কি হয়েছে!!ওনার এমন রূপের কথা শুধু লোক মুখে শুনেছিলাম এখন তো নিজ চোখে সকাল থেকেই দেখে যাচ্ছি।

আমি এতিম বলে,, কোনো বড়লোক বাড়ির মেয়ে না বলেই কি নিশি আপুর এতো ক্ষোভ? তূর্য ভাইয়া কে অপমান করেছি বলে কি আমার প্রতি এতো ক্ষোভ? কই এসব কিছুই তো মনে হচ্ছে না।আমার কেন যেন মন বলছে ওনার ক্ষোভ অন্য কোনো কারণে এবং সেটা হয়তো আমাকেই ঘিরে!!আচ্ছা তূর্য ভাইয়া সামান্য একটা কারণে ওনাদের ফ্রেন্ডশিপ কেন নষ্ট করলেন?ওনার তো আরও খুশি হওয়ার কথা যে নিশি আপু আমায় শাস্তি দেওয়ার জন্য ওনাকে সুযোগ করে দিয়েছে তবে তিনি কেন এতো রাগ দেখালেন?তখন থেকেই প্রশ্নগুলো বার বার ঘুর ঘর করছে আমার মনের ভিতরে।

আমার প্রশ্নের জবাব পেলাম প্রিয়ুর কথায়।চোখে মুখে ভয় নিয়ে প্রিয়ু বলে উঠল,,,

—আগে নুসাইবা আপুর মুখে শুনেছিলাম তূর্য ভাইয়া কতো ডেঞ্জারাস। কিন্তু আপুর মোবাইলে ভাইয়ার পিক দেখে কখনো বিলিভ করি নি আমি।এতো স্মার্ট একটা ছেলে এতো মায়ায় ভরা তার চেহারার মানুষের এতো রাগ কি করে হতে পারে বল?তাই আপুকে বলতাম তুমি মিথ্যা বলো যেন আমি তোমার ক্রাশের উপর ক্রাশ না খায়।তখন আপু বলতো একবার সামনা সামনি দেখিস তবেই বুঝবি তূর্য ভাইয়া কি জিনিস। ভালো হয়েছে আপুর উদয় ভাইয়ার সাথে বিয়ে হয়ে গেছে নয়তো এই লোকের পিছে সারাজীবন ঘুরলেও তার মন পেত না উল্টো জ্বলে পুরে ভস্ম হয়ে যেত।

প্রিয়ুর কথায় আমি হাসব না কাঁদব এই ভাবছিলাম তখনি আবার প্রিয়ু বলল,,,

—জানিস আপু বলেছিল তূর্য ভাইয়া ওনার আর ওনার শত্রুর মাঝে অন্য কারো ইন্টারফেয়ারেন্স পছন্দ করেন না।ওনার শত্রুদের ওনি নিজেই হ্যান্ডেল করতে পছন্দ করেন।তার মানে তুই বুঝতে পারছিস শ্রেয়া? (বড় বড় চোখ করে)

প্রিয়ুর মুখে উচ্চারিত বাক্যে আমার আর বুঝতে বাকি রইল না যে আমি ওনার শত্রু।আমার আর ওনার মাঝে নিশি আপু বা হাত ঢুকিয়েছে তাই ওনার এতো রাগ উঠেছে। হয়তোএই কারণেই তখন ওইসব কথা বলছিলেন। নিজের দোষেই আজ এমন জালে ফেঁসে গেছি আমি।কি দরকার ছিল ওনার সাথে টক্কর নেওয়ার! না জানি আরো কত কিছু ভোগ করতে হয় আমার।

পাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে ফিরে তাকালাম আমি।মুখে মুচকি হাসি নিয়ে দাড়িয়ে আছে আয়ুশ ভাইয়া। আয়ুশ ভাই কে দেখেই লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল প্রিয়ুর মুখ টা।বুঝতে আর বাকি নেই বান্ধবী আমার কঠিন অসুখে ভুগছে।যার নাম প্রেমাসুখ।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমি।আল্লাহ যেন আমার ভয় টা সত্যি না করে।কোনোভাবেই যেন আমার জন্য এই মেয়েটা কষ্ট না পায়।আয়ুশ ভাইয়া যেন কখনও সেই মানুষ টা না হোক।প্রিয়ুর ভালোবাসা যেন প্রিয়ুর ই হয়।মুচকি হেসে আয়ুশ ভাইয়ার দিকে তাকালাম আমি।হাতের বইটা এগিয়ে দিলেন আমার দিকে।অবাক চোখে তাকাতেই ওনি ইশারা করলেন বই টা নিতে।বইটা নিয়ে নিলাম আমি।হাতে নিয়ে দেখলাম এটা তো আমারই বই।গতকাল লাইব্রেরি থেকে নিয়েছিলাম।তূর্য ভাইয়ার ভয়ে ওনাদের ক্লাসেই রেখে চলে আসছি।ভালোই হয়েছে আয়ুশ ভাইয়া নিয়ে এসেছেন নয়তো জরিমানা দিতে হতো আমার।যা এই মুহূর্তে কোনোভাবেই সম্ভব না।হাতে এক টাকা ও নেই।অন্যের থেকে ধার করা ৫০০ টাকাই আছে। খাতা যেহেতু কিনি নি রীতি আপুর টাকা উনাকেই ফিরত দিয়ে দিব।বেচারির নিজের ও অনেক আর্থিক সমস্যা। একটু হেসে আয়ুশ ভাইয়া কে ধন্যবাদ জানালাম।হাসলেন তিনি।সামনের বেঞ্চিতে বসে এক নজর তাকালেন আমাদের দু’জনের দিকে।

—আপনাদের দু’জনের সাথে কি এক কাপ চা খাওয়া যাবে?(হেসে)

আয়ুশ ভাইয়ার কথায় একে অপরের দিকে তাকালাম দুজন।প্রিয়ু চোখের ইশারায় রাজি হয়ে যেতে বলল।কিন্তু ভীষণ অস্বস্তি তে পড়ে গেলাম আমি।আয়ুশ ভাইয়া নিঃসন্দেহে ভালো ছেলে কিন্তু ওনার চোখের চাহনি আমায় কেন যেন অন্য কিছু প্রকাশ করে।মনে হয় ওনি আমায় পছন্দ করেন।সত্যি কি তাই নাকি এটা শুধু সন্দেহ অথবা বুঝার ভুল।

—সমস্যা নেই। না খেতে চাইলে ইটস ওকে।তোমার বইটা দিতে এসেছিলাম।দুজন একা বসে আছো তাই ভাবলাম এক কাপ চা খাওয়া যাক তোমাদের সাথে আর তোমাদের সম্পর্কে ও জানলাম।তাহলে আমি আসি।

আয়ুশ ভাইয়া যেতে নিলেই হুড়মুড়িয়ে বলে উঠল প্রিয়ু,,,

—আমরা চা খেতে চাই ভাইয়া।কিন্তু শ্রেয়া ক্যান্টিনে যাবে না।
–ঠিক আছে।চা এখানেই চলে আসবে।

কিছুক্ষণ ধরে কথা বলে যাচ্ছে আয়ুশ ভাইয়া আর প্রিয়ু। আমি এদিক সেদিক তাকাচ্ছি বার বার।আমার মন বলছে কেউ গভীর নজরে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।আয়ুশ ভাইয়া নাকি অন্য কেউ!! আয়ুশ ভাইয়ার দিকে তাকাতেই সাথে সাথে চোখ ফিরিয়ে নিলেন তিনি।চা শেষ করে উঠে দাঁড়ালাম আমি।একটু পরেই ক্লাস আছে।প্রিয়ু ও আয়ুশ ভাইয়া কথা বলতে বলতে এগোচ্ছে। আমিও তাদের সাথে সাথে চলতে লাগলাম।


ক্লাস শেষে বইটা লাইব্রেরিতে ফিরত দিতে যাবো তখন বইয়ের ভাজ থেকে একটা কাগজ গড়িয়ে পড়ল ফ্লোরে।কাগজ টা তুলে দেখলাম সেই অচেনা মানুষটার লিখা চিরকুট। একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল শিরদাঁড়ায়।বুকটা ধুক করে উঠল প্রিয়ুর দিকে তাকিয়ে। বইটা তো আয়ুশ ভাইয়া দিয়েছেন। তার মানে ওনিই চিরকুট লেখক! তবে কি আমার ভয় টা সত্য প্রমাণিত হলো! চিরকুট টা প্রিয়ু দেখার আগেই ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলাম আমি।মনের মধ্যে কান্না গুলো দলা পাকিয়ে আসছে।ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আয়ুশ ভাইয়া চিরকুট লেখক হলে কীভাবে আমি সহ্য করব ওনাকে প্রিয়ুর পাশে?আর ওনিই বা মেনে নিবেন কি প্রিয়ু কে?মানুক বা না মানুক আমি কখনও আর কারো হচ্ছি না।আমার একটাই পরিচয় আমি শ্রেয়সী।কোনো চিরকুট লেখক বা আয়ুশ ভাইয়া কারো পরিচয় আমার প্রয়োজন নেই। কিন্তু সেই মানুষ টা কে যে আমি ভীষণ ভালোবাসি।।ভীষণ ভালোবাসি আপনাকে চিরকুট লেখক। কিন্তু কখনও আর আপনার হওয়ার ভাগ্য আমার নেই। কোনোমতে কান্না আটকিয়ে প্রিয়ু কে বললাম,,,

–আমি একটু ওয়াশরুমে যাবো প্রিয়ু।তুই যা আমি আসছি।
–ঠিক আছে দোস্ত।


ওয়াশরুমে এসে চোখে মুখে পানি দিলাম আমি।সত্যিই কি আয়ুশ ভাইয়া আপনি আমার সেই ভালোবাসার মানুষ টা?যদি হয়েই থাকেন তবে আবার কেন ফিরে এলেন আমার জীবনে।চলেই তো গিয়েছিলেন আমাকে একা ছেড়ে। একবারও আসেন নি আমার জন্য একবারও না। অন্যের হতে দিয়েছেন আমায়।স্বামী নামক নরপশু টা শেষ করে দিয়েছে আমার জীবন।কেন ভালোবাসা দেখিয়ে নিঃশেষ করে দিয়েছিলেন আমার জীবনটা।কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলছিলাম আচমকাই লাইট অফ হয়ে অন্ধকার ছেয়ে গেল জায়গাটায়।সামনের দিকে এগোতে যাবো দু’হাতে আমার কোমড় আকড়ে ধরে নিজের একদম কাছে নিয়ে নিল কেউ। আমার দু হাত গিয়ে ঠেকল মানুষ টার বুকে।সেই স্পর্শ,,,সেই পুরোনো অনুভূতি। আরেকটু শক্ত করে জরিয়ে ধরে নিজের একদম কাছে নিয়ে নিল আমায়। নিমিষেই ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে লাগল সারা শরীর জুড়ে।আয়ুশ ভাইয়া নয়তো?কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললাম,,,,

—আয়ুশ ভভাইয়া আপনি???আপপপনি কি আয়য়ুশ ভাইয়া?প্লিজ আমায় ছেড়ে দিন।

সাথে সাথেই লোকটা রাগী কন্ঠে বলে উঠল,,,,,

—একদম চুপ।মুখে সারাক্ষণ ছেলেদের নাম নিয়ে ঘুরিস তাই না?ছেলেদের সাথে কথা বলিস,,ঘুর ঘুর করিস।বিধবা হয়েও তোর স্বাধ মিটে নি তাই না?পাখির মতো উড়ে বেড়াচ্ছিস।লাজ লজ্জা কিছুই নেই তোর ।তোর এই কন্ঠই আমি রাখব না কোনো ছেলের সাথে কথা বলার জন্য।

কথাটা বলেই লোকটা সাথে সাথে আমার গলা চেপে ধরল।এতো শক্ত করে ধরেছে মনে হচ্ছে এই বুঝি নিঃশ্বাস টা বন্ধ হয়ে যাবে।হাত দিয়ে ছাড়াতে চাইলাম কিন্তু পেরে উঠলাম না তার শক্তির সাথে।উপায় না পেয়ে তার বুকে দুই হাত দিয়ে ঠেলতে লাগলাম।আমার গলা ছেড়ে দিল লোকটা।কাশতে কাশতে অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে আমার।কিছুটা দূরে সরে আসতেই হাত টা টেনে একদম নিজের সাথে শক্ত করে বুকে জরিয়ে নিল আমাকে।জোর করে আমার মাথা টা বুকে চেপে ধরে রাখতেই ওনার হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানি আমার কানে এসে বারি খেতে লাগল বার বার। লোকটার হৃদপিন্ডের হৃদস্পনদন গুলো কেমন ঘোরে নিয়ে যেত লাগল আমায়।আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে লোকটা বলে উঠল,,,,

—আ’ম সরি জান।কিন্তু এই শাস্তি টা তুমি ডিজার্ভ করো।আর কখনও যদি কোনো ছেলের সাথে কথা বলতে দেখেছি তবে তোমায় খুন করেই দম নিব আমি।আই থিংক বুঝতে পেরেছ তুমি।

লোকটার কথায় আঁতকে উঠলাম আমি।জীবনে একের পর এক কষ্ট,,কঠিন বাস্তবতা ঘিরে ধরছে আমায়। এ কেমন খেলায় মেতে উঠল সবাই আমার জীবনটা কে নিয়ে! আমার কাছে আসলে একদম স্লো ভয়েসে কথা বলে লোকটা।তবুও আজ কন্ঠ টা খুব পরিচিত মনে হচ্ছে। ইনিই কি তবে আয়ুশ ভাইয়া!!!!

একের পর এক আমার গালে, কপালে চুমু দিতে লাগলেন মানুষ টা।শিহরিত হচ্ছি আমি প্রতিবার।কান্না আসছে বুক ফেটে।কাঁদতে কাঁদতে চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে উঠল সবকিছু।ধীরে ধীরে লুটিয়ে পড়লাম ওই মানুষটার বুকে,,,

চলবে,,

(ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

#তোমাতেই পূর্ণ আমি
#পর্ব -৮
#লেখিকাঃআসরিফা সুলতানা জেবা

গৌধূলি লগ্ন।জানালার গ্রিল ধরে আকাশের দিকে চেয়ে আছি।আাকাশ টা কেমন রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে।সূর্যাস্তের এই সময়টা বিশেষ ভালো লাগে না আমার।মনে হয় আমার জীবনের মতোই পৃথিবীর বুকে অন্ধকার নেমে আসছে।পৃথিবীর বুকে আবার আলো ফুটলেও আমার জীবনে অন্ধকার নেমে আসার পর কখনো সূর্য উদয় হয় নি।তবুও ভালো আছি আমি। অন্ধকার জীবনটা ও হয়ত আমার জন্য শ্রেয়।আজ ভার্সিটিতে দুপুরের কথা মনে পড়তেই শিউরে উঠল সারা শরীর।চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল এক ফোঁটা অশ্রু। তখন ওই মানুষ টার বুকে ঢলে পড়ার পর আর কিছুই মনে নেই আমার।প্রিয়ু বলল আমি নাকি অডিটোরিয়াম রুমে বেহুশ হয়ে পড়েছিলাম।মিহি নাকি দেখেছে আমায়।প্রিয়ুর হাজার বার করা প্রশ্ন কেও চেপে গেলাম আমি। কি বলব,,যে অন্ধকারে আড়ালে সেই মানুষ টা আমার কাছে আসে?আর মানুষ টা যদি সত্যিই আয়ুশ ভাইয়া হয় মরে যাবে মেয়েটা।এই কয়দিনে অনেক ভালোবেসে ফেলেছে আয়ুশ ভাইয়া কে।আমার জন্য আর কারো মন না ভাঙুক। শরীর খারাপ লাগছিল তাই অডিটোরিয়াম রুমে গিয়ে বসতে না বসতেই হঠাৎ নিচে লুটিয়ে পড়লাম বলে কথা কাটিয়ে দিলাম।দুপুর থেকেই একটু পর পর ফোন করে যাচ্ছে মেয়েটা। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার জন্য তাড়া দিচ্ছে বার বার।স্কুল জীবন থেকেই মেয়েটা আমার জন্য এত পজেসিভ।আমার জন্য নিজের জীবনের প্রিয় জিনিসটা ত্যাগ করতে এক সেকেন্ড ও ভাবে না।প্রিয়ু যেমন তেমন কিন্তু ওর ফ্যামিলি মেম্বার গুলো ও আমায় খুব ভালোবাসে।সবাই আমাকে ওনাদের বাসায় থাকতে বলছিলেন কিন্তু আমি কারো দয়ায় আর বাঁচতে চাইছি না। প্রিয়ু প্রথমে রাগ করলেও আমায় বুঝতে পেরেছে।এই কয়েকজন মানুষের ভালোবাসা আদর স্নেহ আমার না পাওয়া জীবনে অনেক বেশিই পাওয়া।ফোনটা বেজে চলেছে এখনও।ধরব না।ধরলে এই মেয়ে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার জন্য জোর করবে আবারও। কেন যাবো?আমার তো কোনো অসুখ নেই। আর যদি থাকেও তাতে কি নিঃশ্বাস তো নিতে পারছি। এটাই বা কম কিসের!!

আযান শুনতে পেয়েই ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালাম আমি।অযু করে নামায টা আদায় করে নিলাম।গায়ের থ্রি পিসটা পাল্টিয়ে একটা গোলাপি কালারের রাউন্ড ড্রেস পড়ে নিলাম।কাতান ওড়না টা দিয়ে গোমটা দিয়ে দিলাম মাথায়।বিয়ের পর বর একটা সুতো না দিলেও মায়ের মতো শাশুড়ি দিয়েছেন অনেক কিছু। গহনা গুলো জা রা রেখে দিলেও কাপড় গুলো আনতে পেরেছি। তবে বাবার দেওয়া কানের ছোট দুল গুলো,,মায়ের চেইন টা,,,সেই মানুষ টার দেওয়া পায়েল টা নিতে পারে নি তারা।আমি না মরা পর্যন্ত এগুলো নেওয়ার সাধ্য কারো নেই। এগুলো আমার ভালোবাসার,, প্রিয় মানুষদের স্মৃতি।যা জীবনে অনেক মূল্যবান আমার কাছে।রীতি আপু এখনো অফিসে।তাই সবকিছু গোছগাছ করে ব্যাগ টা নিয়ে বের হলাম আমি।দরজায় তালা দিয়ে নিচে আসতেই দেখলাম নিচের তলার রুহানি ফোনে কথা বলছে বাগানে দাড়িয়ে। এই বাসা টা দু’তলা।বড় না ছোট একটা পুরোনো বাসা।বাড়ির মালিক এখানে থাকেন না।ওনারা থাকেন মিরপুরে।ওখানে ওনাদের চার তলা বিশিষ্ট একটা ভবন আছেন।দুই ছেলে মেয়ে নিয়ে সেখানেই থাকেন।আর এই পুরোনো বাসাটা কিছু টা কম দামে বাড়া দিয়ে রাখেন।উপরের তালায় আমি আর রীতি আপু ও নিচ তালায় রুহানি ও শীতল আপু থাকেন।রুহানির দিকে এক নজর তাকিয়ে গেট থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম আমি।এই মেয়েও বেয়াদব তূর্য চৌধুরী বলতো পাগল।ওনার মাঝে মেয়েরা কি দেখে ভেবে পাই না। আমি তো বেয়াদবি ছাড়া কিছুই দেখি না।ভেবেছিলাম ভালোভাবে ভার্সিটিতে স্টাডি টা কমপ্লিট করবো কারো নজরে না এসেই কিন্তু এই বেয়াদব তূর্য চৌধুরীর জন্য এখন সবকিছুই এলোমেলো হয়ে গেছে। সবাই দেখলেই এখন চোখ বড় বড় করে তাকায় আর হেসে হেসে প্রশ্ন করে তুমিই তো তূর্য ভাইয়ার সাথে বেয়াদবি করেছ তাই না!!!বেয়াদবি তো আমি করি নি।করেছেন তো ওনি।একটা মানুষ,,একটা মেয়ের সাথে কেমন ব্যবহার করতে হবে জানা নেই ওনার।

এসব চিন্তা করতে করতে রাস্তার দিকে পা বাড়াতে যাবো যাব এমন সময় খুব জোরে এসে একটা গাড়ি থামল আমার সামনে।ভয়ে কয়েক কদম পিছিয়ে গেলাম আমি।বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেল শতগুণ।মনে হচ্ছিল এই বুঝি গাড়িটা আমার উপর উঠে গেল।থরথর করে কাঁপতে লাগল সারা শরীর।গাড়ি থেকে বেড়িয়ে এল শাড়ি পরিহিতা একজন মহিলা।বয়স খুব একটা হবে না।ত্রিশের গন্ডি হয়তো পেরিয়েছে।চুলটা খোপা করা।আমার দিকে হাসি মুখে এগিয়ে আসতেই ভয়ে পিছিয়ে গেলাম আমি।কে না কে?আর ওনি আমার দিকেই বা আসছেন কেন?এমনিতে এই নিয়ন আলোতে আমি একাই একটা মেয়ে।মহিলার আবার কু মতলব নেই তো!

–আপনি কি মিস শ্রেয়সী? –হাসি মুখে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

ওনার প্রশ্নে থমকালাম আমি।ওনি কিভাবে আমার নাম জানলেন?আমি তো ওনাকে চিনি না।কি পরিচয় ওনার?
ভয়ার্ত গলায় জবাব দিলাম,,,

–জ্বি,,,।আপনি??

নিজের হাতের ফোনটা এগিয়ে দিলেন আমার দিকে।স্ক্রিনের নাম্বারটা পরিচিত লাগছে।হে,,,এটা তো তিহুর আম্মুর নাম্বার। কানে নিতেই আন্টির কথা শুনে খানিকটা অবাক হলাম আমি।ফোনটা ওনার হাতে দিয়ে এগিয়ে গেলাম গাড়ির দিকে।ড্রাইভার দরজা খুলে দিতেই বসে পড়লাম গাড়িতে।জীবনে প্রথম দেখলাম প্রাইভেট টিউটর কে কেউ এতো সম্মান করতে।গাড়ি পাঠিয়েছেন ওনারা আমায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। খুব ভালো লাগল বিষয়টা। আসার সময় গাড়ি করে পাঠিয়ে দিবে বললেও যাওয়াটা আমার জন্য রিস্কি ছিল।এই শহরে একটা মেয়ে কে একা দেখলেই হিংস্রতা জেগে উঠে অনেক পশুর মাঝে।ওনাদের সবকিছু এতো ভালো হয়ত মানুষ গুলোও খুব ভালো।গেলেই বুঝতে পারব।গাড়িতে হেলান দিয়ে চোখ বুঝে রইলাম আমি।গাড়ি থামাতেই চোখ মেলে দেখলাম বিশাল বড় একটা বাড়ি।এতো সুন্দর বাড়ি কখনও আমি দেখি নি।তিন তলা বাড়িটা।কিন্তু খুবি সুন্দর। দেখেই মনে হচ্ছে অনেক অর্থ খরচ করে বানানো হয়েছে বাড়িটা। আমি দরজা খুলতে যাবো একজন গার্ড এসে দরজা টা খুলে দিল। নেমে দাঁড়াতেই দেখলাম বাড়ির সামনে দশ থেকে বারো জন গার্ড। চারদিকে একবার চোখ বুলাতেই মনে হলো আমার চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে।ফুলের রাজ্যে চলে এসেছি এমন মনে হচ্ছে। দুইপাশে এতো ফুল বলার বাহিরে।চেনা,,,নাম না জানা কতো ফুল।মন চাইছে সব গুলো নিয়ে নেই আমি।এতো সুন্দর কেন সবকিছু!!

–চলুন ম্যাম।

সেই মহিলাটার ডাকে তার সাথে চলতে লাগলাম আমি।পা দুটো কাপছে। ভয় হচ্ছে খুব।এর আগে কখনও এতো বড় বাড়িতে আসি নি আমি।চারদিকের এতো সৌন্দর্যের কাছে নিজেকে অতি নগন্য লাগছে আমার।ভিতরে প্রবেশ করতেই শরীর কাঁপতে লাগল আরো বেশি।বাহিরে যতটা সুন্দর ভিতরে তার চেয়েও বেশি সুন্দর। আমাকে ড্রইং রুমে বসিয়ে ওনি চলে গেলেন।এতো নার্ভাস লাগছে এখানে এসে তো আমি পড়াবো কিভাবে?না এতো ভয় পেলে হবে না। পরে যদি ওনারা রিজেক্ট করে দেয় তাহলে রাস্তায় নামতে হবে আমার।না খেয়ে মরতে হবে।কপালের ঘাম মুছে নিজেকে কিছুটা রিলেক্স করে নিলাম।একটা ছোট মেয়ের হাত ধরে আরেকটা মেয়ে আমার কাছে এসে দাঁড়াল। পিছন পিছন সেই মহিলাটা।মুচকি হেসে সামনের সোফায় বসলেন মেয়েটা।আর পিচ্চি গুলো মুলু মেয়েটা ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।মেয়েটা অনেক অনেক বেশি কিউট।দুধে আলতা গায়ের রং।এই পিচ্চি টাই হয়ত আমার নিউ স্টুডেন্ট। কিন্তু পাশের মেয়েটা কে?এই মেয়ের মা?অবিশ্বাস্য!!! ওনাকে দেখে তো মনেই হয় না ওনার মেয়ে আছে। কি আবোল তাবোল ভাবছি আমি।

বাচ্চা টা কে পাশে বসিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসলেন,,,

—-তুমিই কি শ্রেয়সী? তিহুর আম্মু তোমার কথাই বলেছিলেন?

–জ্বি!

—তুমি করে বললাম মাইন্ড করবে না। তোমাকে নিজের থেকে ছোট মনে হলো তাই।আমি তিতিশার আম্মু।

—ইটস ওকে ম্যাম।

–ম্যাম ডাকবে না।আমার নাম আরিয়ানা। আপু ডেকো আমায়।ভালো লাগবে।আর এই যে তোমার ছাত্রী। সে কিন্তু ভীষণ দুষ্ট। আর একটু বেশিই বাচাল।সামলাতে পারবে তো?(হেসে)

ভেবেছিলাম এতো বড় বাড়ির মানুষ হয়তো কতো অহংকার হবে কিন্তু ভুল প্রমাণিত হলো আমার ভাবনা।নিমিষেই গায়েব হয়ে গেলো সব নার্ভাসনেস।আনন্দিত ভঙ্গিতে বললাম,,,

—জ্বি আপু। অবশ্যই পারব।

আমার মনে হয় তুমি পারবে।ঠিক সামলে নিবে ওকে।–কথাটা বলে তিতিশার দিকে তাকিয়ে বললেন,,,

–যাও মা তোমার ম্যাম কে রুমে নিয়ে যাও।মন দিয়ে পড়বে কিন্তু।

তিতিশা মাথা হেলিয়ে আমার দিকে তাকাল।আবার আরিয়ানা আপুর দিকে তাকিয়ে বলল,,,

—চাচ্চু কখন আসবে মাম্মাম?
–তোমার চাচ্চু একটু পরেই চলে আসবে বেবি।তোমার পড়া শেষ করলেই তোমার চাচ্চু আদর করবে।নয়তো কি বলেছিল মনে নেই?

মাথা উপর নিচ করল তিতিশা।অর্থাৎ মনে আছে।আদো আদো কন্ঠে বলল,,,

—নতুম মিস কে যদি একটু ও জ্বালায় তবে চাচ্চু আর আমায় ঘুরতে নিয়ে যাবে না।রাগ করবে অনেক।বলেছে মিস কে বেশি বেশি ভালোবাসতে।

তিতিশার কথায় অবাক না হয়ে পারলাম না আমি।আরিয়ানা আপু আলতো হেসে বললেন,,,,

—কিছু মনে করো না শ্রেয়া।ওও একটু এমনই। তিতিশা ওর চাচ্চু বলতে পাগল।

জবাবে আমিও একটু হাসলাম।

————————–

তিতিশার রুমে ওকে পড়াচ্চছি প্রায় মিনিট চল্লিশ হবে।রুমটা খুব সুন্দর। চারদিকে পুতুলের ছড়াছড়ি।সত্য তো এটাই অর্থ হলে সবই সম্ভব। গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়ছে তিতিশা।হয়তো চাচ্চুর কথা পালন করছে অক্ষরে অক্ষরে।পড়া শেষ করে আমার দিকে তাকিয়ে মুগ্ধময় একটা হাসি দিল ।বাচ্চাদের হাসি বরাবরই খুব প্রিয় আমার।কিন্তু এই হাসিটার মিল খুঁজে পাচ্ছি আমি একটা মানুষের সাথে।একদম সেই হাসিটা।

—তুমি খুব সুন্দর মিস!!!

তিতিশার মুখে নিজের প্রসংশা শুনে অমায়িক হাসি উপহার দিলাম।এই বাড়ির সদস্য গুলো হয়তো অনেক মিশুক।যেমন আরিয়ানা আপু ও তিতিশা কেমন আপন ভঙ্গিতে কথা বলছে আমার সাথে।থেমে নেই তিতিশা।সত্যিই বলেছে ওর মা তিতিশা কথা একটু বেশি বলে।খারাপ না ভালোই লাগছে আমার ওর মিষ্টি কথাগুলো।হঠাৎ বলে উঠল,,,,,,

—মিস জানো আমার চাচ্চু অনেক স্মার্ট। যেই মেয়ে আমার চাচ্চু কে দেখে ফিদা হয়ে যায়।আমার খালা মণিও চাচ্চু কে লাভ করে।কিন্তু চাচ্চু না তাকে অনেক বকে দিয়েছে সবার সামনে।পাপা আর মাম্মাম বলেছে চাচ্চু নাকি অন্য কাউকে লাভ করে।তাহলে তার সাথে আমার দেখা কেন করায় না বলো তো?আমার মাঝে মাঝে ভীষণ রাগ হয়।দেখো তুমিও চাচ্চু কে দেখলে ক্রাশ খাবে।মিস তুমি আমার চাচ্চুর সাথে দেখা করে যেও।চাচ্চু একদম তোমার মতোই ভালো।

এতটুকু একটা বাচ্চার মুখে এমন কথা শুনে মুখ হা হয়ে গেল আমার।আজকাল কার বেবি গুলো একটু বেশিই চালাক।তিতিশার গালটা টেনে বললাম,,,

—আচ্ছা বেবি।এখন তাহলে কবিতা টা লিখে দেখাও।

লিখতে লিখতে তিতিশা আমার দিকে তাকিয়ে বলল,,

—তুমি কিন্তু প্রতিদিন আসবে মিস।নয়তো ভীষণ কষ্ট পাবো আমি।তুমি খুব ভালো।আমি তোমার কাছেই পড়ব।


পড়ানো শেষ করে বেরিয়ে এলাম আমি।আরিয়ানা আপুও আমার সাথে এলেন গাড়ি পর্যন্ত। এতো বড় বাড়ির বউ ওনি কিন্তু বিন্দু মাত্র অহংকার নেই তার। ড্রাইভারের ফোন আসায় গাড়ি স্টার্ট দিতে গিয়েও দিলেন না তিনি।বিনয়ী কন্ঠে কারো সাথে কথোপকথন চলছে তার।

–জ্বি বাবা।তুমি একদম চিন্তা কইরো না।সাবধানে নিয়া যামু।বাড়িতে ঢুকলেই আমি ফিরা আসমু এর আগে না।ঠিক আছে।আইচ্ছা।

ওনার কথোপকথন গুলো আমার কানে ভেসে এলেও তত একটা মনোযোগ না দিয়ে এক দৃষ্টিতে বাহিরে তাকিয়ে রইলাম আমি দূরে থাকা কালো গোলাপ গাছগুলোর দিকে।কি সুন্দর গাছ গুলো।হয়তো সকালে ফুটেছিল বলে কিছুটা নেতিয়ে পড়েছে ফুলগুলো কিন্তু সৌন্দর্য এখনো বিরাজমান।গাড়ি চলতে শুরু করলেই বেরিয়ে এলাম নিজের ধ্যান থেকে।


শ্রেয়া যেতেই হাতের ইশারায় উপরের দিকে তাকিয়ে বেস্ট অফ লাক জানাল আরিয়ানা।মৃদু হাসল বারান্দায় থাকা লোকটা।এক নজরে তাকিয়ে ছিল এতোক্ষণ শ্রেয়ার যাওয়ার পানে।কফির মগে একটা চুমুক দিয়ে উচ্চস্বরে বলে উঠল,,,

—–ধন্যবাদ আরিয়ানা ম্যাম ওপপসসস্ ভাবী।থেংক ইউ সো মাচ।

হালকা হেসে বাড়ির ভিতরে ঢুকে গেল আরিয়ানা।বারান্দায় দাড়িয়ে থাকা মানুষ টা নিজের মোবাইলের দিকে তাকাল।স্ক্রিনে ভেসে উঠল এক শুভ্রপরীর ছবি।মুগ্ধ দৃষ্টিতে এক নজরে তাকিয়ে শ্রুতিমধুর কন্ঠে বলতে লাগল,,,

“”সম্পর্ক টা অপ্রকাশিত
হৃদয়ে রক্তক্ষরণ অনবরত
মনের মাঝে গড়া স্বপ্ন গুলো অসম্পূর্ণ
তবে আমার হৃদয়ে সঞ্চরিত প্রণয় সত্য।
যদি কখনও দুজন দু প্রান্তে থাকি তবুও বলব ভালোবাসি।
বছর গড়িয়ে সময়ের স্রোতে কখনও যদি সামনে এসে দাড়াও তবুও বলব ভালোবাসি।
ভালোবাসি আমার শুভ্রপরী,,,
ভালোবাসি তোমায়,,,
হৃদয়ের গহীনে তুমি থাকবে সর্বদা বিরাজমান। “””

চলবে,,,
(ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here