তোমাতেই পূর্ণ আমি ❤,পর্বঃ০৬
লেখিকাঃজিন্নাত চৌধুরী হাবিবা
দেখতে দেখতে আমাদের বিয়ের একমাস কেটে গেছে।সারা বাড়ি রান্নার ঘ্রাণে ম-ম করছে।আজ বাসায় অনেক পদের রান্নার হচ্ছে।তার কারণ মাইশা আপু আর তার হাসবেন্ড আজ স্পর্শদের বাসায় আসছে।শাওন (মাইশার হাজবেন্ড) ভাইয়া দুসপ্তাহ আগেই ব্যবসায়িক কাজ চুকিয়ে ঢাকায় ফিরেছেন।মাইশা আপু আর শাওন ভাইয়ার স্পর্শদের বাড়িতে আসার পেছনে একটা কারণ আছে সেটা কি আমরা কেউই জানিনা।আপুরা আসলে বলবেন কারণটা কি…..?মেয়েদের বাবার বাড়িতে আসতে কোনো কারণ লাগে না।কিন্তু মাইশা আপুর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু ভিন্ন।আপু হুটহাট বাবার বাসায় আসেনা।
রান্নার কাজ প্রায় শেষ গিয়ে গোসল করে নাও মিনি।শাওন প্রথম বার তোমাকে সামনে থেকে দেখবে।(তাহমিনা চৌধুরী)।
ঠিক আছে মা(মিনি)।
স্পর্শ আজ দুপুরের আগেই বাসায় ফিরেছে,মাইশা আসবে বলে।রুমের দরজা খুলেই স্পর্শ বড়সড় একটা ধাক্কা খেলো।মিনি একটা খয়েরী রঙের শাড়ি পড়েছে।আজ চোখে কাজল ও পড়েছে সাথে খয়েরী লিপস্টিক স্পর্শ বিয়ের দিন ছাড়া কখনো কাজল পড়তে দেখেনি।হাতে খয়েরী কাঁচের চুড়ি ও পড়েছে।ভেজা চুল দেখেই বোঝা যাচ্ছে মেয়েটা মাত্রই শাওয়ার নিয়েছে।শাড়ি পড়ে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে কোথাও কোমর,পেট দেখা যায় কিনা।স্পর্শের সামনে যেন কোনো অপ্সরা দাড়িয়ে আছে।স্পর্শ যেন দিন দিন মেয়েটার মাঝে হারিয়ে যায়।
মিনি সাজ কমপ্লিট করে রুম থেকে বেরুতে নিলেই দরজার সামনে স্পর্শকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,
আপনি কখন এলেন।আচ্ছা বাদ দিন,অফিস থেকে এসেছেন আগে শাওয়ার নিয়ে নিন।আমি আপনার কফি দিয়ে যাচ্ছি বলে মিনি রান্না ঘরের দিকে যায়।
স্পর্শ মুচকি হেসে ড্রেস নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে।
স্পর্শের কফি এখন মিনিই বানায়।স্পর্শের কড়া নির্দেশ তার কফি মিনিই বানাবে।প্রথম প্রথম মিনি নাকচ করলেও শেষে স্পর্শের জেদের কাছে হার মানতে হয়েছে।মিনি কফি খাটের পাশে ছোট টেবিলের উপর রেখে মাহিরার রুমের দিকে যায়।মাহিরা প্রথমে মিনির সাথে তেমন কথা না বললেও এখন বেশ ভালো সম্পর্ক হয়েছে মিনির সাথে।মাহিরা সবার সাথে খুব সহজে মিশতে পারেনা,কিন্তু একবার কাউকে ভালোবাসলে সহজে তাকে ছাড়েনা।
মিনি মাহিরার রুমে গিয়ে দেখে মাহিরা ভিডিও কলে রিজুর সাথে কথা বলছে।এই এক মাসে অনেক কিছু বদলেছে।মিনির ফ্রেন্ড রিজুর সাথে মাহিরার রিলেশন চলছে।স্পর্শ আর মিনির রিসিপশনের দিন থেকেই রিজু,মাহিরা একে অপরকে চিনে।বিয়ের কিছুদিন পর বাগানে মাহিরার বার বার রিজুর প্রসংশা করা,তার সম্পর্কে জানতে চাওয়ার কারণ এটাই ছিলো।
কিরে সালা দিন দিন ড্রাম হইতাছোস কেন…..?(মিনি)।
তুই আমারে সবসময় ড্রাম বলিস কেনো…?আমি গুলুমুলু,কিউট নট ড্রাম।প্রসংশার সৎ ব্যবহার করতে শিখ বেয়াদপ।এজন্যইতো তুই শুটকি হয়ে আছিস(রিজু)।
আম নট শুটকি।আমাকে দেখলে সবাই বলে পারফেক্ট।আর বাকি রইলো তোর কথা তুই সারাজীবন আমার কাছে ড্রামই থাকবি।(মিনি)
নিচ থেকে কথার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।মাইশা আপুরা বোধহয় চলে এসেছে।মাহিরা তাড়াতাড়ি নিচে এসো।আপুরা মনে হয় এসে গেছে।(মিনি)
আচ্ছ বাবু এখন রাখছি হ্যাঁ।লাভ ইউ(মাহিরা)।
লাভ ইউ টু বাবু।বায়(রিজু)।
মিনি মাইশাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
কেমন আছো আপু।কতোদিন পর দেখলাম তোমাকে।(মিনি)
মাইশা ও হেসে দিয়ে মিনিকে জড়িয়ে ধরে বলে, আমি ভালো আছি।তুমি কেমন আছো…?
এমনিতে ভালো ছিলাম এখন তুমি আসাতে আরো ভালো লাগছে বলে মাইশাকে ছেড়ে পাশে দাড়িয়ে থাকা শাওনকে উদ্দেশ্য করে মিনি বলল,,
আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া। ভালো আছেন…?
উত্তরে শাওন মুচকি হেসে বলল,,
আলহামদুলিল্লাহ ভালো।তুমি কেমন আছো..?
জ্বি ভাইয়া ভালো।(মিনি)।একে একে স্পর্শ, মাহিরা, বাবা,মা সবার সাথে কুশল বিনিময় করে সোফায় গিয়ে বসে পড়লো মাইশা আর শাওন।
মিনি মাইশাকে বলল,,
আচ্চা আপু এতগুলো মিষ্টি কিসের জন্য…?
মিনির কথায় সবাই কৌতূহল দৃষ্টিতে তাকালো মাইশা আর শাওনের দিকে।
মাইশা লজ্জায় মাথা নিচু করে রেখেছে।তাই শাওন কিছুক্ষণ চুপ থেকে মা-বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
আপনারা নানা-নানু হতে চলেছেন।
শাওনের কথা বোধগম্য হতেই মামুন চৌধুরী ও তাহমিনা চৌধুরী ছলছল চোখে মাইশার দিকে তাকিয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরেন।স্পর্শ আর মাহিরা ও যেন খুশিতে আটখানা হয়ে যায়। হবে নাই বা কেন..?পরিবারে নতুন সদস্যের আগমনে যে কেউ খুশি হয়।আমার মুখে ও চওড়া হাসির রেখা।সবাই নতুন সদস্য আসার খুশিতে মেতে ওঠে।
মাইশার বিয়ে হয়েছে প্রায় পাঁচ বছর।এই পাঁচ বছরে একটা সন্তানের জন্য কতো কি করেছে।শেষে আল্লাহ মুখ তুলে তাকিয়েছেন।
বিকালে মিনি,স্পর্শ,মাহিরা,মাইশা,শাওন ছাদে বসে আড্ডা দিচ্ছে।হঠাৎ শাওন মিনি আর স্পর্শকে উদ্দেশ্য করে বলল,আমরাতো তোমাদের মামা-মামী হওয়ার সুযোগ করে দিলাম এবার তোমরাও আমাদের ফুপা-ফুপি হওয়ার সুযোগ দাও।শাওনের কথায় স্পর্শ আর মিনি অস্বস্তিতে পড়ে যায়।অস্বস্তি কাটিয়ে স্পর্শ বলল,,,
মিনি এখনো বাচ্চা।আগে ওর আরেকটু বুঝ হোক তখন না হয় ভেবে দেখব।
স্পর্শের কথায় মিনির লজ্জা যেন আরো এক ধাপ বেড়ে গেলো।এবার মাহিরা মিনিকে চেপে ধরলো গান গাওয়ার জন্য।মাহিরার সাথে মাইশা আর শাওন ও সম্মতি দিলো।কিন্তু বাধা দিলো স্পর্শ ও কিছুতেই মিনিকে গান গাইতে দেবে না।যে ফাঁটা বাঁশের মতো গলা,গান গেয়ে মান ইজ্জত সব হারাবে।তাই স্পর্শ নানাভাবে মিনির গান গাওয়া আটকাতে চাইছে কিন্তু মাহিরা,মাইশা,শাওন এর সাথে পারলোনা।পারবে কিভাবে মিনি নিজেও গান গাইতে ইচ্ছুক।যদি মিনির সম্মতি না থাকতো তাহলে কিছু একটা করা যেত।
শেষ মেষ ঠিক হলো মিনি গান গাইবে আর স্পর্শ গিটার বাজাবে।মাহিরা নিচে নেমে স্পর্শের গিটারটা নিয়ে আসে।
স্পর্শ আল্লাহ আল্লাহ করে গিটারে সুর তোলে,
মিনি গান গাইতে শুরু করে।
♪♪Har lamha meri akhe
Tujhe dekh nahi cahe
Har ra….s..ta..mera
Teri tarafhi jaye…♪♪
Bepanah pyaar tujche Tu Kew janena..
Hiya ekrar tujche Tu Kew mane na…(2)
(বাকিটা নিজ দায়িত্বে শুনে নিবেন)
গান শেষ হতেই সবাই হাত তালি দিয়ে প্রসংশা করে।
ওয়াও ভাবি তুমি এতো সুন্দর গান গাও।আমিতো তোমার গানে ফিদা হয়ে গেছি।
স্পর্শ হা করে তাকিয়ে আছে।ও বুঝতে পারছে না ও কি জেগে আছে নাকি স্বপ্ন দেখছে।এই মাত্র কি মিনিই গান গাইলো।আরে নাহ এটা মিনি হতেই পারেনা ও তো সারাদিন বেসুরা গলায় গান গায়।
স্পর্শকে মিনির দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে শাওন স্পর্শকে খোঁচা মেরে বলল,মুখটা বন্ধ করো সালাবাবু,বউকে ঘরে গিয়ে ও দেখতে পারবে এখানে আমরা সবাই আছি এদিকেও একটু নজর দাও।
দুলাভাইয়ের কথায় স্পর্শের ধ্যান ভাঙতেই ও চট করে মিনিকে প্রশ্ন করলো, তুমি কোথাও রেকর্ডিং চালু করে রাখোনিতো।
স্পর্শের এরকম প্রশ্নে মিনি রেগে গিয়ে বলল,,
মানে…? আপনি কি বলতে চাইছেন।আমি গানটা নিজে গাই নি…..?
স্পর্শ বলল,
যদি এই গানটা তুমিই গেয়ে থাকো তাহলে প্রতিদিন রুমে বেসুরা গলায় কাউয়ার মতো কা কা করে যে সে কে…..?
মিনিকে কাউয়া বলায় রেগে গেলেও নিজেকে সামলে বলল,সুন্দর করে গান গাইতে হলে অনেক কষ্ট করতে হয়।কষ্ট হওয়ার ভয়েতো আমি নিজের গান গাওয়ার ইচ্চেটাকে মাটি চাপা দিতে পারিনা।তাই বেসুরা গলায় গান গেয়ে নিজের ইচ্ছে পূরন করি।
মিনির কথা শুনে স্পর্শ সহ সবাই হো হো করে হেসে ওঠে।
রাত ০২ঃ৪৫ মিনিট।মিনি ঘুমিয়ে আছে,স্পর্শের ঘুম ভেঙে গেছে।একধ্যানে তাকিয়ে আছে মিনির মায়াজড়ানো মুখের দিকে।স্পর্শ ভাবছে কি আছে এই মেয়েটার মাঝে যা আমাকে প্রতি খনে খনে টানছে।অফিস থেকে এসে ওকে না দেখলে কেন আমার শ্বাস আটকে আসে,নিজেকে কেমন পাগল পাগল লাগে।মেয়েরটার পাগলামি গুলো,মাঝেমাঝে উল্টো পাল্টা কথা বলা সব কিছু আমার এতো কেন ভালো লাগে…?।মেয়েটা যতক্ষণ আমার আশেপাশে থাকে অদ্ভুত এক অনুভুতি কাজ করে আমার মধ্যে।আচ্ছা এই অনুভুতিটার নাম কি…..?ভালো লাগা নাকি ভালোবাসা।জানিনা,কিচ্ছু জানিনা শুধু জানি আমার সারাটা জীবন এই মেয়েটার সাথে কাটাতে চাই।এই মেয়েটার হাত ধরে হাজার বছর বাঁচতে চাই,ওর পায়ের সাথে পা মিলিয়ে কোনো এক গভীর রাতে হাটতে চাই,ওর কোলে মাথা রেখে ঘুমাতে চাই,এগুলো যদি ভালোবাসা হয় তবে আমি ভালোবাসি।হ্যাঁ তাকে আমি ভালোবাসি।নিজের জন্য ভালোবাসি,নিজের ভালোথাকার জন্য ভালোবাসি।
তারপর মিনির কপালে ভালোবাসার উষ্ণ পরশ একে দিয়ে মিনিকে বুকে টেনে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ে।এটাই স্পর্শ ভালোবাসার প্রথম পরশ।এর আগে স্পর্শের এরকম অনেক ইচ্ছে হলেও ইচ্ছেটাকে দমিয়ে রেখেছে স্পর্শ। কারণ এতোদিন স্পর্শ শিওর ছিলো না ও কি চায়।আজ যেহেতু ও জেনেছে ও কি চায় তাই আজ আর নিজের ইচ্ছেটাকে দমিয়ে রাখেনি।
স্পর্শ গাড়ি নিয়ে বাসার নিচে দাঁড়িয়ে আছে মিনির জন্য।অফিস যাওয়ার পথে মিনিকে কলেজে নামিয়ে দিয়ে যাবে।প্রতিদিন মিনিকে স্পর্শ কলেজ ড্রপ করে দেয় আর আসার সময় ড্রাইভার নিয়ে আসো মিনিকে।কারণ স্পর্শ তখন অফিসে থাকে।
এতোক্ষণ কি করছে মেয়েটা বলে হাত ঘড়ির দিকে এক নজর তাকিয়ে চোখ সরাতেই স্পর্শের চোখ আটকে গেলো মিনির উপর।ব্লু ও ব্ল্যাক কালার কম্বিনেশনের একটা গোল জামা পড়েছে মিনি চুলগুলো সামনে হালকা একটু ফুলিয়ে পেছনে ছেড়ে দিয়েছে,মুখে হালকা লাইট মেকাপ,গায়ে জড়ালো ব্ল্যাক ওড়নাটা ঠিক করতে করতে এগিয়ে আসছে মিনি।আজকে এতো সাজগোজের কারন ওর বান্ধবী প্রিয়ার আজ বার্থডে।এগিয়ে এসে মিনি তাড়াহুড়ো করে বলল,,
সরি একটু লেইট করে ফেল্লাম।তারপর দুজনেই গাড়িতে উঠে বসলো।স্পর্শ ড্রাইভ করছে আর বারবার মিনিকে দেখছে।
স্পর্শ ওর দিকে তাকাচ্ছে বুঝতে পেরে মিনি বলল,আজকি আমাকে অনেক সুন্দর লাগছে যে বারবার তাকাচ্ছেন।
মিনির কথার উত্তরে স্পর্শ বলল,আজ তোমাকে পেত্নীর মতো লাগছে তাই তাকাচ্ছিলাম।মিনি মুখ ফুলিয়ে বলল,মোটেই আমাকে পেত্নী লাগছে না হুহ।তারপর তারা কলেজে এসে পড়ে।মিনি নেমে যায় কলেজে আর স্পর্শ গাড়ি ঘুরিয়ে অফিসের দিকে চলে যায়।
মিনি আর ওর কিছু ফ্রেন্ড শপিংমলে এসেছে।এমনিতে প্রিয়ার জন্য সবাই সারপ্রাইজ প্ল্যান করেছে তারপরও সবাই আলাদা আলাদা কিছু গিফট করবে প্রিয়াকে।মিনি ড্রেস দেখছে কিন্তু পচন্দ হচ্ছে না।মলের একটি ছেলে বলল ম্যাম আপনি কি ধরনের ড্রেস চান আমাদেরকে বলুন।
মিনি বলল,,
এই ধরুন হঠাৎ কালার,আচমকা ডিজাইনের কোনো ড্রেস হবে…?
মিনির কথা শুনে ছেলেটি ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো।মনে মনে বলল,মেয়েটা নিশ্চয়ই পাগল হয়ে গেছে।কিন্তু মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,না ম্যাম এরকম কোনো ড্রেস হবে না।তারপর মিনি ড্রেসের বদলে একটা হ্যান্ড ব্যাগ কিনে নেয়।
চলবে……..