তোমাতেই পূর্ণ আমি ❤,পর্বঃ০৯
লেখিকাঃ জিন্নাত চৌধুরী হাবিবা
পরীক্ষা শেষে মিনি বেরিয়ে পড়ে।আজ বাংলা প্রথম পত্র পরীক্ষা ছিলো।বান্ধবীদের সাথে পরীক্ষার বিষয়ে ডিসকাস করতে করতে গেইটের সামনে এসে দেখে স্পর্শ গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।এখন মাঝেমধ্যেই স্পর্শ সময় বের করে মিনিকে বাসায় পৌঁছে দেয়।স্পর্শকে দেখে মিনির ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠে।মিনি বান্ধবীদের বিদায় জানিয়ে স্পর্শের দিকে এগিয়ে যায়।স্পর্শ ফ্রন্ট সিটের পাশের দরজা খুলে দেয়।মিনি ও গাড়িতে উঠে পড়ে।স্পর্শ ড্রাইভ করছে আর মিনিকে পর্যবেক্ষণ করছে।মুখ দেখে বোঝা যাচ্চে পরীক্ষা ভালো হয়েছে।তাই আর স্পর্শ কিছু জিজ্ঞেস করলো না।কিছুদূর গিয়ে স্পর্শ একটা লেকের পাশে গাড়ি থামিয়ে দিলো।মিনি ভ্রু কুচকে বলল,
গাড়ি থামালেন যে?কোনো সমস্যা হয়েছে?
মিনির প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে স্পর্শ মিনিকে জিজ্ঞেস করলো,
আইসক্রিম খাবে?মিনি উপর নিচ মাথা দুলালো।যার অর্থ হ্যাঁ আমি আইসক্রিম খাবো।
মিনির উত্তর পেয়ে স্পর্শ গাড়ি থেকে নেমে আইসক্রিম আনতে যায়।এই সুযোগে মিনি গাড়ি থেকে নেমে লেকের পানিতে পা ভিজায়।
স্পর্শ এসেও মিনির পাশে লেকের পানিতে পা ডুবিয়ে বসে পড়ে।মিনির দিকে আইসক্রিম বাড়িয়ে দেয়। মিনি আইসক্রিম খেতে খেতেই স্পর্শকে জিজ্ঞেস করলো আপনি আইসক্রিম খান না?
স্পর্শ বলল,খুব একটা খাইনা।তবে এখন কেউ দিলে না করবো না।
উত্তরে মিনি বলল,তাহলে একটা আইসক্রিম কেনো আনলেন?দুটো আনলেতো আপনি একটা আর আমি একটা খেতে পারতাম।এখন আপনিতো আর আমার এঁটোটা খাবেন না।
মিনির বলার দেরি স্পর্শ ছোঁ মেরে মিনির হাত থেকে আইসক্রিম নিতে দেরি হয় না।
নিয়েই খেতে শুরু করে।
মিনি বোকার মতো চেয়ে আছে।তারপর মিনি কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,
আপনি আমার আইসক্রিম নিলেন কেনো?এখন আমি কি খাবো?
স্পর্শ বলল,তোমাকে আরো কিনে দেবো।আপাতত এইটা আমার।
মিনি চুপ করে আছে।মনে মনে বলল,সালা খাদক,তোর আমার আইসক্রিমই খেতে হলো?তুই একটা কিনতে পারলিনা?আবার বলে তোমাকে আরো কিনে দেবো?(মুখ ভেংচি কেটে)।তুই না বললেও আমি তোর থেকে আইসক্রিম উসুল করে নিতাম।বেটা খবিশ।
স্পর্শ বলল,আর বকো না তোমাকে আইসক্রিম কিনে দিয়েই আমি অফিস যাবো।তারপর দুজনেই উঠে পড়ে।স্পর্শের অফিসে কাজ আছে।মিনিকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আবারো অফিসে যাবে।
গাড়ির দিকে এক পা এক পা করে এগোচ্ছে আর মিনি ভাবছে,আচ্ছা উনি আমার মনে মনে বলা কথা গুলো কিভাবে বুঝেন?শুনেছি মনের টান আর ভালোবাসা থাকলে অন্যের মনের কথা বোঝা যায়।তাহলে কি উনি আমাকে ভালোবাসেন?ধুর উনি কেন আমাকে ভালোবাসবেন?উনার মাঝেতো সেরকম কিছুই আমি দেখছিনা।
স্পর্শের আওয়াজ কানে আসতেই মিনি জোরে পা চালিয়ে গাড়িতে উঠে বসে।স্পর্শ মিনিকে বাসায় পৌঁছে আবারো অফিসে চলে যায়।
বাসায় এসে মিনি তাহমিনা চৌধুরীকে সোফায় বসে থাকতে দেখে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে।কি করছো মা?
তাহমিনা চৌধুরী বলল,হামাগুড়ি দিচ্ছি।
তুমিতো সোফায় বসে আছো,তাইলে হামাগুড়ি কিভাবে দিচ্ছো?কৌতুহল কন্ঠে বলল মিনি।
দেখতেই পাচ্ছো সোফায় বসে আছি।তাহলে জিজ্ঞেস করচো কেনো?তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নিচে আসো।আমি তোমার জন্য না খেয়ে বসে আছি।
অবাক কন্ঠে মিনি বলল,সে কি তুমি বাবার সাথে খাওনি?এখন আবার আমার সাথে খাবে?
তাহমিনা চৌধুরী কটমট চোখে তাকালো।মিনি ছোট্ট একটা ঢোক গিলে উপরে চলে গেলো।মিনি বেশ বুঝতে পারছে শাশুড়ী মা রেগে আছে।এটাও বুঝতে পারছে ওর শশুরের সাথেই ঝগড়া করেছে।আজ স্বামীর রাগ ছেলে,মেয়ে,বউ সবার উপর ঝাড়বে।এসব ভেবেই মুচকি হাসলো মিনি।
তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে এসে খেয়ে আবার রুমে চলে আসে মিনি।এখন একটু রেষ্ট নিবে।তারপর আবারো পড়তে বসবে।হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো।ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখে
ভাইয়া নামটি জ্বলজ্বল করছে।মুখে হাসির রেখা টেনে মিনি কল রিসিভ করে।
কিরে পুচকি কেমন আছিস?(আদিল)
ভালো আছি ভাইয়া।তুমি কেমন আছো?বাবা মা কেমন আছে? বলল মিনি।
আমি ভালো আছি।বাবা মাও ভালো আছে।তোর তো পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে।ঠিক মতে পড়াশোনা করিস।(আদিল)
হুম।ছোট্ট করে জবাব দেয় মিনি।
তোকে একটা কথা বলার জন্য কল দিয়েছি।(আদিল)
কি?(মিনি)
রিয়াদের বাসায় আমাদের বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে বাবা মা।রিয়ার পরিবার ও রাজী।বিয়ের ডেইট ঠিক করেছি তোর বিয়ের এক সপ্তাহ পর।(আদিল)
আদিলের কথা শেষ হতেই মিনি এক চিৎকার দিয়ে বলে ওঠে।ফাইনালি রিয়া আপু আমার ভাবি হচ্ছে।আ’ম সো এক্সাইটেড।ইচ্ছে তো করছে সময়টাকে বাড়িয়ে পরীক্ষার এক সপ্তাহ পরটা এখনই নিয়ে আসি।(মিনি আদিল আর রিয়ার সম্পর্কের কথা জানতো)।
হয়েছে আর এক্সাইটেড হতে হবে না।খুশির চোটে আবার পরীক্ষার কথা ভুলে যাস না।এখন রাখছি,নিজের খেয়াল রাখিস।(আদিল)
তুমিও নিজের খেয়াল রেখো।(মিনি)
সন্ধ্যার পর অফিস থেকে বাসায় ফেরে স্পর্শ।এসেই মিনিকে পড়ার টেবিলে দেখে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে।
স্পর্শ ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে খাটে বসে পড়ে।মিনি পড়ার টেবিল থেকে ছুটে এসে স্পর্শের সামনে দাঁড়ায়।
স্পর্শ শান্ত স্বরে বলল, কিছু বলবে?
মিনি এক্সাইটেড হয়ে একদমে বলতে থাকে,জানেন?ভাইয়ার না বিয়ে ঠিক হয়েছে রিয়া আপুর সাথে।রিয়া আপু আর ভাইয়া দুজন দুজনকে ভালোবাসে।রিয়া আপু ভাইয়ার ভার্সিটির জুনিয়র ছিলো।আমার পরীক্ষা শেষ হওয়ার এক সপ্তাহ পরই বিয়ের ডেইট ফিক্সড করেছে।
স্পর্শ মিনির কথা শুনে বলল,এবার একটু শ্বাস নাও।তারপর আবার বলা শুরু করিও।
মিনি মুখ ভেংচি কেটে আবার পড়তে বসে গেলো।স্পর্শ মিনির চুলের দিকে তাকিয়ে বলল,যতদিন পরীক্ষা থাকবে এই মেয়ে চুলগুলো ও ঠিক করে আঁচড়াবে না।এ কয়দিন স্পর্শই আচড়িয়ে দিতো।এখনও চিরুনি হাতে
এগিয়ে গেলো মিনির দিকে।উদ্দেশ্য চুলগুলো আছড়ে বিনুনি করে দেওয়া।
হঠাৎ মিনি চুলে চিরুনির স্পর্শ পেতেই ঘাড় বেঁকিয়ে তাকালো স্পর্শের দিকে।স্পর্শ একমনে চুলগুলো আছড়িয়ে বিনুনি করছে।ইদানীং মিনির মনে হচ্ছে স্পর্শ একটু বেশিই কেয়ার করছে ওর।মিনির কাছে যে স্পর্শের কেয়ার গুলো খারাপ লাগে তা নয়।বেশ ভালোই লাগে।স্পর্শ আশেপাশে থাকলে মনটা শান্ত হয়ে থাকে।মিনি আবারও পড়ায় মনোনিবেশ করে।
মিনির পরীক্ষা প্রায় শেষের দিকে।সব পরীক্ষাই ভালো হয়েছে।আজ উচ্চতর গনিত ২য় পত্র পরীক্ষা।আজ হলেই পরীক্ষা শেষ।পরীক্ষা শেষ করে বেরিয়ে মিনি দেখলো আজ স্পর্শ নয় ড্রাইভার এসেছে মিনিকে নিতে।মিনিকে দেখে ড্রাইভার বললো,স্যার আমারে পাঠাইছে।স্যারের নাকি ইম্পরট্যান্ট একটা মিটিং আছে।তাই আমারে বলছে আপনারে বাসায় পৌঁছাইয়া দিতে।
স্পর্শ না আসায় মিনির মন খারাপ হয়ে যায়।তারপর ওহ বলে মিনি গাড়ির পেছনের সিটে বসে পড়ে।
আজ আকাশটা কালো মেঘে ছেয়ে আছে।মনে হয় বৃষ্টি নামবে।মিনি গাড়ির জানালা দিয়ে মুখ বের করে রেখেছে।বৃষ্টি ওর অনেক ভালো লাগে।কিন্তু বৃষ্টিতে ভিজলেই দুতিনদিন বিছানা থেকে উঠতে পারেনা।প্রচন্ড জ্বর এসে চেপে ধরে।মিনি গাড়ি থেকে নেমে বাসার ভেতর যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই বৃষ্টি নামে।আস্তে আস্তে বৃষ্টির গতি কমার বদলে বেড়েই চলেছে।মিনি ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে স্পর্শের কথা ভাবছে।এখন ওই মানুষটার কথা ভাবতে ও মনে একটা অদ্ভুত শিহরণ বয়ে যায়।স্পর্শর অনুপস্থিতিতে আজকাল নিজেকে কেমন ফাঁকা ফাঁকা মনে হয় মিনির।
“রাত আটটা বাজে ”
স্পর্শ কাকভেজা হয়ে ঘরে ঢুকে।মিনিকে একপলক ব্যালকনিতে দেখে নিয়ে কাবার্ড থেকে জামাকাপড় তুলে তাড়াতাড়ি ওয়াসরুমে ঢুকে পড়ে।দরজা লাগানোর শব্দে ঘোর ভাঙে মিনির।এতক্ষণ স্পর্শের কথাই ভাবছিলো।রুমে এসে স্পর্শের অফিসের ব্যাগ দেখে ওয়াশরুমের দরজার দিকে তাকালো।
পানির আওয়াজ আসছে ওয়াশরুম থেকে।তারমানে স্পর্শ ওয়াশরুমে।মিনি তাড়াতাড়ি কিচেনে চলে গিয়ে দু মগ কফি করে নিয়ে আসে।মিনি রুমে আসার মিনিট দুয়েক পর স্পর্শ ওয়াশরুম থেকে বের হয়।স্পর্শের চুল থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে।দেখে মনে হচ্ছে শাওয়ার নিয়েছে।মিনি স্পর্শের দিকে একটা কফির মগ এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,এখন শাওয়ার নিলেন যে?
অফিস থেকে ফেরার পথে গাড়ি নষ্ট হয়ে যায়।বাড়ি থেকে বেশি দূরে না পাঁচ মিনিটের পথ।বৃষ্টিতে ভিজেই বাসায় এসেছি।তাই শাওয়ার নিয়ে নিলাম।হাইচ্ছু।বলতে না বলতেই স্পর্শের হাঁচি শুরু হয়ে গেলো।হাইচ্ছু,,,,,,হাইচ্ছু।
মিনি বলল,তাড়াতাড়ি করে কফিটা খেয়ে নিন।ডিনার করেই শুয়ে পড়বেন।
কফি শেষ করে রাত নয়টায় সবাই ডিনার করে শুয়ে পড়ে।শুয়ে পড়লেও ঘুম নেই চোখে মিনি স্পর্শের।
রাতে উষ্ণ তাপে ঘুম ভেঙে যায় মিনির।চোখ খুলে তাকিয়ে দেখে স্পর্শ ওকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে।মিনি নিজের একটা হাত স্পর্শের হাতের উপর রাখতেই চমকে ওঠে।তারপর স্পর্শের কপালে,গালে,গলায় হাত ছুঁইয়ে দেখে স্পর্শের গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।এখন আমি কি করবো?ওনারতো গায়ে প্রচন্ড জ্বর।মাথায় জলপট্টি দিতে হবে।মিনি স্পর্শের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে।স্পর্শ ছাড়ছে না বিড়বিড় করে কিছু একটা বলছে।এভাবে হলে চলবেনা মিনি অনেক কষ্টে স্পর্শের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়।রান্নাঘর থেকে একটা বাটি এনে রুমাল ভিজিয়ে স্পর্শের কপাল বারবার ভিজিয়ে দিচ্ছে।জ্বর যেন কমার নামই নেই।অনেক্ষণ জলপট্রি দেওয়ার পর ড্রয়ার খুলে একটা ঔষধ বের করে স্পর্শকে ধরে খাইয়ে দেয়।স্পর্শের শরীর প্রচন্ড বেগে কাঁপছে।মিনি স্পর্শের গায়ে কাথা টেনে দেয়।তারপর ও কাজ হয় না।এবার আলমারি থেকে দুইটা কম্বল নামিয়ে স্পর্শের গায়ে দেয়।কিছুতেই যেন কাজ হচ্ছে না।এবার মিনি নিজেই কম্বলের ভেতর ঢুকে স্পর্শকে
জড়িয়ে ধরে।স্পর্শ মিনিকে নিজের ভেতর যেন ঢুকিয়ে ফেলবে।
সকালে ঘুম ভাঙতেই স্পর্শ নিজেকে মিনির বুকে আবিষ্কার করে।গতরাতের কথা মনে করেই আলতো হাসে।মিনি একটু নড়েচড়ে উঠতেই স্পর্শ আগের মতো চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান ধরে পড়ে থাকে।মিনি চোখ খুলে প্রথমে স্পর্শের কপালে হাত ছোঁয়ায়।জ্বর নেই।কাল রাতে কি ভয়টাই না পেয়েছিল মিনি।এবার স্পর্শের থেকে সরে আসতেই স্পর্শ শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মিনিকে।মিনি উঠতে না পেরে ওভাবেই আবার ঘুমিয়ে পড়লো।
চলবে………
হ্যাপি রিডিং?