#তোমার খোঁজে এই শহরে
#পর্বঃ১ ভালোলাগে_তোমায়
#নবনী_নীলা
ইয়াদ বিরক্ত হয়ে দাড়িয়ে পিছনে তাকায়, মেয়ে তিনটা এখন এমন ভাব করছে যেনো কিছুই জানেনা। আগে টয়া একা পিছে পিছে আসতো দুদিন ধরে আরো দুইটাকে সঙ্গে করে এনেছে। কলেজে যাবার সময় প্রতিদিন এমন ঝামেলা ইয়াদের ভালো লাগছে না।
ইয়াদ হাতের ইশারায় টয়াকে ডাকলো। টয়া না দেখার ভান করে একটা দোকানের সাইনবোর্ডের দিকে তাকিয়ে আছে। ইয়াদের রাগ আরো বেড়ে গেলো, এই মেয়ে পিছে পিছে ঘুরবে আবার ডাকলে এমন ভাব করবে যেনো চিনেই না। ইয়াদ রাগ সামলে নিলো কারন ঠাণ্ডা মাথায় এদের হ্যান্ডেল করতে হবে নইলে শেষে দেখা যাবে কলেজে ঢুকে ওর ক্লাসে উকি পর্যন্ত মারছে।
ইয়াদ ওদের দিকে এগিয়ে আসছে দেখে টয়ার পাশের দুই মেয়ে দৌড়ে একটা দোকানে ঢুকে পড়ে। টয়া অন্যদিকে তাকিয়ে সাইনবোর্ড দেখছিল তাই ইয়াদ যে আসছে সেটা সে খেয়াল করেনি। হটাৎ পাশের দুইটাকে না দেখে টয়া চমকে উঠে। কি ব্যাপার ? গেলো কোথায় শয়তান গুলো, আয়হায়!
বলেই পাশে তাকাতেই টয়ার টনক নড়ে উঠেছে। ইয়াদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে । টয়া এর আগেও ধরা খেয়েছে কিন্তু এভাবে হাতে নাতে ধরা খায়নি। ইয়াদ পিছনে তাকালেই দৌড় দিয়ে পালিয়ে গেছে কিন্তু আজ মনে হচ্ছে কপালে মহাকাশের সব গ্রহ এক সঙ্গে ঘুরছে।
ইয়াদ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল কারণ সে ভেবেছে টয়া নিজে থেকে কিছু বলবে আর যাই হোক নিজের সাফাই গাইবে কিন্তু টয়া কিছু না বলে হাসি মুখে তাকিয়ে আছে। ইয়াদ এই মেয়েকে যত দেখছে ততো অবাক হচ্ছে।
ইয়াদ ভ্রু কুঁচকে দুই হাত বুকের কাছে ভাজ করে বললো,” কি সমস্যা? এই দিকে কি? হ্যা? তোমার স্কুল তো উল্টো দিকে। প্রতিদিন এইখানে কি করো?”
টয়া ইয়াদের প্রশ্ন শুনে কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছেনা না কারণ সত্যিটা বলা যাবে না। ইয়াদের পিছু পিছু এসেছে এটা বললেই মান ইজ্জতের ফালুদা হয়ে যাবে। টয়া কিছুক্ষণ আমতা আমতা করে রাহি আর ছোঁয়া পাশে আছে কিনা দেখছে।
এভাবে রাস্তার মাঝে দাড়িয়ে কথা বলাটা আসে পাশের লোকজন ভালো ভাবে নিচ্ছে না সেটা বোঝাই যাচ্ছে দোকানদারগুলো তাকিয়ে আছে তাই বলে ইয়াদ আজকে টয়াকে ছেড়ে দিবে না। টয়ার এদিকে হার্টের অবস্থা খারাপ নিজের ক্রাশ সামনে দাঁড়িয়ে আছে এতো সামনে।
তার উপর আবার কথা বলেছে, নিজে থেকে কথা বলেছে এতো দিনের কষ্টের ফল পাওয়া গেছে তাহলে।
এইসব চিন্তা করেই টয়া দ্বিতীয় স্ট্যাচু অফ লিবার্টি হয়ে গেছে। ঘনো ঘনো হাত কচলাচ্ছে।
দোকানদার এবার আরো সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছে। ইয়াদ কিছু না ভেবেই টয়ার হাত ধরে ওকে একটা দোকানের পিছনের ছোটো একটা জায়গায় নিয়ে এলো।
টয়া শুধু ইয়াদের হাতের দিকে তাকিয়ে আছে তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তাতে তার কোনো মাথব্যথা নেই।
টয়া মুগ্ধ হয়ে নিজের আর ইয়াদের একসাথে হাত ধরে হাঁটা দেখছে। নিজের অজান্তেই মাথা নুইয়ে একটু হাসলো।
ব্যাপারটা ঠিক কি হলো ওরা দুজনেই বুঝলো না। ইয়াদ নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে দ্রুত হাত সরিয়ে আনলো। দুইজনেই একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেছে। টয়া নিজের হাত দুটো গুটিয়ে একসাথে ধরে মাথা নিচু করে দেওয়ালের সাথে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
মনে হচ্ছে সে কোনো এক ঘোরের মাঝে আছে কিংবা এটা কোনো স্বপ্ন ঘুম ভাঙলেই সব শেষ।
ইয়াদ একটু নিচু হয়ে বললো,” এবার বলো কি সমস্যা প্রতিদিন আমার পিছু পিছু আসো কেনো?”
ইয়াদের কথায় টয়া ঘাবড়ে গেলো। কি বলবে এবার সে? চুপ করে থাকলে ধরা পড়ে যাবে তাই চোঁখ তুলে তাকিয়ে অনেক সাহস নিয়ে বললো,” কোথায় পিছু পিছু আসি? আমি… .আমি…ক..ল..ম নিতে এদিকে এসেছি।”
ইয়াদ একটা ভ্রু তুলে বললো,” আচ্ছা তাই বুঝি? তা প্রতিদিন কলম কিনতে আসতে হয়? আর তোমার স্কুলের স্টোরে কি কলম সংকট দেখা দিয়েছে?”
টয়া একটা ঢোক গিললো কারণ সে ধরা খাচ্ছে। ধুরো ক্রাশটা দেখছি বেশি চালাক। টয়া ভাব নিয়ে বললো,” এই দিকে একটা দোকানে অনেক ভালো কলম পাওয়া যায় তাই আমি এদিকে আসি। আর ..আর …আর …।” বলতে বলতে টয়া চুপ করে যায়। কারন এর পর কি বলবে সেটা সে জানে না।
ইয়াদ টয়াকে বেঙ্গ করে বললো,” আর.. আর.. আর কি? স্কুল পড় মাত্র, ঘোরাঘুরি বন্ধ করে ভালো করে পড়ালেখা করো বুঝলে?”
টয়া চোখ নামিয়ে হ্যা সূচক মাথা নাড়ল। ইয়াদ সোজা হয়ে দাড়িয়ে দুই হাত ভাঁজ করে প্রশ্ন করলো,” কয়টায় ক্লাস তোমার?”
টয়া চোখ তুলে সাড়ে আটটা বলে চোখ নামিয়ে ফেললো। ইয়াদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,” কয়টা বাজে ঘড়িতে জানো?”
টয়া মাথা নিচু রেখে না সূচক মাথা নাড়লো। ইয়াদ টয়ার হাতের দিকে তাকালো মেয়েটার হাতে ঘড়ি নেই। স্কুলে পড়ুয়া এক মেয়ের হাতে ঘড়ি থাকবেনা এটা কেমন কথা?
ইয়াদ এক হাতে কপাল কচলে নিজের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো,” ৮.২৪ বাজে। তোমার ইউনিফর্ম দেখে তো মনে হচ্ছে কাছেই স্কুলটা দৌড় দিয়ে চলে যাও, যেতে পারবে না? আর ঘড়ি পরার অভ্যাস করো এই বয়সে সময়ানুবর্তিতা খুব জরুরী।” বলে ইয়াদ কাধের ব্যাগ ঠিক করে চলে গেলো, তার গিয়ে আবার বাস ধরতে হবে কলেজের।
ইয়াদ যে উপদেশ মুলুক বাণী টয়াকে দিয়েছে তার সবই উলো বনে মুক্ত ছিটানোর মতন। সে উপদেশের ধারের কাছেও ঘেঁসবেনা।
ক্লাস নাইন এ পড়ুয়া আর্নিহা তাবাসসুম টয়া, স্কুলের শীর্ষ দুষ্ট বালিকা আবার সবার আদরেরও। এই মেয়েকে স্কুলের প্রিন্সিপাল পর্যন্ত স্নেহ করে। বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে বড়ো দুই ভাই আছে। বড় ভাই আমেরিকায় থাকে আর মেজটা ভার্সিটির সেকেন্ড ইয়ার এ পড়ছে। একমাত্র মেয়ে বলে ছোটো বেলা থেকে আহ্লাদে বড়ো হয়েছে টয়া।
ফ্যামিলি নিয়ে কথা আপাদত এই পর্যন্তই থাক। এবার ইয়াদ আর টয়া প্রসঙ্গে আশা যাক।
ইয়াদ কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। ছোট বেলা থেকে বাবার ট্রান্সফার এর কারণে তার ছোটবেলা ছিলো ডিস্টার্ব । তার বাবার ট্রান্সফার এর কারণেই এবার গাজীপুর থেকে ধানমন্ডিতে বাসা নেওয়া। বাসা নিয়েই সে পরেছে এক দুষ্টু পরীর পাল্লায়। দুষ্টু পরী টয়ার বারান্দা আর পড়ুয়া ছেলে ইয়াদের বারান্দা সামনা সামনি। এতেই হয়েছে বিপদ। দুষ্টু পরী ইয়াদের বাসার পাশাপাশি এবার রাস্তায় ও হানা দিয়েছে।
_____________________________
টয়া বাসায় এসেই ব্যাগ টেবিলে ছুড়ে দিয়ে বাবা বাবা ডাকতে শুরু করেছে। ফরিদুর রহমান আজ ফ্যাক্টরিতে যাবে না, তিনি ইজি চেয়ারে বসে আরাম করে পুরনো গান গুলো শুনছিলেন। এর মাঝেই মেয়ের আওয়াজ পেলেন কানে। কানে আওয়াজ আসতে না আসতেই দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে টয়া এসে হাজির। মেয়ে স্কুল থেকে ফিরে ড্রেস না বদলেই, না খেয়ে ফরিদুর রহমানের রুমে এসেছে দেখে তিনি কিছুটা চিন্তিত হলেন।
তিনি রেডিও টা বন্ধ করে বললেন,” কিরে কি হয়েছে? খাসনি এখনো?”
টয়া বাবার কাছে গিয়ে না সূচক মাথা নাড়ল। ফরিদুর রহমান মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন,” কি হয়েছে? বকা খেয়েছিস নাকি?”
” না, বাবা শোনো না! আমি না ঘড়ি কিনবো। আমার ঘড়িগুলো পাচ্ছি না।”, মুখ শুকনো করে বললো টয়া।
ফরিদুর রহমান মেয়ের কথায় হাসলেন,” আচ্ছা ঠিক আছে আমি কালকে তোর জন্য ঘড়ি কিনে আনবো। তা হটাৎ ঘড়ি পড়তে ইচ্ছে হলো যে?”
” এমনেই, বাবা আজ চলো যাই আমার আজকেই ঘড়ি লাগবে। বাবা প্লীজ বাবা।”, মেয়ের কথা ফরিদুর সাহেব ফেলতে পারেন না তাই তিনি বললেন,” আচ্ছা যাবো বিকালে তোকে নিয়ে এবার গিয়ে খেয়ে নে।”
টয়া thank you বাবা বলে নাচতে নাচতে নিজের রুমে গিয়ে ধপাস করে বিছায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে নিজের টেডিটা জড়িয়ে ধরলো। টয়া বারান্দার পাশের জানালা দিয়ে ইয়াদের রুমের দিকে কাত হয়ে শুয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।
ইয়াদকে টয়ার ভীষণ ভাল্লাগে একবার বৃষ্টির দিনে ইয়াদ বারান্দায় এসে গান গেয়েছিলো। এতো সুন্দর চেহারা, লম্বা একটা ছেলে বৃষ্টিতে গান গাইছে দেখতে যে কত সুন্দর লাগছিল। সেই গান শুনেই টয়া এক ঘোরের মাঝে চলে গেছে। টয়ার খুব ইচ্ছা একদিন ইয়াদ মুগ্ধ হয়ে টয়ার দিকে তাকাবে, যদিও এখন বিরক্তি নিয়ে তাকায়।
ছেলেটার একটাই সমস্যা ছেলেটা বেশি পড়ালেখা পড়ালেখা করে। আজ প্রথম কথা বললো তাও দেখো কত জ্ঞান দিয়ে গেলো। সময়মনু হও, পড়ালেখা করো, ঘোরাঘুরি করো না বাপরে!
এখন বাসায় নেই তবে কলেজ থেকে এসে ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নিয়ে পড়তে বসলে আর উঠার নাম নেই। ইয়াদ কে উকি মেরে দেখার জন্য টয়ার ও বসে থাকতে হয়। টয়ার ধারণা এভাবে আর কিছু বছর বসলেই টয়া একদিন কুঁজো বুড়ি হয়ে যাবে। সে কুঁজো হয়ে গেলে ইয়াদেরই কষ্ট হবে ওকে কাধে করে ঘুরতে হবে।
[চলবে]