তোমার প্রেমে মাতাল,পর্বঃ১

0
6963

তোমার প্রেমে মাতাল,পর্বঃ১
লেখিকা_মায়াবী(ছদ্মনাম)

বাসররাতে ঘোমটা টেনে বসে আছি আমার বরের অপেক্ষায়, ফুল দিয়ে সাজানো ঘর টায়।নীলে ছেয়ে আছে পুরো ঘরটায়।নীল গোলাপ আর অপরাজিতায় বেডটা সাজানো।যেন এক টুকরো আকাশ। উঁহু। বরং এক টুকরো আকাশে আমি নীল পরী, ভেসে বেরাচ্ছি। কতো রকম যে অনুভুতি মনে ধরা দিচ্ছে তা বলা বাহুল্য নয়।এক তো এই রাত প্রতিটি মেয়ের জন্য হয় সবচেয়ে মধুর ও মহামূল্যবান। আবার এর সাথে মনে দানা বেধে আছে অসম্ভব ভয়।এইটা মোটেও ভয়ংকর নয় বরং শিহরণের। লজ্জায় বুঝি আজ মরেই যাব…..

হটাৎ কেউ আমার কাছে আসছে। ঘুম ঘুম চলে আসছিল। এমন একটা অনুভূতি হওয়ায় একদম সোজা হয়ে বসলাম। বুক কেমন যেন ধিপ ধিপ করছে।ভয়ংকর লজ্জাটা আবার ভর করল আমার উপর। বিছানার চাদর টা খামছে ধরলাম। চোখ খিচ বন্ধ করে নিলাম। কেপে কেপে আমি, ছন্নছাড়া আমার মন।আস্তে করে ঘোমটা খুলে গেল। চোখ খুলে সামনের মানুষটাকে দেখলাম নীল শেরোওয়ানি পড়া আমার বর নিবিড়। কি অদ্ভুত সুন্দর সুদর্শন আটাশ বছরের যুবক।লাল ফর্সা লম্বাটে মুখ। খোচা খোচা সারা মুখ ভর্তি চাপ দাড়ি। চুল গুলো সিল্কি বড় বেশ। চোখ ঢেকে যায় প্রায়। ৫ফিট১০ হাইটের ছেলেটির চোখের মনি একদম কালচে। আর বেশ বড়।যেন কতো যে গভীর সেই চাহনি। তাকিয়ে থাকলে আমি ডুবেই যাব। টুপ করে ছেলেটি আমার কপালে প্রেম স্পর্শ করে দিল। লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলাম। অমনি সে নিলজ্জের পরিচয় দিল। চোখ নামিয়ে থাকায় আগে বুঝতে পারিনি। সে কথা নেই বার্তা নেই টুপ করে ঠোঁটে ঠোঁট দিয়ে ছুঁয়ে দিল। অমনি আমি ধরফরিয়ে উঠলাম। আসে পাশে ঠিক করে তাকালাম।কি হলো বোঝার চেষ্টা করছি। কই কোথায় নিবিড়? ও তো নেই কোথাও। আমি অপেক্ষা করতে করতে বসেই ঝিমিয়ে গিয়েছিলাম।শাহনজরের সময় আয়নায় তাকে যতটুকু দেখেছিলাম, গাড়িতে কান্নায় চোখ ঘোলাটে ছিল তাই পাশে থেকে তার বাহুতে মাথা রেখে কাদছিলাম, আড় চোখেও আর দেখা হয়নি। বাকি টুকু মনের রং দিয়ে তাকে নীল শেরওয়ানিতে কল্পনায় একে ফেলেছি। এ মা! কি লজ্জা। কি কি ভাবছিলাম। নিলজ্জ তো আমার নিবিড় নাহ। আমিই নিলজ্জ। ছি!!! ভাবতেই লাল হয়ে গেলাম আবার। ভয়ংকর নিলজ্জ আমি! বলেই মুচকি হাসলাম। ভয়ংকর শব্দটি নিবিড় প্রায়ই বলে এই ভেবে হাসলাম। কি বাজে অভ্যেস হয়ে গেছে আমার, নিবিড় ঘিরে….

ভাবতেই হঠাৎ মনে হল এত কিছু ভাবতে ভাবতে কখন মধ্যরাত হয়ে গেছে টের পাওয়া হয়নি। তাড়াহুড়ো করে বিছানা থেকে নেমে রুমে দেয়ালে লাগোয়া একটি ছোট সোফায় আমার পার্স টা হাতে নিলাম।লক্ষ্য আমার, কয়টা বাজে দেখতে। ওমা ফোনটা বন্ধ। এতক্ষণ ঘরটা দেখাও হয়নি। নিজের বাসরের চিন্তায় মগ্ন ছিলাম কিনা।যাহ বাবা! এই ভেবে বুঝি মুখ লাল হয়ে গেল আবার। দরজার উপর এ তাকাতে ঘড়ি টা চোখে পরলো।কিহ! রাত ২টা ৪০ মিনিট…

মায়াবী নাম হলেই কি কেঊ মায়াবী হয়ে যায়? আর যদি সত্যি মায়াবী সে হয়ে থাকে তবে কি সত্যি আমার বরের কাছে আমি মায়াবী? তবে কেন তার কাছে আমার জন্য মায়া নেই। আমি খুব একটা সুন্দর না। হালকা হলদে আমার গায়ের রং।কিন্তু ফর্সা নই। চুল পিঠ ছাড়িয়ে কোমড় ছুঁয়েছে। একদম ঝরঝরে চুল। মুখে আলাদা লাবণ্য নেই। তবে সবাই বলে খুব মায়াবী আমার চোখ জোড়া। তাই বুঝি বাবা নাম রেখেছেন। মায়াবী আলম। ফরহাদ আলমের দুই মাত্র সন্তানের মাঝে এক মাত্র মেয়ে আমি। এক ভাইএর আদরের দুলালীও। দেমাগি ছিলাম বটে কিন্তু অহংকারী নই। দেমাগী রূপটাও সে চলে গেছে পাচঁ বছর পূর্বে।

ফজরের আজান হল মাত্র। এই রাত কি আমরা পাব আর? এত পবিত্র রাত কি আর কখনো আসবে? চোখ বন্ধ করে নিলাম।জানি এখন পানি ও পরবে না। শুকিয়ে গেছে সকল চোখের জল। কেদে সারারাত চোখ ফুলিয়ে ফেলেছি। কালরাতে ২ রাকাআত নামাজ ও পড়া হল নাহ। এখন না হয় ফজরের নামাজ টা সেরে নেই। নীল রঙের বিয়ের বেনারসি টা খুলে একটা মেরুন রঙের গরদের শাড়ি পড়ে নিলাম গোছল সেরে।অজু শেষে ঘরে ডুকতেই নীল রঙের শেরোওয়ানিটা বিছানায় পরে থাকতে দেখলাম। কেন যে তাকে গাড়িতে দেখলাম না। খুব আপসস হচ্ছে।ভেবেছিলাম বাসরে তাকে একনজরে পলকবিহীন ভাবে দেখব।তা আর হলো কোথায়! ভাগ্যিস কালকে স্বপ্নে কয়েক সেকেন্ড হলেও কল্পনায় দেখে ফেলেছি।বিয়েরদিন কি কেউ নীল পড়ে? তার প্রিয় রং এ তাকে দেখতেই এই জেদ ছিল আমার। নিজেকেও তার রঙে সাজাতেও……… ।বুঝলাম নিবিড় এসেছে। রুমের দরজা টা খোলা। কাল রাতে সে আসবে বলে আর লাগানো হয়নি।রুমে বারান্দায় আর তাকে খুজে পেলাম নাহ। বুঝলাম চোরের মত এসে জামা টা পালতে চোরের মতোই বেরিয়ে গেছে।

নামাজ টা সেরে এসে দেখি ৫.১০টা বাজে। দোতালায় এই রাস্তা ঘেষানো বারান্দাটায় দাঁড়িয়ে আছি।হটাৎ তার আগমন যেন আমি টেরই পায়নি। একরাত আগেও আমি তার পায়ের নিঃশব্দ আওয়াজ যেন ৩০/৪০ হাত দূর থেকে টের পেতাম। নিবিড় আসছে…..
পিছন থেকে বলল কেউ, উঠলে কখন?
আমিঃ নিশ্চুপ
নিবিড়ঃ কথা বলছো না কেন মায়াবিনী?
মায়াবিনী নামটা শুনে খুশি হওয়ার বদলে মনে হল কেও আমার বুকে তীব্র ভাবে ছুরি দিয়ে আঘাত করল। তাচ্ছিল্যের হাসি দিলাম তার দিকে ফিরে।
নিবিড়কে দেখে বুক কেমন করে উঠলো। কালকে বিয়ের পর শাহনজরের সময়ও তাকে কতো উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল।কি এমন হলো, একরাতেই আমি আমার নিবিড় কে চিনতে পারছি নাহ। এ কাকে দেখছি আমি। চোখ অসম্ভব লাল। ফুলে গেছে যেন কেদেছে। চুল ও উস্কখুসকো। সারারাত ঘুমায়নি। এক দুশ্চিন্তায় নাহয় খুব বড় অসুখের খবর পেয়েছে।ভিতর এ আমি দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিলাম। সে কি করেছে তা বেমালুম ভুলে কাছে এসে জিজ্ঞেস করলাম
আমিঃ কি হয়েছে আপনার? (কপালে হাত রেখে জ্বর হয়েছে কিনা যাচাই করতে)
নিবিড়ঃ ককই ককিছু ননাহ তো(কিছুটা তুতলিয়ে পিছিয়ে গিয়ে)

আমি অনেকটাই অবাক হয়ে গেলাম। এমন কেন করছে ও।চোখে চোখ রাখতে কেন পারছে নাহ? আমার এমন হটাৎ ছোয়ায় ও এমন দূরে চলে গেল কেন? এমন তো নয় এটা প্রথম ছোয়াঁ!! আমায় কাল রাত এমন অপেক্ষায় রাখল কেন? কি চায় ও? নিবিড় এর দিকে তাকিয়ে এমন আরও কতো কঠিন প্রশ্ন যে মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।
নিবিড় আমায় দেখে বুঝে ফেলল বোধহয় কি চলছে আমার মনে।কেনই বা জানবে নাহ? এই মনে তো শুধু তারই বিচরণ। এই মন শুধুই তার। সেই পাচঁ বছর আগেই আমি আমার মন তার নামে লিখে দিয়েছিলাম।

হ্যা ঠিকই ভাবছেন। আমার আর নিবিড় এর প্রেমের বিয়ে।দীর্ঘ পাচঁ বছর প্রেমের পরিণতি এই বিয়ে। এইটা প্রথম বললেও ভুল হবে এইটা দ্বিতীয় বিয়ে আমাদের। পারিবারিক ভাবে এটা আমদের প্রথম বিয়েই বটে। ধিরে ধিরে বুঝবেন কাহিনির ঝটলা।

নিবিড় এর এমন ছটফট ভাব দেখে নিজেকে কিছুটা সামলে নিলাম। ওর পাশ কাটিয়ে চলে আসলাম রুমে।রুম থেকে বের হওয়ার আগে বললাম বসেন চা আনছি আপনার জন্য। ফজরের নামাজ পড়ে তো আর ঘুমান না।
নিবিড়ঃ কি করে জানলে আমি নামাজ পড়েছি?(অবাক হয়ে)
আমিঃ আমার ভালোবাসা এতোটাও দুর্বল না। যে ছেলেটা আমার ভালোবাসায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে তুলেছে, যে আমাকে পেতে আমার বাবা মার কাছে হাত পেতেছে, যে আমার বলায় পাচঁ ওয়াক্ত নামাজ পড়া শুরু করেছে মসজিদে আরও চার বছর আগে থেকে। একরাতে এমন কিছু হয়ে যাবে না যে সে আমার ভালোবাসা অস্বীকার করে এইসব ভুলে যাবে। (বলে একটু হাসলাম)
নিবিড়ঃ এখনো কি করে আমায় বিশ্বাস করছো মায়াবিনী? কি করে পারছো? বাসররাতে তোমার বর আসেনি।সে এই পবিত্র রাতে কোথায় ছিল? মনে সন্দেহ হচ্ছে না? ( কিছুটা দৌড়ে এসে আমার কাছে দাঁড়িয়ে বিস্ময় চোখে বলছে)
আমিঃভালোবাসা বিশ্বাসের উপর তৈরি। একরাতে আমার বিশ্বাস গুড়ে বালি হবে কে বলল আপনায়?(শান্ত ভাবে)
আর তার চেয়েও বড় কথা এটা কি আমাদের প্রথম রাত ছিল নিবিড়?

এতক্ষন নিবিড় এর চোখ ভাষাহীন ছিল। হটাৎ কি হলো আমার শেষের কথা শুনে, ওর চোখ চিকচিক করে উঠলো যেন শত অভিমান ওই চোখে। ওই চোখে তাকিয়ে থাকলে আমার সব রাগ পরে যাবে।হুড় হুড় করে কেদে দিব। ওই চোখের ভাষাও আমি পড়ে ফেলব।কিন্তু আমি চাই ও নিজে থেকে বলুক আমায় এমন কি হয়েছিল রাতে ও আমার কাছে আসেনি। রাগটা পড়ে গেলে আমার, নিবিড় কিছুতেই আর বলবে না। একটা কথাও আমি আর ওর কাছে থেকে জানতে পারব না। ওকে তো আমি জানি। তাই কঠোর হয়ে থাকতে হবে আমায়। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসলাম।
আজকে শশুরবাড়িতে প্রথম সকাল। জানি কোথায় রান্নাঘর। কিন্তু প্রেম করতাম যখন নিবিড় এর সাথে। ও ছবি তুলে দেখিয়ে ছিল। কোথায় কার রুম, রান্নাঘর বারান্দা ছাদ।ভেবে একটু হাসলাম। তাই আমি জানি কোথায় কি আছে।যেয়ে চা বানালাম চার কাপ। জানি আমার শশুর শাশুড়ী নামাজ পড়েন উঠে। শশুর বাবা মসজিদে যান,
আর শাশুড়ী মা ঘরে পড়েন। চা বানিয়ে বাবার রুম এ গেলাম দেখি উনি মাত্র ফিরেছেন। চা দিলাম। সালাম করলাম। মা আমায় দেখে এক গাল হেসে দিলেন। বাবাও হাসলেন।
বাবাঃ এই জীবনে প্রথম আমি কোনো শাশুড়ীকে ছেলের বিয়ের পরদিনই বউকে দেখে হাসি দিতে দেখলাম।
মাঃ তোমার সাজ সকালে ঝগড়া করার মুড কি করে চলে আসে আমি বুঝি না বাপু।?
বাবাঃ বাহ রে তোমার প্রশংসা করলাম তাও আমি ভুল।?
মাঃ তোমার এইসব ধং আমি জানি।বাকি যে কয়টা চুল আছে এইসব কি মাথা থেকে ফেলে দিতে চাচ্ছো?
বাবাঃএ্যাঁ?(ভেবাচেকা খেয়ে)
এতক্ষন মুচকি হাসলেও আমি এবার হেসেই দিলাম জোরে ??
বাবা লজ্জা পেয়ে গেলেন। আর মা একটু হেসে বললেন মায়াবী মা তুমি নিবিড়কে চা দিয়ে রান্নাঘর এ এসো। আমিও ওখানেই থাকব।
আমি মাথা নেড়ে জি বুঝিয়ে চলে এলাম ২ কাপ চা নিয়ে ঘরে।

চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here