তোমার মাঝে,পর্ব-০১

0
5474

তোমার মাঝে,পর্ব-০১
সারিফা তাহরিম

সোডিয়ামের হালকা আলো এসে পড়ছে তিতলির মুখে।নবম শুক্লপক্ষের চাঁদের আলোও যেন ঝিলমিল করছে।ছাদের এক কোণে আকাশ দেখতে ব্যস্ত তিতলি।বেলী ও বকুল ফুলের সুবাস যেন আরো মনোরম করে তুলছে পরিবেশকে।লালের মধ্যে সাদা কালো রঙের সুতোয় হাতের কাজের পড়ে দাঁড়িয়ে আছে তিতলি।স্নিগ্ধ বাতাস তিতলিকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। আর তিতলির চুলও বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে খেলছে।দূর থেকে এক জোড়া নীলাভ চোখ মুগ্ধ হয়ে দেখছে তিতলিকে।আর তিতলি ডুব দিয়েছে অতীতের স্মৃতির সাগরে….

অতীত?…[৫ বছর আগে ]

তিতলি আজ তারাতাড়ি ঘুম থেকে উঠে কলেজে চলে গেছে। কারণ আজ তাদের কলেজের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান।তিতলির উপর অনেক কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

সকাল থেকে অনেক কাজ করার কারণে তিতলি এখন বেশ ক্লান্ত। কিছুক্ষণ আগে মাগরিবের আজান দেওয়ায় এখন পরিবেশটি বেশ শান্ত।অনেকে নামাজ পড়তে গিয়েছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ফিরে এসেছে,,আর কেউ কেউ এখন আসেনি।ধীরে ধীরে সবাই ফিরে আসল আর আবার উৎসবমুখর পরিবেশ হয়ে উঠল কলেজ ক্যাম্পাস।অনুষ্ঠান ও শুরু হয়ে যায়।

এর মাঝেই স্টেজে উঠে আসে কলেজের প্রাক্তন ছাত্রদের একটি গায়ক দল। যার মধ্যে গিটার হাতে,, ব্ল্যাক জ্যাকেট,, হোয়াইট টি-শার্ট,, ব্ল্যাক জিন্স পড়া একজন সামনে এগিয়ে আসতেই সকলে “সাদাফ” বলে দাঁড়িয়ে পড়ে।মুহূর্তেই চারপাশের পরিবেশ সকলের “সাদাফ সাদাফ” ধ্বণিতে মুখরিত হয়ে উঠে।

আর তিতলি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। তিতলি তার বেস্টি আনিকাকে জিজ্ঞেস করে….

“এই আনু সাদাফ টা কে রে?? সবাই সাদাফ সাদাফ করে করে মাথা ব্যাথাটা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে।”

আনিকা খুব এক্সাইটমেন্টের সাথে বলে…

“আরে দোস্ত সাদাফ ভাইয়া আমাদের কলেজের প্রাক্তন ছাত্র। আর উনাদের গ্রুপ হচ্ছে কলেজ ইভেন ভার্সিটিরও বেস্ট সিঙ্গার গ্রুপ। উনাদের গ্রুপের মেইন লিডার হচ্ছে মেহরাব ভাইয়া আর সাদাফ ভাইয়া। উনাদের গান শুনলে তুই ফিদা হয়ে যাবি। তোর মাথা ব্যাথা হাওয়া হয়ে যাবে।যদিও এখনো মেহরাব ভাইয়া আসে নি।ভাইয়ার নাকি কি জরুরি কাজ পরে গেছে আসতে একটু টাইম লাগবে।কিন্তু সাদাফ ভাইয়া ও কম না অনেক ভালো গান করে। মেয়েদের ক্রাশ।আমি তো উনাদের গ্রুপের সবার উপর ক্রাশ খেয়ে বসে আছি..” (এক প্রকার লাফিয়ে লাফিয়ে কথাগুলো বলল আনিকা)

উফফ আনিকা মেয়েটিও না বড্ড বেশি কথা বলে।তিতলি এবার বেশ বিরক্ত হয়ে কপাল কুচকে বলল…

“উফফ আনু এবার থাম। ক্রাশ খাওয়া তো তোর ফরজ কাজ। ভাতের চেয়ে বেশি ক্রাশ খাওয়া তো তোর নিত্যদিনের কাহিনি। কিন্তু কথা হচ্ছে তুই উনাদের সম্পর্কে এতো কিছু কিভাবে জানলি?একেবারে চৌদ্দগুষ্টির ডিটেইলস বলে দিলি..”

কথাটি বলতেই আনিকা কিছুটা ভাব নিয়ে বলল…
“আমি অনেক কিছুই জানি ম্যাডাম। আর রইলো চৌদ্দগুষ্টি… আরে মেহরাব ভাইয়ার চৌদ্দগুষ্টির মধ্যে আমিও আছি।”

তিতলি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,,
“মানে!!”

“মানে হচ্ছে মেহরাব ভাইয়া আমার কাজিন।আমার একমাত্র ফুপির একমাত্র পুত্র মেহরাব ভাইয়া। বুঝেছেন মিস।”

“হুম বুঝছি।”

এর মধ্যেই সাদাফ সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে কলেজের শিক্ষকসহ সকলের উদ্দেশ্যে কিছু কথা বলে গানের সুর তুলল।মিউজিক শুরু হলো।তিতলি আর আনিকা পিছে বসে আছে যার কারণে সামনের দৃশ্য খুব একটা দেখতে পারছে না।তিতলির কানে একটি সুর ভেসে আসে। আর গান শুরু হয়ে যায় সাদাফের কন্ঠে,,,

Jab tak tujhe pyar se
Beinteha main bhar na dun,,
Jab tak mein dauaoon sa
Sau dafa mein pad na loon

Haan mere paas tum raho
Jaane ki baat na karo
mere sath tum raho
Jane ki baat na karo

Woh oh o..
Woh oh o…
Woh oh o…
Woh oh o…

(Music?)

Tum aa gaye baazoun
mein mere
Sau sawere liye
Sau sawere liye

Haan baadalon se
utaara gaya
Tumko mere liye
Sirf mere liye…..

সাদাফ গান গাইছে আর পিছনের সারিতে বসে তিতলি চোখ বন্ধ করে গান শুনছে।গান শেষ হতেই তিতলি চোখ খুলে তাকালো।চারদিকে আবার হইচই শুরু হয়ে গেল।

আর এর মাঝেই স্টেজে আগমন ঘটে আরও একজনের।কিন্তু পিছন ফিরে থাকার কারণে তার চেহারা দেখা যাচ্ছে না। পিছন ফিরে কারো সাথে কথা বলছিল।বেশ লম্বা,,এ্যাশ কালার টি-শার্ট,, ব্লু কালার জিন্স পড়া। এক হাতে ব্লু কালার জ্যাকেট ভাঁজ করে রাখা।অন্যহাতে গিটার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটি।

হঠাৎ আনিকা দাঁত বত্রিশটি বের করে বলে উঠে,,
” কিরে গান শুনে তো একেবারে ফিদা হয়ে গেলি।”

তিতলি সামনের দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে বলল,,
“হুম,,কিছু বলেছিস আনু?”

“বলছি গান শুনে তো একেবারে ফিদা হয়ে গেলি। ” (তিতলির কাঁধে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলল আনিকা)

তিতলির তো আনিকার কথা শুনে ইচ্ছে করছে আনিকাকে কলেজের ওয়াশরুমে থাকা স্টিলের বদনা দিয়ে বারি মেরে মাথা ফাটিয়ে দিতে। এই মেয়ে কি সারাদিন এইসব ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারে না।এই চিকনি চামেলি যেই পরিমাণ ক্রাশ খায় সেই পরিমাণ খাবার খেলে অবস্থা হয়তো বাতাসের আগে পড়ে যাওয়ার মতো না হয়ে ওভার ওয়েট এর কারণে মরার মতো হতো। উফফ,,বিরক্তিতে কপাল আরও কুচকে নাক সিটকে আনিকার দিকে তাকিয়ে বলল…

“আমাকেও নিজের মতো মনে হয়! যত্তসব ফাউল। ”

“আরে আরে রেগে যাচ্ছিস কেন? আমি তো মজা করছিলাম” (মেকি হাসি দিয়ে বলল আনিকা)

বিরক্তির টপিক চেঞ্জ করতে তিতলি বলল
“আচ্ছা কয়টা বাজে দেখ তো আনু।”

আনিকা নিজের হাতে থাকা রিং এর সাইজের পিচ্চি ঘড়িটির দিকে তাকাল।
চোখের চশমা আরেকটু চোখের দিকে ঠেলে ঘড়িটি আরো কাছে এনে সময় দেখার চেষ্টা করছে আর তিতলি বসে বসে আনিকার কান্ড দেখছে।এই মেয়ে কি ক্রাশ খাওয়া ছাড়া আদৌ কোনো কাজ করতে পারে? টাইম দেখছে নাকি পাহাড় কাটছে। এর থেকে তো ভালো হতো তিতলি নিজের ফোনেই টাইম দেখতো।উফফ…তিতলি খুব বিরক্ত হচ্ছে। আজ দিনটা বোধহয় তিতলিকে বিরক্তির সর্বোচ্চসীমায় পৌছানোর জন্য এসেছে।

আনিকার মুখে বিশ্বজয়ের হাসি ফুটে উঠল।মনে হচ্ছে সে আলোর গতিতে পৃথিবীটাকে নিজের আয়ত্ত্বে করেছে।আনিকা তিতলির বিরক্তির ছাপ কাটাতে বলে,,
“সাতটা বাজার দশ মিনিট বাকি।”

কথাটি তিতলির মুখের বিরক্তির ছাপকে কিক বাট দিয়ে উড়িয়ে অবাক, চিন্তা ও ছটফটানির ছাপ আনতে নিমিষেই সক্ষম হলো।তিতলির হুশ ফিরে আনিকার কথাতে।তিতলির মা আজ তিতলিকে তারাতারি বাড়ি ফিরতে বলেছিল। কথা আর গানের মাঝে কখন যে এতটা সময় চলে গেছে তা খেয়ালই করেনি।

তিতলি এক লাফে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়।আর তারাহুরো করে বলতে থাকে

“আনু, মা তো আজ আমাকে তারাতাড়ি যেতে বলেছে। আমার তো খেয়ালই নেই। আমার এক্ষুনি যেতে হবে।”

আনিকা সামনে কাউকে দেখে তিতলিকে বলে,,
” আরে তিতলি সামনে দেখ মে…”

আনিকাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে তিতলি আবার দ্রুত গতিতে বলে
“কিসের ছাগলের মতো মে মে করছিস।তুই থাক তোর ছাগল নিয়ে আর মে মে কর।আমার যেতে হবে। যাচ্ছি,,বায়।”

বলেই তিতলি ঝড়ের গতিতে বের হয়ে আসে সেখান থেকে। আর এদিকে আনিকা তিতলির কথা শুনে হতভম্ব হয়ে আছে।

তিতলি তারাতাড়ি বের হয়ে কলেজের সামনেই একটি রিকশা পায়।তারাতাড়ি সেই রিকশা ভাড়া করে উঠে পড়ে। আর রিকশাওয়ালাকে বলে,,
“মামা কষ্ট করে একটু তারাতাড়ি চালান প্লিজ।”

তিতলি সাধারণত একা যাতায়াত করে না।আনিকার সাথে সব জায়গায় যায়।আর নিজেদের গাড়ি করেই আসা যাওয়া হয়।কিন্তু আজ ড্রাইভার অসুস্থ আর আনিকাও লেট করে বাসায় যাবে। তাই তিতলির মা আগে থেকে বলে দিয়েছেন যাতে তারাতাড়ি বাসায় যায়।

তিতলি রিকশায় উঠেও কলেজ থেকে ভেসে আসা আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে।সবার একসাথে করা কলরব শুনতে পাচ্ছে। মনে হচ্ছে কারো নামের প্রতিধ্বণি করছে।ঠিক যেমনটা সাদাফ বলে করেছিল।কিন্তু এইবার সকলের ধ্বণি যেন আরো জোরালো হয়ে উঠেছে।সবাই যেন আরো মুখরিত হয়ে উঠেছে। কিন্তু নামটা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে না।

সাথে সাথেই সবাই আবার নিশ্চুপ হয়ে গেল আর একটি গিটারের সুর ভেসে এলো।এই গিটারের সুরটি যেন তিতলির প্রতিটি শিরাকে শিহরিত করে তুলল।সাথে একটি স্নিগ্ধ বাতাস এসে তিতলিকে ছুয়ে গেল।তিতলি চোখ বন্ধ করে বাতাসে ভেসে আসা হাস্নাহেনার সৌরভ নিলো আর গিটারের সুরটি অনুভব করল।

বেশ কিছু দূর যাওয়ার পর সুরটি ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল।তিতলি ভাবল হয়তোবা সাদাফ আবার নতুন গান শুরু করেছে।কিন্তু গিটারের সুরটি কেন জানি তিতলির অস্পৃষ্য হৃদয়টিকে জানান দিচ্ছে “এটি সাদাফ না,,এটি অন্য কেউ।এটি তোমার সাজানো ভালোবাসার রংমহলের একমাত্র প্রেমপ্রদীপ। ”

তিতলির স্বপ্ন এমন,, যে খুব ভালো একজন গিটারিস্ট তাকে খুব ভালোবাসবে। ভালোবাসার বাহুডোরে আবদ্ধ করে তিতলিকে গিটারে তাদের প্রেম সুর তোলা শেখাবে।সেই ব্যাক্তিটি হয়তোবা সাদাফ বা সাদাফের মতো তার আশেপাশেরই কেউ একজন।

এসব ভেবেই তিতলির মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল। সাথে লজ্জা এসে একঝাঁক পাখির মতো ঘিরে ধরল।

তিতলির ভাবনা জগতের মাঝেই পথ শেষ হলো।আর তিতলি নিজের ভাবগুরু মনকে খানিক বিরতি দিয়ে ভাড়া মিটিয়ে বাড়িতে ঢুকে পড়ল।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here