তোমার মাঝে,পর্ব_০৪
সারিফা তাহরিম
বাহিরে ঝিরিঝিরি বাতাস বয়ে যাচ্ছে। চাঁদের আলোয় নাইট কুইন ফুলগুলো নিজেদের শুভ্রতার সৌন্দর্য্য জানান দিচ্ছে। সেই সাথে আছে হালকা মিষ্টি সৌরভ। সব মিলিয়ে এখন মনে হচ্ছে আসলেই এই ফুলের নামের সার্থকতা এর মধ্যেই নিহিত আছে। তিতলি বারান্দায় এসে তার চারাগাছগুলো আলতো পরশে ছুঁয়ে যাচ্ছে। তারপর বারান্দায় থাকা রকিং চেয়ারটিতে গা এলিয়ে দেয়। এইসময় গান শোনার ইচ্ছেগুলো বাস্তবে পরিণত হওয়ার জন্য তার কাছে আকুল আবেদন করছে। এতোদিন পড়ার চাপে গান শোনাই হয় নি। আজ অনেকদিন পরে গানের জগতে প্রবেশ করবে আবার।
তিতলি কানে হেডফোন গুঁজে একটি বাংলা গান প্লে করল। শুরুতেই একটি গিটারের সুর। এই গিটারের সুরটি শুনে তিতলির সেইদিন কলেজের অনুষ্ঠান থেকে ফেরার সময় ভেসে আসা সুরটির কথা মনে পড়ে। কি সুন্দর সেই সুরটি। কতোটা মনোমুগ্ধকর। ইশশ! এতোটা গভীরভাবে এতোটা সুন্দর করে গিটার কেউ কিভাবে বাজাতে পারে!
আচ্ছা সেই ব্যক্তিটি কি সাদাফ? নাকি অন্য কেউ? এই বিষয়টি খুব করে জানতে ইচ্ছে করছে তিতলির।নিজের ইচ্ছেকে দমিয়ে রাখতে না পেরে এই রহস্য উদঘাটন করতে ফেসবুকে লগ ইন করে। ফেসবুকে সে সাদাফের পেইজে ঢুকে। দেখা যাক কিছু পাওয়া যায় কি না।
তিতলির রহস্য উদঘাটনের কাজের সফলতার চিহ্নস্বরূপ সেইদিন অনুষ্ঠানের একটি ভিডিও পায় সাদাফের পেইজে। তিতলি সঙ্গে সঙ্গে ভিডিওটি প্লে করল। দেখল সেদিন সাদাফের সেই বক্তব্য দেওয়ার অংশ। তিতলি ভিডিওটির কয়েকমিনিট এগিয়ে দিল। এবার দেখল সাদাফ তার গান শেষ করছে। হ্যাঁ,, সেদিন সে এই পর্যন্তই ছিল। এরপরে সেখান থেকে বের হয়ে যাওয়ার কারণে আর কিছু দেখা হয়নি। সাদাফের গান শেষ হওয়ার পরে সে দেখল স্টেজে বেশ লম্বা একজন এগিয়ে আসছে। আরে এটি তো আজ সকালে দেখা অচেনা মানুষটি। যার দিকে তিতলি মুগ্ধ নয়নে চেয়ে ছিল। তিনি সামনে এগিয়ে আসতেই সকলে “মেহরাব মেহরাব” বলে চিৎকার করে প্রতিধ্বণি তুলতে থাকে। তিতলি এবার অবাক হয়ে ভিডিওটি দেখতে থাকে। কিছুক্ষণ পরেই তিতলির মস্তিষ্ক তাকে জানান দেয় যে তার কানে এখন তার সেই অতি পরিচিত ও প্রিয় গিটারের সুরটি ভেসে আসছে। তবেই কি এই সেই মেহরাব যার গিটারের সুর,, যার হাত নাড়ান,, খোচা খোচা দাড়ি,, এমনকি প্রতিটি মুভমেন্ট তিতলির মাঝে শিহরণ জাগিয়েছিল?
ভাবতেই তিতলির মাঝে বিদ্যুৎ খেলে গেল। কিন্তু পরক্ষণেই ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি আর মুখে এক রাশ লজ্জা জায়গা করে নিল। তিতলি ভিডিওটি থেকে বের হতেই তার চোখ আটকে যায়।
ইংরেজির গোটা গোটা অক্ষরে লিখা,,
“Sadaf Rezwan is with Mehrab Rayan Chowdhury ”
অর্থাৎ মেহরাবকে ট্যাগ দেওয়া। এটি এতোক্ষণ তিতলি খেয়াল করে নি।লিখাটি দেখেই তিতলি মেহরাবের পেইজে ঢুকে। সেখানে মেহরাবের ছবিগুলো দেখতে থাকে। তিতলি মেহরাবের সেই নীলাভ চোখ জোড়ায় আটকে যাচ্ছে। ইশশ! এই মানুষটার চোখ এতো সুন্দর কেন!তিতলি প্রতিটি ছবি খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে। নিজের অজান্তেই ঠোঁট জোড়া প্রসারিত হয়ে ডান গালে ছোট্ট টোলের সৃষ্টি করছে।
একটি ছবিতে মেহরাব ঠোঁট কামড়ে হাসছে।সেই ছবিটির দিকে তাকিয়ে তিতলি আনমনেই বলে ফেলে,,
“ইশশ!!তুমি এতোটা সুন্দর কেন?এতোটা স্নিগ্ধ কেন? তোমার প্রতিটি দৃষ্টি প্রতিটি হাসি এতোটা মোহনীয় কেন? জানো তোমার এই স্থিরচিত্র কতোটা টানছে আমায়। মন তো চাইছে খুব করে ভালোবাসতে। ইচ্ছে করছে ভালোবেসে ডুবে যেতে #তোমার_মাঝে।”
♣♣♣♣♣
রোদ্দুর মামা মন খুলে তার আলো বিতরণ করছে চারপাশে। ধীরে ধীরে তার প্রখরতাও বেড়ে চলেছে। বাতাসও তার প্রভাবে তপ্ত হয়ে উঠছে। এতে নাট্যকলা ভবনের পিছনে থাকা পুকুরের হালকা সবুজ পানিগুলো ঝিলমিল করছে। আর চারপাশে গাছের ছায়ার নিচে থাকা বেঞ্চগুলোর মধ্যে একটিতে বসে দৃশ্যটি উপভোগ করছে তিতলি। বরাবরের মতো প্রকৃতির মাধুর্য তার মনকে প্রফুল্ল করে তুলছে।
কিন্তু আনিকার কথা মনে হতেই বিরক্তিতে তার কপাল কুচকে যাচ্ছে।এই মেয়ে পারেও বটে। আগে তো সারাদিন ক্রাশ ক্রাশ করতো। আর এখন বাচালবিদ্যা প্রদানে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
ভার্সিটিতে এসে প্রথম ক্লাসগুলো ভালোভাবেই করে। কিন্তু ব্রেক টাইমের পরের দুটো ক্লাস অফ।কারণ একজন টিচার অসুস্থ যিনি গতকালও আসেন নি। আর আরেকজন টিচার জরুরি কাজে বেরিয়ে পড়েছেন। তাই এই অফ টাইমে প্রায় সব নতুন স্টুডেন্টরা ভার্সিটি ঘুরে ঘুরে দেখছে।আনিকা আর তিতলিও ঘুরে দেখছিল। আর তখন সাদাফ আসে। এসেই আনিকার সাথে হাটার আবেদন করলে আনিকাও তাতে সম্মতি দেয়।
গতকাল রাতেও নাকি ৩ ঘন্টা ৫৭ মিনিট তারা কথা বলেছিল। ভাবতেই অবাক লাগে এই গম্ভীর সাদাফও এতো কথা বলেছে!! নাকি শুধু আনিকা বলেছে আর সাদাফ শুনেছে?এই বিষয়ে তিতলি নিশ্চিত না হলেও এদের হাবভাব দেখে এইটা নিশ্চিত যে তাদের মাঝে প্রেম প্রেম ভাব হয়ে গেছে।তাই তিতলি কাবাব মে হাড্ডি হতে চায় নি।সে পুকুর পাড়ে এসে বসেছে। যাওয়ার সময় আনিকা বলেছে তারাতাড়ি চলে আসবে।প্রায় দেড় ঘন্টা হতে চলল। কিন্তু আনিকার আসার কোনো নাম নেই।
একটু পরে আবার ক্লাস শুরু হবে। সেই পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। তার পরে আনিকা আসুক বা না আসুক তিতলি ক্লাসে চলে যাবে বলে সিদ্ধান্ত নিল। আবার এতো সময় এভাবে বসে থাকতে হবে ভেবেই তিতলির মুখের বিরক্তির ছাপ আরো তীব্র হলো। কিন্তু তিতলির বিরক্তির ছাপ কাটিয়ে দেয় একটি ছোট্ট নরম তুলতুলে হাতের স্পর্শ।
তিতলি হাতটির মালিককে দেখার জন্য পিছে ফিরতেই দেখল একটা বাচ্চা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে যার বয়স আড়াই থেকে তিন এর মধ্যে হবে।সে ভাবুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তিতলির দিকে।তিতলি বাচ্চাটিকে দেখে মুচকি হেসে তার হাত ধরে নিজের পাশে বসিয়ে বলে,,
~” এই যে কিউট এঞ্জেল,নাম কি আপনার? আর এখানে কি করছেন?আপনাকে তো আপনার মা বাবা না পেলে অনেক খোজাখুজি করবে।”
বাচ্চাটি তিতলির দিকে সেই ভাবুক দৃষ্টিতেই তাকিয়ে বলল,,
~”আত্থা (আচ্ছা) আগে বলো তো তুমিই কি আমাল তিত্তি মাম্মাম?”
বাচ্চাটির মুখে নিজের নাম শুনে তিতলি বেশ অবাক হয়।আর সাথে মাম্মাম কথাটি শুনে তো সে অবাকের চরম সীমানায় পৌঁছে যায়। নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে জিজ্ঞেস করে,,
~”আপনি আমার নাম কিভাবে জানলেন কিউট এঞ্জেল? আর আমি আপনার মাম্মাম কিভাবে হলাম?”
~”আগে আমাতে তুমি কলে বলতে হবে।নাহলে কিথু বলব না।তুমি জানো না তুমি কলে বললে আপন আপন লাগে।আর আপনি করে বললে পর পর লাগে।আল আমিও তোমাতে তুমি কলে বলতেথি। তুমিও আমাতে তুমি কলে বলবে। থিক আথে?”
তিতলি বাচ্চাটির কথা শুনে অবাকত্বের মাঝেও ফিক করে হেসে দেয়।তারপর বলে,,
~” ওরে পাকনি বুড়ি। আপনি দেখছি অনেক সুন্দর করে কথা বলতে পারেন।আমাকেও শিখিয়ে দিয়েন। আর ঠিক আছে এখন থেকে তুমি করেই বলব।কিউট এঞ্জেল,,তাহলে দেখি এবার লক্ষ্মী মেয়ের মতো সব বলে ফেল।”
~”হুম বলথি। আমাল নাম হত্থে…. বলা যাবে না। আমি কিভাবে এসেথি……আমাল মামাল সাথে।তোমাল নাম মামা বলেথে।আরেকতা কি বলেথ ভুলে গেথি।”
~”আমি তোমার মাম্মাম হলাম কিভাবে?”
~”ও আত্থা। আমি মামাতে একতা মামানি আনতে বলতাম বুত্থো(বুঝছো)। কিন্তু মামা আগে বলত,, না তোনো (কোনো) মামানি আমবে না। একদিন বলেথে তোমাল দন্য (জন্য) মামানি পেয়ে গেথি। তথন আমাতে তোমাল থবি দেখাইথিল।আমাল তোমাতে অনেত অনেত এদ্দম (একদম) এত্তোগুলা ভালো লাগথিলো।তাই আমি মামাতে বলেথিলাম তোমাতে আমি মামানি দাকব না মাম্মাম দাকব। কারণ মাম্মাম তো বেসি আপন,,তাই। তথন আমাল মামা বলেথে থিক আথে। তোমাতে মাম্মাম বলেই দাকতে। বুদেথো (বুঝেছ)?”
একটি ছোট্ট বাচ্চাও যে কাউকে কথার মাধ্যমে এতোটা অবাক করতে পারে তা এই বাচ্চাটিকে না দেখলে তিতলি কখনোই বুঝতে পারত না। বাচ্চাটির কথায় সে বিস্ময়ের সপ্তম আকাশের চেয়ে বেশি কিছু থাকলে তা তে পৌঁছে গেছে।সে বাচ্চাটিকে বলে,,
~”তোমার নাম না বললে তোমাকে আমি কি বলে ডাকব? আর তোমার মামা কে?আমি তো তোমাকেও চিনি না। তোমার মামাকেও চিনি না।”
~”তুমি আমাতে তোমাল দেওয়া তিউত এন্দেল নামে দাকবে।আর আমাতে তো তিনেথো। কিন্তু আমাল মামাল কতা তো বলতে পালব না। এতা থিক্কেত (সিক্রেট)।
তুমি পলে দানতে পালবে।আল থুনো (আর শুনো) মামা আমাতে একতা কাদে (কাজে) পাথাইথে তোমাল কাথে।”
~”কি কাজ কিউট এঞ্জেল? ”
কিউট এঞ্জেল তার পরনের জিন্সে উপরে করে রাখা একটা গোলাপ আর পকেটের ভিতর থেকে একটা চিরকুট বের করে তিতলির দিকে এগিয়ে দেয়।তিতলি এতোক্ষণ গোলাপটি খেয়াল করে নি। বেশ বড় ও সুন্দর গোলাপটি। কিউট এঞ্জেল সেগুলো তিতলির হাতে দিয়ে বলে,,
~”মামা তোমাতে এদুলো দেওয়াল দন্য আমাতে পাথিয়েথে।এদুলো তুমি রেথে (রেখে) দিও তেমন। কালণ (কারণ) মামা ভালোবেতে তোমাতে এদুলো দিয়েথে।”
~”তোমার মামা কোথায়? উনি যদি আমাকে এতোই ভালোবাসত তাহলে তো এগুলো উনি নিজেই দিতো।তোমার মামা নিজে না দিয়ে কোথায় লুকিয়ে আছে বলো তো কিউট এঞ্জেল। ”
~”সেতা তো বলা দাবে না।মামা বলতে নিথেদ (নিষেধ) কলেথে।আত্থা আমাল দেতে (যেতে) হবে।তুমি এদুলো রেথো তেমন।”
~”আচ্ছা। কিন্তু আবার কবে আসবে? তোমাকে আমার অনেক ভালো লেগেছে। আমাকে ভুলে যেও না কিন্তু।তোমাকে আমি খুব মিস করব।”
~”আমিও মিত কলব।আত্থা আমি দাই……ওওও আমাল তো আলেকতা কাদ লয়ে গেথে।”
~”কি কাজ কিউট এঞ্জেল? ”
বাচ্চাটি এসে তিতলির দুই গালে দুটো চুমু এঁকে দিল। তিতলি বেশ খুশি হলো তার এই কাজে। সে ও তার কিউট এঞ্জেলের দুই গালে চুমু খেল।আর বলল,,
~”অনেক ধন্যবাদ কিউট এঞ্জেল তোমার ভালোবাসার পরেশের জন্য।”
~” পাপ্পিতা তো আমি দি নাই।”
~”তুমিই তো দিলে। এখানে তো তুমি ছাড়া আর কেউ নেই যে আমাকে পাপ্পি দিবে।”
~”আলে বাবা আমাল মামা আমাতে বলেথিল তোমাতে নাকি পাপ্পি দিতে ইত্থে (ইচ্ছে) কলথে। তাই আমি বলেথি আমাতে পাপ্পি দিতে। আমি তোমাতে মামাল পাপ্পিতা দিয়ে দিব। আল এথন আমি তোমাতে মামাল পাপ্পিই দিয়েথি।”
বাচ্চাটির কথা শুনে তিতলির চোখ গোলগোল হয়ে গেল। যেন অক্ষিকোটর থেকে বেরিয়ে আসবে।এর মধ্যেই বাচ্চাটি আবার বলে,,
~”তোমাল পাপ্পিতাও মামাতে দিব। থ্যংকু পাপ্পি। এতাকে বলে পাপ্পি তান্সফার (ট্রান্সফার)। আমাল দেরি হয়ে দাত্থে আমি দাই। তা তা।””
~”আরে শুনো…….যাহ চলে গেল।”
কিউট এঞ্জেলের কথাগুলো মনে করে সে স্তম্ভিত হয়ে গেল। হাতটি তার গালে চলে গেল। তার কেমন এক ধরনের অনুভূতি হলো। সে এক দৃষ্টিতে সেই চিরকূটটির দিকে। নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক করে তিতলি চিরকূটটি খুলল।খুলে দেখল……..
চলবে……
(ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)