তোমার মাঝে(সিজন ২),পর্ব_০২,০৩

0
4151

তোমার মাঝে(সিজন ২),পর্ব_০২,০৩
সারিফা তাহরিম
পর্ব-০২

~”কিরে আর কতোক্ষণ রে প্রজাপতি? তারাতাড়ি কর প্লিজ। তোর ভার্সিটির লেট হয়ে যাচ্ছে তো। তাই বলি রাত জেগে হরর ফিল্ম দেখিস না। রাতে ভয়ে দেরিতে ঘুমোবে। আর সকালেও দেরিতে উঠবে।এই মেয়েকে নিয়ে আর পারি না।”

দিয়াপু নিচে লিভিং রুমে বসে বিরক্তির সাথে জোরে জোরে কথাগুলো বলছে। কিন্তু আমার তা তে খুব একটা মাথা ব্যাথা নেই। আমি হেলেদুলে রেডি হতে ব্যস্ত। দিয়াপুর এনগেজমেন্ট হয়েছে আজ তিন দিন হলো। এর মধ্যে আমার আর ভার্সিটিতে যাওয়া হয় নি। এই তিন দিনে সেই দিন আমার সেই ভুলের জন্য নিজের মধ্যে যথেষ্ট অপরাধবোধ কাজ করেছে আর আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে আমি উনার কাছে সরি বলব। কিন্তু উনার সেই রক্তচক্ষু সেদিন রাগের মাথায় আমি তেমন পাত্তা না দিলেও এখন তা মনে পড়তেই ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। কিভাবে সরি বলব তার কিছুই মাথায় আসছে না। ভার্সিটিতে গিয়েই কোনো ব্যবস্থা করতে হবে।

ওই দিনের পরের দিন নাফিজ ভাইয়াকে বলি তার সেই বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করতে।আর খোঁজ করতে যে কি মিশিয়েছিল। তাকে ফোনে শুরুতে পাওয়া না গেলেও বেশ কিছুক্ষণ পাওয়া গেল।তারপর উনি জানায় যে সেই পানির বোতলটি সত্যি সত্যিই তিনি ডাইনিং এ বাকি বোতলগুলো থেকে নিয়েছিল। আর আমারও তখন মনে পড়ে যে আসলেই বোতলটার মুখ নতুন বোতলের মতো বাধা ছিলো। তাই খুলতে পারছিলাম না। তাই আর সেই ভাইয়ার উপর সন্দেহ করা বাদ দিলাম। আর সেদিনের কাহিনিটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিলাম।হয়তো এর পিছনে অন্য কেউ আছে।কিন্তু এতো চিন্তা ভাবনা করতে ভালো লাগছে না।

~”কিরে প্রজাপতি,, তোর হলো? দেরি হয়ে যাচ্ছে তো। ”

দিয়াপু আবার চিল্লিয়ে বলে উঠতেই আমি আমার রুমে থেকেই বললাম,,

“আসছি গো দিয়াপু। আর পাঁচ মিনিট। ”

আজ আমি দিয়াপুর সাথে ভার্সিটি যাব।ভার্সিটি লাইফের এই দু মাসে শুরুতে কিছুদিন আপুর সাথে গেলেও তারপর থেকে একাই যেতাম। কিন্তু আজকের ব্যাপারটা কিছুটা ভিন্ন। কারণ আজ দিয়াপু তার ফিয়ান্সে অর্থাৎ আরাফ ভাইয়ার সাথে দেখা করতে যাচ্ছে।

যাচ্ছে বললে ভুল হবে আমিই এক প্রকার জোর করে পাঠাচ্ছি। এতে তারা দুজন নিজেদের সাথে পরিচিত হবে।কারণ দিয়াপু আর আরাফ ভাইয়ার বিয়ে ঠিক হওয়ার পর তাদের খুব একটা কথা হয় নি। আরাফ ভাইয়া কথা বলতে চাইলেও দিয়াপু তেমন একটা কথা বলত না।তাই আজকের এই আয়োজন। আর আরাফ ভাইয়াকে এই ট্রিক্সের কথা আমিই বলেছি। দিয়াপু আরাফ ভাইয়ার সাথে কথা বলতে যাওয়ার পথে আমাকে ভার্সিটিতে নামিয়ে দিয়ে যাবে।

আমি রেডি হয়ে নিচে নেমে এলাম। দিয়াপু আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে কিছু বলার আগেই আমি বলে উঠলাম,,

“কি ব্যাপার দিয়াপু? এতো তাড়া দিচ্ছো যে? আরাফ ভাইয়াকে দেখার জন্য মন আনছান করছে বুঝি?”

দিয়াপুর দিকে তাকিয়ে কাধ দিয়ে তার কাধে হালকা ধাক্কা দিয়ে কথাটি বললাম আমি। দিয়াপু আমার দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে বলল,,

“প্রজাপতি তুই ভালো করেই জানিস আমি যেতে চাইছি নাকি চাইছি না। তুই ই আমাকে জোর করে পাঠাচ্ছিস। নাহলে আমার তাকে দেখার কোনো শখই নেই। তাই এই ধরনের ফালতু কথা না বলে চল।”

~”হুম চলো। তোমার সে আবার তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।”

বলেই দিয়াপুর দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে আমার দিকে রেগে তাকিয়ে আছে। আমি মেকি হাসি দিয়ে বললাম,,

“মানে আমারও লেট হচ্ছে আর আরাফ ভাইয়াও বসে আছে।”

তারপর আমরা গাড়িতে গিয়ে বসলাম। গাড়ি তার গন্তব্যে পৌঁছানোর পর্যন্ত এগিয়ে চলল।

~~~~~~~~~~~~~~

ইশশ! আজ আমি বড্ড দেরি করে ফেললাম। দিয়াপু যখন বলছিল তখন তো খেয়ালই করি নি। কিন্তু এখন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আমার টনক নড়ল। গাড়ি থেকে নেমেই কোনো দিকে না তাকিয়ে ক্লাসের উদ্দেশ্যে দৌড় দিলাম।

ক্লাসের সামনে আসতেই দেখলাম বিশাল ভূরি ধারী মি.বক্কর আলী স্যার লেকচার দিচ্ছেন। নাম মি.বক্কর আলী হলেও আমরা ফ্রেন্ড সার্কেলের সবাই তাকে অধিক সম্মানের কারণে মি.আলুর বস্তা ডাকি।আমাদের অধিক সম্মানিত আলুর বস্তা স্যার উচ্চতায় লিলিপুট হলেও তার তার রাগের উচ্চতা মিশরীয় পিরামিডের সমান।যা আমাদের লাইফটাকে হেল করতে যথেষ্ট। যেমন এখন আমার হচ্ছে।

আমি একগাদা বইখাতা নিয়ে কোনো দিকে না তাকিয়ে লাইব্রেরীর দিকে ছুটছি।কিছুক্ষণ আগেই মি. আলুর বস্তা স্যার আমায় দেরি করে আসার শাস্তিস্বরুপ আগামী দুই সপ্তাহের এসাইনমেন্ট দুই দিনে শেষ করে পরশু জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। ক্লাসের মধ্যে তিনি বলেছেন,,

~”মিস তিতলি, এটা তোমার মামার বাড়িও না শশুড় বাড়িও না, যে তুমি যে কোনো টাইমে এলেই তোমাকে লাল গালিচা বিছিয়ে স্বাগতম জানানো হবে। এটা তোমার ক্লাসরুম। তাই তোমার এখানে সঠিক সময়ে উপস্থিত থাকতে হবে। আর দেরি করে এলে তার জন্য শাস্তি পেতে হবে। আর আজ তোমার শাস্তি হলো সবাই আগামী দুই সপ্তাহে মিলে যেই এসাইনমেন্টগুলো জমা দিবে তা সবগুলো তুমি দুইদিনে করে জমা দিবে। অর্থাৎ আগামী পরশু তুমি সব এসাইনমেন্ট জমা দিবে। ”

এই আলুর বস্তা স্যারের কাছে শাস্তি কমাতে গেলে তখন আরো বেশি বাড়িয়ে দিবে। তখন হয়তো বলবে,,

“মিস তিতলি,, তুমি কি এটা মামার বাড়ি বা শ্বশুর বাড়ির আবদার পেয়েছো? যে তুমি যে আবদারই করবে তা খেলনা দেওয়ার মতো পূরণ করা হবে?এটা তোমার ক্লাসরুম। তাই এখানে এই ধরনের কথা বেয়াদবি হিসেবে গণ্য হবে। আর তার শাস্তি তোমার পেতে হবে। এই কথার শাস্তি হিসেবে তুমি আগামী দুই মাসের এসাইনমেন্ট দুই দিনে করে জমা দিবে।”

আলুর বস্তা স্যারের কাছ থেকে এই ধরনের কথা অস্বাভাবিক কিছুই না। তাই আমি অগত্যা আর কথা না বাড়িয়ে লাইব্রেরীর দিকে ছুটলাম।

~~~~~~~~~~~~~~

এদিকে,,

দিয়া রেস্টুরেন্টে ঢুকে দেখতে পেল আরাফ গ্লাসের সাইডের একটা টেবিলে বসে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে। আবার ঘড়ির দিকেও তাকাচ্ছে।দিয়া সেদিকে গিয়ে আরাফের সামনের চেয়ারটি টেনে বসতে বসতে বলল,,

“আসসালামু আলাইকুম। আই এম এক্সট্রেমলি সরি ফর বিইং লেইট।”

আরাফ দিয়ার দিকে তাকিয়ে একটি হাসি উপহার দিয়ে বলল,,

“ওয়ালাইকুম আসসালাম। ইটস অলরাইট। ”

দিয়া আরাফের কথায় মৃদু হাসল।তারপর আবার আরাফ জিজ্ঞেস করল,,

~” কেমন আছো?”

~”আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি?”

~”আমিও আল্লাহর রহমতে ভালোই আছি। তা বাসার সবাই ভালো আছে তো?”

~”জি সবাই ভালো আছে। আপনার বাসার সবাই ভালো আছে? ”

~”হুম সবাই ভালো আছে।কিন্তু ‘আপনার বাসার সবাই’ কথাটা ঠিক হজম হয়নি। কারণ এখন থেকে ওটা তো তোমারও বাসা তাই না?”

~”হুম।”

~”তোমার সাথে নাকি মায়ের প্রায় সময়ই কথা হয়। মা প্রায়ই তোমার কথা বলে।তোমাকে তার খুব ভালো লাগে। মা তো চায় যতো তারাতাড়ি সম্ভব তোমাকে বাড়ি নিয়ে যেতে। তোমাকে নিজের মেয়ের মতো ভাবে তো তাই।
আচ্ছা আম্মুর কি অবস্থা? প্রেশার ঠিক আছে?”

~”জি। আম্মুর প্রেশার ঠিক হয়েছে। মাথা ঘুরানোটাও অনেকটা কমে গেছে।”

~”ওহ। যাক ভালোই হয়েছে। আচ্ছা চলো কিছু অর্ডার করি। এভাবে খালি মুখে আর কতোক্ষণ কথা বলব।”

তারপর আরাফ কিছু খাবার অর্ডার করে।দিয়া আরাফের অর্ডার করা খাবারগুলোই আনতে বলেছে।তার কিছুক্ষণ পরে খাবার চলে আসে। এতোক্ষণ দুজনের মধ্যে আর কোনো কথা হয় নি।আবারও আরাফ বলল,,

~”তাহলে শুরু করা যাক?”

~”হুম”

তারপরে তারা খাওয়া শুরু করে। একটু পরে আরাফ আবার বলে উঠে,,

~”তুমি কি আমার সাথে কথা বলতে আনইজি ফিল করছো?”

~”না। তেমনটা না।”

~”তাহলে এমন চুপচাপ হয়ে আছো যে?সবার সাথে তো বেশ প্রাণোচ্ছল থাকো।কিন্তু আমার সাথে এতো চুপচাপ কেন?আমাকে তোমার বন্ধু ভাবতে পার।”

~”আসলে আমার সবকিছুর সাথে এডজাস্ট হতে একটু টাইম লাগবে। ”

~”সবকিছুর সাথে নাকি শুধু আমার সাথে?”

আরাফের এমন প্রশ্নে দিয়া অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল।দিয়ার অবাক দৃষ্টি দেখে আরাফ মুচকি হেসে বলল,,

~”আমি জানি দিয়ামণি, তুমি সবকিছুই সহজে মেনে নিতে পারবে। শুধু আমাকে ছাড়া। আমি তোমার অতীত সম্পর্কে সবকিছু জানি না। কিন্তু তিতলির কাছ থেকে কিছুটা শুনেছি।তোমার আমাকে মেনে নিতে কষ্ট হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমি এই কষ্টটা কমানোর আপ্রাণ চেষ্টা করব। অতীতের কেটে যাওয়া দাগটা আমি আমার ভালোবাসায় মুছে দিব। আমি তোমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে তোমাকে বিয়েও করব না। তুমি যখন আমায় মেনে নিতে পারবে তখনই আমি তোমাকে বিয়ে করবো, এর আগে না। আমি এটা বলবো না যে আমি তোমাকে ইচ্ছা পোষণ করতে জোর করবো না। হ্যাঁ আমি তোমাকে জোর করবো। তবে সেটি হবে আমার ভালোবাসার জোর। একদিন তুমিও আমায় ভালোবাসি বলবে দিয়ামণি।একদিন আমার স্বপ্নটাও পূর্ণতা পাবে তাই না দিয়ামণি।”

আরাফের কথা শুনে দিয়ার অতীতের কথা মনে পড়ে গেল। বুক চিড়ে বের হয়ে আসে বেদনাময় এক দীর্ঘশ্বাস। সে ছোট্ট করে আরাফকে জবাব দেয়,,

~”হয়তো আবার হয়তো না।”

~~~~~~~~~~~~

আমি লাইব্রেরির দিকে ছুটছিলাম। লাইব্রেরির প্রায় ভেতরে ঢুকে পড়েছি। এমন সময় “””” ধপাসসসসসস””””””।
কোনো এক খাম্বার সাথে জোরে সোরে ধাক্কা লেগে পড়ে গেলাম।আমার বই খাতা গুলোর কয়েকটা আমারই মুখে এসে পড়েছে। আমি বইগুলো সরাতে সরাতে বললাম,,

“কোন কানা রে? দেখে চলতে পারিস না? চোখ কি বউয়ের শাড়ির আঁচলের সাথে বেধে এসেছিস নাকি? উফফ গেলো তো আমার কোমরটা ভেঙে। তোকে তো…..

আমি আমার কথাটি আর শেষ করতে পারলাম না। কারণ উপরের দিকে চোখ যেতেই আমার পিলে চমকে উঠে। আমার সামনে রক্তচক্ষু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে স্বয়ং মেহরাব। তার নীলাভ চোখজোড়া থেকে যান আগুন বের হচ্ছে। আর সেই আগুনে এক্ষুনি আমাকে ভস্ম করে ফেলবে। তিতলি আজ তো তু গায়া কাম সে।

আগে থেকেই রেগে আছে। আজ তো রাগ কমানোর কথা ছিল। কিন্তু আমি তো তার উল্টোটা করে বসলাম। আমি কোনো মতো উঠে দাড়ালাম।আমি আমতা আমতা করে বলা শুরু করলাম,,

“আ আ আসলে ওওই আ আমি…

আমাকে বলতে না দিয়ে মেহরাব এগিয়ে আসতে আসতে বলল,,

“তুমি কি? হ্যাঁ? ”

আমি পেছনে যেতে যেতে বললাম,,

“আআসলে আ আ আমার”

~”তোমার কি?”

~”আআসলে আআমি বুঝতে পারি নি যে ওটা আপনি ছিলেন।”

~”হ্যাঁ। তুমি বুঝবে কিভাবে। তুমি সবসময় ভুল আর উল্টোটাই তো বুঝবে।ভুল বুঝে চড় মারবে,, উল্টা পাল্টা বকবে। আর যেখানে সেখানে এতো পড়ে যাও কেন হ্যাঁ? ”

~”আমি কি ইচ্ছা করে পড়েছি নাকের? আর সেদিনের টা তো রাগের মাথায় ভুল হয়ে গিয়েছিল। আমি এমনিতেও আপনাকে সরি বলতে আসতাম। সরি। আই এম এক্সট্রিমলি সরি। ”

~”সরি!! কিসের সরি? কোনো সরি দিয়ে কাজ হবে না। তোমার এর জন্য শাস্তি পেতে হবে। ”

~”কককিসের শাস্তি? কককি শশাস্তি দিবেন আআপনি?আমি কোন শাস্তি মানি না। সরি বলেছি কাজ শেষ। বাড়াবাড়ি করবেন না। সরি টা এক্সেপ্ট করুন।”

~”সেটা আমার ব্যাপার। তুমি তোমার শাস্তি উপভোগ করো।”

এই বলে তিনি আরো এগিয়ে আসতে লাগলো। আর আমি পেছাচ্ছি।এক পর্যায়ে সিড়ির কাছে চলে এলাম। আরেকপা পিছে বাড়াতেই আমি পড়ে যেতে নিলাম। চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে নিলাম। ভয়ে চিৎকার করে উঠার আগে উনি আমার হাত শক্ত করে ধরল। আমিও হাতের ছোঁয়া পেয়ে তার হাত খামছে ধরলাম।

~”আমার সাথে বাড়াবাড়ি করতে মানা করেছিলাম। এতোক্ষণ তো বেশ বড় বড় কথা বলছিলে। এখন সেই সাহস কোথায় গেল? ঠিকই তো ভয় পাচ্ছো। বাঁচার জন্য আমার হাতই আকড়ে ধরেছ।”

আমি কিছু বলবো তার আগেই উনার ফোন বেজে ওঠে। উনি আমার হাত ধরে টেনে সোজা করে দাড় করিয়ে দিয়ে বললেন,,

~”আজকের জন্য এতোটুকুই। নেক্সট দিনের শাস্তির জন্য তৈরি থেকো।”

বলেই তিনি বাকা হেসে সেখান থেকে চলে গেলেন।আর আমি হতভম্ব হয়ে তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম। পরক্ষণেই রাগ উঠে গেল। আমি উনার শাস্তি উপভোগ করবো আর উনি শান্তিতে থাকবে। তা তো আমি হতে দিব না। মি. মেহরাব আগে আগে দেখো হোতা হে কেয়া..।

~~~~~~~~~~~~~~

এদিকে মেহরাব তাদের গোডাউনের পিছে এসে দেখল সেখানে ওইদিন যেই ছেলেগুলোকে তারা ধরে এনেছিল তাদের লাশ পড়ে আছে। এগুলো দেখেই রাগে মেহরাবের মাথায় আগুন জ্বলে উঠল।মেহরাব জোরে চিৎকার করে বলল,,

~”রাকিব। এগুলো কি? ওদের মেরে ফেলেছো কেন? আমি তোমাদের শুধু বলেছিলাম ওদের কে পাঠিয়েছে সেটা না জানা পর্যন্ত আঘাত করতে। জানে মেরে ফেলতে বলি নি। এখন কিভাবে জানব যে ওদের কে পাঠিয়েছে? ”

~”স্যার এদের তো আমরা মারি নি। বাহিরের কেউ এসে আমাদের লোকদের অজ্ঞান করে এদের মেরেছে। আমি তখন বাহিরে ছিলাম। এসে দেখি একজন বাহির হচ্ছে যার হাতে এই বাকিদের মতো একটি ট্যাটু আছে। কিন্তু মুখ ঢাকা থাকায় চেহারা দেখতে পাই নি। আমি পিছু নিয়েছিলাম। কিন্তু একটু দূরে গিয়ে তাকে আর দেখতে পাই নি।”

~”তার মানে সেই ছেলেটিকেও একই মানুষ পাঠিয়েছে এদের মেরে ফেলতে যাতে আমরা কিছু জানতে না পারি। হুম মানতে হবে বেশ তীক্ষ্ণ বুদ্ধি আছে তার। কিন্তু একটা ভুল হলো লাশগুলো এখানেই রেখে গেছে। আর এটাই হয়তো তার কাল হয়ে দাঁড়াবে।”

কথাটি বলেই মেহরাব বাকা হাসল।

চলবে…..

তোমার মাঝে(২)
পর্ব_০৩
সারিফা তাহরিম

মি. বক্কর আলী অর্থাৎ আমাদের অতি সম্মানিত আলুর বস্তা স্যারের বকবকানিতে আমার কানের লাইফ সাপোর্টে যাওয়ার মতো অবস্থা। তার ভারিক্কি কন্ঠের ঝাড়ি খেতে খেতে আমার সকল খিদা এক নিমিষেই উধাও হয়ে গেল।এসাইনমেন্ট জমাদানের দুই দিন সময় আজ শেষ হলো। অর্থাৎ আজ ভার্সিটিতে এসেই আমার উনার কাছে গিয়ে এসাইনমেন্ট জমা দেওয়ার কথা। কিন্তু এই মোটকা আলুর বস্তারে কেমনে বুঝাই যে দুই সপ্তাহের এসাইনমেন্ট দুই দিনে করা কোনো মঙ্গল গ্রহের প্রাণির পক্ষেও সম্ভব না।

আমি তো সাধারণ মানুষ। আমার পক্ষেও অসম্ভব হওয়াটা নিতান্ত স্বাভাবিক ব্যাপার। আমি গত দুইদিন রুম থেকে এক মুহূর্তের জন্য বের হই নি। সারাদিন রুমে বসে এসাইনমেন্ট করেছি। কিন্তু তবুও কিছুটা বাকি ছিল। আমি ভেবেছি ভার্সিটিতে এসে শেষ করে জমা দিব। ক্লাসে বসে বসে এসাইনমেন্ট করে ব্রেক টাইমের একটু আগে শেষ করলাম। প্রচন্ড খিদে পেয়েছিল সেই সাথে ক্লান্তি এসে ভর করল। তাই ফ্রেন্ডদের নিয়ে ক্যান্টিনে বসে খাচ্ছিলাম। ব্রেক টাইমের পরেই এসাইনমেন্ট জমা দিয়ে দেওয়ার কথা। কিন্তু তখনই ভূরি হেলিয়ে দুলিয়ে ক্যান্টিনে প্রবেশ করে মি. আলুর বস্তা। আর আমাকে দেখেই শুরু হয়ে যায় তার ভাষণ।

প্রায় ১৫ মিনিট ধরে তার ভাষণ শুনছি।সবাই আমাদের দিকে চেয়ে আছে। এখন হয়তো তার ভাষণ শেষ হবে। এই মুহুর্তে আমার মনে হচ্ছে আমি কোনো খুনের আসামি। আদালতে আমার বিচার হচ্ছে আর সকলে তা উৎসুক চোখে দেখছে।এখন ই এই অপরাধের শাস্তি স্বরূপ মি. বক্কর আলী আমাকে ফাসির আদেশ দিবেন। হ্যাঁ তাই হচ্ছে,,

~”মিস তিতলি এই ধরনের অপরাধ মেনে নেওয়ার যোগ্য না। এটা তোমার মামার বাড়িও না শ্বশুড় বাড়িও না যে তোমার এই ধরনের বেপরোয়া স্বভাবের পরেও তোমাকে ক্ষমা করা হবে। এটা তোমার ভার্সিটি আর আমি তোমার শিক্ষক। তুমি তোমার সামান্য শাস্তি দুই সপ্তাহের এসাইনমেন্ট দুই দিনে করতে পারো নি। এর জন্য তোমার শাস্তি পেতে হবে অর্থাৎ তোমার শাস্তি আরো বাড়বে। সকল অপরাধের পরে তোমার শাস্তি হলো…..

মাননীয় আদালত মি. বক্কর আলী আলুর বস্তা তার শুনানি সম্পূর্ণ করার আগেই অন্য কেউ গম্ভীর স্বরে বলে উঠল,,

“স্যার স্টোপ।”

উপস্থিত সকল দর্শকের দৃষ্টি এখন তার দিকে। আলুর বস্তা স্যারের এই ধরনের বক্তব্যে কেউই তেমন অবাক হচ্ছে না বরং বিরক্তবোধ করছে।কারণ এটি নিত্যদিনের কাহিনী হয়ে উঠেছে। কিন্তু তার কথার মাঝে ফোড়ন কাটার ব্যাপারটিতে সবাই ই বেশ হয়েছে।আর আমি তো তাকে দেখে অবাকের চরম সীমানায় পৌঁছে গেলাম।

???

দিয়া বারান্দায় বসে ম্যাগাজিন পড়ছে। হঠাৎ ফোন বেজে ওঠে। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখে গোটাগোটা ইংরেজি অক্ষরে আরাফ লিখা।দিয়া একটা হালকা নিশ্বাস ছেড়ে ম্যাগাজিনটা এক পাশে রেখে মোবাইলটা হাতে নিল।এই মানুষটা এই দুটো দিনে দিয়ার সাথে অনেক কথা বলেছে, অনেকটা ফ্রি হওয়ার চেষ্টা করেছে, টাইম দিয়েছে এবং এখনও তা করে যাচ্ছে। দিয়া যাতে তাকে মেনে নিতে পারে তার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আরাফ।কিন্তু দিয়ার কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় নি। সে আগের মতোই আরাফের সাথে চুপচাপ থাকে।

দিয়া ফোন রিসিভ করে সালাম দিল,,

~”আসসালামু আলাইকুম। ”

~”ওয়ালাইকুম আসসালাম দিয়ামণি। কেমন আছো? ”

~”আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি?”

~”আলহামদুলিল্লাহ আমিও ভালো আছি।বাসার সবাই কেমন আছে? ”

~”সবাই ভালো আছে। মা বাবা আর বাকিরা ভালো আছে?”

~”হুম সবাই ই ভালো আছে। তা কি করছো?”

~”ম্যাগাজিন পড়ছিলাম।”

~”ওহ। আমি কি ডিস্টার্ব করলাম?”

~”না না। ডিস্টার্ব হই নি।আপনি কি করছেন?”

~”আমি এতোক্ষণ অফিসের কিছু ফাইল চেক করছিলাম। ওগুলো চেক করেই তোমাকে কল করলাম। এখন তোমার সাথে কথা বলছি।”

~”ওহ”

~”দিয়ামণি,, তোমায় খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।আজ নদীর পাড়ে যাবে? একসাথে ঘুরে বেড়াব।”

~”না আজ যাব না। ভালো লাগছে না। ”

~”কেন দিয়ামণি? কি হয়েছে? ”

~”তেমন কিছু না এমনিই ভালো লাগছে না। আচ্ছা এখন রাখছি। বাই।”

দিয়া আর কোনো কথা না শুনেই ফোন কেটে দিল। দিয়ার কথা শুনে আরাফ কিছুটা চিন্তিত হয়ে গেল। কারণ তার প্ল্যান অনুযায়ী কাজ হচ্ছে না।

~~~~~~~~~~~~

আমি একগাদা খাতা আমার সামনে বিছিয়ে বেঞ্চের উপর পা তুলে ফুচকা খাচ্ছি।ফুচকায় টকের ঝোলটা বেশি করে দেওয়ার কারণে ফোটা ফোটা ঝোল খাতাগুলোতেও পড়ছে। কিন্তু এতে আমার তেমন মাথা ব্যাথা নেই। কারণ খাতাগুলো আমার না।মেহরাবকে দেওয়া মি. বক্কর আলী স্যারের খাতা।

বেশ কিছুক্ষণ আগে ক্যান্টিনে,,

~”স্যার স্টোপ।”

মেহরাবের এমন গম্ভির কন্ঠে সবাই তার দিকে তাকাল। মি. বক্কর আলী স্যারও উনার দিকে তাকাতেই উনার মুখের ভঙ্গিমা পরিবর্তন হয়ে যায়। তিনি মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে উঠলেন,,

~”আসসালামু আলাইকুম স্যার। হুট করে এতো হাইপার হয়ে যাচ্ছেন কেন? এতে তো আপনার শরীর অসুস্থ হয়ে পড়বে।স্যার শুধু স্টুডেন্টদের ভালো দেখলেই হবে নিজেরও তো খেয়াল রাখতে হবে তাই না।”

উনার গিরগিটির মতো রঙ পরিবর্তনে আমার চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল। প্রথমে যেভাবে গম্ভীর করে বলেছে তাতে তো অন্য কিছু মনে করেছিলাম। কিন্তু পরে যা মিষ্টি মিষ্টি কথা বলছে। নিশ্চয়ই কোনো খিচুড়ি পাকাতে এসেছে। এদিকে আলুর বস্তা তো উনার ফুয়েল ও ওয়েল মার্কা কথা শুনে খুশিতে গদগদ করছে।

~”আরে মেহরাব। কেমন আছো বাবা? এই স্টুডেন্টগুলোর কথা আর বলো না। কতোটা ইরেস্পন্সিবল বলে বুঝাতে পারব না। এদের জন্যই তো এতো চিল্লাচিল্লি করতে হয়।”

~”আসলেই কিছু স্টুডেন্ট আছে একটু বেশি ইরেস্পন্সিবল”(আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে কথাটি বলল)

~”কি শাস্তি দেওয়া যায় বলো তো।”

~”থাক স্যার আজ আর শাস্তি না দিয়ে বরং আমার সাথে পাঠিয়ে দিন আমি সুন্দর করে বুঝিয়ে দিব।”

~”তুমি বলছ যখন, তাহলে নিয়ে যাও। কিন্তু আমার তো একটা বিপত্তি ঘটেছে।”

~”কি বিপত্তি স্যার?”

~”থার্ড ইয়ারের ক্লাসে অনেক খাতা পড়ে রয়েছে ওগুলো টিচার্স রুমে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু কে নিয়ে যাবে?”

~”সমস্যা নেই স্যার কাজ হয়ে যাবে।”(আমার দিকে তাকিয়ে বাকা হেসে বলল)

তারপর আর কি মেহরাব আমাকে এখানে এনে খাতাগুলো দিয়ে আসতে বলে বাহিরে চলে গেল। কিন্তু আমি সেই কাজ করছি না। রহিমা খালাকে দিয়ে ফুচকা আর স্প্রাইট আনিয়ে বসে বসে খাচ্ছি।

~”হোয়াট দ্যা হেল আর ইউ ডুইং?”

মেহরাবের সজোরে চিৎকার করে বলা কথায় আমি সামনে তাকিয়ে দেখি মেহরাব রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছে। আমি দাড়িয়ে গেলাম। মেহরাব রেগে আরো কিছু বলতে যাবে তার আগেই আমি তারাতাড়ি দুটো ফুচকা ঠেলে মেহরাবের মুখে ঢুকিয়ে দিলাম। তারপর স্প্রাইট মেহরাবের মাথায় ঢেলে দিয়ে দৌড় দিলাম।

~”আমাকে শাস্তি দেওয়ার ফল দেখেছেন মিস্টার। এবার ভালো মতো গিলেন।”

আমি জোরে জোরে কথাগুলো বললাম।মেহরাব কোন মতো ফুচকাটা গিলে আমার পিছে ছুটতে লাগলো।

~”একবার ধরি। তারপর বুঝাবো তোমাকে। আমার মাথায় স্প্রাইট মারা তাই না।”

আমি মেহরাবের কথা শুনে আরো জোরে দৌড়াতে লাগলাম। এক পর্যায়ে একদম কর্ণারের দিকে চলে এলাম। সামনে একটা ফাঁকা ক্লাস। ক্লাসে ঢুকে আমি আস্তে করে হেটে মাথা ঘুরে পরে যাওয়ার ভান করলাম। আমাকে এভাবে পড়ে যেতে দেখে মেহরাব এসে আমাকে ধরল। এক হাতে জরিয়ে অন্য হাত আলতো করে আমার গালে রেখে উদ্বিগ্ন কন্ঠে ডাকতে লাগল,,

~”তিতলি, এই তিতলি। কি হয়েছে তোমার? তিতলি উঠো।তিতলি।

সেন্সলেস হয়ে গেছে মনে হয়। পানি কোথায় পানি মারতে হবে। ”

মেহরাব কেমন উদ্বিগ্ন হয়ে গেছে। অস্থির অস্থির করছে। পাগলের মতো ছটফট করছে। আমাকে নিজের বুকের সাথে জরিয়ে রেখেছে।মেহরাবের প্রতিটি হার্টবিট শুনতে পাচ্ছি আমি। উনার হৃদপিন্ডও উনার মতো ছটফট করছে,, দ্রুত বেগে চলছে। আমারও কেন যেন খুব ভালো লাগছে। এভাবেই মেহরাবের বুকে মাথা দিয়ে রাখতে ইচ্ছে করছে।

এহ আমি এইসব কি ভাবছি। আমি তো এই টেকনিক এখান থেকে পালানোর জন্য করেছি। এসব কথা ভাবার টাইম নেই।

এগুলো ভাবতে ভাবতে মেহরাব যখন আমার ব্যাগ থেকে পানির ফ্লাস্কটা নেওয়ার জন্য হাতটা আলগা করতেই আমি মেহরাবকে ধাক্কা মেরে উঠে আমার ব্যাগ নিয়ে ঝড়ের গতিতে দৌড় দিলাম।মেহরাব বুঝে উঠার আগেই আমি বললাম,,

“আপনি কখনো আমায় ধরতে পারবেন না মিস্টার। আপনি বসে থাকেন। আমি যাই। টা টা।”

হাসতে হাসতে কথাটি বলে উঠলাম আমি। তারপর আবার দৌড়ে সেখান থেকে বেরিয়ে এলাম।

চলবে……

(ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

ধন্যবাদ?)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here