তোমার মাঝে(২),পর্ব_০৮,০৯

0
3010

তোমার মাঝে(২),পর্ব_০৮,০৯
সারিফা তাহরিম
পর্ব-০৮

~”সাদাফ এইসব কি দেখছি আমি? তার মানে কি তুই….?কি আমি ঠিক বলছি না? বল। অ্যান্সার মি.. ড্যাম ইট।” (মেহরাব চিল্লিয়ে কথাগুলো বলল)

~”মমমেহরাব আ আমার ককথাটা শশুন এএকবার। আ আমি আ আসলে…..(মেহরাবের চিল্লানো শুনে সাদাফ ভয়ে তুতলিয়ে বলতে লাগল।কিন্তু মেহরাব সাদাফকে থামিয়ে দিয়ে আবারও বলল)

~”কিসের আসলে নকলে? আমি কোন আসলে নকলে বুঝি না। আমি যা জিজ্ঞেস করেছি তার সোজা উত্তর দে। আমি যা ভাবছি তা কি সত্যি সাদাফ?”

~”ইয়ে না মানে আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে…. ”

~”কিসের ইয়ে না মানে করছিস হ্যাঁ? আর আমি বুঝতে পারছি যে আমি যা ধারণা করছি তা ই ঠিক। আর তুই অনেক বড় ভুল করে ফেলেছিস সাদাফ। অনেক বড় ভুল। এই ভুলের মাশুল তো তোর পোহাতেই হবে। তোর এই ইচ্ছে তো কখনোই পূরণ হবে না।”

মেহরাবের এমন কথায় সাদাফ কেঁদে দিল।মেহরাবের পা জরিয়ে ধরে কান্না করতে করতে বলল,,

~”এমন করিস না ভাই। এমন করিস না। এমন হলে আমি বাঁচতে পারব না। আমি যে ওকে খুব ভালোবাসি। অনেক বছর ধরে আমি ওকে ভালোবাসি। কিন্তু কখনো ওকে বলা হয় নি। আমি কখনই ওকে বলতে পারি নি। কিন্তু আমার মধ্যে প্রতিটি সময় ওকে হারিয়ে ফেলার ভয় থাকে। আমি ওকে নিজের করে রাখতে চাই। আমার ভালোবাসাকে আমার করে আমার কাছে সারাটা জীবন বেঁধে রাখতে চাই।”

~~~~~~~~~~~~

সূর্য ধীরে ধীরে পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ে আঁধারের আগমন ঘটাচ্ছে। চারপাশে অন্ধকার স্থির গতিতে জায়গা করে নিয়ে আমার মনের অবস্থার সাথে তাল মিলাচ্ছে। ফুরফুরে বাতাসও ধীর গতির হয়ে আমার মতোই তার মনের বিষন্নতা জানান দিচ্ছে। পাখিরাও কিচিরমিচির আওয়াজ বন্ধ করে নিজেদের গন্তব্যে ফিরে যাচ্ছে। অন্ধকারের কারণে বেলি ফুলের শুভ্রতাও নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। “প্রকৃতি মানুষের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু” ব্যাপারটি আজ খুব ভালোভাবে আমি বুঝতে পারছি। আমার মনের সাথে তারাও তাল মিলিয়ে চলছে।

আজ বিকেলের ফুরফুরে মনটা আনিকার কথাটিতে এক নিমিষেই বিষন্ন করে তুলল। আচ্ছা এটা কি আদৌ বিষন্নতা? না না বিষন্নতা আগেও ভর করেছে, মন খারাপ হয়েছে। কিন্তু আজকের মতো এতোটা খারাপ কখনো লাগে নি। আজ সবচেয়ে প্রিয় মানুষটিকে হারানোর কষ্ট। না পাওয়ার হাহাকারের প্রতিধ্বনি তুলছে মনে। প্রতিটি মুহূর্তে এই কষ্ট শতগুণ করে বেড়ে চলেছে। মেহরাবকে হারিয়ে ফেলেছি আমি। মেহরাবের মাঝে আমি নেই। আর কখনো থাকবোও না। এই ভেবে আমার সকল হাহাকার থেকে বুক চিড়ে এক দীর্ঘ শ্বাস বের হয়ে এল। আর চোখ থেকে অজান্তেই টুপটুপ করে কয়েক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল। আজ কান্না ও অভিমান করে আছে। চাইলেও কাঁদতে পারছি না।আমি ভেজা চোখে অন্ধকার হয়ে আসা আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আবারও কারো ফোন আসতেই আমি চোখ মুছে ফোন রিসিভ করে কানে দিতেই ওপাশ থেকে আমার বান্ধবী নিশাতের কন্ঠ ভেসে এলো,,

~”ওই তিতুনি। কই মরসিলি? বোইনের বিয়া খাইতে গিয়া আমাদের ভুলেই গেলি।তুই আয় তারপর তোর খবর করতেসি। ”

আমি নিজেকে ঠিক করে নিলাম।যা হওয়ার তা হয়েছে। আমার অনুভূতিগুলো কেউ জানে না। আর আমি কাউকে জানাতেও চাই না। সবার কাছে আগের সেই তিতলি হয়েই থাকব যার মাঝে কোন মেহরাবকে হারিয়ে ফেলার কষ্ট ছিল না।তাই আমি নিজেকে সামলে সবসময়ের মতো স্বাভাবিক কন্ঠে বললাম,,

~”নিজে তো মনে হয় প্রতিদিন ফোন করে করে কতো খবর নিয়ে ফেলিস। সারাদিন তো বফ নিয়েই ব্যস্ত থাকিস। দুইদিন প্রেম করবি তারপর আবার ব্রেক আপ করবি তারপর আবার নতুন করে প্রেম করবি। এই ব্রেক আপ হওয়া আর নতুন প্রেম হওয়ার মাঝখানে যেই সময়টি থাকে তার পঁচিশ শতাংশ সময় আমাদের খোঁজ নিস। আর বাকিটা বফ খুজতে ব্যয় করিস। আর এখন যেহেতু আমার খবর নিচ্ছিস তাহলে নিশ্চয় এর ব্যতিক্রম নয়। অর্থাৎ আজ নিশ্চয়ই তোর ৭৭ নাম্বার বফের সাথে ব্রেক আপ হয়েছে। রাইট?”

~”হুম, ঠিক ধরেছিস।”

~”এসব করে কি মজা পাস বলতো। শুধু শুধু কারো মন নিয়ে খেলা টা কি ঠিক। কারো সাথে নাটক করে ভালোবাসার অভিনয় করে একটা মানুষের মনে জায়গা করা, তার মনে স্বপ্ন জাগানো, তারপর সেই স্বপ্নগুলোকে ভেঙে অন্য কারো সাথে চলে যাওয়া, এগুলো কি ঠিক? হ্যাঁ আমি মানছি যে তুই যাদের সাথে রিলেশনে গিয়েছিলি তারাও রিলেশনটাকে সিরিয়াসলি নেয় নি। কিন্তু সবাই যে ওরকম ছিল তুই তার গ্যারান্টি কিভাবে দিবি? এমনও তো পারে এই ৭৭ র জনের মধ্যে একজন হলেও তোকে সত্যিই ভালোবাসত, খুব করে ভালোবাসত। কিন্তু তুই সেই ভালোবাসাকে তুই অবজ্ঞা করলি। এতে সেই মানুষটার মনে কতোটা ক্ষতের সৃষ্টি হতে পারে জানিস? কখনো ভেবে দেখেছিস তুই যাকে খুব করে ভালোবাসিস কখনো যদি সেই ভালোবাসার বিনিময়ে তুই অবজ্ঞা আর ঘৃণা পাস তখন তোর কেমন লাগবে? অনেক ভালোবাসার পরেও যদি তুই সেই মানুষটিকে হারিয়ে ফেলিস তাহলে তোর কতোটা কষ্ট লাগবে?

তোর যেমন লাগবে ওই মানুষটার ও ঠিক তেমনটাই কষ্ট লাগবে। তাই তোকে আমি পরামর্শ দিচ্ছি না অনুরোধ করছি এইভাবে আর কারো সাথে মজা করিস না। প্লিজ। ”

~”হ্যাঁ রে তুই ঠিক বলছিস। আর কতো জনের সাথে এমন করব। আমারও আর ভালো লাগে না। তাই আমিও সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে আর কারো সাথে এমন করব না। এরপর যাকে ভালোবাসব তাকে সত্যিকার, মন থেকে ভালোবাসব।”

~”হুম। যাক তাহলে তো ভালোই হলো। তুই বিষয়টি বুঝতে পেরেছিস এতেই আমার বেশ ভালো লাগছে।”

~”আচ্ছা কালকে ভার্সিটিতে আসবি না? ”

~”হুম আসব তো। ”

~”তাহলে কাল থেকে আবার একসাথে থাকা হবে অনেক অনেক কথা হবে। আবার সেই আগের দিনগুলোতে ফিরে যাব। এই মিথ্যে ভালোবাসায় সময় নষ্ট করে তোদের আর হারাতে চাই না। ”

~”ঠিক আছে।”

~”তিতলি সরি রে। পারলে ক্ষমা করে দিস।”

~”আরে আরে সরি কেন বলছিস?”

~”এতোদিনে আমি আমাদের আগের সেই বন্ধুত্বটাকে টিকিয়ে রাখতে পারি নি। সময় দেই নি, অবহেলাও করেছি। তাই অনেক দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। সব আমার জন্য। তাই সরি। প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দিস। ”

~”চুপ কর ফাজিল মাইয়া। আমার সাথে ফর্মাল হইতে আসিস। আগে মেরে যে ভূত বানাই দিতি তখন তো সরি বলতি না। এখন সরি ভিমরুতি উঠেছে তাই না? দাড়া কাল ভার্সিটিতে এসে তোর তোর সব ফর্মালিটি আমি বের করবো।”

~”আইচ্ছা তিতুনি। কালকে দেখা হবে। এখন রাখি।”(আমার কথায় নিশাত হেসে বলল)

~”আচ্ছা ঠিক আছে। আল্লাহ হাফেজ। ”

~”আল্লাহ হাফেজ।”

~~~~~~~~~~~~~

এদিকে সাদাফ মেহরাবের পা জরিয়ে অঝর ধারায় কান্না করছে আর বারবার বলছে “মেহরাব আমি ওকে অনেক বেশি ভালোবাসি। অনেক বেশি। ওকে ছাড়া আমি নিঃস্ব। আমি ওকে অন্য কারো সাথে দেখতে পারবো না। মরে যাব আমি। প্লিজ মেহরাব ওকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিস না। প্লিজ মেহরাব। ওকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না মেহরাব। আমি মরে যাব মেহরাব, আমি মরে যাব। “”

সাদাফের কথাগুলো শুনে মেহরাব স্তম্ভিত হয়ে গেল। সাদাফের এতটা ভালোবাসা দেখে সে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। সকল কথা সে হারিয়ে ফেলেছে। সাদাফ নিজের ভালোবাসাকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে কাতরাচ্ছে, অস্থির হয়ে পড়ছে। যেই ছেলে নিজে কখনো কারো কাছে হার মানতে চাইতো না সেই ছেলে নিজের ভালোবাসা হারানোর ভয়ে কারো পায়ে পড়েছে। সাদাফের এতোটা ভালোবাসা দেখে মেহরাব শক্ত মুর্তির ন্যায় দাড়িয়ে আছে সেই সাথে চোখের কোণে এক ফোটা নোনা জল জড় হয়েছে।

মেহরাব ছলছল চোখে সাদাফকে উঠিয়ে হেসে দিল আর বলল,,

~”তুই কিভাবে ভাবলি আমি তোকে তোর ভালোবাসা থেকে আলাদা করব? আমি কখনোই এমন করবো না। আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তোদের বিয়ে দিব। তোর ভালোবাসাকে তোর নামে করে দিব। আমি তোদের ভালোবাসার ঢাল হয়ে থাকব। কাউকে কেড়ে নিতে দিব না। এটা আমার মানে মেহরাব রায়ান চৌধুরীর ওয়াদা।”

মেহরাবের এমন কথা শুনে সাদাফ অত্যন্ত খুশি হয়ে মেহরাবকে জরিয়ে ধরল। আর সাথে সাথেই মেহরাবের চোখের কোণে জমে থাকা নোনা জলের ফোটা গড়িয়ে পড়ল।

চলবে……..

তোমার মাঝে(২)
পর্ব_০৯
সারিফা তাহরিম

সাদাফ মেহরাবকে জরিয়ে ধরতেই মেহরাবের চোখ থেকে এক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল। এই পানি কোনো দুঃখের চিহ্ন নয় বরং এক প্রশান্তির বার্তা বহন করছে। হ্যাঁ মেহরাব আজ খুব খুশি। সাদাফের এতোটা ভালোবাসা দেখে মেহরাবের মনে প্রশান্তির হাওয়া বয়ে গেছে। আজ সে সাদাফের ভালোবাসা দেখে নিশ্চিন্ত হলো কারণ তার কলিজাকে সে কখনো কষ্ট দিতে পারবে না। সে ও তো সাদাফকে ভালোবাসে। অনেক বেশি ভালোবাসে। তার সকল পাগলামি আর বাচ্চামি তো শুধু সাদাফকে ঘিরেই। কিন্তু এতোদিন মেহরাব এই বিষয়টি এড়িয়ে গেছে কারণ সে শিউর ছিল না যে সাদাফ কি তাকে ভালোবাসে কি না। কিন্তু আজ এই ব্যাপারে আর কোন সন্দেহ নেই যে সাদাফও তাকে ভালোবাসে।

এখন প্রশ্ন হলো কাকে ভালোবাসে? তার উত্তর হচ্ছে আনিকা। হ্যাঁ সাদাফ আনিকাকে ভালোবাসে। সেই ছোট থেকেই আনিকাকে ভালোবাসে সে। কিন্তু কখনোই কাউকে বলে নি আর বুঝতেও দেয় নি। কিন্তু সবসময় আনিকার প্রতি তার অনেক কেয়ার করা,, চোখে চোখে রাখা,, প্রতিটি বিষয় গভীরভাবে লক্ষ্য করা,, আর কোন ছেলের সাথে কথা বলতে দেখলে সেই ছেলেকে মারা আর আনিকাকে বকা দেওয়া কারোই নজর এড়াতো না। কিন্তু কেউই এই বিষয়টিকে ভাই বোনের সম্পর্ক ছাড়া অন্য কিছুই ভাবতো না। আর রইলো আনিকার কথা সে তো সাদাফ বলতেই পাগল। সারাদিন সাদাফের পিছে পিছে ঘুড়া,, সাদাফের সাথে ঝগড়া করা,, সাদাফ বকা দিলে রাগ করা,, পরে সাদাফ সরি বললে ওর পিঠে ঘোড়ার মতো করে চড়া, চকলেট খাওয়ানো এই আবদার আর স্বভাবগুলো ছোট থেকেই। সাদাফকে কেউ কিছু বললে আনিকা গিয়ে তার সাথে খুব ঝগড়া করে, প্রত্যেকের চুল টানা শুরু করে। ছোট থেকেই দুজন দুজনকে ভালোবাসে। আনিকার ব্যাপারটা মেহরাব আর সাদাফ জানলেও সাদাফের ব্যাপার টা কেউ জানত না। প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে কেউ কিছু জানলে যদি মেনে না নেয় সেই ভয়ে সাদাফ কাউকে এমনকি মেহরাবকেও জানায় নি।

সাদাফের হাতে আগে কোনো ট্যাটু ছিল না। কানাডা গিয়ে হাতের বাহুতে একটা ট্যাটু করিয়েছিল। আর সেই ট্যাটুর মাঝে “” Anu”” লিখা ছিল। যেটি মেহরাব দেখে ফেলেছিল। আর তখনই মেহরাব বুঝতে পারে যে সাদাফও আনিকাকে ভালোবাসে। এটি দেখে মেহরাবও অনেক খুশি হয়ে যায়। কারণ আনিকা হচ্ছে তার কলিজার টুকরো বোন যে সাদাফকে অনেক বেশি ভালোবাসে। আর সাদাফও তাকে ভালোবাসে।

কিন্তু তবুও সাদাফের ভালোবাসাটা ঠিক কতোটুকু তা পরীক্ষা করার জন্য রেগে যাওয়ার অভিনয় করে। মেহরাব মনে করেছিল যে সাদাফ তাকে বুঝাবে নাহলে জোর করবে তবুও কখনো নত হবে না। কিন্তু মেহরাবের ভাবনাকে ভুল প্রমাণিত করে সাদাফ মেহরাবের পা জরিয়ে কেঁদে দিল। সাদাফ যেই ছেলে কখনো হার মানে না সেই ছেলে তার ভালোবাসার একটু ইঙ্গিতে পা জরিয়ে ধরেছে তা সত্যিই ভাববার বিষয়। সাদাফ নিজের ভালোবাসার জন্য সবকিছু করতে পারে তা মেহরাবের কাছে প্রমাণিত হলো। প্রশান্তির হাওয়া বয়ে গেল তার হৃদয়ে। চোখ থেকে খুশির অশ্রু ঝড়ে পড়ল।

বেশ কিছুক্ষণ পরে সাদাফ মেহরাবকে ছেড়ে উৎফুল্ল কন্ঠে বলল,,

—”ভাই তুই এতো সহজে ব্যাপারটা মেনে নিবি তা আমি কখনো ভাবি নি। আর প্রথমে যেভাবে রেগে গিয়েছিলি তা দেখে তো আমার কলিজাটা ই উড়ে যাওয়ার অবস্থা হয়েছিল। মনে হয়েছে এই তো এখনই আমি আমার ভালোবাসাকে হারিয়ে ফেললাম।”

সাদাফের কথা শুনে মেহরাব জোরে জোরে হেসে দিল আর বলল,,

—”রেগে যাওয়ার অভিনয় তো আমি তোর রিএকশন দেখার জন্য করেছিলাম। কিন্তু তুই যে এভাবে বাংলা সিনেমার সাবানার মতো কান্না করে করে “” না না না,, এ হতে পারে না,, এটা কিছুতেই হতে পারে না,, তাকে না পেলে আমি মরে যাব,, মরে যাব,, মরে যাব “”” এই ডাইলোগ গুলো বলবি সত্যিই আমার জানা ছিল না। (মেহরাব কিছুটা হাত নাড়িয়ে অভিনয় করে ডাইলোগটি বলল)। আজ আমার রেগে যাওয়ার একটা দূর্দান্ত ফলাফল পেলাম,, নাহলে আর দেখতে পারতাম না। বিনা টিকেটে,, বিনা খরচে,, বিনা পরিশ্রমে বাংলা সিনেমার নায়ক সরি নায়িকার অভিনয়। সত্যিই খুব মজার ছিল।”

মেহরাব হাসতে হাসতে কথাগুলো বলেছে। কথা শেষ হতেই হাসির মাত্রা বেড়ে গেল আর মেহরাব হাসতে হাসতে ফ্লোরে বসে পড়ল। সাদাফ চটে গিয়ে মেহরাবের পিঠে দুড়ুম করে কয়েকটা কিল বসিয়ে বলল,,

—”শালার হারামি আমার অবস্থা খারাপ করে হাসা হচ্ছে। আমার তো প্রাণ পাখি যাওয়ার অবস্থা। আর সে ফ্লোরে গড়িয়ে গড়িয়ে হাসছে। তোর হাসি তো আমি বের করছি শালার হারামি…..”

বলেই আরো কয়েকটি কিল বসিয়ে দিল মেহরাবের পিঠে। কিছুক্ষণ পরে মেহরাব অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বলল,,

—”আমি কিন্তু তোর বউয়ের বড় ভাই। তার মানে তোরও বড় ভাই। তাই সম্মান দিয়ে কথা বল নাহলে কিন্তু বিয়ে ঠুশ করে দিব।”

মেহরাবের কথা শুনে সাদাফ তার দিকে অসহায় চোখে তাকাল। তা দেখে মেহরাব আবার ফিক করে হেসে দিল তারপর বলল,,

—”আচ্ছা সেইসব কথা এখন বাদ দে। যা বলছিলাম,, তোর ট্যাটুটা বেশ গভীর। আমার জানা মতে এই ধরনের ট্যাটু বেস্ট ট্যাটু আর্টিস্ট ছাড়া আর কেউ করে না। তুইও কি সেই আর্টিস্ট এর মাধ্যমে করিয়েছিস?”

—”হুম। ঠিক ধরেছিস। কানাডা গিয়ে উনার খোজ লাগিয়েছিলাম। উনি বাংলাদেশ থেকেও কানাডা আর অন্যান্য দেশে বেশি যায় কারণ বাংলাদেশের মানুষ এতো গভীর ট্যাটু খুব কম করে। তাই আমি ওখানে গিয়ে অনেকজনের কাছ থেকে উনার সম্পর্কে জানি। তারপর অনেক কষ্টে বিভিন্ন জনের রেফারেন্সে দুই মাস পরে উনার দ্বারা এই ট্যাটু করিয়েছি।”

—”আচ্ছা তোর কি উনার সাথে কথা বলা সম্ভব? আমার একটু কথা আছে উনার সাথে?”

—”কেন তুইও কি করাবি নাকি? তুই করলে উনাকে দিয়ে করানোর কি দরকার? আমি আছি না ব্লেড দিয়ে কেটে কেটে আমিই ট্যাটু করে দিব।”

—”তুই ট্যাটু করলে আমার চামড়া খসে পড়বে তা আমার জানা আছে। কিন্তু আমি ট্যাটু করানোর জন্য না আমার কিছু ইনফরমেশন লাগবে তাই উনার সাথে যোগাযোগ করাটা জরুরি। তুই কি পারবি?”

—”উম…আমার সাথে উনার বেশ ভালো সম্পর্কই হয়েছে তাই কথা বলা যেতে পারে যদি উনি ফ্রি থাকে তাহলে।”

—”তুই একটু ট্রাই কর প্লিজ। এটা খুব জরুরি। ”

—”হুম করছি। তোর এতো চিন্তা করতে হবে না। আচ্ছা আমার আবার বাসায় যেতে হবে আম্মু খালামণিকে নিয়ে যেতে বলেছে তুইও আয়। একেবারে ওখানে গিয়ে কথা বলবো। ”

—”ওকে চল।”

~~~~~~~~~~~~~

ভার্সিটিতে যাওয়ার ইচ্ছা না থাকলেও যেতে হচ্ছে কারণ গতকাল আমি নিশাতকে বলেছি আসব আর নিশাতও আমার জন্য অপেক্ষা করবে। আমি যদি না যাই তাহলে আবার রাগ করবে। আবার ভয়ও করছে যদি মেহরাব সামনে চলে আসে আর তখন যদি আমি নিজের কষ্টগুলোকে সামলাতে না পারি তখন কি হবে? না না ভয় পেলে চলবে না। মেহরাবের জন্য আমার জীবন থমকে থাকবে না। উনি তো খুব করে পেরেছে আমার মনে অনুভূতি জাগিয়ে অন্যকারো সাথে ভালো থাকতে। তাহলে আমি কেন পারবো না? আমার ও পারতে হবে। সবকিছুকে ভুলে আবার সেই আগের দিনগুলোতে ফিরে যেতে হবে যেখানে মেহরাব নামের কোন মিথ্যে ভালোবাসার মানুষ আমার জীবনে ছিল না।

এসব ভেবে পা বাড়ালাম ভার্সিটির উদ্দেশ্যে। আজ থেকে মেহরাবের সামনে যাব না। আগের মতো করে আমার জায়গাগুলোতে থাকব।

~~~~~~~~~~~~~~~

—”ওই তিতুনি সেই কখন থেকে এইভাবে ক্লাসেই বসে আছিস। চল না বাহির থেকে ঘুরে আসি। ক্যান্টিনে গিয়ে বসি। ”

—(ক্যান্টিনে গেলে যদি মেহরাবের সাথে দেখা হয়ে যায়,, না না বের হওয়া যাবে না ক্লাসেই থাকতে হবে।) নারে নিশু ভালো লাগছে না। তুই যা। ”

—”তুই না গেলে আমিও যাব না। আচ্ছা বাদ দে বাহিরে যেতে হবে না। এখানে বসেই গল্প করি।”

—”হুম”

—”তোদের বিয়েবাড়ির কাহিনী বল। কি কি হয়েছে?”

—(এই বিয়েবাড়ি থেকেই তো মেহরাবের সাথে পরিচয়, ভালো লাগা, অনুভূতি সৃষ্টি আর সবশেষে সেই অনুভূতিগুলোর বিচ্ছেদ) বিয়েবাড়ির আর কি কাহিনী সব ঠিক মতোই হয়েছে।”

—”আচ্ছা তুই বলেছিলি আরাফ ভাইয়া দিয়াপুকে অনেক ভালোবাসে। কিন্তু দিয়াপু আরাফ ভাইয়াকে মেনে নিতে পারছে না। কিন্তু কেন? আরাফ ভাইয়ার সাথে এমন কি হয়েছে যে দিয়াপু উনাকে মেনে নিতে পারছে না?”

—”আরাফ ভাইয়ার সাথে কিছুই হয় নি। আপুর কিছু পুরনো স্মৃতির কথা আপুকে খুব কষ্ট দেয় যার কারণে ভাইয়াকে মেনে নিতে পারছে না।”

—”কি সেই স্মৃতি? বল না প্লিজ। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে। ”

—”আচ্ছা তাহলে শুন,,

দিয়াপু যখন অনার্সে ভর্তি হয়, তখন একটা ছেলের সাথে পরিচয় হয়। ভাইয়াটা আপুর দুই বছরের সিনিয়র ছিল অর্থাৎ অনার্স ৩য় বর্ষের ছাত্র ছিল। উনি আপুকে ফর্ম ফিল আপের এর বিভিন্ন কাজে হেল্প করেছিল। তারপর থেকে ভার্সিটিতে উনার সাথে আপুর প্রায় সময় দেখা হতো। প্রায় চার মাস পরে তারা অনেক ভালো বন্ধু হয়ে উঠে। ভার্সিটিতে গিয়ে প্রতিদিন দেখা করা তাদের রুটিনে বরাদ্ধ থাকত। ব্রেক টাইমে অনেক গল্প করত, ঘুরত, মজা করত। ভাইয়াটা আপুর প্রতি বেশ কেয়ারিং ছিল। ছোট ছোট বিষয়গুলোও খেয়াল রাখত।

আপুও তার প্রতিটি বিষয় খুটিয়ে খুটিয়ে দেখত। উনার সাথে দেখা হলে আপুর এক অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করত। প্রতিদিন বাসায় ফিরে তার সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো ডায়েরিতে লিখে রাখত। আপুর ভালো লাগার অনুভূতিগুলো ভালোবাসায় পরিণত হয়। দুই বছর এভাবে কেটে যায় কিন্তু আপু তার অনুভূতির কথা গুলো প্রকাশ করতে পারে নি। আপু ভেবেছিল ভাইয়াও আপুকে ভালোবাসে আর উনি সেই কথাগুলো বলার পরেই আপুও বলে দিবে। এরপরে আরও একটা মাস কেটে যাওয়ার পরে আপু ঠিক করে যে আপু ভাইয়াকে প্রপোস করবে।

আপু পরেরদিন ভার্সিটিতে ভাইয়ার জন্য অনেক অপেক্ষা করে কিন্তু ভাইয়া আর আসে না। উনি আপুকে ফোন করে জানায় যে উনি একটা কাজে বিজি ছিল তাই আসতে পারে নি আর পরের দিন আপুকে ভার্সিটিতে আসতে একটা সারপ্রাইজ আছে। আপুও রাজি হয়ে যায়। পরের দিন আপু গিয়ে দেখে ভাইয়া আর একটা মেয়ে পাশাপাশি বসে আছে। উনি মেয়েটির সাথে আপুর পরিচয় করিয়ে দেয় এই বলে যে ওই মেয়েটি তার ফিয়ান্সে যার সাথে গতকাল তার এনগেজমেন্ট হয়েছে। আর উনার পরীক্ষার পরে বিয়ে। উনি আপুকে সরি ও বলেছেন এই কারণে যে সব কিছু অনেক তারাহুরো করে হয়ে যাওয়ায় আপুকে সে জানাতে পারে নি।

সবটা শুনে আপু থমকে যায়। আরো বেশি অবাক হয় তখন, যখন মেয়েটি ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করল যে আপু কে এবং ভাইয়া উত্তর দেয় যে আপু তার ছোট বোন এবং বেস্ট ফ্রেন্ড। সেদিন আপু সেখানে আর এক মুহুর্তও না থেকে ছুটে চলে আসে। তারপর থেকে আর কোনোদিন আপু সেই ভাইয়ার সাথে দেখা করে নি। কিন্তু আজও আপুর মনে উনিই আছেন। চাইলেও ভুলতে পারে না। কারণ আপু খুব বেশি ভালোবাসত উনাকে। আর সেই জায়গা কাউকে দেওয়া অনেক বেশিই কষ্টের।”

—”হুম আসলেই খুব কষ্টের।”

—”আরাফ ভাইয়া তো দিয়াপুকে খুব করে ভালোবাসে। কিন্তু দিয়াপু কি কখনো পারবে আরাফ ভাইয়াকে তার মতো করে ভালোবাসতে?”

চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here